নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বিন্দুর মাঝে সিন্ধু দর্শনের আশায় পথ চলি...

রিদওয়ান হাসান

শুধু একদিন ভালোবাসা, মৃত্যু যে তারপর... যদি তা-ও পাই, আমি তা-ই চাই, চাই না বাঁচতে আমি প্রেমহীন হাজার বছর।

রিদওয়ান হাসান › বিস্তারিত পোস্টঃ

আয়লান-ইউসুফ এবং আমাদের স্থায়ী ঠিকানার ইতিহাস

১৬ ই এপ্রিল, ২০১৬ রাত ৯:১৩


সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে ভিটেহীন, গৃহহীন এবং ঠিকানাহীন হাজার হাজার শরণার্থী ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অভিবাসনপ্রার্থী হয়ে মাটি-কাদা-জলের ওপর, মাইনাস ১৮ ডিগ্রি তাপমাত্রায় খোলা আকাশের নিচে বাস করছে, এই বিয়োগান্ত তাপমাত্রায় যে শিশু নীল হয়ে গেছে, তার স্থায়ী ঠিকানা কী হবে? যে শিশুটি বাবার সঙ্গে সাগরে ভাসতে ভাসতে নিথর দেহ নিয়ে কূলের বালুতটে পৌঁছল, তার স্থায়ী ঠিকানা কী হবে? নৌকায় ভেসে ভেসে কোনো কূলেই ভিড়তে পারল না যে পরিবারগুলো, তাদের স্থায়ী ঠিকানা কী হবে? লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে সলীল সমাধি হওয়া ইউসুফ ও তার বাবা-মার স্থায়ী কোথায় হবে? আমাদের সীমান্তের নো-ম্যান্স ল্যান্ডের কাঁটাতারে ঝুলন্ত ফেলানির লাশের ঠিকানা কী? বিশ্বজুড়ে এমন অসংখ্য 'ঠিকানা কী' প্রশ্ন মাথায় নিয়ে প্রতিদিন শরণার্থী হচ্ছে, ঠিকানাবিহীন হচ্ছে হাজার হাজার মানুষ!
স্থায়ী ঠিকানার ইতিহাস যেন দখলের ইতিহাস। একদল লোক স্থায়ী ঠিকানা গড়ে আরেক দলের ঠিকানা অস্থায়ী হয়ে যায়। ভারত ভাগ হওয়ায় উভয় দিক থেকেই একদল মানুষ স্থায়ী ঠিকানা হারাল। তেমনি ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে পূর্ববাংলা থেকে বহুসংখ্যক মানুষ চিরকালের জন্য ভিটেমাটি ছেড়ে পশ্চিমবাংলায় পাড়ি জমাতে বাধ্য হলো। আবার পশ্চিম বাংলার একদল লোক সেখানকার স্থায়ী ভিটেমাটি ছেড়ে চিরকালের জন্য পূর্ববাংলায় পাড়ি জমাতে বাধ্য হলো। এর ফলে উভয় দেশেরই বহু লোক হারাল তার স্থায়ী ঠিকানা। এই তো, এমনই তো স্থায়ী ঠিকানার ব্যক্তিগত ইতিহাস!

