নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বিন্দুর মাঝে সিন্ধু দর্শনের আশায় পথ চলি...

রিদওয়ান হাসান

শুধু একদিন ভালোবাসা, মৃত্যু যে তারপর... যদি তা-ও পাই, আমি তা-ই চাই, চাই না বাঁচতে আমি প্রেমহীন হাজার বছর।

রিদওয়ান হাসান › বিস্তারিত পোস্টঃ

রক্ত সংবহন তন্ত্রের আবিষ্কারক কে : উইলিয়াম হার্ভে, নাকি ইবনুন নাফিস? একটি ঐতিহাসিক প্রমাণ

১৫ ই এপ্রিল, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:২৩

আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে রক্ত সংবহন তন্ত্র (Blood circulatory system) বা রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়াটি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার। আমাদের শরীরের রক্ত প্রথমত হৃৎপিণ্ড থেকে পালমোনারি ধমনীর মাধ্যমে ফুসফুসে যায়। এবং পালমোনারি শিরার মাধ্যমে আবার হৃৎপিণ্ডে ফিরে আসে। পরবর্তীতে তা আবার ধমনী, উপধমনীর মাধ্যমে সারাদেহে ছড়িয়ে পড়ে৷ রক্ত সংবহন তন্ত্রের কাজের বিশদ বিবরণ আমাদের কাছে বিরক্তিকর মনে হলেও আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা এই প্রক্রিয়াকে কেন্দ্রিয় সূত্র হিসেবে বিবেচনা করেন।

নানা ধরনের আধুনিক অস্ত্রোপচার এমনকি আমাদের শরীরের ঠিক কোন জায়গায় কোন রক্তপ্রবাহে ইঞ্জেকশন দিতে হবে সেটিও এই প্রক্রিয়া যথার্থভাবে জানার ওপর নির্ভর করে।

এই তত্ত্বের প্রধান আবিষ্কারক হিসেবে ধরা হয় বিখ্যাত চিকিৎসক ও বিজ্ঞানী উইলিয়াম হার্ভেকে। ইংল্যান্ডের ফোকস্টোন শহরে ১৫৭৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন উইলিয়াম হার্ভে। তিনি শরীর-বিদ্যা ও চিকিৎসাশাস্ত্রে নানা অবদান রেখেছেন, বলাই বাহুল্য। মানুষের দেহ আর রোগ নিয়ে যারা গবেষণা করে গেছেন তিনি তাদের মধ্যে উইলিয়াম হার্ভে অন্যতম। বলা হয়—এর আগে রক্ত চলাচল সম্পর্কে কারও সঠিক ধারণা ছিল না। শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্তশিরা পথে হৃৎপিণ্ডে আসে এবং হৃৎপিণ্ড থেকে ধমনীর মাধ্যমে বিভিন্ন অংশে সঞ্চালিত হয়, এটা সর্বপ্রথম হার্ভেই বলেছিলেন।

কিন্তু ঐতিহাসিক সত্যতা প্রমাণ করে, উইলিয়ার হার্ভের আগেও রক্ত সঞ্চালনের ব্যাপারে ভিন্ন ধারণা প্রচলিত ছিল চিকিৎসকদের কাছে। হার্ভের চৌদ্দশো বছর পূর্বে বিখ্যাত ইউনানী চিকিৎসাবিজ্ঞানী গ্যালেন রক্ত সঞ্চালনের ব্যাপারে বলেছিলেন—“খাদ্য যখন আমাদের শরীরে প্রবেশ করে তখন তা রক্ত উৎপাদন করে। এই রক্ত যকৃত বা লিভার থেকে হৃৎপিণ্ডে পৌঁছায়। হৃৎপিণ্ড রক্তকে গরম করে এবং অবশেষে কেবলমাত্র শিরার মাধ্যমে রক্ত সারাদেহে ছড়িয়ে পড়ে।”

