নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নেশা সাহিত্য, পেশা শিক্ষকতা।

সুব্রত দত্ত

পরিশ্রমকে সঙ্গী করে কত মানুষ উর্ধ্বে গেলো, আকাশের ঐ তারার দলে/ চিরদিনই অলস আমি, আছি পড়ে অনন্তকাল এই ধরনীর গাছের তলে।

সুব্রত দত্ত › বিস্তারিত পোস্টঃ

আমার কয়েকটি ছোটগল্প [নিতান্তই লেখার প্রয়াস]

২৫ শে নভেম্বর, ২০১৬ সকাল ১১:৩১

অপেক্ষা

১.
আচমকা তার একটা চিঠি এসে গেলো আমার কাছে। চিঠি আসবে ভাবিনি কখনো। যেখানে সকল যোগাযোগ সে-ই বন্ধ করলো, সেখানে তার চিঠি দেয়াটা একদম স্বাভাবিক না। তবে চিঠি পেয়ে মোটেও প্রফুল্ল হইনি। সেটা আমার স্বভাবে পড়ে না। আমি সাধারণ একজন মানুষ। সাথে-পাছে কেউ নেই। ছোট্ট বাড়িটা আর আমি। সারাদিন কাটে বাগানে। বাগানটাই আমার জীবনের রশদ যোগায়। রশদ বলতে শুধু বস্তু-ই না। বেঁচে থাকার প্রেরণাও এই বাগান। অনেকে ভাবে তা কিভাবে! সে রহস্যটাকে রহস্য করে রেখে দিতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। আসলে সেটা রহস্যের কিছু না। সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন একজন মানুষই তা বুঝতে পারবেন যদি একটু খেয়াল করেন। অধিকাংশ মানুষেরই এই এক সীমাবদ্ধতা, তারা খুব কমই বর্তমানে বাঁচেন। কেউ সারাটাদিন ঘুরেন ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে আর কেউ পড়ে থাকেন স্মৃতিকাতর হয়ে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এধরনের মানুষদের পছন্দ করি না। কারণ তারা এমন কিছু সুন্দর ও অভূতপূর্ব সৌন্দর্য দেখতে পান না যা শুধু বর্তমানেই দেখা যায়। আর তারা এটুকুও বুঝে উঠতে পারেন না যে কিভাবে একজন মানুষ তার জীবনটা একটা বাগান নিয়েই কাটিয়ে দিতে পারে। এজন্য আমার বন্ধুও কম। পৃথিবীতে বেশির ভাগ মানুষই দিনের বেশির ভাগ সময় অতীত আর ভবিষ্য নিয়ে থাকেন। আমার বন্ধুরা তেমন না। আর এখন আমার হাতে তাদেরই একজনের চিঠি। চিঠিতে কি লেখা থাকতে পারে তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা করার কিছু নেই। এতদিন যে কথা সে সামনাসামনি বলেছে অথবা ফোন করে বলেছে তা-ই হয়তো আজ তার হাতের সুন্দর অক্ষরে লিখে পাঠিয়েছে। তার কথাগুলো বিরক্তকর লাগলেও কেন যে তা দীর্ঘদিন শুনেছিলাম আজও তার কারণ অজ্ঞাত। সম্ভবত তার সুন্দর মুখখানা আর মিষ্টি কন্ঠস্বরই তার কারণ ছিল। যদিও নারী জাতিটার প্রতি আমি তীব্রভাবে অনুৎসাহিত তবুও নাতাশাকে আমার ভালোই লাগতো। লাগতো কি লাগে। এ ব্যাপারে নিজের প্রতি কঠোর হলেও নাতাশা খুবই সমস্যা করতো। ওকে বোঝানোটা ছিল খুবই কঠিন এক কাজ। তবু শেষ পর্যন্ত তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বিদায় দিতে সক্ষম হয়েছিলাম। তারপর থেকে সে আর যোগাযোগ করে নি। অনেকগুলো বছর। ঠিক কত বছর বলতে পারবো না। ক্যালেন্ডারের প্রয়োজন পড়ে না আমার। দিন, মাস, তারিখের হিসাবও রাখি না। কিন্তু এ মুর্হূতে বুঝতে পারছি না এতদিন পর কি দরকারে সে চিঠি দিলো! আমি যা ভাবছি, তাতো নাও হতে পারে। কারণ একটা মানুষ তার কামনা-বাসনা নিয়ে বহুদিন থাকতে পারে না। সেগুলো পূরণ করতে ব্যর্থ হলে সে বিকল্পের আশ্রয় নেয় নতুবা কামনা-বাসনাগুলোকেই বদলে নেয়। নাতাশা বোধ করি বিকল্প পথই বেছে নিয়েছে। ও সুন্দরী আর ওকে বিয়ে করার পাত্রের অভাব এই দুনিয়ায় হতেই পারে না। তবে যদি বিয়ে করেই থাকে তাহলে আজ হঠাৎ আমাকে চিঠি কেন? কি এমন দরকার! না চিঠিটা পড়া খুব দরকারি হয়ে উঠেছে। কিন্তু এত ব্যাকুলতা তো আমার ধর্ম না। না এখন চিঠিটা পড়বো না। খাবারটা তৈরি করে নেই। দুপুরের খাওয়া শেষে একটু ঘুমোবো। তারপর পড়ন্ত বিকেলে দোতলার বারান্দায় বসে সবুজ পাতায় ঘেরা তরুণ গাছগুলোর উপর পড়া মিষ্টি সোনালি আলোতে চিঠিটা পড়বো। অজানা হাসিতে হয়তো মুখটা ভরে যাবে। নাতাশার করুণ অসহায় মুখটা মনে পড়বে। আমার হাতটা ধরে তার অঝোরে কান্নাটা হয়তো আজও ঠাট্টার মতোই লাগবে।
২.
