নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এপ্রিলফুল এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা--
-: সৈয়দ মবনু :-
আমি একজন মানুষ হিসেবে যদি চিন্তা করি, তবে বলবো, এপ্রিল ফুল উদযাপন মানবতা বিরোধী। কারণ মানবতা কখনো ধোঁকা আর মিথ্যাকে প্রশ্রয় দেয় না। এ প্রসঙ্গে আমি এপ্রিল ফুল উপযাপনের একটি উপমা উল্লেখ করছি: একজন কর্মচারী সকালে ঘুম থেকে উঠে কর্মস্থলে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছেন। হঠাৎ টেলিফোন ক্রিং ক্রিং করে উঠলো। কর্মচারী ভদ্রলোক রিসিভার হাতে নিয়ে বললেন-হ্যালো! অপর পাশ থেকে বলা হলো-আপনার শাশুড়ী হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে হাসপাতালে! ভদ্রলোক রিসিভার রেখে গোটা পরিবারকে নিয়ে ততক্ষনাৎ হাসপাতালের দিকে ছুটলেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখলেন সংবাদটি মিথ্যা। ফিরে আসেন বাসায়। আবার ফোন বেজে উঠলো। রিসিভার হাতে নিয়ে হ্যালো বলতেই অপর পাশ থেকে বলা হলো-এপ্রিল ফুল। ভদ্রলোকের আর করার কিছু নেই। মনে-মনে গালি দিয়ে কর্মস্থলের দিকে গেলেন। সেখানে যাবার পর দেরিতে কাজে আসার জন্য উপর ওয়ালা ডেকে নিয়ে তাকে ধমক দিলেন।
প্রিয় পাঠক! এ রকমের মিথ্যা আর ধোঁকাবাজীর মাধ্যমে এপ্রিল ফুল উদযাপনের ফলে একজন মানুষের সময় এবং অর্থ নষ্ট হয়। সাথে সাথে অহেতুক পেরেশানী এবং উপরওয়ালার গালিও শুনতে হয়।
এছাড়া কোমল ও সজীব হৃদয়ের ছোট ছেলে মেয়েদের ওপর ধোঁকাবাজীর প্রভাব বিস্তৃত হয়। আমাদের সবার জানা যে, সমাজে বড়রা যা করে ছোটরা তা অনুসরণ করে। কারণ ছোটদের হৃদয় থাকে উর্বর। বড়রা ছোটদের উর্বর মনে যা বপন করে তারা গড়ে উঠবে সেই চরিত্রে। আমি নিজে দেখেছি অনেক পরিবারে বড়রা এপ্রিল ফুল পালন করার ফলে ছোটরা এ দিনটিকে মিথ্যা বলার দিন হিসেবে চিহ্নিত করে নিয়েছে। যা অত্যন্ত দুঃখ এবং লজ্জাজনক। এক মানুষ অন্য মানুষকে মিথ্যা কথা বলে ধোঁকা দিয়ে যদি সময় এবং অর্থ নষ্টের মাধ্যমে কষ্ট দেয়, তবে তা নিতান্তই জঘন্য ও কুৎসিতমানসিকতার প্রকাশ ছাড়া কি হতে পারে? এ প্রেক্ষাপটে আমি বলতে বাধ্য ‘এপ্রিল ফুল’ উদযাপন সম্পূর্ণ মানবাধিকার বিরোধী।
যেহেতু বাংলাদেশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ তাই গণতান্ত্রিক কারণেও ‘এপ্রিল ফুল'কে ইসলামী দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। এপ্রিল ফুল শব্দটি ইসলাম এবং মুসলমানের জন্য একটি মর্মান্তিক ও লোমহর্ষক ইতিহাস। যে কারণে এপ্রিল ফুল পালিত হয় তা বড়ই করুন এবং মানবতার ইতিহাসে অত্যন্ত লজ্জাজনক। ধোঁকাবাজ ক্রসেডার গোষ্ঠী কর্তৃক মুসলিম উম্মাহর একটি অংশকে ধোঁকা দেবার ঘটনাই এপ্রিল ফুলের ইতিহাস। বর্বর ক্রুসেডার গোষ্ঠী মজলুম মানুষকে ধোঁকা দিয়ে কত নিমর্মভাবে হত্যা করতে পারে এপ্রিল ফুল তার ইতিহাস।
মুসলিম জাতি একদিন তাদের জ্ঞানের শীর্ষত্ব, বুদ্ধিমত্তা, ইসলামের মানবিক-নৈতিক চরিত্র ও আদর্শ এবং ঈমানী শক্তির মাধ্যমে সমস্ত বিশ্বকে সুখ-শান্তি আর সভ্যতার আলো দেখাতে সক্ষম হয়েছিলো। বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের দিশাহারা মানুষগুলো ইসলামের আদর্শ ধারণ করে সুখ-শান্তির স্পর্শ পেয়েছিলো। দলে-দলে মানুষ ইসলামের ছায়াতলে যখন আশ্রয় নিতে শুরু করলো তখন স্বৈরাচার, পুঁজিবাদী, জালেম শক্তির ভেতরে ভয়ের সঞ্চার হলো, তারা ইসলামকে প্রতিরোধ করার জন্য সংঘবদ্ধ হতে লাগলো। তারা বিভিন্ন কৌশলে ইসলাম এবং মুসলমানদের ওপর আক্রমণ শুরু করলে মুসলিম উম্মাহ তাদের আক্রমণের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতে লাগলেন। ৭১১ খ্রিষ্টাব্দের দিকে রডারিকের সুসজ্জিত বাহিনী মুসলমানদের ওপর আক্রমণ করলে মুসলমানরা তা প্রতিরোধ করেন। রডারিকের বিশাল বাহিনী সেদিন মুসলমানদের কাছে পরাজিত হলে স্পেনের মাটিতে ইসলামের সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর মুসলমানদের অক্লান্ত পরিশ্রম, কঠোর সাধানা, প্রচুর জ্ঞান-বুদ্ধি এবং মহান আল্লাহর উপর দৃঢ় বিশ্বাসের ফলে গ্রানাডা ও কর্ডোভায় ইসলামি সভ্যতা গড়ে উঠে। দীর্ঘ আট শতাব্দীর মতো স্পেনে মুসলিম শাসন চলে। দুঃখজনক হলেও সত্য স্পেনের মুসলমানগণ যখন কুরআন সুন্নাহর সংস্কৃতি ত্যাগ করে পাশ্চাত্যের নোংরা সংস্কৃতির চর্চা শুরু করলো এবং স্পেনের মুসলিম শাসক শ্রেণী নিজেরা ইসলাম বিরোধী নোংরা ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে গেলো, তখন ইসলামি চেতনার মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। শাসক শ্রেণী যখন জনসাধারণের কল্যাণ ও মঙ্গলকে বিলাসিতার অন্তরালে পদাঘাত করতে শুরু করে, তখন সৃষ্টি হয় শাসক এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে গড়ে উঠা ইসলামি ঐক্যের বিরাট ফাটল। মুসলমানদের মধ্যে সৃষ্ঠ ফাটলকে ইউরোপীয়ান ক্রুসেডারগোষ্ঠী সেদিন সংগঠিত হয়ে ঘোষণা করেছিলো: ‘পিরিনীজ পর্বতমালা অতিক্রমকারী দুর্ধর্ষ (?) মুসলিম বাহিনীকে যদি বিতাড়িত করা না যায়, তবে আগামী দিনে ইউরোপের সকল গির্জা থেকে মুসলমানদের আযান ধ্বনি শোনা যাবে।’
তখনকার খ্রিস্টান স¤প্রদায় তাদের ষড়যন্ত্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে স¤প্রসারিত করার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তৎকালীন পর্তুগীজের রাণী ইসাবেলার সঙ্গে পার্শ্ববর্তী রাজা ফার্ডিন্যান্ড বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলো। এই দু’জন মিলে মুসলমানদের ওপর ক্রমাগত আক্রমণ শুরু করে। আজকের বসনিয়ায় যেভাবে কুখ্যাত সার্ব বাহিনী ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রকাশ্য সহযোগিতায় অমানবিক নির্যাতন চালাচ্ছে, তেমনি সে দিন তা স্পেনেও ঘটেছিলো। ইসাবেলা ও তার স্বামীর অমানবিক নির্যাতনে স্পেনের মজলুম মুসলমানরা এক সময় সর্বহারা হয়ে রাজধানী গ্রানাডায় এসে আশ্রয় গ্রহণ করেন। মুসলমানদের বাড়ি-ঘর, সম্পত্তি, মসজিদ, মাদরাসাসহ জনবসতিগুলো ক্রমশ ক্রুসেডার গ্রানাডায় কিংকর্তব্রবিমূঢ় অবস্থায়, তখন ফার্ডিন্যাণ্ডের বাহিনী গ্রানাডার দ্বারপ্রান্তে এসে হাজির। মুসলমানদের ঈমানী চেতনায় দুর্বলতা দেখে রাজা ফার্ডিন্যান্ড ধূর্ত শিয়ালের মতো ঘোষণা করলো, ‘মুসলমানরা যদি গ্রানাডার প্রবেশ দ্বার উন্মুক্ত করে দেয় এবং নিরস্ত্র অবস্থায় মসজিদে গিয়ে অবস্থান করে, তবে তাদেরকে বিনা রক্তপাতে মুক্তি দেয়া হবে।’
তখনকার মুসলিম স্প্যানিস জাতি ফিলিস্তিনের ইয়াসির আরাফাতের মতো জালেমের বিরুদ্ধে জেহাদের পথ ত্যাগ করে ভ্রান্ত শান্তির নীল স্বপ্নে সত্যই মসজিদে আশ্রয় নিলো। হয়তো তাদের ধারণা ছিলো; জেহাদ না করে মসজিদে আশ্রয় নিলে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাবে। তারা ভুলে গিয়েছিলো-‘ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হর কারবালা কে বাদ।’ মুসলমানগণ যখন নিরস্ত্র অবস্থায় মসজিদে গিয়ে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে চাইলো, তখন ক্রুসেডার রাজা ফার্ডিন্যাণ্ড ও ইসাবেলার নরপশু বাহিনী মসজিদের চারিদিকে আগুন লাগিয়ে দেয়। ফলে হাজার-হাজার মুসলমান জ্বলে-পুড়ে মৃত্যুর কাছে পরাজিত হলো। সেদিন হাজার হাজার মুসলমানদের রক্তে লালে-লাল হলো গ্রানাডার রাজপথ। ধ্বংস হলো স্পেনের আটশত বছরের মুসলিম শাসন।
এভাবে ধোঁকা দিয়ে মুসলমানদেরকে হত্যা করার গৌরবে উল্লাসিত হয়ে সেদিন স্পেনের মাটিতে দাঁড়িয়ে কুখ্যাত ফার্ডিন্যান্ড চিৎকার দিয়ে বলেছিলো, ‘হায় মুসলিম জাতি, তোমারা সত্যই বোকা!’
