নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পরিশ্রমকে সঙ্গী করে কত মানুষ উর্ধ্বে গেলো, আকাশের ঐ তারার দলে/ চিরদিনই অলস আমি, আছি পড়ে অনন্তকাল এই ধরনীর গাছের তলে।
দীর্ঘদিন যাবৎই বাংলার ইতিহাস নিয়ে, বঙ্গভূমি, তার ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে নানা তর্ক-বির্তক পরিলক্ষিত হয়ে আসছে। এর বড় কারণ ঐতিহাসিক প্রমাণাদির দুষ্প্রাপ্যতা। স্বভাবতই ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে এই অঞ্চলের সৃষ্টিকর্ম, ঐতিহ্য-স্মারক দীর্ঘদিন টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। আবার সমগ্র ভারতবর্ষের দর্শনে বস্তুতান্ত্রিকতার অভাব, সংরক্ষণ-প্রয়াসহীনতা নেতিবাচক প্রভাব রেখেছে সৃষ্টিকর্ম ও ঐতিহ্যের জন্য। ফলে চট করে বাংলার ইতিহাস নির্মাণ সম্ভব হয়নি এবং যতটুকু যা পাওয়া গিয়েছে তার ভিত্তিতে গবেষকদের মন্তব্যেও তৈরি হয়েছে বৈপরীত্য। তবু একবিংশ শতাব্দীতে এসে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বহুবিধ শাখা-প্রশাখার প্রসার, ঐতিহ্য, নৃতত্ত্ব ও প্রত্নতত্ত্বের প্রতি আগ্রহ আমাদের উত্থান ও বিকাশের একটি গ্রহণযোগ্য ইতিহাস তৈরি করতে পেরেছে। নানা তর্ক-বিতর্কের ভেতর দিয়ে সেই ইতিহাসকে আমরা আমাদের মতো করে সাজিয়ে নিতেই পারি।
বাঙালি ও বাংলার পরিচয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে একটা গল্প একটু শুনে নিতে পারি আমরা। খুব দরকারি না হলেও শুনতে মন্দ লাগবে না।
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। এই যে মানুষকে সেরার আসনটা দেয়া হয়েছে সেটা কিন্তু মানুষ নিজেই দিয়েছে। অন্য প্রাণীরা এসে কিন্তু বলে নাই ওহে মানুষ, তোমরা হচ্ছো সৃষ্টির সেরা জীব। এই যে মানুষ শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করেছে সেটা কিন্তু অমূলক না। মানুষ ভাষা আবিষ্কার করতে পেরেছে। মানুষ পেরেছে প্রকৃতিকে বশে আনতে। মানুষের এসব পারার ভেতর দিয়েই বারে বারে মানুষ অতিক্রম করতে চেয়েছে বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডকে। মানুষের বড় জানতে ইচ্ছে হয়েছে এই পৃথিবী কীভাবে এলো, আদি মানুষ কীভাবে জন্মালো- এমন সব হাজারও ভাবনায় মানুষ নিয়ত খুঁজে ফিরেছে। একদিকে যেমন পৃথিবীকে নিজের মতো করে বাসবাসের উপযোগী করে সভ্যতা তৈরিতে মানুষ নিয়োজিত হয়েছে আবার অন্যদিকে সেই মানুষই আবার খুঁজে ফিরেছে জগৎ ও জীবনের গূঢ় রহস্যসমূহের উত্তর।
পৃথিবী কীভাবে হলো? এ প্রশ্নের বিভিন্ন রকমের উত্তর দিয়েছে মানুষ। স্রষ্টায় বিশ্বাসীদের বক্তব্য এক রকম, দার্শনিক ও বিজ্ঞানীদের বক্তব্য আরেক রকম। ভূতত্ত্ববিদদের ধারণা, পৃথিবীর বয়স ১৫০ থেকে ২০০ বছর। অনেক বৈজ্ঞানিক মনে করেন ৪০০ কোটি বছর পূর্বে পৃথিবীর জন্ম হয়েছিল। খ্রিস্টধর্ম ও ইসলামধর্ম মতে পৃথিবী স্রষ্টার তৈরি। তিনি তাঁর আপন শক্তিতে সময়ের সৃষ্টি করেন এবং সেই সময়ের ভেতর দিয়ে আকাশ, পৃথিবী, বায়ু, মানুষ ও অন্যান্য জীবের সৃষ্টি করেন। পৌরাণিক বিশ্বাস ও কাল্পনিক বিভিন্ন মতবাদেও এর সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। অন্যদিকে বিজ্ঞানী ও বস্তুবাদী দর্শনে পাওয়া যায় ভিন্ন কথা। প্রখ্যাত জার্মান বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট (১৭২৫-১৮০৪) মনে করেন, আদিম নীহারিকা থেকেই সৌরজগত, সূর্য, গ্রহ-উপগ্রহ, ধূমকেতু, উল্কাপিণ্ড, গ্রহানুপুঞ্জ সবকিছুর জন্ম। ওনার বক্তব্যের আরও দীর্ঘকাল পরে ১৯০০ সালের দিকে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন বৈজ্ঞানিক মৌলটন ও চেম্বারলিন সৌরজগতের জন্ম সম্পর্কে ভিন্ন মতামত দেন। বৈজ্ঞানিকসহ অনেকেই এখনও এই মতবাদের প্রতি আস্থাশীল।
তাঁরা বলেন, নক্ষত্র ও সূর্য প্রচণ্ড বেগে ছুটে চলার সময় প্রায় দু’তিনশ কোটি বছর আগে আকাশে সংঘর্ষ হয়। সূর্যের একটি অংশ ছিঁড়ে বাইরে বেরিয়ে ভেঙে অনেকগুলো ছোট ছোট টুকরোতে ভাগ হয়ে যায়। এভাবেই জন্ম হয় পৃথিবীর। বৈজ্ঞানিকদের বিভিন্ন মত থাকলেও অধিকাংশ বৈজ্ঞানিক নিশ্চিত হয়েছেন সূর্য থেকেই পৃথিবীর সৃষ্টি। সূর্যই জীব জগতের প্রাণকেন্দ্র। তাপ দিয়ে আলো দিয়ে, জীব জগতের প্রাণ সঞ্চার করে সূর্য। (ড. আবু মোঃ দেলোয়ার হোসেন, ২০১০ : ৩৪)
অতএব সূর্য থেকে পৃথিবীর জন্ম সে হিসেব ধরেই আমরা মানুষের জন্ম কাহিনির অনুসন্ধান করতে পারি। পৃথিবী তো কয়েকশ কোটি বছর আগে সৃষ্টি হয়েছিল তাহলে মানুষ ঠিক কবে এলো? কীভাবে এর উৎপত্তি হলো? মানুষের উৎপত্তি সম্পর্কিত বিভিন্ন মতবাদ আছে। খ্রিস্টধর্মে আদম ও ইভ, ইসলাম ধর্মে আদম (আ) ও হাওয়া, হিন্দুধর্মে স্বয়ম্ভুর মনু ও শতরূপা আদি পিতা ও মাতা হিসেবে পরিচিত। প্রধান প্রধান এই ধর্মগুলোর ধর্মগ্রন্থ এবং পৌরাণিক বিশ্বাস থেকে জানা যায় স্রষ্টা প্রথমে পুরুষ এবং তারপর নারীর সৃষ্টি করেন, তাদের পৃথিবীতে প্রেরণ করেন আর তাদের ঔরসজাত সন্তান-সন্তানাদি থেকে ধীরে ধীরে পৃথিবীতে মানবকূলের বিকাশ ঘটে। অন্যদিকে বিজ্ঞানীদের নানা গবেষণা থেকে উঠে এসেছে নানা ধরনের ধারণা। একদল গবেষক মনে করেন পৃথিবীতে কোনো জীবনের সৃষ্টির হয়নি। সম্ভবত কোনো দূরপ্রান্তের উৎস থেকে জীব জন্ম নিয়েছে। তবে এ ধারণা মোটেই গৃহীত হয়নি কারো কাছে। আরেকটি শক্তিশালী মতবাদ হলো যান্ত্রিকতা মতবাদ (গবপযধহরংঃরপ ঞযবড়ৎু)। এই মত অনুসারে পৃথিবীর বিভিন্ন উপাদানের প্রাকৃতিক মিশ্রণে জন্ম লাভ করেছে জীব।