বিকেলের সোনালি রোদ যে কখন কালো হয়ে অন্ধকারে মিশে গেছে তা খেয়ালই করি নি। বেশ রাত হয়েছে বুঝতে পারছি। সেই বিকেল থেকে একটা চিঠি নিয়ে এতোটা সময় কাটিয়ে দিলাম! আসলে চিঠিটাই এমন। বেশ বুঝতে পারছি চিঠিটা আমাকে আলোড়িত করেছে। চিঠিটার এক একটা বাক্য, শব্দ আমি অসংখ্য বার পড়েছি। ওগুলো তীরের মতো আমার বুকে এসে বিধেঁছে। চোখদুটোও ভিজে উঠেছে। আজ বহুদিন পর চোখে জল আসলো। শেষদিন সামিরা যখন চলে যাচ্ছিল তখন কেঁদেছিলাম। তা বহু বছর আগের কথা। এখন কান্নাটা সামিরাকে নিয়ে নয়, নাতাশাকে নিয়ে। আর কিছুদিন পরই ও মারা যাবে। মৃত্যু আমার কাছে বড় কিছু নয়। অনেক মৃত্যুকে দেখে দেখে এতটা দিন পাড় করেছি। আর মৃত্যু আমার কাছে নবজন্ম। সে জন্মে অন্ততকালের বেঁচে থাকা আছে। তবে এসব মনগড়া কথা। প্রতিটি মৃত্যুই মানুষকে বিচলিত করে। নাতাশার মৃত্যু নিয়ে আমি বিচলিত হতাম না কিন্তু হতে হলো। মৃত্যু আসবে তা সাধারণ কথা কিন্তু দিন-ক্ষণ বলে যদি মৃত্যু আসে আর তার অপেক্ষায় যদি জীবনের সুন্দরতম মুর্হূতগুলোকে কাটাতে হয় তবে তা খুবই বেদনাদায়ক। নাতাশার ক্যান্সার ধরা পড়েছে, তা-ও প্রায় শেষদিকে। চিকিৎসার আর সময় নেই। ওর লেখা কথাগুলো বারবার আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। ও লিখেছে, “আমার মৃত্যু সন্নিকটে। ক্যান্সার শেষপর্যায়ে। এখন শুধু মৃত্যুর অপেক্ষা। কাল অথবা পরশু, এমনকি আজ, এখনই মৃত্যু এসে আমাকে আলিঙ্গন করতে পারে। এতদিন অপেক্ষা করেছি তোমার, এখন করি মৃত্যুর। তবে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা পীড়া দেয় না, কারণ সে আসবে নিশ্চিত।” মৃত্যুকে আর আমাকে জড়িয়ে ও তীব্র এক আঘাত করলো আমাকে। অন্যসময় হলে ঠাট্টা করে উড়িয়ে দিতাম কিন্তু আজ তা অসম্ভব। মৃত্যুর আগেই আমাকে পৌঁছাতে হবে নাতাশার কাছে। ওর মৃত্যুর বার্তার মতো আরেকটা কথা আমাকে বারবার আঘাত করছে। নাতাশা বিয়ে করে নি। আপন লোক বলতে তেমন কেউ নেই। ওর মৃত্যর পর আমারই মতো দেখতে ওর বাচ্চা ছেলেটার দেখাশুনা কে করবে? যে অতীতকে আমি অনেকদিন আগে আমার স্মৃতি থেকে মুছে দিয়েছিলাম সে অতীত তার অন্ধকারের বুক থেকে এনে দিয়েছে একটি উজ্জ্বল স্মৃতিচিহ্ন। দিনটার কথা আজও মনে পড়ে। সারাটাদিন টিপটাপ বৃষ্টির পর সারারাত ঝড়ের তা-ব হয়েছিল। সব বন্ধুরা চলে যাওয়ার পরও নাতাশা থেকে গেলো। আর আমি নিশ্চিত সে রাতে নাতাশাই আমাকে বারবার আকর্ষণ করছিল। তবে শুধু ওকে দায় দিয়ে আমি মুক্তি নিবো না। ঝড়ের রাতে বিদ্যু চমকানোর আলোতে অন্ধকার রুমে যতবার নাতাশার মুখটা দেখেছিলাম ততবার শুধু সামিরাকেই দেখেছি। আমার বহুদিনের দমিত বাসনা পূরণের সুযোগটা আমি হাত ছাড়া করিনি। তখন পুরোটা সময় আমার মনে হয়েছে আমার বাহুবন্ধনে যে সে আমারই সামিরা। ভুল আমার ভেঙে ছিল তবে অনেক পরে, ঝড়ের তা-ব থেমে, ভোরের সূর্যও এসেছিল। নাতাশা স্বাভাবিকই ছিল। আমি ছিলাম নিশ্চুপ। তারপর অনেকদিন লেগেছিল ওকে বিদায় দিতে। বিদায় করতে সক্ষম হয়ে ভেবেছিলাম অতীতকেও বিদায় করলাম। কিন্তু অতীত কখনো বিদায় নেয় না। যদিও অতীত চলে গেছে বলে অনেক সময় আমরা সুখ অথবা দুঃখ পাই, আসলে অতীত কখনোই চলে যায় না। আমাদের বর্তমান তো অতীতের উপরই ভর করে চলে। যা হোক, অতীত-বর্তমানকে নিয়ে ভাবার সময় এখন নেই। আমাকে রাতেই রওনা দিতে হবে শহরের দিকে। নাতাশার শেষ ইচ্ছা আমি পূরণ করবো। আর ওর বাচ্চার দায়িত্ব নিতেও আমি বাধ্য। আমার এই এতদিনের একাকী জীবনের অধ্যায়টা আমাকে এখানেই শেষ করতে হবে। জানি সিদ্ধান্তটা খুব দ্রুতই নিয়ে নিলাম, কারণ এছাড়া আর কিছু করার নেই। যে আশায় জীবনের এতগুলো বছর এই রকম জীবন কাটিয়েছি, সে আশা পূরণ হওয়ার নয়। আমার অপেক্ষাটা বোধ হয় খুব বেশিই হয়ে গেছে। তা হোক, এখন আমাকে প্রস্তুত হতে হবে। আমার র্দীঘদিনের লালিত্যে গড়া এই ভুবনকে বিদায় দিয়ে যেতে হবে শহরে, নাতাশার কাছে। তবে তার আগে আমাকেও একটা চিঠি লিখতে হবে। বড় না, সামান্য কয়েকটা বাক্য। সামিরাকে জানাতে হবে ওর জন্য গড়া আমার রাজ্যটাকে আমি পরিত্যাগ করে শহরে যাচ্ছি। রাজ্যর সাথে সাথে আমার অপেক্ষাকেও আমি ত্যাগ করলাম। আমার কাছে সে আর কাম্য কিছু না। নাতাশার গল্পটাও হয়তো লিখে ফেলতে পারি। না, তা লিখবো না। সামিরা আমার এমন কেউ না যাকে জীবনের পুরো গল্পটাই বলতে হবে।