যদিও গ্যালেনের এই ভুল মতবাদ অনুযায়ী দীর্ঘকাল ধরেই চিকিৎসা চলে আসছিল। গ্যালেনের এই মতটি চিকিৎসকদের কাছে মহাসত্যের মতো সুস্পষ্ট ছিল। উইলিয়াম হার্ভে এই মতবাদ খণ্ডন করে তার ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশ করলেও সেটি প্রতিষ্ঠিত হতে প্রায় দুইশো বছরের মত সময় লেগে যায়। গ্যালেনের সুপ্রতিষ্ঠিত তত্ত্বের বিরোধিতার জন্য উইলিয়াম হার্ভে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। হার্ভের আগে ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দে ইতিহাসবিদ মাইকেল সারভেদো গ্যালেনের অকাট্য তত্ত্বের ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। ১৬১৬ সালে সারভেদো প্রকাশ্যে গ্যালেনের মতবাদের বিরোধিতা করেন। সারভেদোর কাছে সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা ছিল না। ফলে এর ফলাফল হলো ভয়াবহ। গ্যালেনের মতবাদের অনুসারীরা নিষ্ঠুরভাবে সারভেদোকে পুড়িয়ে মেরে ফেলে।

ইতিহাসে দেখা যাচ্ছে, রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া সম্পর্কে ১৫০ খ্রিস্টাব্দের সময়কার চিকিৎসাবিজ্ঞানী গ্যালেনের মতামতের বিরোধী তত্ত্ব দাঁড় করান পনেরো শতকের উইলিয়াম হার্ভে। ফলে উইলিয়াম হার্ভেই আজকের আধুনিক রক্ত সঞ্চালন পদ্ধতির প্রথম আবিষ্কারক। এর আগে মাইকেল সারভেদোকে কোনো যুক্তিব্যাখ্যা ছাড়া গ্যালেনের বিরোধিতা করতে দেখা যায়। কিন্তু সর্বপ্রথম যুক্তিযুক্তভাবে গ্যালেনের বক্তব্যের বিরোধিতা করেন হার্ভে।

পাঠকদের জানা দরকার, এই ইতিহাসে খানিকটা ফাঁক রয়ে গেছে। উইলিয়াম হার্ভের ৩০০ বছর আগে ১৩ শতাব্দিতে ইবনুন নাফিস নামের একজন প্রতিভাবান মুসলিম ইউনানী চিকিৎসাবিজ্ঞানী প্রচণ্ড দৃঢ়তার সাথে গ্যালেনের একচ্ছত্র তত্ত্বের বিরোধিতা করেন।

বলাবাহুল্য, ইবনুন নাফিসের আগে সমস্ত চিকিৎসাবিজ্ঞানীই খুব দৃঢ়ভাবে গ্যালেনের বক্তব্য সমর্থন করেন। এমনকি বিখ্যাত ইউনানী চিকিৎসক ইবনে সিনা এই মতবাদকে সমর্থন করে তার ‘আল কানুন’ গ্রন্থে সম্পৃক্ত বিভিন্ন বিষয়ের ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ইবনুন নাফিস আল কানুন গ্রন্থের ব্যাখ্যাগ্রন্থ লিখতে গিয়ে গ্যালেনের মতবাদের ক্ষেত্রে ইবনে সিনার সঙ্গে একমত হননি; বরং নানাভাবে সাহসের সঙ্গে এই মতবাদের ভ্রান্তি প্রমাণ করেছেন।

দীর্ঘ সময় ধরে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা ইবনুন নাফিসের এই অভিনব ও একক আবিষ্কারের ব্যাপারে বিস্মৃত ছিল। হঠাৎ করেই ১৯২৪ সালে বার্লিনের একটি লাইব্রেরিতে ‘শরহু তাশরিহিল কানুন’ (আল কানুন ফিত তিব্ব এর ব্যাখ্যা গ্রন্থ) এর একটা পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়। এই ব্যাখ্যা গ্রন্থে ইবনুন নাফিস রক্ত সঞ্চালনের ব্যাপারে বিস্তারিত লিখেছিলেন। তিনি কয়েক জায়গায় বেশ শক্তভাবে ইবনে সিনা ও গ্যালেনের বিরোধিতা করেছেন। মিশরের চিকিৎসাবিজ্ঞানী মুহিউদ্দিন এই পাণ্ডুলিপির ওপর থিসিস করে বেশ বড়সড় একটা ধাক্কা দিয়েছেন আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানী সমাজকে।