তাদের মতে, এই পৃথিবী, প্রাণি ও বস্তু কোন স্রষ্টা কর্তৃক সৃষ্ট হয়নি, বরং এগুলো বিরামহীন বিবর্তনের ফলে উদ্ভব হয়েছে। এ মতে সৃষ্টি সম্পর্কে ধর্মীয় মতকে অস্বীকার করা হয়। অবশ্য বিবর্তনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিভিন্ন জ্যোতির্বিদ, ভূতত্ত্ববিদ, জীববিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন মত পোষণ করেছেন। তবে সকলেই মোটামুটিভাবে বুঝতে পেরেছেন মানুষ আজকের আদলে আসতে বিভিন্ন প্রাণিকূলের আদল অতিক্রম করেছে। (ড. আবু মোঃ দেলোয়ার হোসেন, ২০১০ : ৩৪)
বিবর্তনবাদী মতবাদের জন্য জিন ব্যাপ্টিস্ট ডি ল্যামার্ক, চার্লস লিয়েল এবং চার্লস রবার্ট ডারউইন বিখ্যাত। তাঁদের মতবাদ নিয়ে অনেক রকমের মতপার্থক্য থাকলেও বিবর্তনবাদ, প্রাকৃতিক নির্বাচনকে আধুনিক গবেষকরা স্বীকার করেছেন। ডারউইনের মতবাদ অনুসারে মানুষ বানর জাতীয় প্রাণীর থেকে জন্মেছে সে মতবাদ গ্রহণযোগ্য না হলেও মানুষ যে হাজার হাজার বছরের পথ অতিক্রম করে বিবর্তিত হতে হতে আজকের মানুষের আকার ধারন করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বৈজ্ঞানিক গবেষণাজাত তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায় পৃথিবীতে প্রথম প্রাণের স্পন্দন শুরু হয় এককোষী জীবের জন্ম থেকে এবং তার উৎপত্তিস্থল পানি। সমুদ্রের পানিতে প্রথমে এককোষী এবং বিবর্তনের পথ ধরে দ্বিকোষী এবং ধীরে ধীরে বহুকোষী প্রাণীর জন্ম হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে আদিম মানুষের জন্ম হয় যারা প্রথমত ফলমূল সংগ্রহ করে খেয়ে কোনোরকম জীবন ধারন করতে থাকে। সময়ের পরিক্রমায় তারা গাছ থেকে নেমে মাটিতে পা রাখে, ফলমূলের পাশাপাশি পশু শিকার করতে শেখে এবং ধারাবাহিকভাবে একটু একটু করে মানুষ এগিয়ে যেতে থাকে আর ক্রমশ পিছে ফেলে রাখে অন্যান্য প্রাণীদের। তবে এই প্রক্রিয়া কিন্তু এক, দুদিনের না, হাজার হাজার বছর লেগেছে মানুষকে সভ্য হতে। মানুষ প্রথম যখন অস্ত্র তৈরি শিখল, আগুনের ব্যবহার শিখল, একটু একটু আওয়াজ করে করে ভাষা ব্যবহার করতে শিখল, পাথর ও লোহার ব্যবহার শিখল তখন মানুষ পৃথিবীর সঙ্গে, প্রকৃতির সঙ্গে মোকাবেলা করার সমর্থ অর্জন করল। সভ্যতার শুরুতে মানুষ মনে করত প্রকৃতি তার শত্রু, প্রতিনিয়ত প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করেই টিকে থাকতে হয়। মানুষের এই ধারণা দ্রুতই মানুষকে এগিয়ে নিয়ে গেল সামনের দিকে, মানুষ বশ করে নিল সমগ্র পৃথিবীকে।
এই যে এতক্ষণ ধরে পৃথিবী ও মানুষের গল্প বলা এর কারণ এখন খোলাস করা যেতে পারে। আমরা এখন দেখব ঠিক কবে, কীভাবে বাংলা ও বাঙালির যাত্রা শুরু হলো। পূর্ববর্তী আলোচনার ভিত্তিতে বলা যায় একটা সময় ভারতবর্ষেও নানা প্রজাতির মানুষের জন্ম হয় এবং তারাও একটু একটু করে উন্নত হতে থাকে। মানুষে যেদিন লিখতে শিখল সেদিন থেকেই কিন্তু মানুষের ইতিহাস লিখিত হতে শুরু করল, অলিখিত ইতিহাসের সময়কে গবেষকরা প্রাগৈতিহাসিক কাল বলে চিহ্নিত করেন। প্রাগৈতিহাসিক কালের কিছু তথ্যও পাওয়া যায় প্রত্নতাত্ত্বিক নমুনা গবেষণা করে। যেমন ভারতবর্ষের আদি নির্দশন হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সভ্যতা ৫ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দের। তবে তথ্য-উপাত্তের অপ্রতুলতার জন্য প্রাগৈতিহাসিক কালের ভারতবর্ষ কিংবা বাংলার ইতিহাস নিয়ে তেমন কোনো স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায়নি।
আজ আমরা বাংলা বলতে বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গকে বুঝি। এই বাংলাকে ইংরেজরা বলত ‘বেঙ্গল’। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে সমগ্র বাংলাকে দুটি প্রধান ভাগে আনা হলেও তা বেশি দিন কার্যকর থাকেনি রাজনৈতিক চাপে। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গরদের ভেতর দিয়ে দুই বাংলা প্রযুক্ত থেকে ১৯৪৭ সালের পূর্ব পর্যন্ত। ধর্মীয় জাতীয়তার ভিত্তিতে ১৯৪৭-এ প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান ও হিন্দুস্তান রাষ্ট্রে বাংলা বিভক্ত হয়ে পূর্ব বাংলা (পরবর্তী সময়ে পূর্ব পাকিস্তান) এবং পশ্চিমবঙ্গ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ব্রিটিশ আমালের এই ‘বেঙ্গল’ কথাটি সম্ভবত অন্যান্য ইউরোপীয়দের (বিশেষত পর্তুগিজদের) ‘বেঙ্গালা’ থেকেই নেয়া হয়েছে।
ষোল ও সতেরো শতকে ইউরোপীয়দের লেখনীতে ‘বেঙ্গালা’ নামের দেশের উল্লেখ পাওয়া যায়। সীজার ফ্রেডারিক (১৫৬৩-১৫৮১) ‘বেঙ্গালা’ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত চাটিগানের ১২০ মাইল দূরে অবস্থিত ‘সোন্দাবি’ দ্বীপের উল্লেখ করেছেন। ডুজারিক (১৫৯৯) প্রায় ২০০ লীগ উপকূল বিশিষ্ট ‘বেঙ্গালা’ দেশের উল্লেখ করেছেন। স্যামুয়েল পচার্স (১৬২৬)-এর বর্ণনায়ও ‘বেঙ্গালা’ রাজ্যের উল্লেখ রয়েছে। র্যাল্ফ ফিচ্ (১৫৮৬) ‘বেঙ্গালা’ দেশে ‘চাটিগান’ ‘সতগাম’ (সপ্তগ্রাম), ‘হুগেলি’ (হুগলি) এবং তাণ্ডা (রাজমহলের নিকটবর্তী) শহরের উল্লেখ করেছেন। পূর্ববর্তী ইউরোপীয় ভ্রমণকারীরা ‘বেঙ্গালা/বেঙ্গেলা/বাঙ্গালা’ রাজ্য ও ঐ নামের একটি শহরের কথা উল্লেখ করেছেন। এছাড়া মার্কোপোলো (১৩ শতক), ওভিংটন, ব্ল্যুভ (১৬৫০) এবং সসেন (১৬৫২) ‘বেঙ্গালা’ শহরের উল্লেখ করেন। (ডঃ মুহম্মদ আবদুর রহিম, ২০১০ : ১৮)
এই বেঙ্গালা/বেঙ্গেলা/বাঙ্গালা থেকেই যে ‘বেঙ্গল’ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে এবং একই ভৌগোলিক এলাকাকে বোঝানো হয়েছে সেটা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে কোনো সংশয় নেই আর। সহজাতভাবেই প্রশ্ন ওঠে তাহলে এই বেঙ্গালা নামটিও বা এলো কীভাবে। ইউরোপীয়দের ভারতবর্ষে আসার পূর্বকার ইতিহাস অনুসন্ধান এক্ষেত্রে জরুরি। ষোড়শ শতক থেকে বাংলা তথা ভারতবর্ষে ইউরোপীয়দের আসা-যাওয়া শুরু হয় মূলত ব্যবসা-বাণিজ্যের তাগিদ থেকে। এর পূর্বে এই অঞ্চল শাসন করত মোগলরা। মোগল সম্রাট আকবর তাঁর সমস্ত সাম্রাজ্যকে কয়েকটি সুবায় বিভক্ত করেন। সুবা বিভক্তির সময় তিনি ভূ-প্রকৃতি, প্রাকৃতিক সীমা ও ভাষার দিকে লক্ষ রাখেন। সেই হিসেবে সমগ্র বাংলা ভাষা অঞ্চল সুবা বাংলার অর্ন্তভুক্ত হয়। শাসনের সুবিধার্থে এই সুবা বাংলার রাজধানী বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তিত হলেও ভৌগোলিক পরিসীমা পুরো শাসনকালে একই রকম ছিল। কিন্তু এই সুবা বাংলা বলতে যে পরিসীমাকে নির্দেশ করা হয় সেই বৃহৎ অঞ্চল কি প্রাচীনকাল থেকেই একই রকম ছিল? সে প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানে আমাদের যেতে হবে আরও খানিকটা পেছনে।
মানুষের জন্ম ও বিকাশের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় প্রথমে মানুষ ফলমূল সংগ্রহ ও পশু শিকারের মাধ্যমে জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করত এবং সময়ের পরিক্রমায় ধীরে ধীরে মানুষ কৃষিকাজ, পশুপালন এবং গ্রাম প্রতিষ্ঠা করতে শেখে। তাই প্রাচীনকালে মূলত গ্রামভিত্তিক জীবন ছিল অর্থাৎ স্বয়সম্পূর্ণ গ্রামেই মানুষ বসবাস করত। কয়েকটি গ্রাম নিয়ে গড়ে উঠত এক একটি জনপদ। এই রকম কয়েকটি জনপদ মিলেই প্রকৃত অর্থে বাংলা গড়ে উঠেছিল প্রাচীন সময়ে।
প্রাচীনকালে অনেকগুলো জনপদ নিয়ে বাংলা ভাষাভাষী জনগণের এই দেশ গঠিত হয়েছিল। এই জনপদগুলোর মধ্যে উত্তরাংশে গৌড়, পুণ্ড্র ও বরেন্দ্র; পশ্চিমাংশে রাঢ় ও সুহ্ম; পূর্বদিকে ছিল বঙ্গ, সমতট এবং হরিকেল। ভাগীরথী এবং হুগলী নদী বঙ্গোপসাগরে পতিত হতে গিয়ে রাঢ় এবং বঙ্গের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট সীমারেখা তৈরি করেছে। ‘বেঙ্গল’ নামের উৎপত্তি হয়েছে প্রাচীন জনপদ ‘বঙ্গ’ থেকে। ক্রমান্বয়ে পুণ্ড্র (পুণ্ড্রবর্ধন), গৌড় এবং বঙ্গ এই তিনটি জনপদ একত্রিতভাবে বাংলার ভৌগোলিক সীমারেখঅ নির্দেশ করেছে। (এ কে এম শাহনাওয়াজ, ২০০৯ : ৩৭)
এই পর্যায়ে বোঝা যাচ্ছে ‘বঙ্গ’ নামের কোনো জনপদ থেকেই ধীরে ধীরে সমগ্র বাংলার পরিচয় গড়ে উঠেছে। ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখা যায় ‘বঙ্গ’ শব্দটির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ‘ঐতরেয় আরণ্যক’ গ্রন্থে। সেখানে ‘মগধ’ এর পাশাপাশি ‘বঙ্গ’ কথাটির উল্লেখ রয়েছে। পুরাণে প্রাচ্যদেশের তালিকাতেও ‘বঙ্গ’-এর উল্লেখ দেখা যায়। এছাড়া, প্রাচীন মহাকাব্য মহাভারতে, রঘুবংশের লেখায় এবং বিভিন্ন প্রাচীন সাহিত্যে ‘বঙ্গ’ নামটি লক্ষ করা যায়। ভারতবর্ষের পূর্বদিককার কোনো অঞ্চল বোঝাতে এই বঙ্গ নামটি ব্যবহৃত হতো। বঙ্গ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ বিশ্লেষণ করলেও এমন সাক্ষাৎ মেলে যে বর্তমান বাংলাই প্রাচীনকালের বঙ্গ ছিল।
বঙ্গ শব্দটির উৎপত্তি বানস বা বান (ইধহং ড়ৎ ইধহ) শব্দ থেকে। বানস বা বান শব্দের অর্থ স্যাঁৎসে্যঁতে জলাভূমি। (অন্নপূর্ণা চট্টোপাধ্যায়, ২০০৫: ০১)
নদীবিধৌত বাংলা বরাবরই পানিতে থৈ থৈ করা জলাভূমি। প্রাচীন বঙ্গ জনপদ হতে যে সুবা বাংলা গড়ে উঠেছিল সে কথা এই বঙ্গ শব্দটির অর্থ থেকেও প্রমাণিত হয়। অবশ্য এই বঙ্গের সঙ্গে আরেকটি জনপদের নামের সাদৃশ্য ঐতিহাসিকদের অনেককেই বিভ্রান্ত করেছে। সেই জনপদটি ‘বঙ্গাল’ নামে পরিচিত ছিল। বিখ্যাত ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করতেন ‘বঙ্গাল’ দেশের নাম হতেই কালক্রমে সমগ্র দেশের ‘বাংলা’ নামকরণ হয়েছে। কিন্তু তা নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে এখনও। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। তবে এক্ষেত্রে নীহাররজ্ঞন রায় অবশ্য আবুল ফজলের ব্যাখ্যাকে অযৌক্তিক মনে করেননি। নদীমাতৃক দেশে বন্যা ও জোয়ারের স্রোত রোধের জন্য ছোট বড় বাঁধ (আল্) নির্মাণ কৃষি ও বাস্তুভূমির যথার্থ পরিপালনের পক্ষে অনিবার্য ছিল। সুতরাং বঙ্গ-এর সঙ্গে আল্ যুক্ত হয়ে ‘বঙ্গাল’ বা বাঙ্গাল/বাঙ্গালা/বেঙ্গালা শব্দ তৈরি হতে পারে তিনি ধারণা করেন। বঙ্গাল-এর ব্যবহার মূলত দক্ষিণী লিপিতে দেখা যায়।
রাজেন্দ্র চোলের তিরুমুলাই লিপিতে উল্লিখিত চোল অভিযান দক্ষিণ রাঢ় থেকে বঙ্গাল দেশে এসেছিল (যেখানে বৃষ্টি কখনো থামে না) এবং গোবিন্দচন্দ্রকে পরাজিত করেছিল। দ্বাদশ শতাব্দীর দুই/একটি লিপিতে বঙ্গ ও বঙ্গালের পাশাপাশি উল্লেখ দেখা যায়। (ডঃ মুহম্মদ আবদুর রহিম, ২০১০ : ২৮)
গবেষকেরা এইসব লিপি এবং তথ্য প্রমাণাদির ভিত্তিতে ধারণা করেন বঙ্গ ও বঙ্গাল সম্ভবত একই স্থানকে নির্দেশ করে। সম্ভবত বঙ্গাল বলতে বঙ্গের দক্ষিণভাগ বা পূর্ব-বঙ্গকে বোঝানো হয়েছিল। তবে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
সর্বপ্রথম এই বঙ্গ এবং এর নিকটবর্তী বাংলা ভাষাভাষী মানুষের জনপদগুলোকে একত্রিত করে বাংলাকে একক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ্ ১৩৫২ সালে। তখন থেকেই সুবা বাংলা গড়ে ওঠে যেটা অব্যাহতি পরে মোগলরা, ব্রিটিশরাও অনুসরণ করেছিল। শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহের এই ঐতিহাসিক কর্মের জন্য তাঁকে ‘শাহ-ই-বাঙ্গালা’, ‘সুলতান-ই-বাঙ্গালা’ এবং ‘শাহ-ই-বাঙ্গালীয়ান’ উপাধিও দেয়া হয়েছিল।
