নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সময়ের দর্পণ

সোহাগ তানভীর সাকিব

বাস্তবতাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানোর ক্ষুদ্র প্রয়াস।

সোহাগ তানভীর সাকিব › বিস্তারিত পোস্টঃ

একজন কাফি ও কিছু স্মৃতি

২৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:৪৩



একদিন বাড়িতে মা বলল, মজিদের ছাওয়া অয়ছে, শুনছিস?
- না। ছাওয়ালের পর আবার ছাওয়াল, ভালোই।
আমি বললাম।
- তোর বড় চাচি ফোন করে তাই কোলিয়ে।
- ও।
এভাবেই বড় চাচার মেঝ ছেলে মজিদ ভাইয়ায় দ্বিতীয় ছেলের জন্মগ্রহণের ব্যাপারটি জাননে পারি। তারপর একদিন শালগাড়িয়া বড় কাকার বাসায় গেলে চাচি হাসিমাখা মুখে বলে, মজিদের আবার ছাওয়াল অয়ছে শুনেছো?
আমাকে মিষ্টি খেতে দিতে দিতে চাচীর জিজ্ঞাসা। আমি মিষ্টি খেতে খেতে জবাব দিই,
- হ, শুনেছি।
- রাফি বলে, "দাদি ওর নাম কাফি। রাফির ভাই কাফি।" কলিয়েম, এতো আমারে দ্যাশের চেয়ারম্যানের নাম রে। কাফি চেয়ারম্যান।
বড় চাচির কথায় রস আছে। শুনতে ভালো লাগে। খুবই সহজ সরল তো। তাই সবকিছু সহজ ভাবে উপস্থাপন করে সবার কাছে। আমার কাছেও তাই করলো। নাতীর জন্মগ্রহণে যে বড় চাচী খুশি সেটা আর আমার বুঝতে বাকী থাকলো না।
তার কয়েক মাস পর গুরুবাসি ছোট ফুপুদের বাড়িতে কোনো এক অনুষ্ঠানে মজিদ রেবেকা দম্পতির সাথে দেখা হয়। সেই দিন-ই প্রথম কাফিকে দেখি। ছোট্ট কাফিকে কোলো নিয়ে বসে আছে রেবেকা ভাবি।
- কি ব্যাপার, ছেলের পর আবার ছেলে?
আমার এই কথার রসালো উপস্থাপনায় ভাবির মুখে মুসকি হাসি। হাসির রেস থাকতেই আবার ফ্যাজলামো,
- আবার হ্যাটট্রিক হয়ে যায় না যেন!
- না রে ভাই। এই দুইটাকে আগে ভালো করে মানুষ করি।
ভাবীর সরল উত্তর। আমাদের কথোপকনের মাঝে লক্ষ্যকরি, কাফির ডান হাতের বৃদ্ধা আঙ্গুল জমজ।
- এটা, এমন কেন?
ছোট্ট কাফির আঙুলের দিকে ইঙ্গিত করে ভাবিকে আমার জিজ্ঞাসা। ভাবির উত্তর,
- আল্লাহ এমন করেছে। এখন কি করবো বলো? আল্লাহর ইচ্ছায় তো আর কারো হাত নাই।
- তা নাই। তবে বাবা মায়ের বংশে কারো এমন থাকলে নাকি হয়। অর বাপের বংশে তো কারো এমন নাই।
- ওর মায়ের বংশেও নাই।
- তাহলে?
- ভেবেছিলাম, বড় হলে কলম-টলম ধরতে পারবে কিনা এজন্য অপারেশন করে জমজ আঙ্গুল সিঙ্গেল করে ফেলব। তা মুরব্বিরা নিষেধ করে। বলে, "আল্লাহ যেমন দেছে তেমন-ই থাক।"
সেবার রোজার ঈদের পর কাজিন ফূর্তির বিয়েতে মজিদ ভাইয়া ভাবি গ্রামের বাড়ি আসে। তখন পিচ্চি কাফিকে দেখেছি।
