![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
অধ্যাপক, কোবে গাকুইন বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশ আজ এক অভূতপূর্ব রাষ্ট্রীয় সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। দেশে চলছে ব্যাপক রাষ্ট্রীয় সংস্কারের আলোচনা, সাংবিধানিক পুনর্বিবেচনার দাবি, নির্বাচনী ব্যবস্থার সংশোধনের প্রস্তাব, এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নিয়ে নতুন চিন্তাভাবনা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় বলতে গেলে, এটি একটি 'রাজনৈতিক রূপান্তরের' (Political Transformation) মুহূর্ত, যখন একটি দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন ঘটে। এমন সময়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশা করা যায় যে দেশের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা তাঁদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও পেশাদারিত্ব দিয়ে এই প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন। কিন্তু বিস্ময়করভাবে, এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে বাংলাদেশের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত ও নীরব।
এই অনুপস্থিতি কেবল একটি ব্যক্তিগত ব্যর্থতা নয়, বরং এটি আমাদের সমগ্র বিদ্যায়তনিক ব্যবস্থার কাঠামোগত অক্ষমতার একটি জ্বলন্ত প্রমাণ। দেশের প্রতিটি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ রয়েছে। এসব বিভাগে শত শত শিক্ষক কাজ করছেন, যাঁরা প্রতিদিন হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা—সাংবিধানিক আইন, তুলনামূলক সরকার ব্যবস্থা, রাজনৈতিক তত্ত্ব, জনপ্রশাসন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক—সম্পর্কে শিক্ষা দিয়ে চলেছেন। অথচ এই মুহূর্তে যখন এই সমস্ত বিষয়ের ব্যবহারিক প্রয়োগের সবচেয়ে বড় সুযোগ এসেছে, তখন এই বিশেষজ্ঞরা কোথায় লুকিয়ে আছেন?
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের এই নিষ্ক্রিয়তার পেছনে রয়েছে তাঁদের গভীর জ্ঞানীয় সীমাবদ্ধতা। দশকের পর দশক ধরে তাঁরা যে শিক্ষা দিয়ে এসেছেন তা মূলত বিদেশি পাঠ্যপুস্তকের তত্ত্বীয় আলোচনার পুনরাবৃত্তি। তাঁরা পশ্চিমা গণতন্ত্রের মডেল মুখস্থ বলতে পারেন, কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় সেই মডেলের প্রয়োগ কীভাবে হবে তা বুঝতে পারেন না। তাঁরা মার্কিন বা ব্রিটিশ সংবিধানের বিভিন্ন ধারা ব্যাখ্যা করতে পারেন, কিন্তু বাংলাদেশের সাংবিধানিক সংকট নিয়ে কোনো মৌলিক চিন্তা উপস্থাপন করতে অক্ষম। তাঁদের জ্ঞান একান্তভাবে বইয়ের পাতায় আবদ্ধ, বাস্তব জীবনের সাথে তার কোনো সংযোগ নেই।
এই পরিস্থিতি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার মানের একটি ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে। এসব প্রতিষ্ঠানে গবেষণার নামে যা হয় তা মূলত পুরাতন তত্ত্বের অনুকরণ এবং বিদেশি ধারণার স্থানীয় প্রয়োগ ছাড়া আর কিছুই নয়। মৌলিক গবেষণা নেই, সমসাময়িক রাজনৈতিক ঘটনাবলীর গভীর বিশ্লেষণ নেই, এবং নীতি প্রণয়নে কোনো অবদান রাখার চেষ্টা দেখা যায় না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস, স্বাধীনতা সংগ্রামের অভিজ্ঞতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বহুদলীয় গণতন্ত্রের বিকাশ, সামরিক শাসনের প্রভাব—এসব বিষয় নিয়ে গভীর একাডেমিক গবেষণা হওয়ার কথা ছিল, যা থেকে বর্তমান সংকটের সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যেত। কিন্তু সেই গবেষণা হয়নি, ফলে আজ আমরা সমাধানহীন অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছি।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের ভূমিকা দেখলে আমাদের এই ব্যর্থতা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রে হেনরি কিসিঞ্জার থেকে শুরু করে জোসেফ নাই পর্যন্ত অসংখ্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তাঁদের দেশের নীতি নির্ধারণে সরাসরি ভূমিকা রেখেছেন। ভারতে প্রতাপ ভানু মেহতা বা যোগেন্দ্র যাদবের মতো রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ মতামত প্রদান করেন। এমনকি পাকিস্তানেও হাসান আসকারী রিজভির মতো পণ্ডিতরা তাঁদের দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণে অবদান রাখেন। কিন্তু বাংলাদেশের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা এই ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত। তাঁরা যেন একটি সমান্তরাল জগতে বাস করেন, যেখানে বাস্তব রাজনীতির কোনো প্রভাব পৌঁছায় না।