বঙ্গ নামক একটি জনপদ এবং আরো কয়েকটি জনপদ হয়ে মূলত ভারতবর্ষে মুসলমান শাসনের প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে ‘বাংলা’ স্বয়ংসম্পূর্ণ পরিচয় লাভের দিকে এগিয়ে যায়। ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলার পরিসীমা বিবেচনা করলে বোঝায় যায় ভারতবর্ষের পূর্বাংশই মূলত বাংলা। যেটা বর্তমান বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকাকে নির্দেশ করে।
মোটের ওপর উত্তরে ২১ক্ক ও ২৭ক্ক অক্ষাংশে এবং পূর্বে ৮৭ক্ক ও ৯২০ক্ক- ৩০ক্ক দ্রাঘিমাংশের মধ্যে এই ভূখণ্ডটি অবস্থিত। বাংলার উত্তরে প্রায় ৬৪০ কিলোমিটার দূরে হিমালয়ের অবস্থান এবং দক্ষিণে প্রবাহিত বঙ্গোপসাগর। পশ্চিমে বিহার ও উড়িষ্যার সঙ্গে বাংলার প্রায় ৫৬০ কিলোমিটার সীমান্ত আর পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত রয়েছে আসাম ও মায়ানমারের সঙ্গে। উপরের চিহ্নিত সীমানা অনুসারে বাংলার মোট আয়তন ২,১৬,১৪৬ বর্গকিলোমিটার। (এ কে এম শাহনাওয়াজ, ২০০৯ : ৩৭)
আমাদের বর্তমান আলোচনা যদিও বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে কিন্তু আমাদের এটুকু ভুললে চলবে না যে বাংলাদেশ হুট করে একদিন বাংলাদেশ হয়ে ওঠেনি। হাজার হাজার বছরের পথ অতিক্রম করে আজকের এই ভূ-খণ্ডটি বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীতে পরিচিত। সুতরাং সংক্ষিপ্ত পরিসরে হলেও বাংলাদেশের ভৌগোলিক পরিসরটি জেনে বুঝে নেয়াটা জরুরি ছিল। উপরের আলোচনার সারসংক্ষেপ হিসেবে বলা যায় প্রাচীনকালের ভারতবর্ষের পূর্বদিককার বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনপদের মধ্যে একটি ছিল বঙ্গ যার ভাষা ছিল প্রাকৃত বাংলা, এই বঙ্গ এবং বঙ্গের ভাষার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ অন্যান্য জনপদগুলো নিয়ে মুসলিম শাসনামলে সুলতান পর্বে প্রথম সমগ্র বাংলা প্রতিষ্ঠিত হয় যেটা অব্যাহতি পরে মোগলরাও তাদের শাসনের সুবিধার্থে ‘সুবা বাংলা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। ব্রিটিশ আমলেও ঐ একই পরিসীমায় বেঙ্গলকে চেনা হতো। ব্রিটিশ শাসনের অবসানের সময়ে ধর্মীয় জাতীয়তার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের কারণে বৃহৎ বাংলা প্রধান দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় এবং বেঙ্গলের পূর্বাংশ পূর্ব-পাকিস্তান হিসেবে চিহ্নিত হয়। দীর্ঘ ২৩ বছর পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঙ্গে রাজনৈতিক-সামাজিক ও অর্থনৈতিক নানা ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ মানুষের আত্মদানের পর বাংলাদেশ নামে এই অঞ্চলটি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীর বুকে মাথা তুলে দাঁড়ায়।
বাংলাদেশের অধিবাসীদের ‘বাংলাদেশি’ এবং ‘বাঙালি’ এই দুটি নামে চিহ্নিত করা হয়। যদিও বাংলাদেশি বলতে বাংলাদেশ ভূ-খণ্ডে বসবাসরত সকল জাতিগোষ্ঠীর মানুষকেই বোঝানো হয়, তবে এ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষই জাতিসত্তাগতভাবে বাঙালি। বাংলা ভূ-খণ্ডে বসবাসরতদের বহু পূর্ব থেকেই বাঙালি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসীরাও তাই বাঙালি। বাঙালি জাতিসত্তার পূর্বাপর ইতিহাস খুঁজতে গেলেও বিভ্রান্তিতে পড়া ছাড়া গতি থাকে না। এখানেও অপর্যাপ্ত তথ্য ও উপাত্ত আমাদের যথাযথ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে বাধাগ্রস্ত করেছে। তবে একথা ঐতিহাসিক, গবেষক থেকে মোটামুটি সকলেই মেনে নিয়েছে যে বাঙালি একটি সঙ্কর জাতি। নানা জাতিগোষ্ঠীর সংমিশ্রনে আজকের বাঙালি তার পরিপূর্ণ পরিচয় লাভ করেছে। তুলনামূলক ব্রিটিশরাই সবচেয়ে কম মিশেছে আমাদের সঙ্গে কিন্তু এর পূর্ববর্তী সকল জাতিগোষ্ঠীর শাসকেরাই বাংলা তথা ভারতবর্ষ শাসন করতে এসে আমাদের সঙ্গে মিশে গিয়েছে। আরবি বণিক থেকে শুরু করে ইউরোপীয় কিছু জাতিগোষ্ঠীরও রক্তের মিশ্রণ পাওয়া যায় আমাদের বাঙালিদের মধ্যে।
কিন্তু প্রশ্ন আসতে পারে বাঙালি জাতির ভিত্তিমূল কোথায়? সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে যেতে হয় প্রত্নতত্ত্ববিদ ও নৃতাত্ত্বিকদের কাছে। এই ভূখণ্ডে মানুষ সভ্যতা গড়ার প্রথম স্বাক্ষর রেখেছে সিন্ধু নদের তীরে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে গড়ে ওঠা হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সভ্যতা। ঐ সভ্যতার বাসিন্দা করা ছিল সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে একশ্রেণীর গবেষকরা প্রাপ্ত তথ্যাদির ভিত্তিতে জানিয়েছেন এখানে চার ধরনের মানুষ বাস করত। এরা হচ্ছে- আর্য, তুরানীয়, সেমীয় এবং হামীয়। এই চার ধরনের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল আর্য এবং সেমীয়রা। এই দুই ধরনের জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে আর্যদের বিবেচনা করা হয় বহিরাগত অর্থে এবং সেমীয়দেরকে মনে করা হয় ভারতবর্ষের আদি জাতিগোষ্ঠী। আর্যদের ভাষায় বর্ণিত ‘অসুর’ বা ‘অসুররা’র সঙ্গে এদের সাদৃশ্যও পেয়েছেন অনেক গবেষক। বহিরাগত আর্যদের সঙ্গে পরবর্তী সময়ে আরও বিভিন্ন জাতির মিশ্রণ ঘটেছে এই উপমহাদেশে। বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় গবেষকরা তাদেরকে ৩টি প্রধান শ্রেণিতে অন্তুর্ভুক্ত করেছেন। এরা হচ্ছে- আদিম উপজাতিসমূহ, মঙ্গোলীয় ও দ্রাবিড়।
