নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ডক্টর এ.বি.এম. রেজাউল করিম ফকির, অধ্যাপক, জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় e-mail: [email protected]

রেজাউল করিম ফকির

অধ্যাপক, কোবে গাকুইন বিশ্ববিদ্যালয়

রেজাউল করিম ফকির › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা

২৯ শে জুলাই, ২০২৫ সকাল ৮:২২


ভূমিকা: গোষ্ঠীশাসনতন্ত্রের প্রকৃতি
দেশের গণতন্ত্র ও সুশাসনের প্রধান প্রতিবন্ধকতা হলো গোষ্ঠীশাসনতন্ত্র (ইংরেজি: Oligarchy)। এই শাসনব্যবস্থা গড়ে ওঠে গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত বিস্তৃত স্তরবিন্যস্ত ক্ষমতার ওপর ভর করে। ক্ষমতার এই স্তরবিন্যাসে সর্বদাই বংশমর্যাদা, সম্পদ, পারিবারিক ঐতিহ্য, শিক্ষা ও ব্যবসায় অগ্রগামী শ্রেণির নিকট রাজনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশে বিত্তশালীদের আধিপত্যে প্রযোজিত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় এ ধরনের গোষ্ঠীশাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। যদিও বাংলাদেশ সর্বদাই ধর্মীয় এবং সামরিক গোষ্ঠীশাসনতন্ত্রের ঝুঁকিতে রয়েছে। বর্তমানে বিদ্যমান গোষ্ঠীশাসনতন্ত্রের জাল দেশের সব আধা-আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানে বিস্তৃত রয়েছে, যেখানে বিভিন্ন প্রভাবশালী গোষ্ঠী তোলা, চাঁদা, কমিশন ও ঘুষ ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণকে অব্যাহতভাবে শাসন ও শোষণ করে থাকে।
আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত গোষ্ঠীশাসনতন্ত্রের জাল ভাঙতে ছাত্র-জনতাকে রক্তক্ষয়ী আন্দোলন করতে হয়েছে। এই আন্দোলন থেকে সুফল আনতে সেনাবাহিনী এখন মাঠে নেমেছে এবং তারা আওয়ামী গোষ্ঠীশাসনতন্ত্রের কলকব্জা ভেঙে দিতে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। তবে সেনাবাহিনী একসময় রাজনীতির মাঠ থেকে উঠে যাবে। তারপর আবার নতুন গোষ্ঠীশাসনতন্ত্র গড়ে উঠবে না তো?
মনে রাখতে হবে, বিএনপির রাজনৈতিক ক্ষমতাও কিন্তু গড়ে উঠেছে গোষ্ঠীশাসনতন্ত্রের ওপর ভর করে। কাজেই বাংলাদেশ পুনরায় গোষ্ঠীশাসনতন্ত্রের কবলে নিপতিত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি বজায় থাকলে, পুনরায় গোষ্ঠীশাসনতন্ত্র গড়ে উঠতে পারে। তখন সেই গোষ্ঠীতন্ত্রকে ভাঙতে পুনরায় সেনাবাহিনীকে নামতে হতে পারে। আন্দোলন-সংগ্রাম করে সেনাবাহিনী নামানোর মতো বিষয়টি সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি নয়। কাজেই গোষ্ঠীশাসনতন্ত্র যাতে না গড়ে ওঠে, সেজন্য বিদ্যমান এই গোষ্ঠীশাসনতন্ত্রের কলকব্জা স্থায়ীভাবে ভেঙে দেওয়া প্রয়োজন।
গোষ্ঠীশাসনতন্ত্রের কলকব্জা স্থায়ীভাবে ভাঙতে হলে রাষ্ট্রক্ষমতার পৃথকীকরণ ও বণ্টন এবং প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ করা প্রয়োজন


