নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সুরা বাকারা সম্পর্কিত কিছু কথা
সুরা বাকারা, রুকু ৪০, আয়াত ২৮৬, মদিনায় অবতীর্ণ। বাকারা শব্দের অর্থ গাভী। এই সুরায় বনি ইসরাঈলের একটি বিশেষ ঘটনার প্রেক্ষিতে আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি গাভী জবাই করার ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। তাই এই সুরার নাম ‘বাকারা’ রাখা হয়। এই সুরা পবিত্র কোরআনের সবচে বড় সুরা। এই সুরার মতো অন্য কোন সুরায় এতো বেশি শরিয়তের আহকাম, রীতিনীতি এবং আদেশ-নিষেধ বর্ণিত হয়নি। তা ছাড়া এই সুরায় আরো বর্ণনা করা হয়েছে মুমিনদের বৈশিষ্ট্য, অবিশ্বাসী এবং মুনাফেকদের চরিত্র, মানুষের জীবন-মৃত্যুর বিভিন্ন বিষয়, সৃষ্টিতত্ত্ব, আদম-হাওয়ার জন্ম বৃত্তান্ত, তাদের জান্নাতে অবস্থান আর জান্নাত থেকে বেরিয়ে পৃথিবীতে আসা, বনি ইসরাঈল সম্প্রদায়ের অবাধ্যতা, আল্লাহর নির্দেশে হযরত ইবরাহিম-ঈসমাইল (আ.) কর্তৃক কাবা নির্মাণ এবং হযরত মুহাম্মদ (স.) কর্তৃক কেবলা পরিবর্তন, ইসলামী রাষ্ট্রের বিভিন্ন আইন, জিহাদ, কিসাস, ওসিয়ত, নামায, রোজা, হজ্ব, যাকাত, হালাল এবং হারাম ইত্যাদি বিষয়ক বিভিন্ন আলোচনা। বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে সুরা বাকারার বিভিন্ন অংশের বিভিন্ন শানে নুজুল রয়েছে। শানে নুজুল বলা হয় আল্লাহর পক্ষ থেকে কোরআন অবতীর্ণের প্রেক্ষাপটকে। প্রেক্ষাপটানুসারে সুরা বাকারার বিশেষ কিছু অংশের গুরুত্ব কোরআনের অন্যান্য আয়াতগুলো থেকে অনেক বেশি। সুরা বাকারাকে হযরত নবী করিম (স.) বলেছেন-‘সেনামুল কোরআন’। ‘সেনামুল’ অর্থ উপরিভাগ বা উৎকৃষ্টতম অংশ। ‘সেনামুল কোরআন’ অর্থ : কোরআনের উৎকৃষ্টতম অংশ। ইমাম ইবনে কাসির (র.)-এর মতে সুরা বাকারার ‘আয়াতুল কুরসী’ পবিত্র কোরআনের অন্যান্য আয়াত থেকে উত্তম। আরেকটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ না হলেও আলোচনায় নিয়ে আসা যেতে পারে, পবিত্র কোরআনের প্রথম সুরার নাম ‘বাকারা’, যার অর্থ : গাভী। আর শেষ সুরা হলো ‘নাস’, যার অর্থ : মানুষ। শুরুটা হলো পশু দিয়ে আর শেষ হলো মানুষ দিয়ে। কোরআনে বিভিন্ন বিষয়ে এমন চমৎকারিত্ব রয়েছে।
‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’
অর্থ : আল্লাহর নামের সাথে শুরু করছি, যিনি পরম দয়াময় এবং অতি দয়ালু
বিসমিল্লার তাফসির ইতোমধ্যে আলোচিত হয়েছে। আমরা এখানে সুরা বাকারার প্রথম আয়াত ‘আলিফ লাম মিম’ দিয়ে শুরু করতে চাই।
সুরা বাকারা
প্রথম রুকু
الم {১}
আয়াত-১
‘আলিফ লাম মিম’
