নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লন্ডনে প্রথম পর্ব
লন্ডন শহরে আমার প্রথম আস ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে। আমার মা-বাবা, ভাই, বোন তখন থাকতেন বার্মিংহামে। সেই সময় লন্ডন শহরকে আমার কাছে ঢাকা শহরের মতো মনে হতো। আর বার্মিংহামকে মনে হতো সিলেট। তখন লন্ডনে আমাদের অনেক আত্মীয় থাকলেও আমার কাছে খুব আপন বলতে ছিলেন হোসনা খালা, তিনি হলেন আমার মায়ের মামাতো বোন। কেন আপন লাগতো একটু ব্যাখ্যা করি। তিনি খালা, আদর করতেন-ই। আমি আগের এক লেখায় বলেছি আমার মায়ের মামুর বাড়ি মায়ার সাগর। আমার মা তাঁর মামুদরে বড় বোনের বড় মেয়ে। অধিকারটাই আলাদা। হোসনা খালার স্বামী সৈয়দ খসরু মিয়া একজন ভালো পাঠক এবং ভালো মানুষ। আমি বয়সে অনেক ছোট হলেও বই নিয়ে তাঁর সাথে খুব আলোচনা জমতো। হোসনা খালার শশুড় সৈয়দ আবরু মিয়া বৃটেন এসেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে বা পরে। আমার দাদাদের সাথে ছিলো তাঁর খুব সখ্য। তিনি এবং আমার আব্বার দুজন চাচা ছিলেন জাহাজের কর্মচারী। হোসনা খালা থাকতেন লন্ডনের পপলারের কারি হাউসে। কারি হাউসে তখন থাকতেন আমার বাবার চাচাতো ভাই সৈয়দ আব্দুল মুহিত, যিনি বিশিষ্ট লেখক সৈয়দ জগলুল পাশা, সাংবাদিক সৈয়দ নাহাস পাশা, সাংবাদিক সৈয়দ বেলাল পাশার আব্বা। জগলুল ভাইয়ের আম্মা ছিলেন এক অসাধারণ মহিলা। কথায় কথায় গান গাইতেন। সবাইকে খুব আপন করে নিতেন। আমাদের পরিবারের সবার উপর ছিলো তাঁর খুব কর্তৃত্ব, কারণ আব্দুল মুহিত চাচা ছিলেন আমার বাপ-চাচাদের বয়সে বড়। আমার আব্বা খুব গরম মানুষ, কিন্তু আব্বার উপরও ছিলো চাচির কর্তৃত্ব। জগলুল ভাই তো ঢাকায় সচিবালয়ে চাকুরী করেন, ভাবিও ঢাকায় থাকেন। জগলুল ভাইয়ের বিয়ের পর ভাবি যখন সিলেট থাকতেন তখন সুযোগ পেলেই ভাবিকে দেখতে চলে যেতাম। তখন মোবাইলের যোগ নয়। ছিলো টেলিফোন। আব্বাকে ফাঁকি দিয়ে সুযোগ পেলেই ভাবিকে টেলিফোন করে না রঙের কথা বলতাম। তখন আমাদের বংশে ভাবি বলতে তিনিই ছিলেন। ভাবিও আমাদেরকে খুব আদর করতেন। অতঃপর আমরা চলে আসি লন্ডনে আর ভাবি চলে যান ঢাকায়। ঢাকায় গেলে আগে মাঝেমধ্যে তাদের বাসায় যাওয়া হতো, তখন জগলুল ভাই থাকতেন আজিমপুর সরকারি কলোনিতে। এখন নিজেরই সময় নেই। নাহাস ভাইয়ের বউও এক অসাধারণ মহিলা। ভাবির সাথে আমার ঘণিষ্টতা হয় লন্ডনের কারি হাউসে। কারি হাউসে গেলে দীর্ঘ আলাপ হতো ভাবির সাথে। অনেকদিন এক সাথে খাওয়া-দাওয়াও হয়েছে। বেলাল ভাই বিয়ে করেছেন বেশ পরে। ফলে ভাবির সাথে ঘণিষ্টতা তেমন হয়ে উঠেনি।