(২)
গত সেপ্টেম্বরে গ্রিক উপকূলে উদ্ধার হওয়া নিষ্প্রাণ আয়লানের কথা কমবেশি সকলের মনে আছে। ভয়ংকর সাগর যাত্রা নিয়ে সারা বিশ্বের ঘুম ভাঙানো সেই সিরীয় শিশু, যে গত ২রা সেপ্টেম্বর তুরস্কের উদ্বাস্তু শিবির থেকে মা-বাবার সাথে সাগরপথে ইউরোপে পালানোর সময় নৌকাডুবে সাগরে নিমজ্জিত হয়ে মারা যায়। পরদিন সকালে তার লাশ উদ্ধার করা হয় তুরষ্কের বোদরুম উপকূল থেকে এবং বিশ্বব্যাপী এই ছবি ঝড় তুলে। সিরিয়ার কোবানিতে জন্ম নেয়া এ শিশুর পরিবারটাকে আচমকাই ‘শরণার্থী’ বানিয়ে দিল যুদ্ধ পরিস্থিতি। কোবানি ছেড়ে প্রথমে দামাস্কাস, আলেপ্পো, সেখান থেকে আবার কোবানি। কিন্তু সিরিয়ায় আইএস জঙ্গি এবং কুর্দ বাহিনীর লড়াইয়ে ছেদ পড়ে না। তাই একেবারেই ছাড়তে হয় ভিটেমাটি। মাসখানেক আগে সপরিবার তুরস্কের বোদরুমে এসেছিলেন আয়লান কুর্দির পরিবার। কিন্তু এখান থেকে ২ সেপ্টেম্বর উদ্বাস্তু এই পরিবার তুরুষ্কের শিবির থেকে গ্রিসে পালানোর সমাধান বের করলো, কারণ উদ্বাস্তুদের অন্য কোনো দেশে যাওয়ার আইন নেই। তাই আইনবহির্ভূত পন্থায় কোনোমতে গ্রিস পৌঁছলে সেখান থেকে কানাডার ভিসা পাওয়া যাবে। তাই সাগরপথে কষ্টসাধ্য পথ মাড়ানোর জন্য তৈরি হয়ে গেল পরিবারটি।
যেই ভাবা, সেই কাজ। ছয়জনের ধারণক্ষমতাসম্পন্ন নৌকাটিতে গাদাগাদি করে প্রায় ছাব্বিশজনের মতো উঠে পড়লো ইউরোপের গ্রিসের উদ্দেশে। নৌকা যখন সাগর মাঝপথে এমন নিকষ অন্ধকার মুহূর্তে কেঁপে উঠলো সাগর এলোপাতারি ঝড়। বিশাল বিশাল ঢেউ উঠছিল সমুদ্রে। ডিঙিটা দুলছিল বিপজ্জনকভাবে। আয়লানের বাবা আবদুল্লাহ কুর্দি হঠাৎ দেখেছিলেন, হাল ধরে থাকা লোকটা পানিতে ঝাঁপ দিল। মা রেহানা উত্তাল ঢেউয়ের নোনাপানির ছিটা থেকে ছেলেকে বাঁচাতে গায়ের উড়না দিয়ে ঢেকে নিলেও রেহাই হয় না। যেন আরো উন্মত্ত হয়ে উঠছে সাগরের ঢেউ। সবাই অলৌকিক কোনো মহাশক্তির কাছে প্রার্থনা করছে। জোরে জোরে কালেমা জপছে। আবদুল্লাহ বুঝেছিলেন, নৌকা ডুবছে। সঙ্গে স্ত্রী এবং আয়লান ও তার ভাই। আরও অন্তত তেরোজন যাত্রী নৌকায়। আবদুল্লাহ শেষ চেষ্টা করলেন হাল ধরার। তবু নৌকা উল্টোলো। আর তখন স্ত্রীর হাতটা শক্ত করে ধরতে ধরতে আবদুল্লাহ দেখলেন, হাতের ফাঁক গলে আয়লান পড়ে গেল ওই উথালপাথাল সমুদ্রে।
এমনটিই ছিল আয়লান কুর্দির ঘটনা। কিন্তু এর সপ্তাহখানেক আগে আগস্টে প্রায় অভিন্ন ঘটনার শিকার হয়েছিল ছয় বছর বয়সী বাংলাদেশি শিশু ইউসুফ। আয়লানের নিথর মরদেহ উদ্ধার করা সম্ভব হলেও ২০১৫ এর ২৭ই আগস্ট রাতে ভূমধ্যসাগরে ভেসে গেছে ইউসুফ এবং তার মা ও বাবার মরদেহ। তারা সবাই প্রতিকূল পরিবেশ ও অবৈধ অভিবাসনের শিকার।
সেদিন যাত্রা শুরুর সময় নৌকার আকার দেখে নিমেষেই সব উচ্ছ্বাস উধাও হয়েছিল ভাগ্যতাড়িত কয়েক শ অভিবাসীর। লিবিয়ার জোয়ারা উপকূল থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরের জলসীমায় দালালচক্রের একচ্ছত্র শাসন। পা ফেলার জায়গা নেই, তবু সবাইকে পিটিয়ে তোলা হয় ছোট্ট কাঠের নৌকায়। কষ্টের কথা বলতেই নেমে আসে নির্যাতনের খড়্গ। ইতালির উদ্দেশে যাত্রা শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই গভীর সাগরে নৌকাটি ডুবে যায়। এরপর শুরু রাতের আঁধারে হাতে গোনা কয়েকটি লাইফ জ্যাকেট কাড়াকাড়ি করে কয়েক শ অভিবাসীর বেঁচে থাকার লড়াই; সহযাত্রীর মরদেহ ধরে ভেসে থাকা কিংবা অন্য যাত্রীর লাইফ জ্যাকেট খুলে নিয়ে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা। এমন অনেকেই সপরিবারে গত কয়েক বছরে লিবিয়া ছেড়ে ইতালি বা ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। তাদের সবাই সফল হয়নি। পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের মতো অনেক আয়লান, অনেক ইউসুফ ভূমধ্যসাগরে ডুবে হারিয়ে গেছে চিরদিনের জন্য। ইরাক-সিরিয়া যুদ্ধের ডামাডোলে এরকম হাজারও আয়লান-ইউসুফ আজ মৃত্যুমুখে পতিত।