‘আলিফ লাম মিম’ এখানে রয়েছে তিনটি বিচ্ছিন্ন বর্ণ। দুই বা তিন বর্ণে শব্দ কিংবা বাক্য হয়। যেমন ‘খা তা মীম’ খতম, যার অর্থ : শেষ। কিন্তু ‘আলিফ লাম মিম’ দিয়ে কোন শব্দ কিংবা বাক্য হচ্ছে না। শব্দ কিংবা বাক্য ছাড়া আমরা সাধারণ ব্যাকরণের নিয়মে অর্থ উঠাতে পারছি না। বেশির ভাগ কোরআন বিশেষজ্ঞ এই নিয়ম থেকে ‘আলিফ লাম মিম’ অক্ষরগুলোকে ‘হুরূফ-আল মুকাত্তায়াত’ বলেছেন, যার অর্থ : বিচ্ছিন্ন বর্ণমালা। পবিত্র কোরআনে ২৯টি সুরার শুরুতে এরকমের বিচ্ছিন্ন বর্ণমালা রয়েছে। যেগুলোর অর্থ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে প্রচুর মতানৈক্য পাওয়া যায়। সঠিক অর্থ কারো পক্ষে-ই দেওয়া সম্ভব নয়। হযরত ইমাম কুরতুবী (র.)-র মতে চার খলিফা এবং হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) প্রমূখ সাহাবীরা মনে করতেন ‘আলিফ লাম মীম’ হলো আল্লাহ পাকের রহস্যজনিত বিষয় এবং তাঁর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ। ইমাম ইবনে কাসীরও এই মত প্রকাশ করেছেন। অনেকে মনে করেন, এই বিচ্ছিন্ন শব্দগুলোর কোন অর্থ নেই। এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে অন্যদলের প্রশ্ন, আল্লাহ পাক অনর্থক কিংবা অকারণে কিছু বলেন না, তা যদি সত্য হয় তবে এই অক্ষরগুলোরও কোন কারণ বা অর্থ আছে। তাদের বক্তব্য হলো বিষয়টা বাতেনি, যেহেতু হযরত রাসুল (স.) আমাদেরকে জানাননি, তাই আমরা এর কোন অর্থ জানি না। অর্থ অবশ্যই একটা আছে। ইমাম বাগাবী (র.) থেকে কাযি ছানাউল্লাহ পানিপথি (র.) বর্ণনা করেন যে, হযরত আবু বকর (রা.) বলেছেন- প্রত্যেক ঐশী গ্রন্থে এক গোপন রহস্য লুকিয়ে আছে, আর কোরআনে আল্লাহর গোপন রহস্য হলো সুরার শুরুতে ‘হুরূফÑআল মুকাত্তায়াত’। (তাফসিরে মাযাহারী, প্রথম খন্ড)। হযরত আবু বকর (রা.) এর এই বর্ণনাকে সামনে রেখে অনেক বিশেষজ্ঞ বলেন, পরিশুদ্ধ মনে সত্যসন্ধানী হয়ে কোরআন পাঠ করলে কোরআন তার রহস্যভেদ করে আলোর কিরণ পাঠকের মনে দিয়ে যায়।
ভারতীয় সুফিদের বিশেষ একটি গ্র“প আছেন যারা মনে করেন, ‘আলিফ লাম মিম’-এর পর যে ‘যালিকাল কিতাব’ বলা হয়েছে, তা মূলত এই ‘আলিফ লাম মিম’-এর দিকে-ই ইশারা করেছে। তা আধ্যাত্মিক বিষয়, সাধারণ মানুষের বুঝে আসার কথা নয়। এটাই মারিফতি। এই মারিফত লাভের জন্য ধ্যান, সাধনা, মোরাকাবা, মোশাহেদা করতে হয়। কেউ চাইলে একাকি এই পর্যায়ের সাধনা করতে পারে না, এখানে গুরু বা মুর্শিদ প্রয়োজন। এ বিষয়ে সুফিদের অনেকের বিশ্বাস খুবই দৃঢ়। তাদের এই বিশ্বাসের কিছু দলিলও আছে। যেমন হযরত কাতাদা (র.), হযরত ইবনে জুবায়র (র.) প্রমূখ অনেক কোরআন বিশেষজ্ঞ ‘আলিফ লাম মীম’ কে বলেছেন কোরআনের নাম-সমূহের একটি।’ প্রশ্ন হতে পারে বিচ্ছিন্ন বর্ণমালা নাম হয় কীভাবে? এর উত্তরে আবু জাফর মুহাম্মমদ ইবনে জারীর তাবারী (র.) বলেন, কোন ব্যক্তি যদি বলে আমার ছেলে তোয়া ও জোয়া বর্ণের মধ্যে রয়েছে, তা যেমন জায়েয, তেমনি জায়েয এটাও। (তাফসীরে তাবারী, আবু জাফর মুহাম্মমদ ইবন জারীর তাবারী র.)।
আর সত্য যদি কোরআনের নাম ‘আলিফ লাম মীম’ হয় তবে অবশ্যই ‘যালিকাল কিতাব’ দিয়ে আলিফ লাম মীমকে বুঝানো হয়েছে।
অবশ্য সুফিদের মধ্যে আরেকটি গ্রুপ আছেন যারা এই বিশ্বাসকে গুরু-শিষ্যের সম্পর্কে আধ্যাত্মিক রহস্য সৃষ্টির জন্য লালন করে থাকেন। অনেক ভারতীয় মুসলিম সুফি বা পির কিংবা হিন্দু যোগী বা গুরু তাদের শিষ্যদেরকে আধ্যাত্মিক রহস্যের জালে আটকিয়ে রাখতে বেশি পছন্দ করেন। এসব যে সর্বক্ষেত্রে অকারণ, তা কিন্তু নয়। এই অঞ্চলের মানুষের আদি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলো আধ্যাত্মিক রহস্যের পিছনে ঘুরে আনন্দ উপভোগ করা। এখানে একটি বিষয়ে রহস্য সৃষ্টি করে একেক গুরু একেক রকম ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন। ব্যাখ্যার ব্যাবধান থেকেই অনেক সময় নিত্য-নতুন গ্র“প জন্ম হয়। অনেক সময় গুরু-শিষ্যের ব্যাখ্যায়ও ব্যাবধান প্রচুর হয়ে যায়। প্রত্যেকের ব্যাখ্যায় মনগড়া পৃথক পৃথক যুক্তিও আছে, যদিও অনেকের যুক্তি সত্য আর দর্শনের স্থান থেকে হাস্যকরও। যেমন এদেশে কিছু পির মনে করেন-‘আলিফ এবং মিমে চিরস্থায়ী মদ রয়েছে। তাছাড়া মিমে তাসদীদ রয়েছে। এতে মুহাম্মদ (স.) তাঁর আহাল সহকারে সৃষ্টির মধ্যে জাহিরি এবং বাতিনি চিরন্তন হয়ে বিরাজমান রয়েছেন। এখানে আহাল অর্থ নুরের বংশধর।’ আমরা এই পিরদের নাম-ঠিকানা উল্লেখ না করেই মূল বিষয়টাকে উল্লেখ করলাম। কারণ, ব্যক্তির চিন্তা বদলে যেতে পরে। তারা আলিফ লাম মিম-এর যে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন এই ব্যাখ্যা হযরত নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) কিংবা হযরত সাহাবায়ে কেরাম (রা.) কর্তৃক সত্য বলে প্রমাণিত নয়। সাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত আরবে-আযমে কোন কোরআন বিশেষজ্ঞ এই রকমের ব্যাখ্যাকে সত্য বলে উল্লেখ করেন নি। মূলত এ বক্তব্য ওদের মনগড়া-অবশ্য ক্ষেত্রবিশেষ হযরত রাসুল (স.) ও তাঁর বংশের প্রতি প্রেমের নির্দশনও রয়েছে। এই মনগড়া প্রেমের বক্তব্যের উৎপত্তি শিয়াদের চিন্তা-চেতনা থেকে। হযরত রাসুল (স.) এবং তাঁর বংশধরদেরকে আমরা সম্মান করবো সত্য, রাসুল প্রেম কিংবা আহলে বায়েত (রাসুল-বংশ)-এর প্রতি প্রেম আমাদের অন্তরে অবশ্যই থাকবে এবং এই থাকাটা ঈমানেরও অংশ। কিন্তু যা আল্লাহ-রাসুল কিংবা সাহাবাদের কর্তৃক স্বীকৃত নয় তা আমরা গ্রহণ করতে পারি না।