সেই সময় আপ্টনপার্কে থাকতেন তুতা নানা। সৈয়দ তুতা মিয়া হলেন আমার নানার আপন মামাতু ভাই। আবার তুতা নানার বউ হলেন আমার নানির চাচাতো বোন। ইষ্ট লন্ডন মসজিদে মাঝেমধ্যে তুতা নানার সাথে আমার দেখা হলেই তিনি যাওয়ার জন্য বলতেন। একদিন সত্যি গিয়ে হাজির হলাম। নানা-নানি-খালারা খুব আদর করলেন। বয়সে বেশ ছোট একজন মামা ছিলেন। এর পর থেকে মাঝেমধ্যে তুতা নানার ঘরেও যাওয়া-আসা হতো। লন্ডনে নুরুল আমিন ভাই ও সমসুল ভাইয়ের ঘরেও মাঝেমধ্যে যাওয়া আসা হতো। তবে সেই সময় সব চাইতে আপনজনের মতো গার্জিয়ান ছিলেন আমার সম্পর্কে খালাতো ভাই শেখ আব্দুন নুর। শেখ নুর বা শেখ সাব হিসেবে তিনি লন্ডনে সেই সময় খুব পরিচিত ছিলেন। সেই সময় লন্ডনের কমিউনিটিতে এক শেখ আর এক সৈয়দের খুব কর্তৃত্ব ছিলো। শেখ বললে আব্দুন নুর, আর সৈয়দ বললে সৈয়দ দুলুকে বুঝাতো। আমি বলছি ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দের কথা। সৈয়দ দুলু হচ্ছেন বর্তমান আওয়ামীলীগের যুক্তরাজ্য শাখার সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাজেদুর রহমান ফারুকের বড় ভাই। সৈয়দ ফারুকের সাথে আমার চাচাতো বোন রেখার বিয়ে হয় বেশ পরে।
২০০০খ্রিস্টাব্দে এসে আমি বাংলাদেশের স্থায়ী বাসিন্দা। মাঝেমধ্যে ভাই-বোন-আত্মীয় স্বজনকে দেখতে আসি। এখন লন্ডন শহরে আমার আপনজন, বন্ধু-বান্ধবের কোন অভাব নেই। আমার নানি, তিন মামা, এক বোন, দুই চাচাতো বোন ছাড়াও অনেক আত্মীয়-স্বজন থাকেন লন্ডন শহরে। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে বৃটেন সফরে এসে বেশ ক’বারই লন্ডনে যাই।
লন্ডনে পা রেখেই প্রথমে দেখতে যাই নানিকে। নানির স্থায়ি ঠিকানা মেঝ মামা আহমদ কুতুবের সাথে। মেঝমামা দীর্ঘদিন সৌদিতে ছিলেন। বর্তমানে লন্ডনে আছেন। তিনি লন্ডনের কমিউনিটির সাথে খুব দ্রুত মিশে গেছেন। বর্তমান লন্ডনের জনপ্রিয় মেয়র লুৎফুর রহমানের সাথে তাঁর খুব ঘণিষ্টতা রয়েছে। লুৎফুর রহমানকে যখন লেবার পার্টি মনোনয়ন দিলো না মৌলবাদির অভিযোগে তখন তিনি স্বতন্ত্রভাবে দাঁড়িয়ে যান। সেই নির্বাচনের সময় আমি লন্ডনে ছিলাম। মামাকে দেখেছি খেয়ে-না খেয়ে লুৎফুর রহমানের জন্য দৌঁড়ছেন। বিপুল ভোটে সেদিন লেবার মনোনিত প্রার্থীকে পরাজিত করে লুৎফুর রহমান বিজয়ী হয়েছিলেন। এবারও এসে দেখি মামা সর্বদাই চেষ্টা করেন লুৎফুর রহমানের জনপ্রিয়তাকে ধরে রাখতে। আমাকে লন্ডন নিয়ে এসেছে কবি প্রাবন্ধিক মোহাম্মদ মারুফ। লন্ডনের ওয়াটারলিলি হলে একটা অনুষ্ঠান ছিলো। সেখানে দেখা হয় আমার ভগ্নিপতি অধ্যাপক মাওলানা আব্দুল কাদের সালেহ, মেঝমামা, কবি আব্দুল কাইয়ূম, কবি শাহ সোহেল প্রমূখের সাথে। আমরা একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া করি। সেখান থেকে মারুফ আমাকে মেঝমামার ঘরে দিয়ে বার্মিংহামে চলে যায়। নানি তখন