নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বিন্দুর মাঝে সিন্ধু দর্শনের আশায় পথ চলি...

রিদওয়ান হাসান

শুধু একদিন ভালোবাসা, মৃত্যু যে তারপর... যদি তা-ও পাই, আমি তা-ই চাই, চাই না বাঁচতে আমি প্রেমহীন হাজার বছর।

রিদওয়ান হাসান › বিস্তারিত পোস্টঃ

সাভারে একদিন : রানা প্লাজা ট্রাজেডির সাতকাহন

২৫ শে এপ্রিল, ২০১৬ সকাল ১১:৫৮

ভাতিজার আবদার, তাকে ল্যাপটপ কিনে দিতে হবে। এখানে ভয়ের কারণ নেই। কারণ টাকাটা আমাকে গুণতে হচ্ছে না। ভাতিজার চার মাসের বেতনের টাকা জমেছে। সেটা দিয়ে একটা ল্যাপটপ কিনবে। ভাতিজা আমার একটাই। বেশ পড়ালেখাও করেছিল। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে অনার্সে ভর্তি হয়েছিল। পরে শুনলাম, বাড়ি থেকে রাগ করে এসে সাভারে উঠেছে দুঃসম্পর্কের এক মামার কাছে। গার্মেন্টসে কাজ করে। মেধা ভালো ও কর্মঠ হওয়ায় কয়েক দিনেই ঝানু হয়ে গেছে। কোয়ালিটি হেলপার থেকে সোজা কোয়ালিটি কন্ট্রোলারের হেড বনে যায়। ওর কথা, ‘আমি কম্পিউটার-ল্যাপটপ সম্পর্কে তেমন জানি না, বুঝিও না। তুমি তো এসব নিয়ে পড়ে থাকো; তুমিই ভালো বুঝবে। তাছাড়া একটু শিখিয়ে না দিলে চালাবো কি করে?’
ঢাকায় থাকি। কর্মব্যস্ততায় শুক্রবার ছাড়া সারাসপ্তাহে আর কোনো দিনেই ছুটি মেলে না। আর শুক্রবারেও যাওয়া যাবে না। তাই গতকাল ২৪ এপ্রিল রবিবার অর্ধদিবসের কাজ সেড়ে সাভারে যাওয়ার জন্য বের হলাম। মিরপুর-১০ থেকে ‘তিতাস’ নামক বাসে চড়ে বসলাম। কানে হেডফোন লাগিয়ে এফ.এম শুনছিলাম। তাই সময় আঁচ করতে পারিনি, তবে যেতে আনুমানিক ঘণ্টা দুয়েক লেগেছিল। বুঝতে পেরেছিলাম, আজ রাতে ফিরতে পারব না। তাই রাতটা ওখানে থেকে পরের দিন ভোরে রওয়ানা করার প্ল্যান ছিল আমার।
যাকগে, বাস থেকে নামতেই ভাতিজা আমাকে রিসিভ করল। তারপর দুজনেই একটা রিকশায় চেপে বসলাম ভাতিজার বাসায় যাওয়ার জন্য। রিকশায় বসে থেকে হঠাৎ চোখ গেল কিছু লোক জড়ো হয়ে থাকার দৃশ্যে। যেখান ভেসে আসছিল দুঃখ-কষ্ট, কান্না-আহাজারি, রাগ-ক্ষোভমিশ্রিত কিছু কথা।
হঠাৎ মনে পড়ল, রানা প্লাজার কথা। ২০১৩ সালের এই তারিখে তাজরীন ফ্যাশনের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কয়েকদিনের মাথায় সাভারের ‘রানা প্লাজা’ ধসে পড়ে যে মর্মন্তুদ উপাখ্যানের সৃষ্টি হয়েছিল, তা আকাশ ভেঙে মাথায় পড়ার মতো। সেই সাথে বাংলাদেশ জন্ম দিয়েছিল এক নতুন ইতিহাস ‘রানা প্লাজা ট্রাজেডি’। সেটাও হয়ত বা মনে পড়ত না, যদি রিকশাটা রানা প্লাজার সামনে দিয়ে না যেত। সেই সুবাদে খানিকটা সময়ের জন্য রিকশা থেকে নেমেছিলাম সেখানে।
রানা প্লাজা ধসের তিন বছর হলো আজ। ইতিহাস আজ নতুন করে বলব না। কম-বেশি আপামর জনগণ সবাই জানে রানা প্লাজার ইতিহাস। দেখলাম, বিভিন্ন দাবি নিয়ে দূর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া শ্রমিক, নিহতদের স্বজনসহ আরো অনেক ধরনের মানুষের সমাগম। কারো চোখে জল। কারোর অশ্রুবিহীন কান্না—চোখ শুকিয়ে যেন চৈত্রের খড়া বইছে। অন্যদিকে বৈশাখের তীব্র দাবদাহ আর তপ্ত রোদ্দুরও দমাতে পারছে না তাদের। বুক চাপড়ে কষ্ট চাপা দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টাও নজরে পড়েছিল তখন। আবার কারোর ক্ষোভ-প্রতিবাদের উচ্চকিত কণ্ঠও ভেসে আসছিল দিগ্বিদিক থেকে। এভাবেই মানুষের দুঃখ-কষ্ট, রাগ-ক্ষোভ একাকার হয়ে শোক-শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় স্মরিত হয় নিহতরা।
সবচেয়ে বেশি কষ্ট লেগেছিল এক মাকে দেখে। সে তার ২১ বছরের ছেলে ও সদ্যবিবাহিতা বৌমাকে নিয়ে এসে দুই দিনের মাথায় দুর্ঘটনার শিকার হয়। তারা আজ দুজনেই নিখোঁজ। আজো তাদের সন্ধান মেলেনি। শুধু বুকের ধনই নয়, দুর্ঘটনা কেড়ে নিয়েছে তার পরিবারের আরো তিনজনকে। যদিও বাকি তিনজনের লাশ সনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। সেই মায়ের কান্না, বুক ফাটা আর্তনাদ এখনো আমাকে শিউরে তোলে। সরেজমিনে গিয়ে জানতে পারলাম, শুধু একজন ছেলে ও তার সদ্যবিবাহিতা স্ত্রীই নয়; আরো অনেক শ্রমিকের আজ অবধি কোনো হদিস মেলেনি। আহতদের মধ্যে অনেকেই পঙ্গুত্ব বরণ করে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির শিকার হয়ে যন্ত্রণাকাতর জীবন ধারণ করছে। দুর্ঘটনার তিন বছর পার হলেও এখনো থামেনি স্বজনহারা ও দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকাদের কান্না-আহাজারি। তিন বছর আগের সেই দুর্ঘটনায় নিখোঁজ হওয়া অনেক শ্রমিকের খোঁজ এখনো পাওয়া যায়নি। কোনো ধরনের আর্থিক সহায়তাও পায়নি তাদের স্বজনরা। মোট কতজন এখনো নিখোঁজ- সুনির্দিষ্টভাবে এই সংখ্যাটি নিশ্চিত হওয়া না গেলেও গত বছরের ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত ১৫৯ জন শ্রমিক নিখোঁজ ছিল বলে খবর বেরিয়েছিল।