হযরত নবী করিম (স.)-এর কোন ছেলে বংশ ছিলো না। তিনি তাঁর স্ত্রী সকলকে, তাঁর চার মেয়েকে, মেয়ের স্বামী আলী ও উসমানকে, আলী ও ফাতেমার দাম্পত্য থেকে জন্ম নেওয়া হাসান-হোসেনকে এবং তাঁর চাচা আব্বাস (রা.) কে নিজ বংশের স্বীকৃতি দিয়েছেন। ইসলামি পরিভাষায় তাদেরকে আহলে বায়েত বলা হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, শিয়া সম্প্রদায় হযরত আলী, মা ফাতেমা এবং হাসান-হোসেনকে সম্মান দেখাতে গিয়ে হযরত নবী করিম (স.)-এর অন্যান্য সাহাবী, বিশেষ করে হযরত আবু বকর (রা.), হযরত ওমর (রা.), হযরত উসমান (রা.) এবং উম্মুল মুমিনিন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) কে গালাগালি পর্যন্ত করে থাকেন, যা ইসলামি নিয়ম-নীতিতে কখনও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আমাদের দেশে ইসলামের বিস্তারটা হয়েছে বিভিন্ন সুফি-সাধকদের মাধ্যমে। এদেশের অনেক সুফিদের চিন্তা-চেতনায় পার্সিয়ানদের সংস্কৃতির প্রভাব স্পষ্ট। তা ছাড়া এখানে অনেক শাসক ছিলেন শিয়া সম্প্রদায়ের চিন্তার বিশ্বাসী। সমাজের সাধারণ মানুষ সবসময় রাজকীয় সংস্কৃতির খুবই অনুকরণপ্রিয় হয়। শাসকদের চিন্তার একটা প্রভাব থেকেই যায় জনসাধারণের ওপর। আদি থেকেই ভারতবর্ষে পার্সিয়ান সংস্কৃতির প্রচুর প্রভাব ছিলো। ভারতীয় সনাতন আর্যরাও এদেশে পারস্য হয়ে এসেছেন। পার্সিয়ান জাতিও আর্য সম্প্রদায়ের অংশ। তাই পারস্যের আর্যদের সাথে ভারতীয় আর্যদের সাংস্কৃতিক কিছু মিল পাওয়া যায়। এর প্রভাব হিন্দু বৈষ্ণব চিন্তা হয়ে কিছু মুসলিম সুফি এবং বাউলদের মধ্যেও আছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারতবর্ষে বৈষ্ণবদের সাথে এই সুফিদের চিন্তার বেশ মিল রয়েছে। যেমন পার্সিয়ানরা ছিলো আগুনের উপাসক। সনাতন আর্যরাও মঙ্গল প্রদীপ আর শিখা জ্বালিয়ে উপাসনা করেন। আমাদের সুফিদের মধ্যেও রয়েছে আসনে পাঞ্জাতনের পাঁচটি বাতি জ্বালিয়ে মিলাদ এবং যিকির করার নিয়ম-নীতি। আমি শুধু একটি উপমা দিলাম। আরো অনেক আছে। অবশ্য একথা সব সুফিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। সুফিদের মধ্যেও বিভিন্ন গ্র“প রয়েছে, রয়েছে চিন্তার ভিন্নতা। এই ভিন্নতাগুলোকে পর্যবেক্ষণ করে সঠিক এবং বেঠিক দেখাটা খুবই জরুরী। তবে গ্র“পিং মানসিকতা থেকে নয়, কাজটা করতে হবে দয়ার দৃষ্টিতে, এখলাসের সাথে এবং দ্বিনের দায়ী হয়ে। নতুবা হিতেবিপরীত হয়ে যেতে পারে।