আগস্ট ৯, ২০১২

ত্রয়ী

বেশ চলছে জীবন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্নাস পড়ছি। ঝামেলাহীন জীবন। একটি প্রেম ও একটি টিউশনি। মাস শেষে পাঁচ হাজার টাকা। সপ্তাহ শেষে একটি দিন ডেটিং।
বাসস্ট্যান্ডের পাশে বয়ে যাওয়া মৃত নদী। অল্প পানি। ফ্যাক্টরির বর্জ্য পদার্থে ভর্তি দূষিত কালো পানি। তার উপর তীর ঘেঁষে বস্তি। বসতি থেকে বস্তি। বাঁশের ঘর। ভাঙাচোরা। একটি ঘর। সাত জন মানুষ। পাঁচ জনই শিশু।
রাস্তার দু’ধারে বিল্ডিং। উঁচু উঁচু সারিবদ্ধ বিল্ডিং। ফ্লাটের পর ফ্লাট। অল্প মানুষ। শান্ত, ছিমছাম। এক পাশে বাগান। এক পাশে লেক। সায়লার বাড়ি।
কাজে আমি ফাঁকিবাজ না। নিয়মিত টিউশনিতে যাই। ক্লাসও করি। ফলাফল বেশ ভালো। ডিপার্টমেন্টে মোটামুটি জনপ্রিয়। দেলোয়ার হোসেন স্যারের প্রিয় ছাত্র। স্যার আগামি তিন বছরের জন্য সভাপতি। আমার পড়াশুনা শেষ করতে লাগবে দু’বছর।
সামনে নির্বাচন। নেতা-কর্মীর রাজপথ থেকে অলিতে-গলিতে আনাগোনো। নির্বাচনী প্রচারণা। প্রচারণা থেকে প্রতারণা। বস্তিতে আনন্দ। মিটিং-মিছিলে গেলেই একশো। ছেলে-বুড়ো, যুবক-শিশু সবার আয় রোজগার। দিন শেষে গরুর গোস্তের ঘ্রাণ।
দু’দিন পর থারটি ফাস্ট নাইট। ফ্লাটে ফ্লাটে আলোর সমারোহ। নানা আয়োজন। সায়লার জল্পনা-কল্পনা। এবার নাইটটা সে আমার সাথে কাটাবে। কৌশলী মেয়ে। সিটিং আর ফিটিং-টা বাকি।
যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি চাই। নাস্তিকদের বিচার চাই। জামায়েত ইসলাম নিষিদ্ধ কর। ফ্যাসীবাদ রুখে দাঁড়াও।
হরতাল। অবরোধ। ভাঙচুর। লুটপাট। অগ্নিসংযোগ। গ্রেফতার। সংঘর্ষ। ১৪৪ ধারা।
ডিপার্টমেন্ট বন্ধ। দেলোয়ার হোসেন গ্রেফতার। সভাপতিত্ব বাতিল। বদ্জাত কাদের রহমান স্ব-নির্বাচিত সভাপতি। ক্যাম্পাসে আন্দোলন। রিলেশন স্ট্যাটাস সিঙ্গেল।
বস্তি উচ্ছেদ।
ফ্লাটে ফ্লাটে আলোকসজ্জা। নববর্ষ উদ্যাপন। স্যাম্পেন আর উইস্কি। আনন্দ আর ফূর্তি।