মজিদ ভাইয়া আমাদের কাজিন বা আত্মীয়দের নিয়ে যেমন মজা করেছে ঠিক তেমনি তার ছোট দুইটা ছেলেকে নিয়েও মেতে থেকেছে সারাক্ষণ। খুবই মজার মানুষ মজিদ ভাইয়া। দাদার মত। সবার সাথে হইহুলা করে বাড়ি-ঘর আনন্দে মাতিয়ে রাখতে ভালোবাসে। আমরা কাজিনেরা যেমন মজিদ ভাইয়াকে পছন্দ করি ঠিক তেমনি আমাদের মা, চাচি, ফুফুসহ সবাই মজিদ ভাইয়াকে পছন্দ করে। আবার রেবেকা ভাবিকেও সবাই পছন্দ করে। রেবেকা ভাবি আমাদের বাড়িতে আগত কোনো কাজিনের প্রথম বউ। তারপর আমার আরো কাজিন বিয়ে করেছে কিন্তু মজিদ ভাইয়ার বিয়ের মত মজা আর হয় নি। বিয়ের দিন থেকে রেবেকা ভাবি আমাদের সকল কাজিনের আত্মার সাথে মিশে আছে।
ঢাকায় আসার পর, একদিন বাড়ি থেকে আব্বা ফোন করে জানায়, মজিদ ভাইয়ার ছোট ছেলে কাফি নাকি খুব-ই অসুস্থ। ক্যান্সার হয়েছে। মজিদ ভাইয়াকে ফোন করে জানতে পারি ব্লাড ক্যান্সার।
একদিন সন্ধ্যায় বাড্ডা শাহজাদপুর গিয়ে মজিদ ভাইয়াকে ফোন করলে, ভাইয়া মটরসাইকেলে করে আমাকে তার বাসায় নিয়ে যায়। ভাইয়ার সাথে বাসায় প্রবেশ করে দেখি, ভাবি কোরআন তেলওয়াত করছে। কায়দা বই নিয়ে পাশে বসে আছে রাফি। আর কাফি আব্বুর আগমনে খুশিতে আত্মহারা হয়ে ছুটে আসে আব্বুর কাছে। আমি গেছি অসুস্থ কাফিকে দেখতে। কিন্তু কাফির প্রাণবন্ত ছুটাছুটি আর উৎস্বাস দেখে মনেই হয় না ও ব্লাড ক্যান্সারের মত মরণ ঘাতক রোগের রুগী। মাথায় চুল নাই কাফির, সব পরে গেছে। ভাইয়া জানায়, ক্রোম থেরাপি দেওয়ার কারণে মাথার সব চুল পরে গেছে। আবার উঠবে। সমস্যা নাই।
ভাইয়া আর ভাবি আমাকে আসতে দেয় না। সে রাত থাকতে হয়। রাতে ভাইয়া ভাবির সাথে পারিবারিক অনেক গল্প করি। শুনি কাফির অসুস্থতা সম্পর্কে অনেক কথা। আপাতত অশংকা মুক্ত। ডাক্তার নিয়মিত চিকিৎসা সংক্রান্ত একটা বই বানিয়ে দিয়েছে, বইয়ের নির্দিষ্ট তারিখ অনুযায়ী শুধু একটা করে ইন্জেকশন দিতে হবে। এভাবে সাত বছর বয়স পর্যন্ত ইন্জেকশন দিলেই কোর্স কমপ্লিট। ওর বয়স এখন যেহেতু চার তাই তিন বছর ধরে দিতে হবে। পাশে রাফি আর কাফি। আমি কাফিকে কোলে নিয়ে আদর করতে চাইলে আমার কাছে আছে না। ভাবি বলে.....
- কিছু সময় যাক, তারপর দেখো তোমাকে কি করে।
সত্যি কিছু সময়ের মধ্যেই কাফির সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়ে যায়। সব সময় আমার পাশে থাকে।
সকালে ঘুম ভাঙ্গলেই আমার রুমে চলে আসে কাফি।