হযরত রাসুল (স.)-এর বংশের প্রতি মর্যাদা প্রকাশের ক্ষেত্রে ভারতবর্ষে অনেকে সনাতন আর্যদের কর্তৃক ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়কে মর্যাদা দানের বিষয়টি বিবেচনায় রেখেছেন। কোরআন-হাদিস যে আহলে বায়েতকে একেবারে মর্যাদা দেয় নি, তা কিন্তু নয়। তবে এভাবে নয় যেভাবে শিয়া সম্প্রদায় এবং ভারতীয় সুফিরা দিয়ে থাকেন। ভারতীয় প্রেক্ষাপটগতভাবে সুফিদের এই কাজ অযৌক্তিক ছিলো না। বরং তা ছিলো সময়ের প্রয়োজন। যেমন, ভারতবর্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে মিলাদুন্নবী বা সিরাতুন্নবী পালন, এ উপলক্ষে জশনে জৌলুস বা র্যালী বের করা ইত্যাদি এসেছে কৃষ্ণের জন্মাষ্ঠোমি পালনের বিষয়টি মাথায় রেখে। এখানে শবে বরাত উদ্যাপনের সংস্কৃতির সাথে দেওয়ালী উদ্যাপনের সংস্কৃতির বেশ মিল রয়েছে। যারা এসব শুরু করেছিলেন তাদের কর্মকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। তাদেরও একটা নেক নিয়ত ছিলো। তৎকালিন সময় এগুলো ছিলো মূলত সাংস্কৃতিক আন্দোলন। এই আন্দোলন অভ্যাহত না থাকায় আজ এখানে বিভিন্ন রকমের অপসংস্কৃতি, বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রভাব প্রচণ্ডভাবে দেখা যাচ্ছে।
আবার যখন এদেশের কিছু মানুষ হঠাৎ সৌদি রাজতন্ত্রের টাকা নিয়ে ধর্ম প্রচারকের দায়িত্ব আদায় করতে অস্থির পাগলের মতো সৌদিয়ান সংস্কৃতির সাথে দেশীয় সংস্কৃতির কিছু বেমিল দেখে বিদআত আর শিরক বলে চিৎকার শুরু করেন তখন মানুষ হয় আরো বিভ্রান্ত। প্রকৃতভাবে বিদআতের একটা সংজ্ঞা, ব্যাখ্যা এবং প্রেক্ষাপট আছে। তারা এসব বুঝেন না তারা তাদের বক্তব্যে হাদিস আছে বলে চিৎকার করেন, দেখেন না অন্যদের বক্তব্যের পক্ষেও যে হাদিস রয়েছে। তারা যে স্থানে দাঁড়িয়ে এদেশের কিছু সংস্কৃতিকে বিদআত বলেন আমাদেরও কিন্তু এই স্থান আছে। আমরা যদি আমাদের স্থানে দাঁড়িয়ে মোকাবেলা শুরু করি তবে সালাফিপন্থী বিদআতিরা আর এমাটিতে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবেন না। আমরা যে তাদেরকে বিদাতি বললাম তার পক্ষে অসংখ্য দলিল উপস্থাপন করা যাবে। বিদআতের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ধর্মের নামে পূণ্যের উদ্দেশ্যে প্রত্যেক নতুন জিনিষ বিদআত। এই সংজ্ঞায় হানাফি মাযহাব যদি বিদআত হয়, তবে অবশ্য সালাফি এবং আহলে হাদিস মাযহাবও বিদআত। সালাফি এবং আহলে হাদিসরা বলেন তারা কোন মাযহাব নয়, কিন্তু তাদের কর্মকাণ্ড প্রমাণ করে তারাও একটি মাযহাবের প্রতি