ভারতবর্ষে দ্রাবিড় গোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা বেশি হলেও বাংলায় মঙ্গোলীয়দের আধিক্য লক্ষ করা যায়। তিব্বত এবং মঙ্গোলিয়া হচ্ছে মঙ্গোলীয়দের আদিভূমি। এরা উত্তর-পূর্বের পাহাড়ি পথ ধরে ভারতে প্রবেশ করে। এক সময় এরা আর্যদের সঙ্গে মিশে যায়। এই গোষ্ঠীর লোকেরা হিমালয়ের পাদদেশে সিকিম, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য-চট্টগ্রাম অঞ্চলে আবাস গড়েছে। প্রাচীনকাল থেকে এদের বংশধারা বাংলাদেশে সুদৃঢ় অবস্থান তৈরি করেছিল। (এ কে এম শাহনাওয়াজ, ২০০৯ : ২৪)
মঙ্গোলীয় এবং আর্যদের সংমিশ্রণের ভেতর দিয়ে বাঙালি জাতিসত্তা গড়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল বললে খুব একটা ভুল বলা হবে না। এরপর আরও নানা জাতি, উপজাতির মিশ্রণের ভেতর দিয়ে বাঙালি জাতি পেয়েছে পরিপূর্ণতা।
উপরিউক্ত আলোচনার ভেতর দিয়ে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে বাংলা এবং বাঙালি জাতি হিসেবে গড়ে উঠেছে দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায়। কিন্তু এটাও বিবেচনায় রাখা জরুরি যে যেকোনো জাতিসত্তার গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় তার ভাষা। বাঙালি যে বাঙালি সেটা তার ভাষাগত পরিচয়ের ভিত্তিতেই পরিপূর্ণতা পেয়েছে। বাংলা ভাষার উদ্ভব ও বিকাশ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনায় না গিয়েই বলা চলে বাংলা ভাষা তার যথার্থ পরিচয়ে পরিচিতি পেয়েছে মাত্র হাজার খানেক বছর আগে। ভারতবর্ষের প্রাকৃত ভাষার অপভ্রংশ হয়ে বাংলার উদ্ভব হয়েছে এই ষষ্ঠ কি সপ্তম খ্রিস্টাব্দে। মূলত তখন থেকেই বাংলাকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতি ও বাংলা অঞ্চল পরিচিতি পেতে শুরু করেছিল। আমাদের গবেষণার বিষয়ে বাংলা ভাষা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ বাংলা অঞ্চল এবং বাঙালি জাতি তাই এই দীর্ঘ আলোচনার অবতারণা।
বাঙালি জাতিসত্তা গঠনের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া
বঙ্গ থেকে বাংলার উৎপত্তি যেমন সত্য, তেমনি সত্য ভাষা হিসেবে বাংলাকে কেন্দ্র করেই বাংলা অঞ্চল ও জাতিসত্তা গঠিত হয়েছে। ইতিহাসের পাতায় ঠিক যে সময়টাকে বাংলা ভাষার জন্মসূত্র হিসেবে বারংবার চিহ্নিত করা হয়েছে সেই সময়সীমা ৬৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৯৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। যেহেতু একটি ভাষাকে পরিপূর্ণতা পেতে অনেকটা সময় লেগেই যায় সেহেতু আমরা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতপার্থক্যকে স্বীকার করেই বলতে পারি বাংলা ভাষার উদ্ভবকাল ৭ম থেকে ১০ম শতকের মধ্যে। এই সময়কালের বাংলা অঞ্চলের রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমরা সহজেই অনুমান করতে পারব যে বাঙালি জাতিসত্তার জন্ম কিংবা শুভ সূচনাটা হয়েছিল ঠিক এই সময়েই।
প্রাচীন বাংলা যেহেতু বেশ কয়েকটি জনপদ নিয়ে সামগ্রিক একটি ভূ-খণ্ড হিসেবে পরিচিত ছিল সেহেতু সেখানে বিভিন্ন জনপদ বিভিন্ন শাসন ব্যবস্থার ভেতর দিয়ে এগিয়ে এসেছিল দীর্ঘ সময় ধরে। পুণ্ড, বঙ্গ ও গৌড় জনপদের প্রাধান্য ছিল সেসময় সর্বাধিক। এই জনপদের শাসনব্যবস্থাকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে বাংলা অঞ্চলের রাজনৈতিক পটভূমি। প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে একজন ব্যক্তির নাম বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই বারংবার উচ্চারিত হয়। তিনি রাজা শশাঙ্ক। তাঁর বংশ বা বাল্যজীবন সম্পর্কেসঠিক কোনো তথ্য পাওয়া না গেলেও এবং ঐতিহাসিকদের ভেতর তাঁকে নিয়ে নানা রকমের মতামত থাকলেও এটা সত্য যে-
যাহোক, এই কথা স্পষ্ট যে, সপ্তম শতাব্দীর প্রারম্ভে কোনো এক সময়ে শশাঙ্ক গৌড় রাজ্যের ক্ষমতাসীন হন। তাঁর রাজধানী ছিল কর্ণসুবর্ণ- বর্তমানে মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরের ছয় মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত রাঙামাটি। বাংলার উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাংশ শশাঙ্কের রাজধানী ছিল। এই এলাকায় পরবর্তী গুপ্তবংশীয় রাজাদের শাসনের অবসানের পরই শশাঙ্কের উদ্ভব। (ডঃ মুহম্মদ আবদুর রহিম, ২০১০ : ৬০)
তবে শশাঙ্ক পূর্ব বঙ্গের দিকে তাঁর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন কিনা তা নিয়ে যথাযথ তথ্য- প্রমাণাদি পাওয়া যায় না। গৌড়াধিপতি শশাঙ্ক তাঁর বুদ্ধিমত্তা এবং পেশিশক্তি দিয়ে ভারতবর্ষের ইতিহাসে যে জায়গা করে নিতে পেরেছিলেন সে বিষয়ে কোনো সংশয় নেই এবং তাঁর মূলকেন্দ্র নিঃসন্দেহে বাংলা ছিল। কেবল বাংলার পূর্বাংশ ঠিক কীভাবে, কোন রাজার অধীনের ছিল তা নিয়ে রয়ে গেছে সংশয়। শশাঙ্কের মৃত্যুর পর আবার সমগ্র বাংলায় নেমে আছে অন্ধকার যুগ। তথ্যের অভাবে সপ্তম শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়কালের রাজনৈতিক ইতিহাসও সেভাবে নির্ণয় করা যায়নি। তবে চরম অরাজকতার ভেতর দিয়ে, রাজনৈতিক কোন্দল, হত্যা ও রক্তপাতের ভেতর দিয়ে যে
এই সময় পার হয়েছে তার বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায় এবং সেজন্যই এই সময়কে ঐতিহাসিকেরা ‘মাৎস্যন্যায়’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। মাৎস্যন্যায় বলতে আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার মতো শক্তিশালী শাসন ক্ষমতার অভাবে সমাজের বিশৃঙ্খল অবস্থাকে বোঝানো হয়। মাছের রাজ্যে যেমন বড় মাছগুলো ছোট মাছদের ধরে ধরে খায়, তেমনি রাজাবিহীন রাজ্যে প্রভাবশালীরা দুর্বলের উপর নির্মম অত্যাচার চালায়, এ অবস্থাকেই বোঝানো হয়েছে মাৎস্যন্যায় শব্দটি দিয়ে।