বই নিয়ে এসে আমাকে বিভিন্ন পশু পাখির ছবি দেখায়, আর নাম বলে। যে পাখিটার নাম কাফি বলতে পারে না; সেটা আমি বলে দিই। খাতা নিয়ে আসে। কলম দিয়ে লেখে খাতায়। জোড়া বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়েই কলম ধরে। অসুবিধা হয় বলে মনে হয় না। কাফি আমার পাশে শুয়ে থাকে। আমার ফোন দিয়ে সেলফি তোলে। রাফিও থাকে পাশে।
তারপর আরো একদিন বাড্ডায় মজিদ ভাইয়ার বাসায় যাই। ভাই ভাবি বলেছে, আমার যখন মন চায় তখন-ই যেন তাদের বাসায় যাই। তেজগাঁও থাকি; আর তাছাড়া বাড্ডার ওদিকে তেমন একটা যাওয়া হয় না। যে দুদিন বাড্ডা গিয়েছি মজিদ ভাইয়ার বাসাকে উদ্দেশ্য করে গিয়েছি। তো সেদিন বিকালে গিয়ে দেখি মজিদ ভাইয়া বাসায় নাই। রাফি আর কাফি দুই ভাই টিভিতে কার্টুন দেখছে। কার্টুন দেখলেও দু'জনের হাতে দুইটা ফোন। ফোনে গেম চালু। আমি চিপসে্র প্যাকেট দিলে সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নাই। সব ভ্রুক্ষেপ ফোনের দিকে। দু ভাই স্থীর থাকে না। ছোটাছুটি করে বাসা মাতিয়ে রাখে।
- ভাইয়া কই?
- অফিসে।
- শনিবারেও অফিস?
- ওর আবার শুক্র শনি আছে।
- সরকারী চাকুরীদের তো শুক্র শনি দুই দিন ছুটি।
- ওর কোনো ছুটি নাই।
ভাবির সাথে আলাপের এক পর্যায়ে রাফি বেলকনি থেকে দৌড়ে এসে খরব দেয়, বারান্দায় বানর। বড় ভাইয়ের খবর শুনে আমার পাশে থেকে কাফি দৌড়ে বারান্দায় যায়। কিছু সময় পর দৌড়ে এসে আমাকে ভাবিকে বারন্দায় ডেকে নিয়ে যায়। দেখি,সামনের ভবনের কার্ণিশে বড়সড় একটা বানর লাফালাফি করছে। বানর দেখে রাফি আর কাফি খুশিতে দিশেহারা। কাফি বারান্দার গ্রীল বেয়ে ওঠে ভালো ভাবে দেখার জন্য। আমি কাফিকে গ্রীলের সাথে লেগে থাকার জন্য পেছন থেকে সার্পোট দিই। রাফি কাফি দু ভাই গলা ফাঁটানো চিৎকার করে.........
- বানর!
- এই বানর!! কলা খাবি?
বানরটি আকৃতিতে একটু বড়। রাস্তার পাশে বানরটির রং ঘং দেখতে বেশ কিছু বাচ্চা জমায়েত হয়। রাফি আর কাফির মত আমারও ভালো লাগে।
সেদিনও ভাইয়া আর ভাবির আন্তরিকতার কাছে পরাস্ত হয়ে রাত্রি যাপন করতে হয় আমাকে। সন্ধ্যায় ভাইয়া অফিস থেকে এসে-ই কাফিকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যায়। ভাবিও সাথে যায়। আমাকে টিভি দেখতে বলে যায়। আমি রাফির সাথে টিভি দেখি।
সেই রাতেও ভাইয়া ভাবির সাথে অনেক গল্প হয়। কাফি এখন অনেকা শঙ্কা মুক্ত জেনে খুবই ভালো লাগে। আমার কথার মাঝে কাফি কিছু সময় পর পর ঘুরে এসে হ্যান্ডশেক করে আর বলে......
- সালামাইকুম, ভালো আছেন?
মূলত এটা ওর আব্বুর কথা কপি করে উপস্থাপন করে কাফি। আমারও তার এমন উপস্থানাকে ওর চাহিদা মতই মুল্যায়ন করি।
সেই দিন আর আগে একদিন এই মোট দু'দিন মজিদ ভাইয়ার বাসায় যাওয়াতেই কাফির সাথে আমার বন্ধুত্ব ঘনিষ্ঠ হয়ে যায়। রাতে শোয়ার আগে ওষুধ খাওয়া, ইলেক্ট্রিক থেরাপি নেওয়া। সব কিছু আমার কোলে বসে থেকে গ্রহণ করে কাফি। সেই রাতে কাফি আমার সাথে ঘুমাবে। রাতে আমার বিছানা থেকে কিছুতেই ভাবি কাফিকে নিয়ে যেতে পারে না। নিয়ে গেলেও আবার আমার কাছে চলে আসে সে। অবশেষে কাফি ঘুম আসার পর ভাবি নিয়ে যায়। কারণ, অসুস্থ কাফি রাতে মায়ের কাছে থাকাই ভালো।
মাত্র একদিনের ঘনিষ্ঠতায় কাফি আমাকে এতো কাছে টেনে নিবে ভাবতেই পারি নি।
শেষবার কাফি অসুস্থ হওয়ার সংবাদ বাড়ি থেকে আব্বা ফোন করে জানায়। মজিদ ভাইয়াকে ফোন করে নিশ্চিত হই এবং জানতে পারি ঢাকা মেডিকেলে আছে। বিকালে ছুটে যাই ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে। মজিদ ভাইয়া ফোন করে জানতে পারি পিজি হাসপাতালে আছে।
আই ই বি থেকে ক্লাস শেষ করে রাত আটটায় পিজি হাসপাতালের ডি ব্লকের তৃতীয় তলায় গিয়ে মজিদ ভাইয়াকে ফোন করি। যে মজিদ ভাইয়া আমাদের সকল কাজিনদের প্রাণবন্ত রাখে সেই মজিদ ভাইয়াকে খুবই বিবর্ণ আর চিন্তগ্রস্ত দেখি। আমাকে রুমের ভেতর পাঠিয়ে দিয়ে বাহিরে ভাইয়া অপেক্ষা।
আমি শায়িত কাফির বেডের পাশে যেতেই স্নেহের মণি নাড়ি ছেঁড়া ধন কাফিকে জড়িয়ে ধরে ভাবি আর্তনাদ করে.........
- আমার সব শেষ সোহাগ!, আমার এতোদিনের সব কষ্ট বিফলে।
আমার চোখের কনায়ও পানি চলে আসে। পরিস্থিতি আন্দাজ করেই হয়তো মজিদ ভাইয়া আমার সাথে ভেতরে আসে নি।