ডক্টর মুহিউদ্দিন যখন এই থিসিস তৈরি করে বোর্ডের কাছে পেশ করে তখন ইবনুন নাফিসের সাথে সম্পৃক্ত করে এই ধরনের অভিনব দাবি দেখে তারা হতবুদ্ধি হয়ে যায়। ব্যাপারটা ঠিক তারা পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারে না।

সে সময় বিখ্যাত জার্মান প্রাচ্যবিদ মাইরহোফ কায়রোতে থাকতেন৷ শিক্ষকবোর্ড এই থিসিস সম্পর্কে তাঁর মতামত জানতে চায়। তিনি বেশ দৃঢ়ভাবেই ডক্টর মুহিউদ্দিনকে সমর্থন করেন। জার্মান প্রাচ্যবিদ ব্যাপারটা বিখ্যাত ইতিহাসবিদ জর্জ সার্টনকে জানিয়ে দেন। ফলে তিনি তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘তারিখুল ইলম’-এর শেষে এই বিষয়টাও যুক্ত করে দেন। ডক্টর মুহিউদ্দিন তার গুরুত্বপূর্ণ থিসিসের মাধ্যমে আধুনিক বিশ্বে নতুন করে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা এমন একজন আবিষ্কারককে স্বীকৃতি দেয়নি বলে তাদের বিরুদ্ধে নানা বিতর্ক তৈরি হতে থাকে। এই থিসিসের ফলে আধুনিক বিশ্ব নতুন ইবনুন নাফিসকে চিনতে পারে।

রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়াটির প্রথম আবিষ্কারক ইবনুন নাফিস, এটি একটি চূড়ান্ত সত্য। পনেরো শতকের ইতালিয়ান চিকিৎসাবিজ্ঞানী ‘আলবাজু’ ল্যাটিন ভাষায় ইবনুন নাফিসের ‘তাশরিহু শরহি কানুন’ গ্রন্থটি অনুবাদ করেন। আলবাজু প্রায় ৩০ ছরের মতো রুহায় ছিলেন। এবং বেশ ভালো আরবি শিখে ফেলেছিলেন। পরবর্তীতে আলবাজুর কাছ থেকে এই গ্রন্থের ‘রক্ত সঞ্চালনের প্রক্রিয়া’ নিয়ে আলোচনার অংশটুকু হারিয়ে যায়।

অন্যদিকে মাইকেল সারভেদো তখন ফ্রান্সের ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করতেন। আলবাজুর করা এই অনুবাদ একসময় তার হস্তগত হয়। এভাবে মাইকেল সারভেদো রক্ত সঞ্চালনের এই আবিষ্কার সম্পর্কে জানতে পারেন। ইতোমধ্যে সারভেদো বিশ্বাসগত কোনো এক কারণে ইউনিভার্সিটি থেকে বহিষ্কৃত হোন। পরবর্তীতে বিভিন্ন শহরে ঘুরে ঘুরেও স্থির হতে পারেননি; নানা জায়গা থেকে তাকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। শেষপর্যন্ত তাকে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হয়।

