নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সময়ের দর্পণ

সোহাগ তানভীর সাকিব

বাস্তবতাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানোর ক্ষুদ্র প্রয়াস।

সোহাগ তানভীর সাকিব › বিস্তারিত পোস্টঃ

আমাদের মান্নান স্যার

০১ লা নভেম্বর, ২০১৭ রাত ১১:৩৫



আমাদের সময় সপ্তম শ্রেণীর শ্রেণী শিক্ষক ছিলেন মান্নান স্যার। যেহেতু তিনি সে সময়ে সপ্তম শ্রেণীর নিচে কোনো ক্লাসে ক্লাস নিতেন না তাই ষষ্ঠ শ্রেণী থেকেই স্যারের ব্যক্তিত্ব আঁচ করে স্যারের ক্লাস করার জন্য মুখিয়ে থাকি।
তারপর ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে উত্তীর্ণ হয়ে জানুয়ারী মাসের প্রথম দিন সকালে স্যারের ক্লাস সপ্তম শ্রেণীতে প্রবেশ করি। অফিস রুম থেকে হাজিরা খাতা, চক, ডাস্টার আর বেত হতে করে স্যার ক্লাসে আসতেন। নাম হাজিরা দিয়ে ক্লাস শুরু করতেন, আর শেষ করতেন ব্ল্যাডবোর্ড মুছে। সপ্তম শ্রেণীতে আব্দুল মান্নান স্যার আমাদের সাধারণ গণিত এবং সাধারণ বিজ্ঞান পড়াতেন। গণিত বইয়ের শুরু থেকে প্রতিটা অঙ্কের সমাধান খুবই সহজভাবে উপস্থাপন করতেন তিনি। গণিতের কোনো সমাধান আমরা না বুঝলে বা বার বার প্রশ্ন করলে স্যারকে কোনোদিন বিরক্ত হতে দেখিনি। সপ্তাহের শেষ দুই দিন অর্থাৎ বুধ ও বৃহস্পতিবার নিতেন জ্যামিতির ক্লাস। সারা সপ্তাহ বেত শুধু নিয়েই আসতেন আর ব্যবহার করতেন জ্যামিতির ক্লাসের দু'দিন। বিশেষ করে যারা জ্যামিতি বক্স না নিয়ে ক্লাসে আসতো তাদের ওপর। তবে বীজ গণিত ক্লাসের দিনগুলিতে মাঝে মাঝে বীজ গণিতের সূত্রগুলি মুখস্ত ধরতেন। ভুল বললেই বেত দিয়ে দিতেন হাতের ওপর দুই ঘা। তবে সেটা খুবই স্বাভাবিক ভাবে।
স্যার সব সময় গণিত বা বিজ্ঞানের বিষয়গুলি আমাদের সামনে বাস্তবতার মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করতেন। জ্যামিতির ক্লাসে কাঠের কম্পাস নিয়ে এসে জ্যামিতির প্রতিটা চিত্র মাপ অনুসারে ব্ল্যাকবোর্ডে অঙ্কন করে আমাদের বুঝাতেন। সেই সপ্তম শ্রেণীর পর থেকে এখন পর্যন্ত আর কোনো স্যারকে পায় নি যে, ক্লাস করানোর সময় প্রদত্ত মান অনুসারে জ্যামিতিক চিত্র বোর্ডে অঙ্কন করেছেন।
জীবনের প্রথম বৈজ্ঞানিক কোনো বিষয় পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ দেখি আব্দুল মান্নান স্যারের ক্লাসে। "তাপ প্রয়োগে কঠিন পদার্থের আয়তন বৃদ্ধি পায় বা প্রসারণ ঘটে" বিজ্ঞানের এই বিষয়টি "রিং ও বল" পরীক্ষার মাধ্যমে সেই সপ্তম শ্রেণীতে প্রমাণ করে দেখিয়ে ছিলেন তিনি। সেটাই আমাদের জীবনের প্রথম দেখা বৈজ্ঞানিক কোনো বিষয়ের বাস্তব প্রমাণ।
একদিন দেখি, কাঠের তৈরি বিশাল এক স্কেল নিয়ে ক্লাসের দিকে আসছেন স্যার। লম্বায় স্কেলটির দৈর্ঘ্য প্রায় স্যারের দৈর্ঘ্যের সমান। স্যার ক্লাসে আসলে জানতে পারি ওটা হলো স্লাইডক্যালিপার্স।
বিজ্ঞান ভবনে এসব ব্যবহারিক জিনিষপত্র স্বপ্রণোদিত হয়ে নিজের তত্ত্বাবধানে যত্ন করে রাখতেন স্যার। নবম শ্রেণীতে আমাদের রসায়নের হাতেখড়ির স্যারের কাছেই হয়।
স্যার সবসময় আমাদেরকে তাঁর ছেলেদের মতই ভালোবাসতেন। ক্লাসে একদিন স্যারকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম.......