(৩)
প্রায় সতের বছর ধরে লিবিয়ায় বাস করে ইউসুফ-পরিবার। যুদ্ধের পর থেকে বন্ধ হয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। সিরত শহরে কাজের সুযোগ নাই বললেই চলে। এলাকার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় আইএস এর হাতে। পরিবেশের প্রতিকূলতা কাটাতে প্রতিবেশীদের অনেকেই লিবিয়া ছেড়ে ইতালি পালায়। পরিচিত এক পাকিস্তানি পরিবারও ইউরোপ পৌঁছে ফোনে রহমান আলীর বাবাকে ইতালি ও জার্মানির সুযোগ-সুবিধার কথাও জানায়। এ প্রেক্ষাপটে জনপ্রতি এক হাজার ১০০ দিনার (প্রায় ৬৩ হাজার টাকা) খরচে দালালের ব্যবস্থাপনায় ইতালি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি এবং মা-বাবা, বোন খাদিজা, ভাই শাহনেওয়াজ ও ছয় বছর বয়সী ইউসুফ।
দালালদের সাথে ‍চুক্তি হয়েছিল, ত্রিপোলি পৌঁছার দুই দিনের মধ্যে জোয়ারায় নিয়ে যাওয়া হবে তাদের। এরপর তারা চড়বে ইতালিগামী নৌকায়। দালালদের সঙ্গে কথা বলে নির্ধারিত দিনে সব কিছু গুছিয়ে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তারা ত্রিপোলিতে পৌঁছায় ঠিকই, কিন্তু আবহাওয়া খারাপসহ নানা টালবাহানায় যাত্রার দিন এক সপ্তাহ পিছিয়ে দেয় দালালরা। ত্রিপোলিতে ছোট্ট দুই কক্ষের এক বাসায় তাদেরসহ মোট ৫৫ জনকে রাখা হয়। এরপর একদিন সাগরের তীরে নিয়ে তাদের আবার ফিরিয়ে আনে দালালচক্র। এভাবে আরো প্রায় এক মাস প্রতীক্ষার পর আসে নির্মম সেই দিন।
২৭ আগস্ট ২০১৫। তাদের জীবনের সবচেয়ে দুঃস্বপ্নময় দিন। তারা ভেবেছিল, কেটে যাবে দুর্দিন। ইতালিতে গিয়ে কাটাবে স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন। কিন্তু দালালচক্রের মতলব ততক্ষণে সবার কাছে পরিস্কার। দালালচক্র ডাঙায় থাকতেই তাদের কাছ থেকে ছোট ছোট গ্রুপে কেড়ে খাবার, কাপড়ের ব্যাগ—সব। এরপর ছোট দুটি স্পিডবোটে করে ৩০-৪০ জনের একেকটি গ্রুপকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে পানিতে অবস্থানরত কাঠের নৌকায়। স্পিডবোটে কে কার আগে উঠবে তা নিয়েও চলছিল প্রতিযোগিতা। স্পিডবোটে প্রায় ১০ মিনিট যাত্রার পর তারা যখন কাঠের নৌকার দেখা পেল, তখন তাদের আত্মবিশ্বাস অর্ধেকে নেমে এলো। বুঝতে পারল, এত দিন যা বলা হয়েছে- সব ভুল ও মিথ্যা।
কোরবানির গরু-ছাগলের মতো তাদেরকে টেনেহিঁচড়ে নৌকায় তোলা হচ্ছিল। কেউ যদি নিজের পরিবারের সদস্যদের খোঁজার জন্য একটু উঠে দাঁড়াচ্ছিল, সঙ্গে সঙ্গে তাদের পাইপ ও জুতা দিয়ে পেটানো হচ্ছিল। ব্যাচেলর ও আফ্রিকানদের ওপর অত্যাচার হচ্ছিল সবচেয়ে বেশি। তাদের জোর করে ইঞ্জিন রুমে ঢোকানো হচ্ছিল। বেশি মানুষ ঢোকানোর জন্য সবার লাইফ জ্যাকেট কেড়ে নেয়া হয়েছিল। ওই ছোট নৌকাতেই তখন চার থেকে পাঁচ শ অভিবাসীকে সাজানো হলো। কেউ নড়াচড়া করে উঠলেই তাঁর পিঠে পড়ছিল জুতার বাড়ি । মিনিট কয়েক পর নৌকা ছাড়লে অনেক কষ্টে পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে দেখেন সময়। 12টা বেজে ততক্ষণে মিনিটের কাটা দশকের ঘরে। নৌকা ছাড়ার প্রায় ১০ মিনিটের মাথায় ইঞ্জিন রুম থেকে চিৎকার-চেঁচামেচি শোনা যায়। তাকিয়ে দেখেন, ইঞ্জিনের ফাটা পাইপ দিয়ে পানি ঢুকছে। চালক অভয় দিয়ে বলেন, চিন্তার কিছু নেই। কিন্তু তাঁর কথায় ভরসা রাখতে পারছিলেন না। তাদের সবার চোখ যাচ্ছিল সেই পাইপের দিকে। এরই মধ্যে ২০-২৫ জনের সিরীয় একটি গোষ্ঠী নৌকার নিয়ন্ত্রণ নেয়। তাদের নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তির হাতে ছিল ছুরি। তিনি সবাইকে উচ্চস্বরে ইশ্বরের নাম জপতে বলেন। কেউ চুপ করে থাকলেই তারা চড়-থাপ্পড়, লাথি-ঘুষি মারছিল। কিছুক্ষণ পর চেঁচামেচি শুরু হয়। নৌকায় ওঠা পানির পরিমাণ আর অগ্রাহ্য করার মতো নয়। চালক স্যাটেলাইট ফোনে বিষয়টি জানালে মালিক বলেন, কোনোভাবেই নৌকা যেন লিবিয়ায় ফিরে না আসে। তাই কয়েকজন ছোট পানির বোতল দিয়ে নৌকার পানি বাইরে ফেলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে হাল ছেড়ে দেন।
