নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সব বিষয়ে প্রজা হওয়ার চেয়ে, কোন বিষয়ে রাজা হওয়া অনেক ভালো। - রুবেল পারভেজ

Rubel Parvez

রুবেল পারভেজ, কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, সমালোচক ও নাট্যকার। শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ এম, এস, সি, ফিসারিজ।

Rubel Parvez › বিস্তারিত পোস্টঃ

টি. এস. এলিয়টের কাব্যে মিথের ব্যবহার

০৪ ঠা আগস্ট, ২০১৫ রাত ৮:১১

পাশ্চাত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আধুনিক কবি টি. এস. এলিয়ট (১৮৮৮-১৯৩৫)। এলিয়ট তাঁর জগদ্বিখ্যাত কাব্য " The Waste Land" এ ( পোড়োজমি, ১৯২২) প্রথম বিশ্ব যুদ্ধোত্তর পৃথিবীর অর্থনৈতিক মন্দা, বেকারত্ব, নৈরাজ্য ও নৈতিক অবক্ষয় প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার কারণে এবং পরোক্ষভাবে যুদ্ধ শেষে আশাভঙ্গজনিত চিত্তবিক্ষোভের প্রচণ্ড অভিঘাতে পাশ্চাত্যের সমাজ-মানসে যে সুগভীর আলোড়ন ও বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিল; অন্যপক্ষে মানুষের অতি যত্নে গড়া মানবিকতা ও দার্শনিক আদর্শবাদকে জলাঞ্জলি দিয়ে, প্রেম-সৌন্দর্য-নৈতিকতাকে মেকি সাব্যস্ত করে, তদস্থলে ঐহিক বস্তুগত সমৃদ্ধি ও ভোগ বিলাসের জয়জয়কার যে ভয়ঙ্কর চিত্তসংকটের জন্ম দিয়েছিল, তারই বেদনা গভীর ও রক্তাক্ত আলেখ্য হলো এলিয়টের এই কাব্য।

এলিয়ট এই কাব্যকাহিনীকে গ্রীক পুরাণের পুরাণের ' টিরেসিয়াস' নামক মিথচিত্রের জবানিতে প্রকাশ করেছেন। টিরেসিয়াস গ্রীক পুরাণের দীর্ঘজীবী অন্ধ ভবিষ্যৎ-বক্তা। অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ তার অধিগত। ভারতীয় পুরাণের 'নারদ' চরিত্রের সাথে তার তুলনা করা যায়। সমস্ত কাহিনী ঘটনা ও অনুভব অনুষঙ্গের সঙ্গে টিরেসিয়াস জড়িত। আসলে টিরেসিয়াস বিশ শতকের ইউরোপের যে বন্ধ্যা অনুর্বর সর্বনাশা রূপ দেখেছেন, দেখেছেন প্রেমের কলুষতা ও বিকার, ইন্দ্রিয়ের ভোগ, অহংকারমত্ত মানুষের ঔদ্ধত্য, বিশ্ব নিয়মের লঙ্ঘন, মানবিক প্রজ্ঞার অভাবে সুখ ও আনন্দের পরিবর্তে মানুষের বিষণ্ণ পরিণাম- এই কাব্য তারই চিত্ররূপ। বস্তুত মানবীয় জীবনের উদার ও মহৎ মূল্যবোধসমূহ যা মানুষকে প্রেম, প্রশান্তি, আত্মতৃপ্তি এবং জীবনের অনিত্যতা সম্পর্কে আগ্রহী ও সচেতন করে তোলে। যা মানুষকে প্রত্যক্ষ গোচর অভিজ্ঞতার অতিরিক্ত অনির্বচনীয় আধ্যাত্মবোধে উপনীত করে, সে প্রজ্ঞাই মানুষকে বিশ্ব শক্তির সাথে একাত্ম হতে প্রেরণা জোগায়। যখন এই প্রজ্ঞা মানুষ হারায় তার ঔদ্ধত্যে, ক্ষমতার অহংকারে, ইন্দ্রিয় ভোগে, তখনই বিষণ্ণ ধ্বংস মানুষকে মৃত্যুর সীমানায় নিয়ে যায়,তখন বেঁচে থাকাই হয়ে ওঠে মৃত্যুর চেয়েও ভয়ঙ্কর।

"পোড়ো জমিতে" টিরেসিয়াস দেখতে পেয়েছেন, টাইপিস্ট রমণী ও অফিস ফেরত পৌঢ় ক্লার্কের প্রেমহীন উদাসীন সঙ্গমের দৃশ্য। এ কালের যৌনজীবন যে আনন্দ দেয় না, প্রশান্তি আনে না, ঐতিকতা সর্বস্ব বন্ধ্যা বিলাসিতাকেই শুধু প্রশ্রয় দেয়, এই ঘটনা তাই ব্যঞ্জিত করে।