১৬০৮ খৃস্টাব্দে তিব্বতি ভাষায় লিখিত ভারতে বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে লামা তারনাথ এই সময়ের বাংলাদেশের যে বিবরণ দিয়েছেন তা থেকে এই ‘মাৎস্যন্যায়’ অবস্থারই পরিচয় পাওয়া যায়। তারনাথ লিখেছেন : সমগ্র দেশের কোনো রাজা ছিল না। প্রত্যেক ক্ষত্রিয়, সম্ভ্রান্ত লোক, ব্রাহ্মণ এবং বণিক নিজ নিজ গৃহ ও আশেপাশের এলাকায় স্বাধীনভাবে শাসন করতেন। (ডঃ মুহম্মদ আবদুর রহিম, ২০১০ : ৬৭)
এই অরাজকতার মধ্য দিয়েই পালবংশের প্রতিষ্ঠা হিসেবে গোপালের আর্বিভাব হয়। এই গোপাল নিয়েও ইতিহাস থেকে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় না। তবে ঐতিহাসিকদের দাবি দীর্ঘদিনের অরাজকতার পর স্থানীয় লোকজনের উদ্যোগেই একজন যোগ্য ব্যক্তিকে রাজা হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। ঐ যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন রাজা গোপাল। দীর্ঘ প্রায় ৪০০ বছরের শাসনে আমলে পালবংশের দ্বারাই বাংলা অঞ্চল, বাংলা ভাষা ও বাঙালির জাতির প্রভূত কল্যাণ সাধিত হয়। পাল আমলে বাংলা অঞ্চলে অসাম্প্রদায়িক পরিবেশের ভেতর দিয়ে হিন্দু, বৌদ্ধধর্মের বিকাশসহ বহিরাগত বণিকদের হাত ধরে ইসলাম ধর্মেরও প্রসার শুরু হয়। বাংলার শিল্প ও সঙ্গীত, সাহিত্যে অভাবনীয় উন্নতি লক্ষ করা যায় এই সময়েই। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় পাল আমলেরও অবসান ঘটে। দক্ষিণ ভারতের কট্টর হিন্দুত্বাবাদী সেন রাজারা বাংলা দখল করে নেয় একসময় এবং বাংলার স্বাধীন সূর্যের হয় অবসান, বাংলা নিমজ্জিত হয় গভীর অন্ধকারে। সেন বংশের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে সামন্তসেনের নাম পাওয়া গেলেও তাঁর রাজত্ব অধিকার ও শাসনের কোনো তথ্য পাওয়া যায় না কিন্তু অনুমান করা হয় সেন রাজা বিজয় সেন ১০৯৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ধীরে ধীরে গৌড়, মিথিলা, রাঢ়, পূর্ববঙ্গ ইত্যাদি জয় করে রাজ্যের পরিধি বাড়ান। এরপর দীর্ঘ সময় ধরে বাংলা অঞ্চলে সেন রাজাদের শাসন চলে। বৌদ্ধরা বিতাড়িত হয়, হিন্দুধর্মের কৌলিন্য প্রথার বিকাশ হয়, নিচুজাতের হিন্দু ও বৌদ্ধরা দেশত্যাগে বাধ্য হয় এবং বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও শিল্পকলার বিকাশ রুদ্ধ হয়। চর্যাপদ ব্যতীত তাই তৎকালীন উল্লেখযোগ্য সাহিত্যের সন্ধান মেলে না এবং চর্যাপদ বাংলার সম্পদ হলেও তা আবিষ্কৃত হয় নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থশালা থেকে। ভিন্নমত থাকলেও অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মত সেন শাসনে অতিষ্ট সাধারণ জনগণ মনে-প্রাণে রাজার পরাজয় কামনা করতো বলেই মাত্র ১৬ জন সৈন্য নিয়ে বাংলা ভ্রমণে এসেই তুর্কির সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন্ বখতিয়ার খলজি বাংলা দখল করে নিতে সক্ষম হয়েছিল এবং তার সূত্র ধরেই দ্রুত সময়ের মধ্যে সমগ্র ভারতবর্ষে মুসলমান শাসনের প্রেক্ষাপট রচিত হয়েছিল।
বঙ্গে হিন্দু শাসনের অবসান ও মুসলিম শাসনের সূত্রপাত হয় মোটামুটি ১২০১ খ্রীষ্টাব্দে। যাঁহারা এদেশে মুসলিম শাসনের প্রতিষ্ঠা করেন, তাঁহারা ছিলেন জাতিতে তুর্কী, ধর্মে মুসলমান ও সংস্কৃতিতে মুখ্যতঃ পারসিক। তাঁহারা ঘরে তুর্কী-ভাষা বলিতেন, রাজনীতিতে ফারসী-ভাষা ব্যবহার করিতেন এবং ধর্মীয় ক্ষেত্রে আরবী-ভাষা চালাইতেন। সংস্কৃতির দিক হইতে বঙ্গে মুসলিম তুর্কীর অবস্থা ছিল মোটামুটি এইরূপ। (ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক, ১৯৫৫ : ১৭)
এই তুর্কিদের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম শাসন ভারতবর্ষে দীর্ঘ প্রায় ৫০০ বছর বলবৎ ছিল। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মধ্যযুগ এই মুসলিম শাসন পর্বটিই।
৫০০ বছরের এই মুসলিম শাসনের ভেতর দিয়ে বাঙালি জাতি এবং বাংলা অঞ্চল বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সংযোজন ও বিয়োজনের ভেতর দিয়ে তার আজকের রূপটিতে পৌঁছেছে। প্রধানত এই সময় তিনটি ধাপে পুরো ভারতবর্ষ শাসিত হয়েছিল মুসলিমদের দ্বারা। সেগুলো হলো-
১। তুর্কি আমল (১২০১ - ১৩৫০)
২। সুলতানি আমল (১৩৫০ - ১৫৭৫)
৩। মোগল আমল (১৫৭৫ - ১৭৫৭)
তুর্কি আমলে বিভিন্ন রাজনৈতিক উত্থান পতনের ভেতর দিয়ে বাংলার এগিয়ে গেলেও এসময় বাংলার সঙ্গে ইসলামের পরিচয় গভীরতর হতে শুরু করে। প্রথমত, ব্যবসা-বাণিজ্যের সূত্রে। এই সময় ভারতবর্ষের সঙ্গে আরব এবং অন্যান্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশের ব্যবসায়িক লেনদেন বেড়ে যায় এবং এই সূত্রে অনেক মুসলিম এদেশে এসে স্থায়ী বসবাস শুরু করে। দ্বিতীয়ত, ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে বহু দরবেশ ও সূফি-সাধক এদেশে আসেন এবং তাঁদের অমায়িক আচরণ, মানবিকতা ও সৌহার্য্যপূর্ণ ব্যবহার অতি সহজেই আপামর জনতাকে স্পর্শ করতে সক্ষম হয়। ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হতে শুরু করে অনেক মানুষ। তবে রাজনৈতিক অরাজকতায় অচিরেই দেড়শো বছরের ভেতরই তুর্কিদের অবসান ঘটে এবং প্রতিষ্ঠা পায় স্বাধীন মুসলিম বাংলা।
গৌড়ের শমসুদ্দীন ইলিয়াস শাহের (১৩৪২-১৩৫৭ খ্রী) অভ্যুত্থানে বঙ্গে তুর্কী আমলের অবসান হইল। (ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক, ১৯৫৫: ২৯)