মার্চ ১৫, ২০১৩

জীবন

একটা গল্প ঠিক কীভাবে শুরু হয় আর কীভাবেই বা শেষ হয় তার খবরটা হয়তো সাহিত্য-সমালোচকের নখদর্পনে। তত্ত্ব দিয়ে তারা বেশ একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে ফেলেন কিন্তু জীবনের গল্প কেবা বোঝে খুব করে। অন্তত ব্যস্ত নগরীর এই সব মানুষেরা - যাদের জীবনগতি নিয়ত ঘুরতে থাকে পুঁজির কলে, তারা বোঝে না জীবনের গল্পটা। তাদের দোষ নেই তাতে, এতো বুঝে কি বা হয়!! মানুষ যত নিজেকে জানে ততোই সে বেঁচে থাকার প্রেরণা হারায়। ধর্ম তাই মানুষকে বেড়া দিয়ে আটকে রাখে।
আজকের বিকেলের গল্পটাও তাই আমাদের জানা নেই। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। মতিঝিলের ব্যস্ত পথটায় কেবল মানুষের সমারোহ। অফিস শেষে বাড়ি ফেরা। পাখিদের নীড়ে ফেরা মতো সুন্দর এ দৃশ্য নয়। কারণ মানুষের বাসে উঠতে হয়, পাখিরা নিজের পাখাতেই উড়ে চলে।
অনেক মানুষ। কেউ যাবে মিরপুর, কেউবা উত্তরা। কেউ আরো সুদূরে গাজীপুর পেরিয়ে। বাস কম। বিকেলের এ সময়টায় বাস যেন কমে যায়। আসলে তা নয়। মানুষের আধিক্য কেবল এমন সময় উপলব্ধ হয়।
দাঁড়িয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ ধরে। বাস আসে একটার পর একটা। উঠতে পারি না। যাত্রীরা ঝুলছে বাসের গেটের কাছে। মানুষ ওঠার জায়গাই নেই। আর আমি তো হাল্কা-পাতলা মানুষ। গায়ের জোরে দুটো মানুষকে ধাক্কাও দিতে পারি না। তাছাড়া আমার চৈতন্যটাও শালার বেকুবের বাচ্চা। মানুষের তাড়াহুড়ো দেখে মনে হয় আমার আগে তাদের বাসে ওঠাটা বেশি জরুরি। আমি না উঠে জায়গা করে দেই। এভাবে প্রতিদিন বাসে ওঠার জন্য নষ্ট হয় ঘণ্টাখানেক। তবু বেশ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি এর সাথে। যাদের বেঁচে থাকাটাই প্রধান লক্ষ্য তাদের এতে সন্তুষ্ট না হয়ে চলে না।
যা হোক একটা প্রায় খালি বাস পেয়ে গেলাম মতিঝিলের মোড়েই। দৌঁড়ে উঠে পড়লাম বাসে। পিছনের দিকে একটা সিটও পেয়ে গেলাম। এমন সৌভাগ্য মাঝেমাঝে ঘটে। তখন খুব করে স্রষ্টাকে ধন্যবাদ জানাই। হায় কি দিনই না আসলো। অনেকগুলো মানুষকে বাসে উঠতে না দিয়ে নিজে উঠতে পারলাম আর বাসে দু’চারজনকে দাঁড় করিয়ে রেখে বেশ আরাম করে বসলাম। তার জন্য আবার স্রষ্টাকে ধন্যবাদও দেই আর তিনিও বেশ সন্তুষ্ট হয়ে বর দেন!!
তবে বাড়তি ভাড়া আদায়ের জন্য বাসচালকেরাও ফন্দি করলো। সিটিং সার্ভিস বলে বাসে একজন যাত্রীও দাঁড় করিয়ে নিলো না এবং সবার কাছ থেকে বাড়তি দশ টাকা করে নিলো। এদেশের নিয়মের সাথে এর কোনো বৈপরীত্য নেই। এদেশের অধিকাংশ মানুষ নিজে বাসে উঠতে পারলেই হলো আর নিজে আরামে বসে যেতে পারলেই হলো- অন্য জনের জন্য তার কোনো মমতা নেই। তাই দশ টাকা বেশি দিতে কারোই বাঁধলো না। আমি চুপ করে দশ টাকা বেশি দিলাম। এবং চুপটি মেরে বসে রইলাম বাসে। সূর্য ততক্ষণে অস্ত গেছে। রাজপথের নিয়ন আলোতে ঝকঝকে করে উঠলো সমস্ত পথ। শপিংমলের আলোর চমৎকারিত্ব আর গাড়ির গায়ে গায়ে লাগানো লাল-সবুজ-হলুদ আলোর মুচকি হাসি।
গাড়ি এগিয়ে চললো ধীরলয়ে। ব্যস্ত পথ। মোড়ে মোড়ে যানজট। সিটিং সার্ভিস বলে যাত্রী কম। সবাইকে দেখে নিলাম এক পলকে কিন্তু আমার সামনের সিটের বা পাশে চোখটা বারবার পড়ছিল। সত্যি মেয়েটা অসাধারণ সুন্দর। হাল্কা মিষ্টি রঙের সালোয়ার কামিজে মৃদু উজ্জ্বল রঙা মেয়েটাকে বেশ লাগছিল। আর ছেড়ে দেয়া রেশমি চুলগুলো বাতাসে উড়ছিল একটু একটু। ঘন কালো এমন চুলের ভেতর অমা রজনীর পথে হাঁটতে আমি ঢের রাজি, লাগবে না আলোর বিচিত্র সমারোহ। মেয়েটাকে খুব ভালো লাগছিল। জীবনের সঙ্গী যদি এমন স্নিগ্ধ কেউ হতো তবে বেশ হতো। জীবনের ব্যস্ততা ভুলে চলে যেতাম বহুদূরে নির্মল কোনো দেশে। এমন কল্পনা অবশ্য স্বপ্নে ভালোই লাগে কিন্তু বাস্তবে কখনোই ঘটে না। হঠাৎ কেউ একজন বলে উঠলো “ভাই ভাড়াটা দিয়েন।” ভাড়া অবশ্য একটু আগেই দিয়েছি। কিন্তু এমন প্রশ্নটা আরো কয়েকবার শুনতে হবে। তবে বিরক্ত হলাম না। ছেলেটার মুখটা অল্প আলোতে বেশ মায়াবী লাগলো। অল্প বয়স। মুখে ছোট ছোট দাঁড়ি। বললাম, “ভাড়া দেয়া হয়েছে।” ছেলেটি নীরবে চলে গেলো। আমি আবার বা’দিকে তাঁকালাম। মেয়েটি ফোনে কথা বলছিল। কি বলছিল শুনলাম না কিন্তু তার কণ্ঠস্বরটাও আমাকে মুগ্ধ করলো। খুব মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করলাম। হঠাৎ পাশে বসা লোকটার ফোন আসলো। এতো উচ্চস্বরে