তার সমস্ত বই আগুনে পুড়িয়ে জ্বালিয়ে দেয় ক্ষুব্ধ মানুষেরা। ঘটনাক্রমে আলবাজুর করা অনুবাদটুকু অক্ষত থাকে। গবেষকরা মনে করেন, মূলত এই অনুবাদের মাধ্যমেই মাইকেল সারভেদো নিজের মত বলে প্রচার করতে থাকেন। এরপরই উইলিয়াম হার্ভে জানতে পারেন। এবং তার পক্ষে পূর্ণাঙ্গভাবে আবিষ্কার সম্ভব হয়। ডক্টর মুহিউদ্দিনের থিসিস গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে গবেষকদের কাছে৷ জার্মান প্রাচ্যবিদ মাইরহোফ ইবনুন নাফিসের বক্তব্য পড়ে বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন—“আমি যখন ইবনুন নাফিসের বক্তব্য পড়লাম তখন একধরনের দ্বিধা-সন্দেহে পড়ে গেলাম। কারণ হুবহু একই রকম কথা মাইকেল সারভেদোও বলেছেন। অথচ মাইকেল সারভেদো আদতে চিকিৎসাবিজ্ঞানী ছিলেন না। আবার ইবনুন নাফিস তার থেকে বেশ আগের মানুষ।”

কাজেই প্রথম আবিষ্কার যে ইবনুন নাফিসের হবে এত কোনো সন্দেহ নেই। আলদু মিলী বলেন—“ইবনুন নাফিস আর মাইকেল সারভেদোর বক্তব্য হুবহু এক। কাজেই এখান থেকেই স্পষ্ট বুঝা যায়, প্রথম চিন্তা ও আবিষ্কার ইবনুন নাফিসের; মাইকেল সারভেদো বা উইলিমায় হার্ভে প্রথম আবিষ্কারক নয়।

১২১০ খ্রিস্টাব্দে, ৬০৭ হিজরিতে সিরিয়ার দামেশক শহরে ইবনুন নাফিস জন্মগ্রহণ করেন। তার পুরোনাম, আবুল হাসান আলাউদ্দিন আলি ইবনে আবিল হাজাম। খুব অল্প বয়সেই কুরআন হিফজ করেন। বাইশ বছর বয়স পর্যন্ত ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয় অধ্যয়ন করে চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে মগ্ন হয়ে পড়েন ইবনুন নাফিস। মুসলিম সভ্যতার অন্যতম ইউনানী চিকিৎসাবিজ্ঞানী চক্ষুবিশেষজ্ঞ মুহাযযাবুদ্দিনের কাছে প্রাথমিক তালিম নেন। নুরুদ্দিন যিনকির প্রতিষ্ঠিত আননুরি হসপিটালেও তিনি চিকিৎসাশাস্ত্র চর্চা করেন। ইবনুন নাফিস ৬৩৩ হিজরিতে মিশরের কায়রো চলে আসেন। আন নাসিরি হসপিটালে চিকিৎসক হিসেবে নিযুক্ত হন।

পরবর্তীতে সুলতান কালাউনের প্রতিষ্ঠিত আল মানসুরি হসপিটালেও নিযুক্ত হন। একসময় এই হসপিটালে তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের প্রধান হয়ে উঠেন। তার মজলিসে প্রতিভাবান চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের পাশাপাশি শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও উপস্থিত থাকতেন। ইবনুন নাফিসের যোগ্যতা দেখে সুলতান বাইবার্স তাকে ব্যক্তিগত চিকিৎসক হিসেবে নিযুক্ত করেন। খুব অল্প সময়েই ইবনুন নাফিস সমস্ত মিশরের প্রধান চিকিৎসাবিজ্ঞানী হয়ে উঠেন। ইবনুন নাফিস ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি একইসঙ্গে চিকিৎসক, সাহিত্যিক, হাদিস বিশারদ ও ফিকহবিদ ছিলেন। হাদিস বিষয়ে তার মৌলিক গ্রন্থ রয়েছে। তিনি কায়রোর আল মাসরুরি মাদরাসায় ফিকহে শাফেয়ির দরস দিতেন।

