![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লেখালেখি করার চেষ্টা করি। সিরিয়াস লেখা এবং আন্তরিক কাজ - এই দুটোর সম্মিলিত শক্তি সমাজে পরিবর্তন আনতে পারে বলে বিশ্বাস করি।
দেশের খবর জানার জন্য আমার ভরসা অনলাইনে দু‘একটি বাংলা পত্রপত্রিকা। আন্তর্জাতিক খবর শুনি রেডিওতে। টিভি দেখি না বহুদিন হলো । অবশ্য প্রায়ই বন্ধুবান্ধব আর পরিচিতজনদের বাসায় বাংলা চ্যানেলে দেশের সচিত্র সংবাদ দেখা এবং শোনা হয়। সেদিন এক বন্ধুর বাসায় বসে গল্প করছি। হঠাত দেখি লন্ডনের কোন এক বাংলা চ্যানেলে দেশ থেকে আগত বিরোধী দলের এক নেতার (সাবেক চিফ হুইপ) সাড়ম্বর সাক্ষাতকার চলছে। অনুষ্ঠানের শুরুতেই উপস্হাপক নেতাকে জিজ্ঞেস করলেন ‘কেমন আছে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ?‘ নেতা মাথা দুলিয়ে হাতপা ভীষণভাবে নেড়ে সক্রেটিসের ভাবগাম্ভীর্য নিয়ে জবাব দিলেন ‘দেশ ভালো আছে, তবে মানুষ ভালো নেই‘। জাতীয় সংসদের সাবেক চিফ হুইপ এবং একজন সিরিয়র রাজনীতিবিদের এমনতর জবাব শুনে দেশের মানুষের মতো আমি আবারও নতুন করে হতাশ হলাম। দেশ এবং মানুষ যে একই জিনিস - একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ এই বোধবুদ্ধি যাদের নেই তাদের কাঁধেই আমরা দিয়েছি দেশসেবার গুরুভার।
নেতার উত্তর শুনে আমি বন্ধুস্ত্রীকে তার প্রিয় চ্যানেলে ফিরে যাবার জন্য অনুরোধ করলাম যেটা তিনি কিছুক্ষণ আগে দেখছিলেন। বন্ধুস্ত্রী যখন তার প্রিয় ড্রামা সিরিয়াল দেখছেন আমরা দুবন্ধু তখন একটু আধটু দেশ-রাজনীতি- এবং নেতাদের নিয়ে ফিসফিসিয়ে কথা বলছিলাম। নেতার আগপাশতলাবিহীন উত্তর তখন আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। হঠাত মনে পড়ল জওয়াহরলাল নেহরুর কথা। নেহরু তখন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় চষে বেড়াচ্ছেন সমগ্র ভারতবর্ষ। ভারত ছাড় আন্দোলনে কাঁপছে সারা দেশ। তাঁর ঘুমানোরও সময় নেই। এক মিটিং থেকে আরেক মিটিংএ যাওয়ার পথে গাড়ির মধ্যে খানিকটা ঝিমিয়ে নেন। এই রকম এক মিটিংএ অংশগ্রহণের জন্য তিনি দলবল নিয়ে ইন্ডিয়ার কোন এক শহরে হাজির হলেন। অবাক হয়ে তারা দেখেন পুরো শহর প্রায় জনশূন্য। অফিস-আদালত, দোকান-পাট সব বন্ধ। খোঁজ নিয়ে জানলেন অধিকাংশ মানুষ শহরতলীস্হ মিটিংস্হলে তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছে। মিটিং শুরু হলো। এক সময় নেহরু দাঁড়ালেন বক্তৃতার জন্য। হাজার হাজার মানুষ স্লোগান দিচ্ছে ‘ভারত-মাতা কি জয়‘ ভারত-মাতা কি জয়‘ । নেহরু তাদের থামার জন্য নির্দেশ দিলেন। জনতা খামোশ হওয়ার পর তিনি বললেন ‘আপনারা স্লোগান দিচ্ছেন ভারত-মাতার জয়ের জন্য। বলুন, কে এই ভারত-মাতা?‘ প্রশ্ন শুনে জনতা স্তম্ভিত। তারা হয়তো ভাবছিলো কী এক উটকো ঝামেলা! সারাজীবন এই স্লোগান দিলাম। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলো না। আজ এই লোক হঠাত ভারত-মাতার পরিচয় জানতে চায় ! যে লোক ভারত-মাতাকে নেতৃত্ব দিচ্ছে সে কী জানে না ভারত-মাতা কে! ইতস্তত জনতার কেউ কেউ কম্পিত হস্তে মাটি স্পর্শ করে উত্তর দেয়ার চেষ্টা করলো যে ভারতের মাটিই হচ্ছে ভারত-মাতা। নেহরু ততক্ষণাত বললেন ‘না, মাটি নয়, ভারত-মাতা হলেন আপনারা নিজেরা - আপনারা প্রত্যেকে হলেন একেকজন ভারত-মাতা। সুতরাং আপনারা যখন ভারত-মাতা কি জয় বলেন , তখন আসলে নিজেদের জয়ের কথা বলেন। মানুষ ছাড়া এই মাটির কোন মূল্য নেই। মানুষ আছে বলেই এই মাটি আমাদের ভারতমাতা। দেশের মাটি এবং মানুষের মধ্যে কোন তফাত নেই।‘