পূর্ণাঙ্গ আনুগত্যশীল। তারা এক রকমের গ্র“পিং বা দলতান্ত্রিক মানসিকতা থেকে দ্বীনের বিভিন্ন বিষয়ে ফিতনা তৈরি করেন পথে-ঘাটে, স্থান-কাল-পাত্রে কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়ে। তা ছাড়া তারা যে সৌদি রাজতন্ত্রের মদদপোষ্ট সেই রাজতন্ত্র জিনিষটাইতো পূর্ণাঙ্গ বিদাআত। হযরত নবী করিম (স.) এর আদর্শে কোথাও রাজতন্ত্র নেই। আছে খিলাফত। সৌদ পরিবার হযরত রাসুল (স.)-এর স্মৃতিধন্য জাজিরাতুল আরবের নাম পর্যন্ত পরিবর্তন করে তাদের নামে সৌদি আরব রেখে দিয়েছে। এই রাজতান্ত্রিক সৌদি আরব প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীর জঘন্যতম অনেকগুলো বিদআতের প্রতিষ্ঠাতা। তাদের অনেক কর্মই ইসলামের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। জাজিরাতুল আরবের নাম পরিবর্তনকে সরাসরি বিদআতের সংজ্ঞানুসারে দালিলিক বিদআত বলা না গেলেও বিষয়টি অসংখ্য বিদআত এবং ফিতনার জনক। তা ছাড়া এই নাম পরিবর্তনে হারিয়ে গেছে প্রাচীনতম ঐতিহাসিক গ্রন্থসমূহে জাজিরাতুল আরবের যে বর্ণনা ছিলো, তার অনেক কিছু। সৌদি আরব নামের রাজ্যে যাযাবর সৌদের রাজ্য দখলের ইতিহাস পাওয়া যায়, পাওয়া যায় সৌদ রাজ পরিবারের অসংখ্য স্মৃতি এবং ছবি। পাওয়া যায় না হযরত ইবরাহিম, ঈসমাইল কিংবা হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর স্মৃতি বিজরিত ইতিহাস-ঐতিহ্য। বিদআত নির্মূলের নামে সৌদি রাজতন্ত্র ইসলামের প্রাথমিক সময়ের সব ঐতিহ্য ধ্বংস করে দিয়েছেন। পৃথিবী যেখানে ঐতিহ্য সংগ্রহে প্রচুর অর্থ ব্যয় করছে সেখানে তারা ঐতিহ্য ধ্বংসে প্রতিদিন টাকা খরচ করে যাচ্ছে। তাদের দাবী হলো-এগুলো নাকি বিদআতের জন্ম দিচ্ছে। তাদের এই মূর্খতায় হারিয়ে যাচ্ছে ইসলামের ইতিহাস-ঐতিহ্যের বিরাট এক ধারা। অতঃপর পৃথিবীর নতুন প্রজন্ম জানবে সৌদি রাজপরিবারের কথা, জানবে না জাজিরাতুল আরব আর সেই আরবের ঐতিহ্য। যে-সব কারণে মানুষের জন্য বিদআত ক্ষতিকর তা থেকেও বেশি ক্ষতিকর ঐসব মূর্খদের কর্তৃক ঐতিহ্যের ধ্বংস। ঐতিহ্য ধ্বংসের প্রথা অবশ্যই একটি জঘন্যতম নব্যবিদআত। আমরা রাজতান্ত্রিক সৌদি আরব কিংবা রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলছি বলে তাদের ভালো জিনিষকেও যে অগ্রাহ্য করবো তা কিন্তু নয়। তারা যদি কোন গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেন তা আমরা নিজেদের মতো করে বিবেচনা করবো।