এই নিষ্ক্রিয়তার পেছনে কয়েকটি কাঠামোগত কারণ রয়েছে। প্রথমত, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার সংস্কৃতি অনুপস্থিত। অধ্যাপকরা একবার নিয়োগ পাওয়ার পর আর নতুন জ্ঞান সৃষ্টিতে আগ্রহী থাকেন না। তাঁদের কাজ হয়ে দাঁড়ায় নির্ধারিত সিলেবাস অনুযায়ী ক্লাস নেওয়া এবং পরীক্ষা গ্রহণ। দ্বিতীয়ত, আমাদের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপকদের মধ্যে সামাজিক দায়বদ্ধতার গভীর অভাব রয়েছে। তাঁরা মনে করেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের বাইরের জগতের সাথে তাঁদের কোনো সম্পর্ক নেই। তৃতীয়ত, আমাদের বিদ্যায়তনিক পরিবেশ এমন যে সেখানে সৃজনশীল চিন্তা ও মুক্ত মতামত প্রকাশের পরিবেশ নেই। রাজনৈতিক প্রভাব, আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ এবং প্রাতিষ্ঠানিক জটিলতা শিক্ষকদের বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের এই অনুপস্থিতির প্রভাব কেবল একাডেমিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। যখন একটি দেশের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা তাঁদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন, তখন সেই দেশের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় অনভিজ্ঞ ও অযোগ্য ব্যক্তিদের দ্বারা। ফলে দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হয় এবং জাতীয় উন্নয়নে সমস্যা সৃষ্টি হয়। বর্তমান রাষ্ট্রীয় সংস্কারের এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে যে বিশেষজ্ঞ মতামত ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের প্রয়োজন, সেই ভূমিকা পালন করতে পারতেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপকরা। কিন্তু তাঁদের অক্ষমতা ও নিষ্ক্রিয়তার কারণে জাতি হয়তো একটি ঐতিহাসিক সুযোগ হারিয়ে ফেলবে।
এই বিদ্যায়তনিক অক্ষমতা থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রয়োজন আমূল সংস্কার। প্রথমত, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগগুলোতে গবেষণাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং সেজন্য পর্যাপ্ত অর্থায়ন ও সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, পাঠ্যক্রমে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে এবং বিদেশি তত্ত্বের অন্ধ অনুকরণ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তৃতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কমাতে হবে। চতুর্থত, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপকদের সামাজিক দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি করে তাঁদেরকে জাতীয় রাজনীতিতে গঠনমূলক ভূমিকা পালনে উৎসাহিত করতে হবে। পঞ্চমত, গণমাধ্যমে নিয়মিত কলাম লেখা, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম আয়োজন, এবং নীতি প্রণয়নে পরামর্শ প্রদানের মাধ্যমে তাঁদের জ্ঞানকে সমাজের কাজে লাগাতে হবে।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের এই নিষ্ক্রিয়তা ও বিদ্যায়তনিক অক্ষমতা শুধুমাত্র একটি একাডেমিক সমস্যা নয়, বরং এটি জাতীয় উন্নয়নের পথে একটি বড় বাধা। যে মুহূর্তে দেশ একটি নতুন রাজনৈতিক কাঠামোর দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে, সেই মুহূর্তে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অনুপস্থিতি একটি জাতীয় দুর্ভাগ্য। এই অবস্থার পরিবর্তন না হলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
©somewhere in net ltd.