দুই.
পাঁচ-ছয়টা শো-রুম দেখে এইচ.পি প্যাভিলিয়ন সিরিজের কমদামি একটি ল্যাপটপ কিনলাম। রাত হয়ে গেয়েছিল। তাই পূর্বপ্ল্যান অনুযায়ী রাতে থেকে গেলাম ভাতিজার কাছে। কিন্তু রানা প্লাজার সামনে স্বজনহারাদের গগণবিদারী কান্না আর অশ্রুবিহীন চেহারায় ফুটে ওঠা বিষাদের ভয়াবহতা যেন আমার চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। তাই ভাতিজার সাথে এ ব্যাপারে চুলচেড়া বিশ্লেষণ করতে লাগলাম। বিশ্লেষণের একপর্যায়ে আলোচনার মোড় ঘুরে গেল। ঠিক একবছর আগে যেমনটি মোড় ঘুরে গিয়েছিল—আপনাদের মনে হয়ত আছে, গত বছর ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজায় চাপাপড়া শ্রমিকদের বেঁচে থাকার আশা ছেড়ে দিয়ে স্বজনরা যখন শুধু প্রিয়জনের মরদেহটি পাওয়ার আশাতেই বুক বেঁধেছিল, ঠিক সে সময় ভবনটির নিচতলায় থাকা ১৭ দিন পর ধ্বংসস্তূপ থেকে জীবিত উদ্ধার হন পোশাকশ্রমিক রেশমা আক্তার।
এ ঘটনা শুধু দেশের মানুষকেই লাগিয়ে দেয়নি, চমকে দিয়েছিল গোটা বিশ্বকে। কারণ যেখানে ১১৩৮ জন নিহত এবং ২০০০ চেয়েও বেশি মানুষ আহত, সেখানে দুর্ঘটনার ১৭ দিন পর্যন্ত খাবার ও পানি ছাড়া বেঁচে থাকা সম্ভব নয় কিছুতেই। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের অভিমতও এটা। আর এ কারণেই রেশমা ‘অলৌকিক কন্যা’র আখ্যা পেয়েছিল। অনেকটা অলৌকিকভাবেই হাজির হয়েছিল সে। কতিপয় বিশ্লেষক এটাকে ‘পলিটিক্যাল মুটিভ’ বলেও চালানোর চেষ্টা করে।
সে যাই হোক, রেশমার আবির্ভাব হলো আমাদের আলোচনায়। পাল্টে গেল কথার ধারা। এবারের টপিক ছিল রেশমার পূর্বাপরের অবস্থান নিয়ে। আমাদের কথার ধারা যেমন পাল্টালো, অনুরূপ সেদিনকার ১৭ দিনের পর থেকেই পালটে গেছে রেশমার জীবনও। এক দরিদ্র পোশাক শ্রমিকের জীবন থেকে উঠে এসেছে মধ্যবিত্তদের কাতারে। ভাতিজার পরমাত্মীয় ছিল সে। সেই সূত্র ধরে রেশমার সাথে গোটা তিনেক কথা বলার ‘সৌভাগ্য’ও হয়েছিল আমার অনেকদিন আগে। আমি আলোচিত সেই ১৭ দিনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাইলে সে বলেছিল, ধ্বংসস্তূপ থেকে বেঁচে ফেরা হাজারো শ্রমিকের মতোই সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনার স্মৃতি আজো তাকে দাপিয়ে বেড়ায়। নিদ্রাহীনতা আর শরীরে ব্যথার যন্ত্রণায় এখনো সে মাঝরাতে আতকে ওঠে। তবুও থেমে থাকেনি তার জীবন, এসেছে ইতিবাচক পরিবর্তন।
ভাতিজার মুখ থেকে শোনা, ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারীতে প্রেমিককে বিয়ে করেছে রেশমা। ঢাকার আন্তর্জাতিক পাঁচতারা হোটেল ওয়েস্টিনে নিজের নতুন কাজও উপভোগ করছে সে। আর কখনো পোশাক কারখানায় যাবে না উল্লেখ করে সে বলে, বর্তমানের কাজটা আমার অনেক ভালো লাগে। আমার এখানকার কাজ অনেক আরামের-সম্মানের।