তিনি কথা বলা শুরু করলেন যে আমি বিরক্ত হয়ে গেলাম। মেয়েটার কণ্ঠস্বর কিছুই পেলাম না। লোকটা তার ছোট ছেলের সাথে কথা বলছিলেন, দুজনের সব কথাই বুঝে গেলাম। ছেলেটা তার আবদারের একটা বিশাল তালিকা দিলো। তিনি ফোন রাখার পরপরই বাসে যেন একটা নীরবতা নেমে এলো। স্বস্তি পেলাম। আবার কল্পনায় বিচরণ শুরু করলাম। কিন্তু আর কোনো প্রেরণা পেলাম না বরং দু‘সারি সামনে বসা দম্পতিদের দেখে বেশ লাগলো। তাদের দেখে নব দম্পতি মনে হচ্ছিল। খুব নিচুস্বরে তারা কথা বলে চলছিল অনেকক্ষণ ধরে, হয়তো জীবনটাকে সাজানোর স্বপ্নে তারা মশগুল। বাসটা শাহাবাগে পৌঁছালো অনেকক্ষণ পরে। কিছু বোঝার আগেই বাসে একটা বিস্ফোরণ হলো। দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো আগুন। মুর্হুতে ছড়িয়ে পড়লো সারা বাসে। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। আমার আশেপাশের মানুষগুলো ধাক্কাধাক্কি আর ভয়াবহ চিৎকার শুরু করলো। আমি আগেই বুঝে ফেললাম আমাকে জানালা দিয়ে বের হতে হবে এবং যতটা সম্ভব ধীরস্থির ভাবে। সে মুর্হূতে আমি খুব স্থির ভাবে খুঁজলাম জানালার পথ। কিন্তু বের হতে না হতেই আমার এক হাতে আগুন জ্বলে উঠলো। উহ্ কি ভীষণ যন্ত্রণা। চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগলো কিন্তু চিৎকার দেয়ার সামর্থ পেলাম না। বাস থেকে নামতে পারলাম এবং জানটা বেঁচে গেলো। চারিদিকে মানুষের ছোটাছুটি। আগুন নেভানোর আপ্রাণ চেষ্টা। কয়েকজন মানুষ আমার গায়ে পানি ছিটিয়ে দিলো এবং আগুন নিভে গেলো। তবে হাতের মাংসটা ঝলসে গেলো। অনেকে আমাকে ধরে নিয়ে গেলো ঢাকা মেডিকেলে। খুব বেশি নাজুক অবস্থা না, তাই চেতনা হারাই নি। যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে উপলব্ধি করলাম এই ভয়াবহতার যন্ত্রণা। কত মানুষ পুরোপুরি ঝলসে গেলো। আমার পাশ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো একটি লাশ। একেবারে পুড়ে গেছে মেয়েটি। না জানি কে ছিল? হঠাৎ লাশের পাশে এক টুকরো কাপড় চোখে পড়লো। একটি মিষ্টি রঙের ওড়নার খ-াবশেষ। উহ, কী ভয়াবহতা!! একটা লোককে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো। তিনিও বীভৎস রকমের পুড়ে গেছেন তবু জানটা এখনো আছে। ছেলের বিশাল আবদারটা হয়তো আজ না হলেও কোন একদিন পূরণ করে উঠতে পারবেন।
আমার পরিবারের সবাই দৌড়ে এলো হাসপাতালে। সকলের ভয়াবহ কান্নায় আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। বেঁচে থাকার এতো বড় মর্যাদা আগে অনুভব করিনি। আমাকে ঐ দিনই বাসায় আনা হলো। একেবারে বেডরেস্ট শুরু হলো দীর্ঘদিনের। আর সিদ্ধান্তও হলো মতিঝিলে কাজ করতে যাওয়া হবে না আর। কিছুই বলছিলাম না আমি। মেয়েটার কথা বারবার মনে পড়ছিল আর ঐ লোকটার কথা। পত্রিকায় বড় বড় করে লেখা হলো এই বোমা হামলার কথা। মারা গেলেন ১৫ জন। হায় আমার ধারণা সত্যিই ছিল, সেই দু’জন দম্পতি ছিল নবদম্পতি। দু’জনে একই সাথে পাড়ি জমালেন পরপারে। আর ঐ মেয়েটার নাম আজ জানলাম। যাকে নিয়ে নির্জন দেশে যাওয়ার মিথ্যে কল্পনা করেছিলাম। অপরূপ মেয়েটি নির্জন দেশেই চলে গেছে শুধু আমাকে সঙ্গী হিসেবে নিলো না। আর দু’একজনের নাকি পরিচয়-ই জানা যাচ্ছে না। এটা শুনতেই মনে পড়লো স্বল্প আলোয় দেখা হেল্পার ছেলেটার মায়াবী মুখটা। আচ্ছা ওকি বেঁচে আছে। স্রষ্টার কাছে ওর জন্য প্রার্থনা করলাম।
তারপর অনেকগুলো দিন কেটে গেলো। মোটামুটি সুস্থ হলাম। চাকরিটা ছেড়ে দিতেই হলো। বাড়ি কাছে একটা ছোট্ট অফিসে কাজ নিলাম। অল্প মাইনের সঙ্কীর্ণ জীবন। তবু বহু দিন পর মতিঝিলের পথে রওনা হলাম। বারবার প্রতিটি বাসের হেল্পারদের দেখতে লাগলাম যদি ঐ ছেলেটাকে দেখতে পাই। কিন্তু পেলাম না তাকে। মতিঝিলের পথের সাথে সর্ম্পকের অবসান হলো।
অনেকগুলো বছর কেটে গেলো। দিব্যি বেঁচে আছি। ভালো চাকরিও পেলাম উত্তরায়। বাসাও শিফট করলাম উত্তরায়। বিয়ের সব যোগাড়ও করা হয়ে গেছে। একদিন ক্লান্ত দুপুরে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ছিলাম বাসের অপেক্ষায়। হঠাৎ একটা বাস খুব কাছ থেকে দ্রুত চলে গেলো আমাকে অতিক্রম করে। হেল্পারের মুখ খানা এক পলক দেখতেই মনে পড়লো সেই সন্ধ্যার কথা। সেই বাস, সেই লোক, দম্পতি আর সেই মেয়েটি --- যার ঘন কালো চুলের ভেতর অমা রজনীর পথ পেয়েছিলাম। একটা অদ্ভূত তৃপ্তি পেলাম। যাক বাবা, অন্তত হেল্পারটা বেঁচে গেছে।