- "স্যার, আপনার ছেলে মেয়ে কয়ডা?"
-" আমার ছেলে মেয়ে তো অসংখ্য।"
মুচকি হেসে বলেছিলেন স্যার।
স্যার ছিলেন আলোর মশাল। সেখান থেকে অসংখ্য প্রদীপ আজ আলোকিত। আমি যতদূর জানি, দেশে এবং দেশের বাইরে অনেক উচ্চ পর্যায়ে পর্যন্ত অবস্থান করছে স্যার কর্তৃক বীজ বপণকৃত অনেক ফসল।
সপ্তম শ্রেণী থেকে প্রতি বছর রমযানে আমরা ইফতার পার্টি করি। ইফতার পার্টির নিমন্ত্রণ পত্র দিতে গেলে স্যার প্রতিবার-ই একই কথা বলে....
"-ইফতারির সময় তো আমি থাকতে পারবো না। আমার বদলে কোনো গরীব মানুষকে দাওয়াত দিতে পারলে না?"
স্যারের মন মানুষিকতা ছিল এমন উদার।
স্মার্টনেস যে কি সেটা সেই সপ্তম শ্রেণী থেকে স্যারকে দেখে বুঝেছি। কেতাদূরস্ত মান্নান স্যার সবসময় স্মার্টলি ভাব বজায়ে রাখতেন। তাঁর চলন বলন এবং পড়ানোর ধরন সবকিছুতেই ছিল স্মার্টনেসের প্রভাব। পড়ানোর কৌশল আর বুঝানোর স্পষ্টতায় স্বল্পভাষী অত্যান্ত ভদ্র মান্নান স্যার আমাদের কাছে ছিল খুবই প্রিয় । নিয়মানুবর্তিতা আর দায়িত্ব সচেতনতা ছিল স্যারের স্বভাবের একটা বিশেষ গুণ। পারতো পক্ষে তিনি ক্লাস মিস দিতেন না।
২০১২ সালে আমাদের বিদায় অনুষ্ঠানের দিন স্যারের ফর্সা মুখের হাসির আড়ালে দেখেছি মলিনতার ছায়া। সেই মলিনতার মানে তখন বুঝতে না পারলেও এখন ঠিকই বুঝি।
বিদায় নিয়ে চলে আসার পর পাবনা শহরে কিংবা শিবপুর গেলে মাঝে মাঝে স্যারের সাথে দেখা হতো। স্যার অত্যান্ত আগ্রহী হয়ে খোঁজ খবর নিতেন। আমাদের সফলতার কথায় স্যারের মুখে তৃপ্তিদায়ক হাসি দেখতে পেতাম। শেষে স্যার বলতো.....
-" আমার ছেলেদের জন্যও দোয়া কোরো। বড়টা তো রংপুর মেডিকেলে পড়ছে, ওটাকে নিয়ে আর বেশি চিন্তা নাই। এখন ছোটটাকে নিয়েই কেবল চিন্তা।"
সেই ছোট ছেলের চিকিৎসা করাতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি।
সম্রাট বাবরের পুত্র হুমায়ূন মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হলে বাবর নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও পুত্রের সুস্থতা কামনা করে প্রার্থনা করে। মহান আল্লাহ তায়ালা সম্রাট বাবরের প্রার্থনা কবুল করেন। ফলে হুমায়ূন সুস্থ্ হলেও বাবর এহলোক ত্যাগ করে।
হতে পারে আব্দুল মান্নান স্যার এমন কিছু কামনা করেছিলেন। কারণ, পৃথিবীতে সবচেয়ে ভারী বস্তু হলো পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ। পিতা সন্তানের বাঁধে চড়ে কবরস্থানে যাওয়ার কামনা করলেও সন্তানকে বাঁধে করে কবরস্থানে যাওয়ার কামনা কখনও কোনো পিতা করে না।
স্যারকে নিয়ে এতই স্মৃতি জমা রয়েছে যে, শুধু লিখতেই মন চাইবে লেখা কখনও শেষ হবে না।
"একটি জীবনের অবসান।
নিভে যায় একটি আলোর প্রদীপ।
যে প্রদীপ করত সৃজন
আলোকিত রত্নদ্বীপ"
মহান আল্লাহ্ তায়ালা শ্রদ্ধেয় আব্দুল মান্নান স্যারকে যেন জান্নাতুল ফেরদাউস দান করেন আর স্যারের আওলাদদের সুস্থ রাখেন এবং স্যারের প্রিয়তম স্ত্রীকে ধৈর্য ধারণ করার তৌফিক দান করেন। আমীন।

স্যারের স্নেহধন্য ছাত্র
-সোহাগ তানভীর সাকিব
তেজগাঁও, ঢাকা।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.