প্রায় পাঁচ মিনিট চুপ থাকার পর আবার হৈ চৈ। ইঞ্জিনের ধোঁয়া আর প্রচণ্ড গরমে শ্বাস নিতে সমস্যা হওয়ায় কয়েকজন আফ্রিকান ইঞ্জিন রুম থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলে সিরীয় গোষ্ঠী তাদের হুমকি দিয়ে ফেরত পাঠায়। একজনকে এ সময় নৌকা থেকে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করা হলেও সে ভাগ্যগুণে বেঁচে যায়। এরপর ইঞ্জিন রুমে পানি আরো বেড়ে যাওয়ায় চালকও ভয় পেয়ে যান। এ ঘটনা মালিককে জানানো হলো- ‘আর সামনে এগোনো সম্ভব নয়। তিনি নৌকা ঘোরাচ্ছেন, আপনি দ্রুত উদ্ধারকারী নৌকা পাঠান।’
ঘড়ির কাটা বলছে রাত ২টা বেজে ৩০ মিনিট। ইতিমধ্যেই ইউসুফ-পরিবার বুঝতে পারলেন, ইতালি আর যাওয়া হচ্ছে না। তীরে পৌঁছতে পারলে সিরত শহরেই ফিরবেন তাঁরা। কিন্তু হঠাৎ নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেল। ইঞ্জিনের অর্ধেক ততক্ষণে ডুবে গেছে। ইঞ্জিন রুম থেকে লোকজন ওপরে উঠে আসছে। আর ওপরে থাকা লোকজন সবাই দাঁড়িয়ে গেছে। সে সময়ে বুঝতে পারেন তাঁর চারদিকে পানি। ইউসুফ ‘বড় ভাইয়া’ বলে চিৎকার করতে করতে ডুবে যেতে থাকে। অথচ কেউ কিছুই করতে পারছিল না। ডুবন্ত অবস্থায় মুখে পানি ঢুকছে। এ অবস্থায় কথা বলতে চাইলে কেমন আওয়াজ হয়- তা যে না শুনেছে তাকে বলে বোঝানো সম্ভব নয়।
অশান্ত হয়ে ওঠে সাগর। মানুষের কোলাহলে মরাসাগর যেন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেছে। চারদিকে শত শত মানুষ সাগরে ভাসছে, আর তাদের ওপর হামলে পড়ছে শত শত লাইফ জ্যাকেট ছাড়া মানুষ। চারদিকে কান্না আর চিৎকার। একজনকে ডুবিয়ে অন্যজন ভেসে থাকতে চাইছে, আবার কেউ কেউ দেখলাম ওই অবস্থায় লাইফ জ্যাকেট কেড়ে নেওয়ার জন্য মারামারি করছে। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কাউকে চেনার উপায় নেই, শুধু কিছু মানুষের কালো অবয়ব ছাড়া আর কিছু বোঝা যাচ্ছিল না।
প্রায় ঘন্টা ছয়েক এ প্রাণপণ লড়াই চললো। তখনকার অবস্থা মারো মর্মান্তিক হয়ে দাঁড়ালো। কেউ কাছে আসতে চাইলে অন্যরা কিল-ঘুষি মেরে দূরে সরিয়ে দিচ্ছিল। কয়েক শ অভিবাসীবোঝাই নৌকাটি ডোবার পর বোঝামুক্ত নৌকাটি আবার ভেসে উঠল। তখন দালালচক্র তাদের মধ্যে বেঁচে থাকা লোকদেরকে নৌকায় তোলার চেষ্টা করে। কিন্তু খুব কম লোকই মেলে নৌকায় তোলার জন্য।
একসময় দেখা যায় বোন খাদিজাকে ভাসতে। খাদিজার এক হাতে ইউসুফ, অন্য হাতে তার বাবা। কিন্তু তাঁদের কেউই আর তখন বেঁচে নেই। খাদিজা কাঁদছিল আর বলছিল- ‘ইউসুফ, ওঠো। ইউসুফ ওঠো।’ ইউসুফের ভাগ্যে কোনো লাইফ জ্যাকেট জোটেনি। আর তাঁর বাবার জ্যাকেট ঘুরে পিঠে চলে গিয়েছিল, যার কারণে শরীর উপুড় হয়ে পানির নিচে চলে যায়। ভাই রহমান আলীর জ্যাকেট তখন প্রায় ছিঁড়ে গেছে। তাই বাবার নিথর দেহ থেকে লাইফ জ্যাকেট খুলে নিজের গায়ে পরার পর হঠাৎ রহমান আলী ও খাদিজা পরস্পরের দিকে প্রশ্ন করতে লাগল, ‘ইউসুফ কোথায়?’ জ্যাকেট পরার কোনো এক মুহূর্তে হাত ফসকে ইউসুফের নিথর দেহ তাদের হাত থেকে ছুটে হারিয়ে যায় গভীর সাগরে। তারপর আর ফিরে পাওয়া যায়নি তাকে। সকলকে ছেড়ে চলে যায় স্থায়ী ঠিকানার খোঁজে।