ইবনুন নাফিস এনাটমি ও ফিজিওলজি কেন্দ্রিক বহু প্রাচীন ধারণার বিরোধিতা করেন। তিনি চিন্তার উদারতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন। যা তার কাছে ভুল মনে হত তিনি সেটা অকপটে বলে দিতেন। এক্ষেত্রে কোনো কুসংস্কার বা মানুষের বিরূপ প্রতিক্রিয়াকে তিনি ভয় করতেন না। মানবদেহের রক্ত সঞ্চালন পদ্ধতি, শ্বাসনালী, হৃৎপিণ্ড, শরীরে শিরা উপশিরা, বায়ু ও রক্তের প্রবাহ সম্পর্কে নানা ধরনের নতুন তথ্য তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রে যুক্ত করেন। চোখ সম্পর্কেও তিনি বিভিন্ন নতুন নতুন বিষয় মানবজাতিকে অবহিত করেন৷

তিনি বলতেন—“চোখ হলো একটা যন্ত্রবিশেষ। চোখের নিজস্ব শক্তি দিয়ে দেখার ক্ষমতা নেই। যদি নিজের ক্ষমতা থাকত তাহলে দুই চোখ দিয়ে আমরা প্রতিটি জিনিসকে দুটি করে দেখতে পেতাম। কিন্তু বাস্তবে তো তেমন হয় না; বরং চোখের সঙ্গে মস্তিষ্কের যোগাযোগ আছে।”

অতিমাত্রার লবণ কেন ক্ষতিকর বা এর মন্দ প্রভাব মানবদেহে ছড়িয়ে পড়ে এই সম্পর্কেও সতর্ক করেন ইবনুন নাফিস। লবণের সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম বেশকিছু বিষয় তিনি উল্লেখ করেন তার বিভিন্ন গ্রন্থে। অতিমাত্রার লবণ ব্লাড প্রেসারের কারণ হতে পারে, চিকিৎসাবিজ্ঞানে এটি ইবনুন নাফিসই সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেছিলেন। কোনো ওষুধ প্রয়োগ না করে খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে চিকিৎসা করার ব্যাপারে ইবনুন নাফিস বিশেষ আগ্রহী ছিলেন এবং কিছু ক্ষেত্রে এর সফল প্রয়োগ করতে তিনি সক্ষমও হয়েছিলেন।

লেখালেখির ক্ষেত্রেও ইবনুন নাফিস উদ্ধৃতির চেয়ে নিজের বক্তব্য, চিন্তাকে উপস্থাপনের প্রতি গুরুত্ব দিতেন। তিনি ‘আর রিসালাতুল কামিল ফি সিরাতিন নাবি’ নামে একটা কাল্পনিক উপন্যাস লিখেছেন। এটিকে আরবি সাহিত্যের প্রথম দিকের মৌলিক উপন্যাস হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তার নিজের বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক মতবাদ প্রকাশ করার জন্যই তিনি এই গ্রন্থটি রচনা করেন।

ইবনুন নাফিস শরীরবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান বিষয়ে তার ব্যক্তিগত বিভিন্ন মতাদর্শ এই বইয়ের মাধ্যমে তুলে ধরেন। এই বইটি সায়েন্স ফিকশনের অন্যতম একটি উদাহরণ। তিনিই মুসলিমদের মধ্যে সর্বপ্রথম সায়েন্স ফিকশন রচনা করেন। এছাড়া ইবনুন নাফিসের প্রচুর লিখিত গ্রন্থ আছে চিকিৎসা বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে। যেগুলো এখনও পর্যন্ত আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত।

ইবনুন নাফিস রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়ার প্রথম আবিষ্কারক ছিলেন। এর বাইরেও নানা ধরনের শক্তিশালী উদ্ভাবন তার রয়েছে। এরপরও তার কাজ অতটা বিস্তৃতভাবে ছড়ায়নি কেন? ইতিহাসবিদদের কাছে এই প্রশ্নটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসবিদরা বিজ্ঞানকে আলাদা করে দেখতে রাজি না। তারা মনে করেন, বিজ্ঞানের জন্য রাজনীতি এবং অর্থনীতি দুটোই খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কেবল বিজ্ঞানের আবিষ্কার দিয়েই পৃথিবী চলতে পারে না। বিজ্ঞানের বাস্তবায়নের জন্য দরকার রাষ্ট্রীয় সহায়তা ও সমর্থন এবং একইসঙ্গে বিপুল অর্থ।

