![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
"বাসা ভাড়া এখনও দেওয়া হয় নি। ছেলের স্কুল থেকে বেতন কার্ড পাঠিয়েছে, তারপরও তুমি বাড়িতে টাকা পাঠালে কেন?"
"- আব্বা ফোন করে বললো মা নাকি অসুস্থ, ডাক্তার দেখাতে হবে। তাই কিছু টাকা পাঠিয়ে দিলাম।"
"-তোমার মায়ের কি প্রতি মাসে মাসে চাঁদে চাঁদে অসুখ হয়?"
পাশের ফ্ল্যাটের আসলাম-সাবিনা দম্পতির ঝগড়ার সূত্রপাত এভাবেই। মাসের ত্রিশ দিনের বিশ দিন-ই আসলাম-সাবিনা দম্পতি ঝগড়া করে। কখনও স্ত্রীর এমন যুক্তিযুক্ত ইস্যু নিয়ে আবার কখনও যুক্তিহীন ইস্যু নিয়ে ভিত্তিহীন ঝগড়া। ঝগড়ার সময় আসলাম সাহেবের কণ্ঠস্বর স্পষ্ট বুঝা না গেলেও সাবিনা ভাবির জ্বলাময়ী কণ্ঠ চ্যুত অগ্নিবাণী নিকটবর্তী ফ্ল্যাটের বাসিন্দা জাকিরসহ নিটকদূরবর্তী ফ্ল্যাটের বা ভবনের বাসিন্দাদের কানের পর্দায় গিয়ে আঘাত করে।
ভদ্রতার খাতিরে অনেক সময় কান বুজে স্বৈর্য করে জাকির। ঝগড়া নির্গত কথার জোয়ারে যখন স্বৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায় তখন দু কথা শোনাতে গিয়ে সাবিনা ভাবীর মুখ নির্গত চার কথা শুনে আসে।
আজও তাই। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় সাবিনা ভাবীকে দু কথা বলতে গিয়ে উল্টো চার কথা শুনে স্বৈর্য ধরে মুখ বুজে বাসা থেকে বের হয়।
জাকির মহাখালি রেলগেট বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে উত্তরা যাবে বলে। দুপুর গড়িয়ে বিকাল। অফিস ছুটির আওয়ার তাই গণপরিবহনগুলিতে প্রচন্ড ভীর। রাস্তায় গাড়ির স্রোত বইছে তবুও সঠিক সময়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যের গাড়ি পেতে কিছু কিছু সময় অনেক সময় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয়। গাড়ি আসে। গাড়ি থামে। যাত্রীরা নামা-ওঠা করে। গাড়িগুলোতে মানুষের এতই ভির যে, ভির ঠেলে গাড়িতে উঠতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে যাওয়া হয় না। ঢাকা শহর মানেই পনেরো মিনিটের রাস্তা যেতে সময় খরচ একঘন্টা। গাড়িগুলো চলে পাঁয়ে হাঁটার গতির চেয়ে একটু জোড়ে আবার কখনও সে তুলনায় ধীরে। কখনও কখনও ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যামে আটকে থাকে। অল্প দূরত্বে গন্তব্য যেমন মহাখালি থেকে বনানী কিংবা ফার্মগেট থেকে কারওয়ান বাজার এমন হলে পাঁয়ে হেঁটে গেলেই গাড়ির আগে পৌঁছানো যায়। গাড়ির ট্রাফিক সিগন্যাল আছে জট আছে প্রকট, পাঁয়ে হাঁটার কোনো ট্রাফিক সিগন্যাল বা জট নাই। আবার যারা ক্ষমতাযুক্ত ব্যক্তি তাদের অনেকেই যানজট থেকে মুক্ত চলাচল করে। ক্ষমতাযুক্ত এসব কর্তা ব্যক্তিদের কর্তৃত্বে তাদের বহনকৃত ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যক্তিগত কাজে অনেক সময় উল্টাপথে চলতে দেখা যায়। কারণ, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদ দখলকারী সামরিক বা বেসামরিক