ছোটমামার ঘরে। আমি রাতে থেকে যাই মেঝমামার ঘরে। সকালে আমার দ্বিতীয় বোন লিমা আসে আমাকে দেখার জন্য। সে বেশ দূরে থাকে। তার সাথে দীর্ঘ আলাপ করি। এবার তাদের ঘরে যাবো না, কারণ আমি এখনও গাড়ির ব্যবস্থা করতে পারি নি। লিমাকে বিদায় দিয়ে আমি ছোটমামার ঘরে আসি। ছোট মামা আহমদ ময়েজ লেখালেখির জগতে খুবই পরিচিত, বিশেষ করে লিটেলম্যাগ ঘরে। তিনি ভূমিজ নামে একটি লিটেলম্যাগের সম্পাদক। লন্ডনের জনপ্রিয় বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা সুরমার সাহিত্য সম্পাদক। ছোট মামার ঘরে গিয়ে দেখি নানি অজু করে নামাজের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। আমি মনে মনে সুবহানাল্লাহ পড়তে থাকলাম। আমার নানি নামাজে দাঁড়ালে খবর আছে। নানি নামাজ পড়েন খুব দীর্ঘ সময় নিয়ে। তাঁর দু রাকাত নামাজের সাথে অন্যজন ১০ রাকাত পড়ে নিতে পারবে। দীর্ঘ কিয়াম, দীর্ঘ রুকু, দীর্ঘ সেজদা নানির আজীবনের অভ্যাস। ছোটমামা আমাকে বললেনÑআম্মা নামাজে দাঁড়ানোর আগে দেখা করে নে, নতুবা দীর্ঘ সময় বসতে হবে।
এই দিন রাতে ১০টার দিকে ছোট মামা, আমি, শাহ সোহেল, কবি আব্দুল কাইয়ূম ঘুরতে যাই লিটলম্যাগ শব্দপাঠের সম্পাদক কবি আবু মকসুদের রেষ্টুরেন্টে। সেখানে কবি কাজল রশিদ ও আতাউর রহমান মিলাদ ভাইও আসার কথা ছিলো। কিন্তু আমাদের যেতে দেরি হওয়ায় তারা কেউ আসেন নি। আমরা আবু মকসুদ ভাইয়ের রেষ্টুরেন্টে খাওয়া-দাওয়া করি। সেখানে বসে সিদ্ধান্ত হয় বাংলাদেশের প্রচীনতম পত্রিকা আল-ইসলাহের ৮১ বছরের প্রথম সংখ্যার অন্তরঙ্গ পাঠ অনুষ্ঠান করা হবে। প্রস্তাবটা ছিলো আবু মকসুদ ভাইয়ের। এবং তাঁর সুবিধার জন্যই ১৬ মে ২০১৩ খ্রিস্টাব্দের বৃহস্পতিবার তারিখ নির্ধারণ করা হয়। আবু মকসুদ ভাইয়ের রেষ্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে আমরা চলে আসি লন্ডনের সাপ্তাহিক পত্রিকা অফিসে। রাত তখন দুইটা, তখনও কাজ করছেন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ও লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মুহাম্মদ বেলাল আহমদ, সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক ও লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এমদাদুল হক চৌধুরী। তাঁরা দুজনই আমাকে খুব ¯েœহ করেন। এমদাদুল হক চৌধুরী বারবার চা খাওয়ার জন্য অনুরোধ করলেও আমরা আপত্তি করলাম। ছোট মামা মুহাম্মদ বেলাল আহমদকে আল-ইসলাহের অনুষ্ঠানের কথা বলে হল বুকিং করতে বলেন। আমরা চলে আসি ঘরে। খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ। ঘুমিয়ে যাই।