ইবনুন নাফিস যেই সময়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনের জন্য নিজের সবটুকু প্রতিভা ব্যয় করেছিলেন তখনকার পৃথিবী ছিল খুব দুর্যোগপূর্ণ। নানা ধরনের অনৈতিকতা ভোগ বিলাসসহ সমস্ত রাষ্ট্র নীতিহীন নগরে পরিণত হয়েছিল। মানুষের কাছে ভোগ বিলাসই প্রধান হয়ে উঠেছিল। গৃহযুদ্ধসহ বিভিন্ন রকমের পারিবারিক সামাজিক কলহে মানুষ ব্যস্ত ছিল। ফলে ইবনুন নাফিস ও তার বিপুল কর্ম এত সব অনৈতিকতার ভিড়ে আড়ালেই পড়ে গেছে। রাষ্ট্রপক্ষ বা সমাজপক্ষ কোনো বৈজ্ঞানিক সফলতার প্রতি দৃষ্টি ফেরাবার সুযোগ পায়নি।

সাধকের মৃত্যু ১২৮৮ খ্রিস্টাব্দে ইবনুন নাফিস বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। চিকিৎসকরা কোনোভাবে রোগ সারাতে পারছিলেন না। শেষে প্রতিষেধক হিসেবে মদ্যপানের চেষ্টা করা হলেও তিনি কোনোভাবেই মদ্যপান করেননি। তিনি বলেছিলেন—“আমার পেটে সামান্য পরিমাণ মদ নিয়ে আমি কি করে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাত করব?” এই বাক্য বলে তিনি মদপান থেকে বিরত ছিলেন। ইবনুন নাফিস অবিবাহিত ছিলেন। তার মৃত্যুর আগে তিনি বাড়ি, লাইব্রেরিসহ সমস্ত সম্পত্তি আল মানসুরি হাসপাতালে দান করে যান।

তথ্যসূত্র :
১. উইনূল আম্বা ফি তবকাতিল আতিব্বা- ইবনে আবি উছায়বিয়া (সিসিআরইউএম, ইন্ডিয়া)
২. কিসসাতুল উলুমিত তিব্বিয়্যাহ ফিল হাজারাতিল ইসলামিয়্যাহ, রাগেব সারজানি রচিত।
৩. দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত প্রবন্ধ

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ১৫ ই এপ্রিল, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:৫২

রাজীব নুর বলেছেন: ভালো পোষ্ট।

২| ১৫ ই এপ্রিল, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৩৩

মাহিরাহি বলেছেন: আপনার লেখাটা প্রাসঙ্গিক।

al-Nafïs constructed an outbreak map and both men concluded that Damascus was the origin of the outbreak. This method of locating an outbreak origin was used by John Snow 600 years later, when he constructed his own outbreak map


John Snow (15 March 1813 – 16 June 1858[1]) was an English physician and a leader in the development of anaesthesia and medical hygiene. He is considered one of the founders of modern epidemiology, in part because of his work in tracing the source of a cholera outbreak in Soho, London, in 1854,

৩| ১৫ ই এপ্রিল, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৪৯

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: অলস, আত্মবিস্মৃত মুসলমান সম্প্রদায় না আছে গবেষনায়, না আছে নিজেদেরে ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে।

ইউরোপিয়ানরা আরবী থেকে অনুবাদ করে তারে গবেষনা করে তাই দাবী করে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করছে -এমন বহু ইতিহাস আছে। আর সমসাময়িকতায় অতীতকে সু সামঞ্জস্য করার চেষ্টা্ও নাই।

জেগে উঠুক মুসলিম জাতি। জ্ঞানে, ধ্যানে, গবেষনায় মানবকল্যানে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.