অফিসার কিংবা পাওয়ারে থাকা রাজনৈতিক দলের নেতা অথবা সংবাদগ্রহীতাদের অনেকেই ব্যক্তিগত গাড়ির মতো রাস্তাটাও ব্যক্তিগতই মনে করে। যে কর্মকর্তা রাস্তায় ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে আইন অমান্য করে উল্টা লেনে গাড়ি চালানোর অপরাধে চালকদের শাস্তি দেয় কিংবা অভিযুক্ত গাড়ির বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন অনুযায়ী মামলা করে। সেই কর্মকর্তা বাসায় ফেরার সময় তাঁর গাড়ির উল্টা লেন ব্যবহার করার দৃশ্যও যানজট যুক্ত ঢাকা শহরে হয়তো অনেকেই দেখেছে। আইন অমান্যকারীদের ফাইন করে যে, দিন শেষে সে-ই আইনের ক্ষমতায় আইন ভঙ্গ করে বেআইনি পন্থা অবলম্বন করে এমন ব্যক্তির সংখ্যা আমাদের এই সোনার বাংলায় মোটেও অল্প না।
আকাশে ফ্যাকাশে মেঘ। শরতের রৌদ্র ঝলমলে উতপ্ত দিনে কোত্থেকে যেন কয়েক গুচ্ছ মেঘ এসেছে ঢাকার পুরা আকাশ-ই দখল করে নেয়। কিছু সময় আগ পর্যন্তও মুশলধারে বৃষ্টি হয়েছে। এখনও সেই বৃষ্টির রেশ যায় নি।
-দেখছেন নি মিয়া ভাই, আল্লায় কি না পারে। কয় মিনিট? এতেই দুনিয়াদারি এক্কেরে ঠাণ্ডা।"
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জনৈক ব্যক্তি জাকিরকে উদ্দেশ্য করে বলে। জাকির সম্মতিসূচক মাথা নাড়িয়ে তার কথায় সহমত প্রকাশ করে।
- বৃষ্টি হইলেই রাস্তায় হাডু পানি। এডাই আমাগো ঢাকা শহর!"
বৃষ্টি পরবর্তী রাজধানীর রাস্তায় পানির স্রোত দেখে অপর পাশ থেকে অারেক জনের উক্তি। ঢাকা শহরে বৃষ্টি হলেই রাস্তায় পানি জমে যায়। এক ঘন্টার বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন হতে দু তিন ঘন্টা লেগে যায়। স্থান বিশেষে তারও বেশি সময় লাগে। শ্যালো ইঞ্জিন দিয়ে রাস্তায় জমে যাওয়া বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের দৃশ্য ঢাকাবাসি দেখেছে অনেক। এমনিতে ঢাকাবাসির দুর্ভোগের অন্ত নেই তারপর বৃষ্টি হলে জনদুর্ভোগ চরম পর্যায়ে দেখা দেয়। বিশেষ করে যারা গণপরিবহনে চলাচল করে তাদের ভোগান্তিই যেন বেশি।
এমনই এক দুর্যোগপূর্ণ দিনান্তে দুর্ভোগের দাপটে দুর্বল হয়ে মহাখালি ফ্লাইওভারের নিচে দাঁড়িয়ে গণপরিবহণের অপেক্ষায় জাকির।
"কিছু সাহায্য করেন, স্বামীর অপারেশন"
পেছনের দিক থেকে কোন এক নারী কণ্ঠের আওয়াজ জাকিরের কনে প্রবেশ করে। ঘুরে তাকিয়ে দেখে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত এক মহিলা হাত পেতে দাঁড়িয়ে। সিঁথিতে সিঁদুর হাতে শাখা। বয়স ত্রিশ পয়ত্রিশ। শ্যামবর্ণের মুখটা মলিন। শরীরের জীর্ণ কাপড়ের প্রায় পুরাটাই ভেজা। চোখে অসহায় চাহনি। বাম হাতে মুষ্ঠিবদ্ধ কিছু খুচরা টাকা পলিব্যাগে জড়ানো। বৃষ্টির পানি যেন টাকাগুলির কোনো ক্ষতি করতে না পারে। ডান হাত জাকিরের দিকে বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে।