এই সময়ে এসে মুসলমানরা বাংলা অধিকার করে বটে কিন্তু তখনও দেশে হিন্দু আমলের সামন্ত শাসন চলছিল এবং অধিকাংশ সামন্তই হিন্দু ছিল। অর্থাৎ এই পর্বে এসে বাংলা অঞ্চলে শাসক শ্রেণিতে হিন্দু মুসলমান উভয়েরই মর্যাদা ছিল। বাংলা ভাষা, সাহিত্য, জাতিসত্তাগত বিকাশ এই সময়ে বেগবান হয়। সুলতান গিয়াসুদ্দীন আজম শাহের রাজত্বকালে গৌড়ের শাহী দরবারে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নীরব অগ্রগতি সূচিত হয়। মিথিলার কবি বিদ্যাপতি ও মুসলমান বাংলা কবি শাহ মুহম্মদ সগীরও সুলতানের সুদৃষ্টি লাভ করেছিলেন বলে জানা যায়। সুলতান গিয়াসুদ্দীন আজম শাহ পারস্যের কবি হাফিজকে বাংলায় নিমন্ত্রণ করেছিলেন বলেও ঐতিহাসিক সাক্ষ্য পাওয়া যায়। এই সময়ে রচিত হয় বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের অসামান্য সাহিত্যকর্মগুলো এবং চৈতন্যদেবের আবির্ভাবও সমসাময়িক কালে। সুলতানি আমলের অবসানের পর ভারতবর্ষে মোগল শাসনের সূচনা হয়। সময়টা ১৫৭৫ যা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলা দখলের সময় পর্যন্ত সক্রিয় ছিল। তবে উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো এই দীর্ঘ সময়ে মোগল শাসন তেমনভাবে বাংলাকে প্রভাবিত করতে পারেনি। মোগলদের শাসন ব্যবস্থার ভেতরে অনেকটা স্বাধীনভাবেই বাংলা পরিচালিত হয়েছিল।
সম্রাট আকবরের সময়ে নামমাত্র বাংলাদেশ মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়েছিল। এই প্রদেশে মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। মুঘল শাসন উত্তর-পশ্চিম বাংলার শহর ও দুর্গ এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল। বাংলার বড় বড় জমিদাররা মুঘল শাসন মেনে নেননি। তাঁরা কররানী রাজত্বের অবসানের পর নিজেদের জমিদারিতে স্বাধীনতা অবলম্বন করেন। জমিদারদের সৈন্যদল ও শক্তিশালী নৌবহর ছিল। তাঁরা সম্মিলিতভাবে বাংলায় মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে সম্রাট আকবরের খ্যাতনামা সেনাপতিদের সঙ্গে সংগ্রাম করেছেন এবং তাদের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে নিজেদের স্বাধীনতা রক্ষা করেছেন। এই জমিদাররা বার ভূঁইয়া নামে খ্যাত। তাঁদের আমলের বাংলাদেশ ‘বার ভূঁইয়ার মুলুক’ নামে অভিহিত হত। বার ভূঁইয়ার অধিকাংশই মুসলমান ছিলেন। (ডঃ মুহম্মদ আবদুর রহিম, ২০১০ : ২৫০)
পূর্ববঙ্গ বাদে বাংলার অন্য অংশগুলোর শাসনভার মোগলরা গ্রহণ করতে সক্ষম হওয়ায় ধীরে ধীরে সমগ্র বাংলাকে তারা তাদের সাম্রাজ্যের একটি অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।
মোগল আমলে বাংলাদেশ মোঘল সাম্রাজ্যের একটি সুবা বা প্রদেশে পরিণত হয়। সম্রাট আকবর সারা মোগল সাম্রাজ্যকে কয়েকটি সুবায় বিভক্ত করেন। সুবা বিভক্তির সময় তিনি ভূ-প্রকৃতি, প্রাকৃতিক সীমা ও ভাষার দিকে লক্ষ্য রাখেন। সেই হিসেবে সম্পূর্ণ বাংলা ভাষা অঞ্চল সুবা বাংলার অন্তর্ভুক্ত হয়। মোগল আমলের শেষ পর্যন্ত সুবা বাংলা আকবরের নির্ধারিত অবস্থানেই ছিল। মোগল বিজয়ের সময় বাংলার রাজধানী ছিল তাঁড়ায়, পরে আকবরের রাজত্ব কালেই রাজধানী রাজমহলে স্থানান্তরিত হয়, রাজমহলের নাম আকবরনগর রাখা হয়। জাহাঙ্গীরের সময়ে ইসলাম খান চিশতী ঢাকায় রাজধানী স্থানান্তর করেন। শাহ শুজা রাজমহলে অবস্থান করতেন কিন্তু পরবর্তী সুবাদারেরা আবার ঢাকায় থাকেন। মুর্শিদকুলী খানের সময়ে রাজধানী ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত হয়, মীর কাসিম স্বীয় নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে মুঙ্গেরে অবস্থান করেন। পলাশীর যুদ্ধের পর কলিকাতা প্রাধান্য লাভ করে এবং কিছুদিন পরে ইংরেজেরা মুর্শিদাবাদ থেকে কলিকাতায় রাজধানী স্থানান্তর করেন। (আবদুল করিম, ২০১২ : ২৪৭)
এর ফলে বাংলা তার স্থানিক, ভাষিক ও জাতিগত সত্তাকে আরও গভীরভাবে উপলব্ধি এবং সংঘবদ্ধ হওয়ার সুযোগ লাভ করে। যার ফলে মোগল সাম্রাজ্যের পতনেও বাংলায় তেমন কোনো সঙ্কট সৃষ্টি হয়নি এবং খুব দ্রুত সে সঙ্কট কেটে উঠতে সক্ষম হয়। ইতিহাসের করুণ জায়গাটি হলো মোগল সাম্রাজ্যের পতন ছিল দুঃখজনক। বড় কোনো জাতির আক্রমণ কিংবা যুদ্ধের ভেতর দিয়ে এর অবসান হয়নি বরং ক্ষমতার উত্তরাধিকারের যুদ্ধে মোগলরা দুর্বল হতে হতে একসময় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
মোগল সাম্রাজ্যের পতনের একটা প্রধান কারণ উত্তরাধিকারের যুদ্ধ। জাহাঙ্গীর এবং শাহজাহান উভয়ে তাঁদের পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। শাহজাহান, আওরঙ্গজেব এবং শাহ আলম বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পরে তাঁদের পুত্রদের মধ্যে উত্তরাধিকারের যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধ শত্রুর বিরুদ্ধে নয়, ঘরে ঘরে যুদ্ধ, ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ, মোগলদের বিরুদ্ধে মোগলদের যুদ্ধ। ফলে প্রত্যেক যুদ্ধেই সাম্রাজ্য কম বেশি দুর্বল হয়, অনেক সেনাপতি ও সৈন্য হতাহত হয়। শেষে এমন অবস্থা হয় যে বনেদী, অভিজাত, কর্মঠ, অভিজ্ঞ এবং সাহসী নির্ভীক সেনাপতি, উজীর, দীওয়ানের পদ পূরণ করার মত কর্মকর্তাদের অভাব দেখা হেয়। কেন্দ্রের এই দুর্বলতার প্রভাব প্রদেশেও পড়ে এবং বলতে গেলে প্রশাসনিক অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। (আবদুল করিম, ২০১২ : ২৪৯)