জানুয়ারি ২, ২০১৪

দেহের ওম

শরীরের ওমের স্বাদ এই প্রথম উপলব্ধি হল হাফিজের। কনকনে শীতের রাতে ঘন কুয়াশায় ঢাকা বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে সুরু মেঠো পথে হাঁটতে হাঁটতে তার শুধু ঐ ওমের কথা মনে পড়ে। সত্যি জরিনার শরীরটা মায়াবী। দেহের প্রতিটি ভাঁজে, কোণে কোণে যেন ছিটকে পড়ে সৌন্দর্য। এতদিন পোশাকের ওপর দিয়ে অবয়ব দেখেই হাফিজের দিন কেটেছে, আজ প্রথম একেবারে সরাসরি সব দেখল, ধরল, উপভোগ করল। কিন্তু কাজটা কি ভালো হয়েছে? এই প্রশ্নকেও এড়াতে পারে না হাফিজ। শত হলেও জরিনা তার আপন ভাইয়ের বৌ। দু’বছর আগে বিয়ে করে ভাই চলে গেছেন সৌদীতে। সেই থেকে জরিনা বাপের বাড়ি। বাপের বাড়ি আর শ্বশুর বাড়ির দূরত্বই বা কতটুকু, কয়েক ক্রোশ মাত্র, তবু জরিনা বাপের বাড়িই থাকে। অনেকদিন পর হাফিজ ভাবীর সঙ্গে দেখা করতে এসে দেহের ওমও নিয়ে যাচ্ছে। হাফিজের অস্বস্তি লাগে। আবার একই সঙ্গে সেই মুহূর্তগুলোর ভাবনায় সে আনন্দিত হয়। জীবনে এই প্রথম কোন নারীর দেহের স্বাদ পেল সে। বিস্ময় তো লাগবেই। তবুু জরিনা কেন বাঁধা দিল না! হাফিজ কেবল একবারই জরিনার কোমরে হাত দিয়েছিল তারপর তাকে আহ্বানও জানাতে হয় নি, শাড়ির আঁচলটা এমনিতেই মেলে ধরল জরিনা। হাফিজের আর কিবা করার ছিল? ঐ সুন্দর বুকের ওম পেতে তার খুব স্বাদ হল। তারপর......। জরিনা আসলে ভালো মেয়ে না। এমনটা ভাবতে ভাবতেই হাফিজের পথ শেষ হয়ে আসে। শীতের রাতগুলো এমনিতেই খুব ভয়াবহ। চারিটা পাশ যেন শশ্মানের মত নিশ্চুপ হয়ে থাকে। নীরবতা আর নিস্তব্ধতাই ছড়িয়ে থাকে সর্বত্র। গ্রামের ভুতুড়ে পথে আলোর সামান্য নিশানও পাওয়া যায় না। চলতে ফিরতে তাই শীতের রাতটা ভয়ঙ্কর। তবু হাফিজ একা একাই হেঁটে চলে অনেকটা পথ। ভাবনায় এতটাই মশগুল ছিল যে কখন সে হেঁটে এসে নিজেরই ঘরের সামনে দাঁড়িয়েছে তা বুঝতে পারল না। ঘরের দরজা খুলে লাইটটা অন না করেই শুয়ে পড়ে। ভাবতে থাকে অনেক কিছু। দু’টি ভাবনার স্রোত বইতে থাকে হাফিজের মস্তিষ্কে। জরিনার দেহের ওম আর জরিনা ভালো মেয়ে না।
হঠাৎ ঘুম ভাঙে হাফিজের। আতকে ওঠে। ভাবীকে নিয়ে এমন স্বপ্ন দেখার পূর্বাপর কারণ সে খুঁজতে থাকে। কোনদিন, কখনই জরিনার দিকে খারাপ দৃষ্টিতে সে তাঁকায় নি তবে কেন স্বপ্নে ভাবী! ভাবীর বুকের ওম, দেহের স্বাদ- সবকিছু এত স্পষ্ট কেন অনুভূতিতে। হাফিজের মনে পড়ে রাতের কথা। আজ বড্ড বেশি মদ খেয়েছিল সে। জীবনে কখনও এতটা খায় নি। এসব ভাবতে ভাবতে চেয়ে দেখে সে তার ঘরে না। অন্ধকারে বুঝে উঠতে পারে না কোথায় সে। প্রচ- শীত লাগে তার। মাথায় অদ্ভূত দোলাতে সে বিছানায় শুতে নিয়ে দেখে একটি মেয়ে ঘুমিয়ে আছে। নিজের মুখটা মেয়েটির মুখের কাছে নিতেই সে চিনতে পারে। এ যে জরিনা। কিন্তু মদ খেয়ে মাতাল হলেও তো হাফিজ ভাবীর ঘরের দিকে আসে নি। তবে কি জরিনাই তাকে ভুলিয়ে নিয়ে এসেছে? স্বপ্নটা কি স্বপ্ন ছিল নাকি বাস্তব? কোন উত্তর পায় না হফিজ। হাজার হাজার প্রশ্নে হাফিজের মাথা ঘুরতে থাকে অনবরত। রাত বাড়ে। গভীর রাতে শীত পড়ে খুব করে। হাফিজ কিছু ভেবে পায় না। শুয়ে থাকে জরিনার পাশে। তারপর একসময় কম্বলটা গায়ে দেয়ার জন্য একটু টান দিতেই জরিনার উন্মুক্ত বুকটা চোখে পড়ে। শীতের কষ্টের ভেতর স্বপ্ন কিংবা বাস্তবের দেহের ওমের স্বাদ পেতে ব্যাকুল হয় হাফিজ। আস্তে করে ঢুকে পড়ে কম্বলের ভেতর। কনকনে শীতের কুয়াশা ভরা মাঝরাতে দেহের ওম খুব ভালো লাগে তার।