বর্তমানে এদেশে যারা প্রতিদিন পথে-ঘাটে শুধু বিদআত আর শিরক দেখেন তারা বেশিরভাগেই জানেন না এ অঞ্চলের জমিনে ইসলাম কিংবা মুসলমানদের ভিত্তিপ্রস্তুর কীভাবে হয়েছিলো। ফলে তাদের অনেক সত্য বলার পদ্ধতিতেও প্রচুর ভুল রয়েছে। এদেশের মানুষ এবং মানুষের মধ্যে ইসলামের উৎপত্তি আর ক্রমবিকাশের পথ ও পদ্ধতি না বুঝলে কারো পক্ষেই দ্বীনের সঠিক দাওয়াতি কাজ করা সম্ভব নয়। একথা প্রত্যেক দায়ি সংগঠনের বিবেচনায় রাখতে হবে। সাথে সাথে তারা আরো বুঝতে হবে, এখানে শিয়াদের চিন্তার সাথে সনাতন আর্যদের চিন্তা কিছুটা রক্তের বন্ধনে একাকার হয়ে আছে। একাকার হয়ে আছে বৈষ্ণব আর কিছু সংখ্যক সুফিদের চিন্তাও। ইসলামের মৌলিক শিক্ষার সাথে এই সুফিদের চিন্তার কিছুটা পার্থক্য যেমন লক্ষ্য করা যায় তেমনি বৈষ্ণবদের সাথেও সনাতন আর্য সম্প্রদায়ের চিন্তার পার্থক্য রয়েছে। এসব চিন্তা সময়ের ব্যবধানে সমাজে বিস্তার লাভ করেছে। যাতে বাস্তবতা থেকে বেশি আবেগের গুরুত্ব পাওয়া যায়। চাইলেই কেউ এগুলো পাল্টিয়ে দিতে পারবে না। আবেগ অনেক সময় মানুষকে অন্ধ করে রাখে। একথা ভারতবর্ষের সব দল এবং গ্র“পের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। মানুষকে পরিবর্তনের জন্য প্রেমের বিকল্প কিছু নেই।
প্রেমকে অনেকে মনে করেন আবেগ। কিন্তু দয়াদর্শনে প্রেম আবেগ নয়, প্রেম হলো সত্য। এখানে এই সত্যকে লাভ করতে হয় সাধনা এবং ত্যাগের মাধ্যমে। জ্ঞান, বুদ্ধি, কর্মের সাথে প্রেমের সমন্বয় করতে পারলে আবেগ অনেকটা হ্রাস পায়। দয়াদর্শনের সত্য মনে করে, সবাইকে তার নিজের স্থানে মর্যাদা দেওয়াই প্রকৃত মর্যাদা। যে যা নয় তা বলার মধ্যে কোন মর্যাদা নেই। স্মরণ রাখতে হবে, আল্লাহর স্থান নবীকে, নবীর স্থান সাহাবীদেরকে, সাহাবীদের স্থান ওলি-আউলিয়াদেরকে দেওয়া যাবে না। আহলে বায়েতের প্রতি আমাদের দুর্বলতা কম নয়। আমার ব্যক্তিগত দুর্বলতারও কিছু কারণ আছে, তা ছাড়া মুসলমান হিসেবে নবী বংশের প্রতি শ্রদ্ধা কার নেই? কিন্তু যতটুকু আল্লাহ ও রাসুল কর্তৃক বৈধ ততটুকুই মর্যাদা দিতে হবে। এর বাইরে অন্তরে থাকলেও দেখানো যাবে না। অন্তরের কথার উপর পাপÑপূণ্য লেখা হয় না। তবে প্রকাশ হলে পাপ-পূণ্য লেখা হয়। ‘আলিফ লাম মিম’ দিয়ে আল্লাহ তাঁর হাবিবকে কি বলেছেন তা তারা দুজনের নিজস্ব ব্যাপার। তবে অবশ্যই এখানে ‘যালিকাল কিতাব’ দিয়ে ‘আলিফ লাম মিম’ এর দিকে ইঙ্গিত করে ‘আহলে মুহাম্মদ’ বুঝানো হয় নি।