জন্মের পর থেকেই একজন মানুষ কাগজে-কলমে লেখা একটি ঠিকানার জন্য যুদ্ধ করে। যার ঠিকানা নেই তাকে বলি উদ্বাস্তু। আর উদ্বাস্তুর জীবন অনেকটা দাসের জীবন। আজ এখানে তো কাল ওখানে। আজ যে বাড়ির প্রধানের নাম, নম্বর, সড়কের নম্বর এবং এলাকা দিয়ে একেকটি বাড়ির সামনের নগর অথবা গ্রাম কর্তৃপক্ষের ঠিকানা টানানো থাকে, স্থায়ী বাসিন্দাদের নামই সেখানে দেখা যায়। যারা অস্থায়ী তাদের নাম ঠিকানা সেখানে খোদিত হয় না। তবে কেই বা স্থায়ী বাস করছে এ বিপুলা পৃথিবীতে? আমাদের স্থায়িত্ব কতকাল? ১ দিন, ১০০ বছর বা আরো কিছু কম বা বেশি? তবে তা কি স্থায়ী ঠিকানা হতে পারে? স্থায়ী মানে তো অজর, অনড়। শতাব্দী থেকে শতাব্দীকাল। জীবিতকালে বাড়ির সামনে স্থায়ী ঠিকানা লেখা থাকে। আর মৃত্যুর পর কবরের সামনের এপিটাপে মৃত্যুব্যক্তির ঠিকানাই লেখা থাকে।
কোন্ ঠিকানার জন্য যুদ্ধ করা উচিত? স্থায়ী না অস্থায়ী। স্থায়ী কোন ঠিকানা আর কোনটিই অস্থায়ী- এ প্রশ্নের উত্তর পাঠকই দেবে।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১৬ ই এপ্রিল, ২০১৬ রাত ৯:৩০

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: মর্মস্পর্শী!

হায়রে জীবন! হায়রে স্বপ্ন! হায়রে ক্ষমতার লড়াই!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!


আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.