গাড়িতে বা রাস্তায় অনেক সময় দেখা যায়, সুস্থ-সবল কর্ম সক্ষম ব্যক্তিরাও হৃদয়বিদারক করুন কথা আর চোখের পানি খরচ করে ভিক্ষাবৃত্তি করে। বনানী সৈনিক ক্লাব বাসস্ট্যান্ডে একশিশু বাচ্চাকে নিয়ে এক মহিলা প্রায়-ই ভিক্ষা করে। শিশু বাচ্চার উরু থেকে দু'ই পা একেবারে কাটা। একটা শিশু বাচ্চার দুইটা পা না থাকার কারণে বাচ্চার কর্ম সক্ষম মায়ের ভিক্ষা করার কি কোনো দরকার আছে? নেই। খেয়াঘাট এলাকায় গত একবছর ধরে বাচ্চা কোলে নিয়ে এক মহিলা গাড়ি ভাড়া নাই অজুহাতে মানুষের নিকট অর্থ সাহায্য চায়। এই একবছর ভিক্ষা করেও তার বাড়ি যাওয়ার গাড়ি ভাড়া হয়নি। এছাড়া প্রতিবন্ধী বা রোগীর অভিনয় করে পেশা হিসেবে ভিক্ষাবৃত্তি বেছে নিয়েছে এমন অনেকেই আছে। নেশাখোর নেশার টাকা সংগ্রহে ভিক্ষা করে। হিজড়ারা কোনো কর্ম না করে ভিক্ষাকে কর্ম হিসেবে বেছে নিয়েছে। এছাড়া ফকির, দরবেশ, সাধু, সন্ন্যাসী নানান কিসিমের ভিক্ষুক ভিক্ষাবৃত্তি করে এই ঢাকা শহরে। ভিক্ষুকদের কেউ শারীরিক প্রতিবন্ধী আর কেউ বার্ধ্যকের কারণে কর্ম অক্ষম। আর এ দুইয়ের কিছুই নয় যারা তারা কর্মবিমুখ তাই পেশায় ভিক্ষুক।
যারা শারীরিক কর্ম সক্ষম তারা জাকিরের কাছে কর্ম উপযুক্ত হাতকে ভিক্ষার হাত হিসেবে বাড়িয়ে দিলে জাকির অত্যান্ত সুন্দরভাবে সেই হাতকে শূন্যতাপূর্ণ ভাবেই ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু গুড়িগুড়ি বৃষ্টি উপেক্ষা করে সঙ্গীহীন একাকী ভেজা কাপড়ে জীবন সঙ্গীর জীবন বাঁচাতে কর্মক্লান্ত ঘরমুখি নগরবাসীর করুণার্থে যে নারী সাহায্য প্রার্থী হয়ে হাত বাড়িয়ে জাকিরের সামনে দণ্ডায়মান সে যে আসলেই অসহায় সেটা তার মুখের বর্ণ আর চোখের চাহনি দেখে যে কেউ বুঝতে পারবে। তার চলন এবং সাহায্য চাওয়ার ধরণ দেখে-ই মনে হয় সে পেশাদার ভিক্ষুক নয়। স্বামীর অপারেশন! স্বামী আহ! একজন স্ত্রী স্বামীর চিকিৎসার জন্য নিজের আত্মমর্যাদাকে জলাঞ্জলী দিয়ে মানুষের কাছে হাত পেতেছে। এখনকার দিনে এমন স্ত্রীও আছে! যার কাছে স্বামী নামের মানুষটি দেবতা সমতুল্য কিংবা স্বামীর পদতলে বেহেস্ত খোঁজে?
" কি হয়েছে?"
জাকিরের সরল জিজ্ঞাসা। মহিলাটির অসহায় জবাব......
" কিডনী সমস্যা, অপারেশন করতে হইবো।"
" ও। আমি ছাত্র মানুষ। অল্প দিলাম, কিছু মনে করবেন না।"
আমার এমন কথায় মুখ দেখে মনে হয় আমার কাছে অল্প পাওয়াতে নয় বরং আমার কাছে হাত পাতাতেই তার মনে অনেক সংকোচ আর পরিতাপ। তারপরও বাঙালী নারীর পতি বলে কথা! স্বামীর ব্যাধিগ্রস্থের জন্য মানুষের দারস্থ হয়েছে সিঁথির সিঁদুর না মুছার প্রত্যয়ে। স্বামীর জন্য বাঙালী নারীরা যত সহজে অন্যের নিকট হাত পাততে পারে স্ত্রীর জন্য বাঙালী পুরুষেরা এত সহজে অন্যের নিকট হাত পাততে পারে বলে মনে হয় না। তবে এখন এমন স্বামী ভক্তী নারী পাওয়া খুবই মুশকিল। যে নারী লাঞ্চনা গঞ্জনা ধৈর্যসহ স্বৈর্য করে স্বামীর জন্য ভিক্ষা করবে।
(সংক্ষেপিত)
সোহাগ তানভীর সাকিব
গল্পলেখক
[email protected]
©somewhere in net ltd.