‘আলিফ লাম মিম’কে অনেকে বলেছেন কোরআনের অনেকগুলো নামের একটি। যদি তা সত্য হয় তবে যারা দাবী করছেন ‘যালিকাল কিতাব’ দিয়ে ‘আলিফ লাম মিম’-এর দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে, তাদের কথা গ্রহণযোগ্য। আমরা মনে করি ‘যালিকাল কিতাব’ দিয়ে শুধু আলিফ লাম মিম নয়, বুঝানো হয়েছে সমগ্র কোরআন। আর তাও সত্য, সমগ্র কোরআন বললে এতে ‘আলিফ লাম মিম’ও এসে যায়। আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে জারীর তাবারী (র.) লিখেছেন যে, যায়দ ইবনে আসলাম তাঁর ছেলে আব্দুর রহমানকে বলেছেন, ‘আলিফ লাম মিম’ হচ্ছে সুরার নাম। তবে ইবনে জারীর তাবারী (র.) এবং ইবনে আবু হাতিমের নিজস্ব মত হলো, আলিফ দিয়ে আলাআউল্লাহ (আল্লাহর নিয়ামত সমূহ), লাম দিয়ে লাতিফুল্লাহ (আল্লাহর অনুগ্রহ), মিম দিয়ে মালিকুল্লাহ (আল্লাহর রাজ্য) বুঝায়। (তাফসিরে ইবনে তাবারী)। আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ূতি (র.) বলেছেনÑ আলিফ দিয়ে আল্লাহ, লাম দিয়ে জিব্রাইল, মীম দিয়ে মুহাম্মদ বুঝানো হয়েছে। আবার তিনি একথাও বলেছেন-আল্লাহ এর মর্ম ভালো জানেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন-এর অর্থ আল্লাহ বলছেন-আনাল্লাহু আ’লামু, অর্থাৎ আমি আল্লাহ অধিক জানি। তাফসিরে হোসাইনিতেও হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-র কথাকে সমর্থন করা হয়েছে। যারা কোরআনের ২৯ সুরার ‘হুরূফ-আল মুকাত্তায়াত’ কে বিভিন্ন বিষয়ের গণনা বলেছেন কাযি মুহাম্মদ ছানাউল্লাহ পানিপথি (র.) তাদের সাথে দ্বিমত করে বলেনÑপারস্যবাসি কারো জন্ম-মৃত্যুর তারিখ কিংবা বাদশার মুকুট পরিধান বা অন্য অসাধারণ ঘটনার সময়কাল স্মরণ রাখার জন্য বর্ণমালার সংখ্যাগত হিসাব নির্ধারণ করে রেখেছিলো। এই গণনার আবিস্কারক আরবরা নয়। আরবে এই গণনার ব্যবহার কখনও হয়নি। তবে ইহুদী আলেমগণ এই গণনারীতির সাথে পরিচিত ছিলো। এ জন্য তারা অংক কষে হযরত নবী করিম (স.) কে প্রশ্ন করেছিলো।’ বর্ণনা থেকে জানা যায়, হযরত নবী করিম (স.) ঐ ইহুদির প্রশ্ন শোনে হেসেছেন। সানাউল্লাহ পানিপথির বক্তব্য হলো হযরত রাসুল (স.)-এর হাসির অর্থ ব্যাঙ্গাত্মক। অর্থাৎ ওদের গণনা সত্য ছিলো না। আবার কেউ বলেছেন, সম্পূর্ণ ‘আলিফ লাম মীম’ই হলো আল্লাহর নাম। আবার কেউ বলছেন আলিফ লাম মীম হলো আল্লাহর কসম। তবে আল্লামা যামাখশারি (র.) বলেছেন, আলিফ লাম মীম হলো এই সুরার নাম। সবশেষ আমাদের কথা : এই অক্ষরগুলোর অর্থ আল্লাহ-ই ভালো জানেন। কোরআন বিশেষজ্ঞদের মধ্যে যারা আলিফ লাম মীমের অর্থ উঠানোর চেষ্টা করেছেন তাদেরকে অবশ্যই আমরা শ্রদ্ধা জানাই। তবে তাদের কারো বক্তব্যই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নয়।
©somewhere in net ltd.
১| ২২ শে জুন, ২০১৫ রাত ১১:২৭
হানিফঢাকা বলেছেন: the concept of ahle bayt, hidden meaning and sufi philosophy -all are the wrong concept.