ছেলের চিন্তায় চিন্তায় ভাবির অবস্থা একেবারে হাড়ির হাল। মৃত্যু সজ্জায় শায়িত সন্তানের মা কে শান্তনা দেওয়ার ভাষা আমার জানা নাই।
আমি ভেতরে বেশি দেড়ি করি না। বাহিরে এসে মজিদ ভাইয়া আর কাফির বড় মামার সাথে দেখা করি।
তার পর দিন বিকালে আমি কোন একটি কাজে কারওয়ান বাজার যাই। গাড়ি যানজটে আটকে আছে। আব্বা ফোন করে জানায়, কাফি মারা গেছে। আমি গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে-ই কারওয়ান বাজার থেকে শাহবাগ যাই। পিজি হাসপাতালের ডি-ব্লকের তৃতীয় তলায়। রুমের সামনে মজিদ ভাইয়ার সাথে দেখা। আমাকে জড়িয়ে ধরে মজিদ ভাইয়া বাচ্চাদের মত কাঁদে। জীবনের প্রথম সেদিন মজিদ ভাইয়াকে কাঁদতে দেখি। পাশে উপস্থিত রাজ্জাক ভাইয়া আর টুটুল ভাই (কাফির বড় মামা) নিজ নিজ চোখের পানি মুছে। ঝরঝর করে আমার চোখ দিয়ে বেরিয়ে আসে পানি।
চোখ মুছে রুমের ভেতরে গিয়ে দেখি কাফির নিথর নিস্তব্দ দেহ বেডে ওপর। পাশে ভাবি পুত্র শোকে আর্তনাদ করছে। কখনও জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে ভাবি।
আমার চোখ ঝাপসা। কানে ধ্বনিত হচ্ছে কাফির সেদিনের সেই কথা
"সালামাইকুম, ভালো আছেন?"

-সোহাগ তানভীর সাকিব
তেজগাঁও, ঢাকা।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ০৯ ই মার্চ, ২০১৮ রাত ১২:১৮

ওমেরা বলেছেন: উঃ---------কি ভয়ংকর কষ্টের লিখাটা । আল্লাহ কাফিকে জান্নাত দান করুন ।আমীন

০৯ ই মার্চ, ২০১৮ সকাল ৭:৪৫

সোহাগ তানভীর সাকিব বলেছেন: হুম,খুব-ই কষ্টের লেখা। একদম বাস্তব কাহিনী। আল্লাহ আপনার দোয়া কবুল করুক---আমীন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.