১৪৯২ খ্রিষ্টাব্দের পহেলা এপ্রিল ফার্ডিন্যান্ড গ্রানাডায় ধোঁকা দিয়ে মুসলমানদেরকে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছিলো বলে পরবর্তীকালে ইউরোপের খ্রিস্টান জাতি তা উৎসব হিসেবে পালন করতে শুরু করে। এই উৎসবের নাম দেয় তারা ‘এপ্রিল ফুল’ অর্থাৎ এপ্রিলের বোকা। ধোঁকা দিয়ে একটি মানব স¤প্রদায়কে নরপশুর দল নির্মমভাবে হত্যা করলো যেদিন, সেদিনটিকে আমরা আনন্দের দিন হিসেবে উদ্যাপন করি কোন মানবতা নিয়ে? যে দিনের ইতিহাস মুসলিম উম্মাহর জন্য নিষ্ঠুর, হৃদয়বিদারক, সে দিনকে বাংলাদেশের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশে আনন্দ তামাশার দিন হিসেবে উদযাপন করা হয় কিভাবে? অত্যন্ত দুঃখ ও লজ্জাজনক বিষয় হলো এই যে, বোকা বানিয়ে যারা আমারই ভাইকে নির্মমভাবে হত্যা করলো, আজ আমরা তাদেরই সাথে তাল মিলিয়ে আনন্দ উৎসব করছি। আমরা একবারও ভাবি না; এপ্রিল ফুলের ইতিহাস আমাদের জন্য কত নির্মম বরং প্রতি বছর ক্রুসেডার বলে, সেভাবে ‘এপ্রিল ফুল’ উদযাপন করে আমাদেরকে গালি দিচ্ছি। আমাদের কার্যকলাপ থেকে স্পষ্ট; আজো আমরা ইতিহাসের অজ্ঞতার ফলে বোকা থেকে গেলাম। এর প্রমাণ আমরা এখনো নিজের সংস্কৃতি ত্যাগ করে অনন্ত মুগ্ধতার সাথে অন্যের সংস্কৃতি চর্চায় লিপ্ত। দেশ ও জাতির জন্য কোন কাজ মঙ্গল এবং কোন কাজ অমঙ্গল তা আমরা অনেক সময় তলিয়ে দেখি না। ইসলাম সম্পর্কে আমাদের মূর্খতার ফলে আমরা এপ্রিলে আমাদের শোচনীয় পরাজয়কে নিজেরাই পরম বিমুগ্ধ চিত্ততার সাথে উদযাপন করছি। অথচ আজ যদি আমরা সেদিনের ইতিহাস জানতাম তবে হাসি তামাশার পরিবর্তে চোখের জলে বুক ভাসাতাম। তৃপ্তির পরিবর্তে প্রচণ্ড কষ্ট পেতাম। যদি আমাদের সংস্কৃতির স্বরূপ জানা থাকতো তবে পহেলা এপ্রিল ‘এপ্রিল ফুল’ উদযাপন না করে শোক দিবস হিসেবে পালন করতাম। যারা মসজিদে আশ্রয় নিয়ে মৃত্যুর শিকার হয়েছে তাদের মাগফেরাতের জন্য মসজিদে বসে দোয়া করতাম।
এখনো বুঝার সময় আছে। তাই আসুন আমরা প্রতি বছর এপ্রিলের প্রথম তারিখে নিজে বোকা না হয়ে, অপরকে বোকা বানানোর চেষ্টা না করে, মিথ্যা আর ধোঁকবাজী ছেড়ে এই দিনে শোক দিবস পালন করি। আমাদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে বিজাতীয় সংস্কৃতির লালন নয় বরং তার বিরুদ্ধে শক্তিশালী দূর্গ গড়ে তোলার শপথই পহেলা এপ্রিলের প্রধান দাবী। স্মরণ রাখতে হবে; ইসলামই বাংলাদেশের সংস্কৃতির মূল মানদণ্ড।
[দৈনিক জালালাবাদ-২ এপ্রিল ১৯৯৪ ]
©somewhere in net ltd.