গ্রীক নাট্যকার সফোক্লিক এর ' ঈদিপাস' নাটকে বর্ণিত থিবসে ঈদিপাসের রাজত্বের মতো যুদ্ধোত্তর ইউরোপও আজ মহামারি, মুদ্রাস্ফীতি, মৃত্যু, শুষ্কতা ও বন্ধ্যা জীবনের প্রতীক। নারী গর্ভধারনে ব্যর্থ, বৃষ্টি নেই, তাই শস্য হয় না। অন্ধকার পাতালের দেবতা তার যন্ত্রণার হাহাকার ও বিলাপ নিয়ে চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সমস্ত ইউরোপ আজ নৈতিকতা ও মূল্যবোধহীন ঊষর মরুভূমি, কোথাও যেনো প্রাণের স্পর্শ নেই। এই ইউরোপই কবির ভাষায় - 'The Waste Land'.

এলিয়ট গ্রীক পুরাণের ত্রিকালজ্ঞ মিথচরিত্র টিরেসিয়াসের মাধ্যমে যুদ্ধ বিধ্বস্ত হতাশাগ্রস্ত ইউরোপের সর্বাত্মক বন্ধ্যাত্বের জীবন্ত চিত্র চিত্রায়ন করেছেন তাঁর কাব্যে। এই বন্ধ্যাত্ব ও মরুভূমির ধূসরতা যে আত্মিক ও নৈতিক, এই কাব্য তারই সারাৎসার। মূলত ‘The Waste Land’ এ এলিয়ট বর্তমান যুগযন্ত্রণার থেকে মুক্তির যে উপায় লক্ষ্য করেছেন মানুষের হৃদয়ে সংযম, দয়া ও দানের মধ্যে, বিশ্ব নিয়মের সাথে যুক্ত হয়ে তা উপনিষদে বর্ণিত ‘ দত্ত দয়ধ্বম দাম্যত শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ’ উক্তির অনুরণন।সমালোচকগণ স্বীকার করেছেন- ‘ টিরোসিয়াস প্রতীক ব্যতীত অন্য কোন মিথের ব্যবহারে এই সিদ্ধি অর্জন সম্ভব ছিল না।’

মিথ প্রতীকের এই অঘটন ঘটন পটুতা ও কাব্যে মিথ ব্যবহারের সাফল্যের কারণ হিসেবে সমালোচক বার্ণিক রায় বলেছেনঃ ” মিথের মধ্যে যুগের ভাষার সমষ্টিগত অবচেতন কাজ করে, কডওয়েল অনুকরণ করে নাম দিয়েছেন ‘সমষ্টিগত অনুভূতি’ বা কালেকটিভ ইমোশন। বিশ্ব জগতের বস্তুর ছবি ছাপ বা চিত্রকল্প আর্কিটাইপের মত, আদি ও আদিম মানুষের রক্তের মত আলো ছায়া তৈরি করে। ঐ ছবিগুলোর মধ্যে অথবা ছবিগুলোই বাসনার অনুরাগে শক্তি হয়ে কাজ করে মানুষের অবচেতনে! ঐ ছবিগুলো ব্যক্তি মানুষের নয়, সমষ্টিগত মানুষের বলেই একটি দেশের ও জাতির।”
উদ্ধৃতিটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, কবিরা ও সমষ্টিগত মানুষের প্রতিনিধি, সমাজের মানুষ হিসেবে দেশের ও জাতির গোষ্ঠীভাবনার অংশীদার। পুরাণ তাদের সমকালীন বিশেষ ভাব প্রকাশের মাধ্যম হয়ে ওঠে মাত্র।

প্রসঙ্গত স্মরণীয় যে, আধুনিক বাংলা কাব্যে মিথ বা পুরাণ প্রসঙ্গ ব্যবহারের প্রথম কৃতিত্ব মাইকেল মাইকেল মধুসূদন দত্তের, যিনি প্রথম পাশ্চাত্য কাব্য বীক্ষণে গ্রীক ও পাশ্চাত্য পুরাণের নানা প্রসঙ্গ উদ্ধারের সাথে ভারতীয় পুরাণের অসংখ্য চরিত্র ও ঘটনার সার্থক কাব্যরূপায়ণ ঘটিয়েছেন। তবে আধুনিক কাব্যে এর ব্যবহার বহুমাত্রিক তাৎপর্যে অনুস্যূত।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.