রাষ্ট্রক্ষমতার পারস্পরিক জবাবদিহিতা ও ভারসাম্য
রাষ্ট্রক্ষমতার পৃথকীকরণ এমনভাবে করা প্রয়োজন যেন আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে পারস্পরিক জবাবদিহিতা ও ভারসাম্য নিশ্চিত হয়। লক্ষ্য যদি থাকে টেকসই রাষ্ট্র সংস্কার, তাহলে রাজনীতি বিজ্ঞানের দর্শন, তত্ত্ব ও সূত্রকে মেনে নিয়ে রাষ্ট্রকাঠামোর সংস্কার করতে হবে।
নিম্নোক্ত বিষয়গুলো সংবিধানে সংযোজনের মাধ্যমে এই পারস্পরিক জবাবদিহিতা ও ভারসাম্য নিশ্চিত করা যেতে পারে:
ক) বিচার বিভাগের জবাবদিহিতা: উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ এবং আদালতে দোষী সাব্যস্তদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার বিষয়টি রাষ্ট্রপতির নিকট ন্যস্তকরণের মাধ্যমে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহিতায় আনা যেতে পারে। উল্লেখ্য, বর্তমানে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে এই নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকেন। প্রস্তাবিত বিকেন্দ্রীকৃত প্রশাসনের মাধ্যমেও এই নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ রাখা যেতে পারে।
খ) নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহিতা: জাতীয় সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে প্রাপ্ত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কোনো প্রশাসনিক সিদ্ধান্তকে বাতিল এবং রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসনের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের নিকট প্রদানের মাধ্যমে আইন বিভাগ প্রশাসনিক বিভাগকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারে।
গ) আইন বিভাগের বিচার বিভাগের ওপর নিয়ন্ত্রণ: আইন বিভাগকে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার ক্ষমতা এবং নিয়োজিত বিচারককে অভিশংসনের ক্ষমতা অর্পণের মাধ্যমে আইন বিভাগ বিচার বিভাগকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারে।
ঘ) বিচারিক পর্যালোচনা: বিচার বিভাগকে আইন বিভাগ কর্তৃক প্রণীত কোনো আইন এবং রাষ্ট্রপতি প্রযোজিত কোনো প্রশাসনিক ক্ষমতাকে পর্যালোচনা করার ক্ষমতা প্রদানের মাধ্যমে আইন বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারে।


বিকেন্দ্রীকরণ ও ক্ষমতার বণ্টন
প্রস্তাবিত এই রাষ্ট্রকাঠামোর অধীনে সরকারের ধরন হবে রাষ্ট্রপতি শাসিত প্রতিনিধিত্বশীল সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা। এ সরকার ব্যবস্থায় কিছু নির্বাহী ক্ষমতা প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি, জেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা চেয়ারম্যানের নিকট আনুপাতিক হারে বণ্টন ও বিকেন্দ্রীকরণ করা যেতে পারে।
এই বণ্টন ও বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে নিম্নোক্ত দায়িত্ব বিভাজন করা যেতে পারে:
রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব: প্রতিরক্ষা বিভাগ, নির্বাচন কমিশন ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির নিকট ন্যস্ত করা যেতে পারে।
স্বায়ত্তশাসিত জেলা সরকারের দায়িত্ব: পুলিশ প্রশাসন, উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, সমবায়, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি বিভাগের পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব স্বায়ত্তশাসিত জেলা সরকারের নিকট ন্যস্ত করা যেতে পারে।
উপজেলা সরকারের দায়িত্ব: উপজেলাধীন প্রশাসনের ক্ষমতা উপজেলা সরকারের নিকট ন্যস্ত করা যেতে পারে।
এই বিকেন্দ্রীকরণের ফলে ক্ষমতা এক স্থানে কেন্দ্রীভূত হয়ে গোষ্ঠীশাসনতন্ত্র গড়ে ওঠার সুযোগ থাকবে না।