এমনিতেই অনেকটা স্বাধীন সুবা বাংলা এই সুযোগে আরও স্বাধীন হওয়ার সুযোগ লাভ করে। ১৭১৬ সালে মুর্শিদকুলী খান (জাফর খান) বাংলার সুবেদার নিযুক্ত হওয়ার পর বাংলার নবাবী আমল শুরু হয়। এবার সুবা বাংলা নবাবের প্রত্যক্ষ শাসনের চলে যায়। মুর্শিদকুলী খান এবং তাঁর পরবর্তী নবাবেরা নামে মাত্র মোগল সাম্রাজ্যের বশ্যতা স্বীকার করে। তাঁরা রাজস্ব সম্রাটের কাছে পাঠিয়ে দিতেন কিন্তু শাসন সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে সম্রাটের হস্তক্ষেপের সুযোগ ছিল না। কিন্তু নবাবী আমলের বড় সীমাবদ্ধতা ছিল স্বজনপ্রীতি। মুর্শিদকুলী খান তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের বড় বড় পদে দায়িত্ব দেন এবং পুরো ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার চেষ্টা করেন। আলীবর্দী তাঁর মনিবের ছেলেকে হত্যা করে মসনদে বসেন এবং সেজন্য তাঁর প্রতি মুর্শিদকুলী খান ও অন্যান্যদের আস্থার অভাব ছিল। এরই ক্রম-ধারাবাহিকতায় নবাবের অধীন ছোট ছোট জমিদার ও অন্যান্য মোগল কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ ও চাপা ক্ষোভের জন্ম হয় যেটা পরবর্তী সময়ে নবাব সিরাজউদ্দৌলার সময় বিশ্বাসঘাতকতায় রূপ নেয় আর এরই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলাকে পরাস্থ করে বাংলার স্বাধীনতার সূর্যকে দীর্ঘ সময়ের জন্য অস্তমিত করে ফেলে।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রুগ্ন মোগল সম্রাটের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে ভারতবর্ষে দ্বৈত শাসন শুরু করে যেখানে নামে মাত্র সম্রাটকে সিংহাসনের বসিয়ে রেখে পুরো ভারতবর্ষকে শাসন করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। শাসনের নামে শোষণ এবং ভারতবর্ষ থেকে সম্পদ পাচার তীব্রতর হলে নানা বিদ্রোহ দানা বাঁধে বিভিন্ন অঞ্চলে। ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহসহ বেশ কিছু বিদ্রোহ সংঘটিত হলেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে দমন করা যায়নি। শেষ পর্যন্ত ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ যাকে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার প্রথম সংগ্রাম হিসেবে চিহ্নিত করা হয় তার ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্ষমতা নড়বড়ে হয়ে পড়ে। ব্রিটিশ রাণীর হস্তক্ষেপে ১৮৫৭ সালে ভারতবর্ষে পুরোপুরি অর্থে ব্রিটিশ শাসনের আরম্ভ হয় এবং দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরের ক্ষমতার অবসানের ভেতর দিয়ে মোগল সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে।
১৮০০ শতকের শুরু থেকে বাংলা তথা ভারতবর্ষে এক নবজাগরণের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। ব্রিটিশদের সংস্পর্শে এসে বদলে যায় অনেক কিছু, শিক্ষা-দীক্ষা, আচার-আচরণ, সংস্কৃতি আসে জোয়ার। এর সূত্র ধরেই ভারতবর্ষ নতুন ভারতবর্ষ হিসেবে পৃথিবীতে জায়গা করে নেয়। আমাদের বর্তমানে গবেষণায় সে অংশটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এবং জরুরি। পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে তাই সে প্রসঙ্গে সবিস্তারে আসবে। আলোচনার সমাপনীতে এসে বলতে হয় বাংলার এই রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে সহজেই অনুভব করা যায় যে সহস্র বছরের রাজনৈতিক উত্থান পতনের ভেতর দিয়ে বাংলা অঞ্চলে নানা জাতিসত্তার আগমনে নানা রক্তের সংমিশ্রণে বাঙালি এক সংকর জাতিতে পরিণত হয়েছে। বারংবার রাজনৈতিক ক্ষমতার পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি বহুবার ধর্মান্তরিত হয়েছে একথা বললেও ভুল বলা হবে না। তবে ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে বাঙালি তার জাতীয়তাবোধ ও জাতিসত্তাকে চিনতে শিখেছে। প্রথম দিকে সেই উপলব্ধি হিন্দুদের মধ্যে সক্রিয় থাকলেও কিছু কাল পরেই মুসলমানরাও তাদের অস্তিত্বকে উপলব্ধি এবং তার যথাযথ স্বীকৃতির প্রয়োজন উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে।
তথ্যসূত্র:
১. ড. আবু মোঃ দেলোয়ার হোসেন (২০১০)। সভ্যতার ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ)। বিশ^বিদ্যালয় প্রকাশনী, ঢাকা।
২. ডঃ মুহম্মদ আবদুর রহিম (২০১০)। বাংলাদেশের ইতিহাস প্রথম পর্ব (প্রাচীন যুগ)। নওরোজ কিতাবিস্তান, ঢাকা।
৩. এ কে এম শাহনাওয়াজ (২০০৯)। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। নভেল পাবলিশিং হাউস, ঢাকা।
৪. অন্নপূর্ণা চট্টোপাধ্যায় (২০০৫)। ‘ইতিহাস সমকালীন ঐতিহাসিকদের কলমে’ [সম্পা. সামিনা সুলতানা]। ইতিহাস বিভাগ, জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়, ঢাকা।
৫. ডক্টর মুহাম্মদ এনামুল হক (১৯৫৫)। মুসলিম বাংলা সাহিত্য। মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা। ৬. আবদুল করিম (২০১২)। বাংলার ইতিহাস মুসলিম বিজয় থেকে সিপাহী বিপ্লব পর্যন্ত [১২০০-১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ]। জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা।
২| ১৭ ই অক্টোবর, ২০২৪ রাত ১০:২৯
কামাল১৮ বলেছেন: ঐতিহাসিক বর্ননা ভালো লাগলো।
৩| ১৮ ই অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ১১:১৬
সুব্রত দত্ত বলেছেন: মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
©somewhere in net ltd.
১| ১৭ ই অক্টোবর, ২০২৪ রাত ১০:২২
কামাল১৮ বলেছেন: আপনি যে সমস্যাগুলোর কথা বলেছেন তার প্রায় সবগুলির নিখুঁত লমাধান মানুষ করে ফেলেছে।কেউ মানছে কেউ মানছে না।এই সমস্যা থাকবেই।মানুষের চিন্তার বিকাশে সমতা নাই।ধার্মিকরা একভাবে চিন্তা করে বিজ্ঞান মনস্করা করে অন্য ভাবে।