পরদিন আমার বন্ধু মিলন ভাই এসে আমাকে নিয়ে যান তাঁর ঘরে। ষ্টাটফোট লাইব্রেরীর কাছেই মিলন ভাইয়ের একটা মিনি মার্কেট আছে। আমি মিলন ভাইয়ের সাথে তাঁর মিরি মার্কেটে চলে যাই। রাত ৯ টার দিকে মেঝমামা গাড়ি নিয়ে আসেন, সাথে তাঁর ছোট মামাও, যাবো বড় মামার ঘরে। বড় মামা হলেন অধ্যাপক কবি ফরীদ আহমদ রেজা। বড় মামানী আমার নানির মতোই একজন পিরানি। আমার নানি কিংবা বড় মামানি পিরানি বলে যে দুনিয়ার খবর রাখেন না, তা কিন্তু নয়। তাদের কাছে সব খবরই আছে। মামানি তো সিলেট মহিলা কলেজের নেত্রী ছিলেন ছাত্র জীবনে। তাঁর বাবা জনাব আব্দুল আজিজ খান ছিলেন সিলেট মহিলা কলেজের প্রধান দু’জন প্রতিষ্ঠাতার একজন। আরেকজন ছিলেন কৃষ্ণ কুমার পাল, অর্থাৎ কে কে পাল। আব্দুল আজিজ খান সিলেট গোটাটিকর আলিয়া মাদরাসারও প্রতিষ্ঠাতা। পাকিস্তান যুগে তিনি গোটাটিকর ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বারও ছিলেন। নানা খুব নেক এবং জ্ঞানী মানুষ ছিলেন। আমার খুব গর্ব হতো তিনি আমার লেখার একান্ত পাঠকও ছিলেন। দেখা হলেই আমার বিভিন্ন লেখা নিয়ে আলোচনা করতেন। আমাকে খুব মহব্বত করনে। মামানির মধ্যে তাঁর বাবার অনেক গুণ আমি দেখতে পাই। মামানি কর্ম জীবনের শুরুর দিকে ছিলেন সিলেট নয়াসড়ক মহিলা হাইস্কুলের শিক্ষিকা (স্কুলের নাম এই মূহুর্তে মেমরি থেকে নাই হয়ে গেছে)।
বড় মামার ঘর থেকে মেঝমামা আমাকে আবার মিলন ভাইয়ের বাসায় নামিয়ে দিলে, কারণ পরদিন মিলন ভাই আমাকে বার্মিংহামে পৌঁছিয়ে দেবেন।
মিলন ভাই একটু আধ্যাত্মিক লাইনের মানুষ। তিনি লেস্টাওে একজন গোজরাটি পীরের মুরিদ। পীরের নাম মাওলানা সেলিম দাউরাত। মাওলানা সেলিম দাউরাত হলেন তাবলিগী নেসাবের লেখক শায়খুল হাদিস মাওলানা জাকারিয়া (র.) এর খলিফা এবং ইংল্যান্ডের বিখ্যাত মাদরাসা দারুল উলূম বেরির প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইউসুফ মুতালার ছাত্র। মিলন ভাই মাসে একদিন তাঁর পীর সাহেবের সহবতে যান। তালিম-তরবিয়ত করেন। তিনি আমাকে জিজ্ঞাস করলেন আমি যাবো কি না? রাতে মসজিদে থাকতে হবে। আমি সম্মতি দিলে তিনি লেস্টারের দিকে যেতে থাকেন। পথে কিডিমিনিস্টার মাদরাসা থেকে তার ছেলে ওমরকে সাথে নিলেন। এক রাত লেষ্টার মসজিদে শত শত মানুষের সাথে খুব ভালো লাগলো। আমার খুব ইচ্ছে হলো মাওলানা সেলিম দাউরাতের সাথে একান্ত কিছু কথা বলতে। আমি তাঁর কাছে মিলন ভাইয়ের মাধ্যমে সময় চাইলে তিনি সকালে আমাকে ১০ মিনিট সময় দিলেন। আমি কিছু সময় তাঁর সাথে নিজের আমালি জীবন নিয়ে আলাপ করলাম। তিনি আমাকে কিছু দিক নির্দেশনা দিলেন। লেষ্টারে থাকে আমাদের মহল্লার এক ছোট ভাই, জাকারিয়া। তাঁকে ফোন দিলে সে সকালে মসজিদে এসে আমার সাথে দেখা করে। দীর্ঘ আলাপ হয় তার সাথে। দশটায় আমরা বার্মিংহামের দিকে যাত্রা শুরু করি।
©somewhere in net ltd.