নির্বাচন পদ্ধতির আমূল সংস্কার
গোষ্ঠীশাসনতন্ত্রের সবচেয়ে বড় অস্ত্র হলো নির্বাচন পদ্ধতিতে ত্রুটি। এই সমস্যা সমাধানে নির্বাচনী ব্যবস্থার আমূল সংস্কার প্রয়োজন।
প্রত্যক্ষ নির্বাচনের প্রবর্তন
অতীতে কোনো দল বা একাধিক দল মিলে নির্বাচনে শতকরা ২০% ভোট প্রাপ্তির ইতিহাস আছে এমন দলের মনোনীত প্রার্থীদের মধ্য থেকে প্রত্যক্ষ ভোটে রাষ্ট্রপতি ও জেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনের ব্যবস্থা করে নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার করা প্রয়োজন। এই যোগ্যতার শর্ত নির্ধারণের ফলে শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠিত ও জনসমর্থনপ্রাপ্ত রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থীরাই এই গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোর জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন।
উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনের ক্ষেত্রে বর্তমানে যে ব্যবস্থা রয়েছে, তা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি রাষ্ট্রপতি ও জেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনে জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা একইসাথে নিশ্চিত হবে।
মিশ্র সংসদীয় নির্বাচন পদ্ধতি
জাতীয় সংসদে আদর্শবাদী রাজনীতিবিদদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে সংসদীয় নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার করা প্রয়োজন। আমরা জানি, জাসদ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ও গণফোরাম ইত্যাদি ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সর্বদাই রাজনৈতিক দর্শন, তত্ত্ব ও সূত্র নিয়ে আলোচনা, বিতর্ক ও বাহাস চলমান থাকে। কিন্তু নির্বাচন পদ্ধতির ত্রুটির কারণে জাতীয় সংসদে এসব আদর্শবাদী দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ থাকে না।
প্রস্তাবিত মিশ্র পদ্ধতি: এক নির্বাচনী অঞ্চল এক প্রতিনিধি নির্বাচন পদ্ধতি এবং আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বশীল নির্বাচন পদ্ধতি—এই দ্বিবিধ নির্বাচন পদ্ধতির সমন্বয়ে মিশ্র নির্বাচন পদ্ধতির প্রচলন করা প্রয়োজন। প্রস্তাবিত এই মিশ্র নির্বাচন পদ্ধতির প্রথম পদ্ধতি এবং দ্বিতীয় পদ্ধতিতে যথাক্রমে ৩০০ করে মোট ৬০০ জন জাতীয় সংসদ প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ থাকবে।
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের কার্যপ্রণালী
বিদ্যমান নির্বাচন পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদে ৩০০ ব্যক্তিকে প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচনের যে ব্যবস্থা আছে, তার বাইরে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বশীল সংসদ নির্বাচন পদ্ধতিতে (দ্বিতীয় প্রকার) আরও ৩০০ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এই দ্বিতীয় প্রকার নির্বাচন পদ্ধতিতে প্রত্যেক রাজনৈতিক দল নির্বাচনের পূর্বেই প্রার্থীদের অনুক্রমিক তালিকা প্রকাশ করবে এবং নির্বাচন শেষে ৩০০টি নির্বাচনী অঞ্চলে মোট প্রাপ্ত ভোটের হিস্যা অনুসারে অনুক্রমিক তালিকা থেকে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধি প্রেরণের সুযোগ পাবে।
তৃণমূল নেতৃত্ব উন্নয়ন
এই প্রক্রিয়ায় জাতীয় সংসদ গঠিত হলে, জাতীয় সংসদে বড় দলগুলোর সঙ্গে সব ছোট ছোট আদর্শবাদী রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধত্ব নিশ্চিত হবে। প্রসঙ্গত, দেশজুড়ে প্রতিষ্ঠিত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রসংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা থাকলে, তৃণমূল পর্যায়েও তরুণ নেতৃত্ব গড়ে উঠবে। প্রস্তাবিত এই নির্বাচন পদ্ধতির প্রবর্তন করা হলে, জনগণের ভোটে যে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি হবে, তা টেকসই জাতীয় নেতৃত্বের জোগান দিবে।

উপসংহার
নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্বের সৃজন ও তা জাতীয় নেতৃত্বে আত্তীকরণের প্রক্রিয়া সৃষ্টি হলে, তা গোষ্ঠীশাসনতন্ত্র বিকাশের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করবে।
রাষ্ট্রক্ষমতার যথাযথ পৃথকীকরণ, বণ্টন ও বিকেন্দ্রীকরণ এবং ক্ষমতার বলয়ে নতুন সৃষ্ট নেতৃত্ব আত্তীকরণের সুযোগ থাকলে, বংশপরম্পরানির্ভর গোষ্ঠীশাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ চিরতরে রুদ্ধ হবে। ফলে দেশে টেকসই গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ঘটবে।
এই সংস্কারগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে, যেখানে ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ হবে এবং জনগণের কল্যাণে সরকার পরিচালিত হবে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.