ভাতিজার আশা ছিল, রেশমার সাথে জীবনের একান্ত মুহূর্তগুলো কাটানোর। এ কিন্তু বলা বলা করে সে কথা আর কোনো দিন বলা হয়ে ওঠেনি। নিভে গেছে সেই আশা। আসলে মানুষের সব আশা পূরণ হলে একপর্যায়ে মানুষ আশা করাই ছেড়ে দিবে। আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি কারো কোনো আকর্ষণ থাকবে না। সব আশা পূরণ হয় না বলেই মানুষ আশা নিয়ে বুক বাধে। আশার প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করে। যেমন আশা করেছিল হতদরিদ্র এলাকা থেকে আসা হাজারো শ্রমিকরা। কিন্তু তা সে আশা আর পূরণ হয়নি। তবুও এর নেপথ্যে প্রশ্ন থেকেই যায়- ‘কেন পুরণ হলো না তাদের আশা, কেন ঘটেছিল এই বিপর্যয়?’ এমন অনেক প্রশ্নেরই কোনো মীমাংসা হয়নি।
আমি যতটুকু বুঝেছি- কতিপয় স্বেচ্ছাচারী, লোভাতুরের কারণে মূলত ভবনমালিকের একগুঁয়েমি আর সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের উদাসীনতা এবং ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও ওই ভবনে শ্রমিকদের কাজ করতে বাধ্য করাসহ দূর্বল কনস্ট্রাকশন, বিল্ডিং কোড না মেনেও রাজউকের পক্ষ হতে ৪তলা বাণিজ্যিক ভবনের ছাড়পত্র দিলেও রাজউকের নাকের ডগায় ৪তলা বিল্ডিং হয়ে গেল ৮তলা। আবার এই অপরিপক্ক তলাগুলোতেই অবলীলায় গার্মেন্টস করার অনুমোদন দিল বিজিএমইএ! এ ধরনের নানা কারণে ঘটেছিল এ বিপর্যয়, ভেঙে গিয়েছিল হাজারো মানুষের আশা। শুধু কি আশাই ভেঙেছে; ভেঙেছে দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড, নষ্ট হয়েছে দেশের ভাবমূর্তি। অসহায় শ্রমিকদের বিয়োগ আর আত্মীয়-স্বজনদের আহাজারিতে কেঁদে উঠেছিল আকাশ-বাতাস। শুধু কাঁদেনি দুর্নীতিবাজদের পাষাণ মন।
রানা প্লাজার মর্মন্তুদ ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়া দরকার। প্রত্যেকটা বিপর্যয়ই আগামী প্রজন্মদের শিখিয়ে যায়। তবে কেন আমরা শিক্ষা নিচ্ছি না? এখনো অনেক গার্মেন্টস কারখানাগুলোর সার্বিক অবস্থা প্রশ্নের উর্ধ্বে নয়। কতিপয় সেচ্ছাচারীদের খামখেয়ালিপনা আর ভবনমালিকের লোভাতুরে মন এবং অনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য আমাদের মাশুল গুনতে হবে কেন? কেনই বা তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ত্বরিত ব্যবস্থা নেয়া হয় না? কেউ কি এর জবাব দেবেন?

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.