ডিসেম্বর ৯, ২০১৪

যৌনতা

আচমকা ঘুম থেকে আৎকে ওঠে ফয়সাল। কি ভয়ঙ্কর স্বপ্নটাই এতক্ষণ দেখছিল। জীবনে বহুবার পর্ন-সাইটগুলোতে ফোর্সড সেক্স বা রেপড ভিডিওগুলো ও দেখেছে। বেশ ভালো লাগে দেখতে। পোশাক ছিঁড়ে ফেলা বা জোরপূর্বক দেহের বিভিন্ন অঙ্গে স্পর্শ, কামড়ানো, দৃশ্যগুলো ওকে পাশবিক আনন্দ দিয়েছে বরাবর। রাস্তা দিয়ে যখন কোন সুন্দরী মেয়ে হেঁটে যায়, ও অপলক চোখে চেয়ে থাকে। মনে মনে কল্পনা করে পর্ন ভিডিও-র গল্পগুলো। একেবারে ফালতু, একপেশে গল্পগুলোর মধ্যে কোথায় যেন সুখ আছে। ও তার কারণটা বোঝে না। এমনিতে বক্তা, বিশ্লেষক বা গবেষক হিসেবে ওর জুড়ি নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা, এমনকি কোন কোন শিক্ষকরাও ওকে স্কলার হিসেবে বিবেচনা করেন। সমাজনীতি, রাজনীতি, অর্থনীতি ও মানুষের মনস্তত্ত্ব নিয়ে ওর ভাবনার শেষ নেই। লেখেও মাঝেমধ্যে। দু’একটা আর্টিকেল প্রকাশিত হয়েছে জাতীয় দৈনিকে। তবু ও গোপনে চেয়ে থাকে সুন্দরীদের দিকে। ওর চোখে সবগুলো মেয়েই সুন্দরী। কালো-ফর্সা ব্যাপার না, ব্যাপার না পোশাকও। কেবল সাইজ, ৩৬/৩৪-এ ঘোরাফেরা করা শরীরগুলো ওর চোখে সুন্দরী। কিন্তু আজ ঘুমের ভেতর যে পর্ন ভিডিওটা দেখল, তা ওকে আনন্দিত করেনি বরং ভয়ঙ্কর ভীত করে তুলেছে। স্বপ্নে ও একটা নারী ছিল। ওর অনিচ্ছা সত্ত্বেও কয়েকটি ছেলে ওকে রেপড করেছে। উহ্ কি অসহ্য যন্ত্রণা! ইচ্ছা না থাকলে যে সঙ্গম করা যায় না, সেটা ও বোধ হয় এই প্রথম বুঝলো। ও ভাবতে থাকে, এগুলো ও কীভাবে বুঝল! স্বপ্ন কতটা কাছ থেকে উপলব্ধি করা যায়? আর যতই হোক একজন পুংলিঙ্গের মানুষ যতই উপলব্ধি করতে চাক, যোনিমুখের যন্ত্রণা তো সে উপলব্ধি করতে পারবে না। তাহলে? তাহলে হলো কি? ফয়সাল আয়নাতে নিজের মুখটা দেখল। এই বর্ষণমুখর দিনেও ও ঘেমে একাকার। ওর মুখ থেকে টুপটুপ ঘাম ঝরছে। গায়ের জামাটা ভিজে টইটুম্বর। লুঙ্গিটাও ভিজেছে ঘামে। অন্য যে কোন সময় হলে ঐ স্বপ্নের পর ওর লুঙ্গিটা ভিজে যেতেই, তাতে শঙ্কিত হওয়ার কিছু ছিল না। সকাল মাত্র ৭টা। এমনিতে ৯টার আগে ঘুম থেকে ওঠে না ও। অনার্স শেষ, মাস্টার্সের ক্লাসের গুরুত্ব তেমন নেই। মাঝেমধ্যে ক্লাসে যায়। সেদিন ৮টায় ওঠে। কিন্তু আজ ৭টায়, একেবারে রুটিন ব্রেক। ঘর্মাক্ত দেহ নিয়ে বাথরুমে গোসল করতে যায় ফয়সাল। ঝরণার নিচে উদাম দেহে দাঁড়িয়ে থাকে। পুরুষের দেহটার দিকে তাঁকিয়ে থাকে অনিমেষ। এভাবে কখনো নিজেকে দেখেনি সে। দেহের কোন অঙ্গে তার সাড়া নেই। কেবল মাথাটা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে। কেন? এমন স্বপ্ন সে কেন দেখল? হঠাৎ মনে পড়ল গতরাতে ঘুমানোর আগে সোহাগী জাহান তনুর ধর্ষণ ও হত্যার একটা রির্পোট পড়েছিল ও। সেখানের কথাগুলো ওর বুকে বন্ধুকের গুলির মতো বিঁধেছিল। চোখ দিয়ে টপটপ পানি ঝরেছিল। কখনো কোন ধর্ষণের নিউজ ওকে এতটা ব্যথা দেয়নি। এরও কারণ ও বুঝতে পারছে না। সম্ভবত, ঐ রির্পোটই ওর মস্তিষ্কে জন্ম দিয়েছে একটি স্বপ্নের। ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন, নিজেকে নারী হিসেবে দেখা স্বপ্ন। ওর নিজের মনে প্রশ্ন জাগে তাহলে এই যে নারী যারা, তারা কি মানব জন্ম হিসেবে একটি দুঃস্বপ্ন কাটাচ্ছে! এই জীবন কি একটা দুঃস্বপ্ন! যখন বাবার মতে বাধ্য হয়ে একটি মেয়ে একটি অচেনা পুরুষের ঘরে বৌ হয়ে যায়, তখন বাসররাতটি কি তার কাছে ধর্ষণের রাত হয়ে যায় না? অথবা আমরা যে কেউ যখন কোন বিয়ের কথা নিয়ে কোন মেয়েকে দেখতে যাই, তখন কি চোখ দিয়েই মেয়েকে ধর্ষণ করে ফেলি না? তাহলে পুরুষের কাছে নারী কি যৌনযন্ত্র মাত্র? ফয়সালের মাথা ঘোরায়। ঝরণার অবিরাম পানিতে ভিজে ভিজে ওর দেহ ঠা-া থেকে ঠা-া হতে থাকে। মনে হয় মৃত লাশে পরিণত হচ্ছে ও। তনুর একটা ছবি ভাসতে থাকে ওর চোখে। গোসল থেকে বের হয়ে নাস্তা করতে যায় ডাইনিং রুমে। বাবা অফিসে, মা স্কুলে। বাসায় কেবল ছোট বোন আয়েশা আর কাজের মেয়ে নাজরিন। খাবার টেবিলে বসতেই নাজরিন রুটি আর সবজি এগিয়ে দেয় ওর দিকে। নাজরিনের দিকে চোখ পড়তেই ও দেখে মেয়েটি নাজরিন না, তনু। ঐ মেয়েটি, যে ভয়ঙ্করভাবে ধর্ষিত হয়ে খুন হয়েঝে ফয়সালদের হাতে। রুটিগুলো মুখে উঠতে চায় না। আয়েশা রেডি হয়ে কলেজে যাচ্ছিল। ‘ভাইয়া, আসি বলতেইÑ ফয়সাল আয়েশার দিকে তাকিয়ে দেখল, মেয়েটা আয়েশা না তনু। ফয়সাল বলে উঠল, ‘না বোন, একা যাস না, আমি আসছি।’ আয়েশা অবাক হয়। ফয়সাল কোনদিনই ওকে কলেজে এগিয়ে দিতে যায়নি। ফয়সাল নাস্তা করা বাদ দিয়ে তাড়াতাড়ি জুতো জোড়া পরে নেয়। আয়েশাকে নিয়ে বের হয় রাস্তায়। সকাল বেলা রাস্তায় একটু ভিড় বেশিই থাকে। একটা ভিড় বাসে উঠতে নেয় আয়েশা। ফয়সাল বাধা দেয়। বলে, ‘এটায় খুব ভিড়। পরেরটায় উঠি।’ আয়েশা বলে, ‘কি হল ভাইয়া? তুমি এমন করছ কেন? এর থেকে বেশি ভিড় বাসেই যাতায়াত করি আমি।’ ফয়সাল নির্বিকার। পরের বাসটায় বোধ হয় ভিড় আরো বেশিই ছিল। ফয়সাল বাধা না দিয়ে আয়েশার পিছে পিছে বাসে উঠে পড়ে। আয়েশা গন্তব্যে নেমে যায়। ফয়সালের গন্তব্য আরেকটু দূরে, বিশ্ববিদ্যালয়। আজ অবশ্য ক্লাস নেই কিন্তু জামির স্যারের সঙ্গে সাক্ষাৎটা জরুরি। পুরো ব্যাপারটা কারো না কারো সঙ্গে শেয়ার না করলে হচ্ছে না। আর স্যার যেহেতু মনোবিজ্ঞানী, সুতরাং তিনিই যথার্থ ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। বাসের ভিড় কিছুটা কমেছে। ওর পাশের সিটটা খালি হতেই একটা মেয়ে পাশে এসে বসল। মিষ্টি একটা পারফিউমের গন্ধ। মাতাল, মাতাল লাগে। ও জানে, এখনকার বডি স্প্রে বা পারফিউমগুলোতে নারীদেরটা পুরুষদের কাছে টানে আর পুরুষদেরটা নারীদের কাছে টানে। পণ্যগুলোর বিজ্ঞাপনে তো একেবারে খোলসা করেই তা বুঝিয়ে দেয়া হয়। ফয়সালের চিন্তা এবার অন্যস্্েরাতে বইতে থাকে। পুঁজিবাদের ওপর আরও তিন/চারটা বই পড়া বাকি। তারপর সার্বিক একটা আলোচনায় যাওয়া যাবে। ছোটভাইদের সংগঠন ‘ঐতিহ্য’-তে একটা সেমিনারের আয়োজন করা হবে, যাতে ওকেই থাকতে হবে প্রধান আলোচক হিসেবে। সুতরাং অনেকটা পরিশ্রমই করতে হবে। অবশ্য কথা বলার জন্য ওর কোন ক্লান্তি নেই। কথার ভাঁজে কথা ভাঁজ করতে করতে ও যেন মহাপুরুষ হয়ে ওঠে। আচ্ছা, মহাপুরুষদের কি সফটকোর ভালো লাগে না? আচমকাই চিন্তাটা দুম করে অন্য স্্েরাতে চলে যায়। বাসটা আরেকটা বাস আচমকা ওভারটেক করতে গিয়ে যাত্রীদের একটু দুলিয়ে দিয়েছে। আর এরই ফাঁকে মেয়েটার কনুইটা আলতো করে লেগেছে ফয়সালের পেটে। তাতেই চিন্তার বিশাল রদবদল। ফয়সাল আড় চোখে দেখল মেয়েটাকে। পাশ দিয়ে মেয়েটার কাপড়ের নিচের বাম স্তনটা অনুভব করা যায়। সম্ভবত ব্রা পরেনি, তাই নিপলটা কিছুটা আন্দাজ করা যায়। হঠাৎ বিদ্যু চলে গেলে যেমন কম্পিউটারের মনিটরটা একটা কালো পর্দা হয়ে ওঠে, তেমনি করে ফয়সালের চিন্তার জগতে নেমে আসে ভয়াল রাত। ফয়সাল ঘাড়টা কাত করে মেয়েটার দিকে তাঁকায়। মেয়েটা তনু। তীব্র ঘৃণা, রাগ, বিতৃষ্ণা আর যন্ত্রণায় ফয়সাল হাতের মুঠোটা শক্ত করে বাসের জানলায় একটা ঘুষি মারে। গ্লাস ভেঙে কয়েক টুকরো কাঁচ ঢুকে গেছে ওর হাতে। গাড়িটা হঠাৎ কড়া ব্রেক কষে থেমে গেল। তনু আৎকে উঠল। বাসের যাত্রীরা নিশ্চুপ। ফয়সালের বোধ হয় ‘ফাদার সির্য়েগি’ গল্পটা পড়া আছে।

মার্চ ২৪, ২০১৬










































মন্তব্য ৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৫ শে নভেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১২:৩৭

আখেনাটেন বলেছেন: ভালো লিখেছেন। তবে লেখাগুলো একসাথে না দিয়ে একটা একটা করে পোষ্ট করলে ভালো হতো। আর লেখার মাঝে প্যারা থাকলে পড়তে চোখের অতটা কষ্ট হয় না।

২৫ শে নভেম্বর, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৪৩

সুব্রত দত্ত বলেছেন: মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার পরামর্শগুলো মনে থাকবে এবং পরবর্তী পোস্টগুলোতে তা অনুসরণ করব। ভালো থাকবেন।

২| ২৭ শে নভেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১২:৩২

দেবজ্যোতিকাজল বলেছেন: তুমি আমার সাথে এই মেলে যোগাযোগ করবে
[email protected]

২৭ শে নভেম্বর, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৫৭

সুব্রত দত্ত বলেছেন: আচ্ছা। ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.