আজ দেশের মাটি এবং মানুষকে ভিন্ন সত্ত্বা হিসেবে বিবেচনা করে আমরা অভ্যস্হ হয়ে গেছি। অন্যদিকে দেশটা নষ্ট হয়ে গেছে শুনে শুনে আমরা এবং আমাদের প্রজন্মরা বেড়ে উঠেছে। এত বছর পর আজও কান পাতলে শোনা যায় সেই একই হতাশার সুর। দেশ নষ্ট হয়ে গেছে - কথাটা আমরা অবলীলায় এমন ভঙ্গীতে প্রচার করি যেন এটা স্রেফ একটা বস্ত বা মেশিন বা কোন বাহারী বস্ত্র। আমরা অনুধাবন করি না - দেশ নষ্ট হওয়ার মানেই হলো মানুষ নষ্ট হওয়া। আর দেশ ভালো থাকলেই মানুষ ভালো থাকে অথবা মানুষ ভালো থাকলেই দেশ ভালো থাকে। দেশ নষ্ট হয়ে গেছে বলে আমরা অনেকটা অবচেতনে নিজেদের দোষ কোন জড় পদার্থে র উপর চাপিয়ে দেয়ার হাস্যকর চেষ্টা করি। দেশ নষ্ট হয়ে গেছে বললে আপাত স্বস্তি মেলে। সেটা হলো যেখানে বিশাল একটা দেশ নষ্ট হয়ে গেছে , সেখানে আমরা ক্ষুদ্র ব্যক্তি বা দল হিসেবে তার নিরাময়ে কীইবা করতে পারি! এই চিন্তাচেতনা সমাজ-রাষ্ট্রের শ্বাসরোধী অচলঅয়তন রক্ষায় যুতসই। সাধারণ মানুষ এমনকি শিক্ষিতজনেরা নির্বিবাদে নির্লিপ্তভাবে এই নষ্ট হওয়াকে মেনে নেয়। এমনকি অনেক উচ্চ শিক্ষিত আন্তর্জাতিকমানের ডিগ্রিধারী বিশেষজ্ঞরাও এই নষ্ট হওয়ার থিয়োরীকে মনেপ্রাণে মেনে নেন। শুধু মেনে নেয়া নেয় - ‘দেশ নষ্ট হয়ে গেছে‘ - এই আপতবাক্য অহরহ যত্রতত্র কারণে অকারণে পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে সাধারণ্যে চিরন্তন বাণীর মর্যাদায় ভূষিত করেছেন।
যেহেতু বিশাল একটা জিনিস নষ্ট হয়ে গেছে সেহেতু স্বাভাবিকভাবেই আমরা সবাই এ ব্যাপারে দারুন ব্যথিত। এবং এ নিয়ে অামরা ঘরে-বাইরে, বৈঠকে-আড্ডায় দিনরাত আলাপ-আলোচনা এবং আফসোস করি। আলাপের মাত্রাও আমাদের সাধ্যের মতোই সীমিত! কান পাতলে প্রায়ই শোনা যায় ‘দেখেছেন ভাই, দেশটার কী দশা হলো? এক্কেবারে নষ্ট হয়ে গেলো !‘ কিন্ত এ ব্যাপারে আমাদের যেন করণীয় কিছুই নেই।ভাবখানা এমন, এত বড় একটা বস্ত নষ্ট হয়ে গেছে - সেখানে আমি কোন ছার যে সেটাকে মেরামত করার চেষ্টা করবো! আর আমি কী পাগল হয়েছি যে এত বড় জিনিসটাকে মেরামতের দু:সাহস দেখাব ? কেউ যদি সাহস সঞয় করে অথবা অতিআবেগে মুখ ফসকে বলে ‘ আচ্ছা ভাই, এই দশা থেকে দেশটাকে উদ্ধারের জন্য আমরা কী কিছু করতে পারি? সে প্রশ্ন আমাদের কাছে এতটাই অবান্তর এবং অবাস্তব এবং উদ্ভট ঠেকে যে আমরা না প্রায় না শোনার ভান করি। কারো কারো ভাবভঙ্গিতে প্রতিফলিত হয় ‘আরে ভাই, দেশটা কি মোবাইল ফোন নাকি টেলিভিশন যে ম্যাকানিকের কাছে নিয়ে গেলেই ঠিক হয়ে যাবে!‘ যে অল্প কজন প্রশ্নটা একআধটু মনোযোগ দিয়ে শুনেন তাদের অধিকাংশ হেসেই উড়িয়ে দেন । কেউ কেউ দেশের দু:সহ অবস্হাকে ভবিষ্যতদ্রষ্টার মতো - চিরন্তন নিয়তি এবং কেয়ামততক এই বদহাল জারী থাকবে বলে আস্হার সঙ্গে ঘোষণা দেন। এই ধরনের পয়গম্বরী অভিমত শুনে সমাজে যে গুটিকয়েক আশাবাদী মানুষ থাকেন তারাও একবারে ভড়কে যান। একঘরে হওয়ার ভয়ে, সর্বোপরি মানসম্মান হারানোর ভয়ে, এমনকি প্রাণ হারানোর ভয়ে তথাকথিত হতাশাবাদী বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে তারাও সুর মেলাতে বাধ্য হন। শেষ পর্যন্ত ‘ওয়েটিং ফর গডোর‘ সেই বিখ্যাত সংলাপের মতো আমরা সবাই সমস্বরে বলি ‘নাথিং টু বি ডান‘ , তাই ‘কোন রকম বাঁচান আপনার জান‘! দেশের জন্য যা করার সন্ত্রাসী, দুর্ণীতিবাজ আর চাঁদাবাজ, দাগাবাজরাই করবে ! এ যেন বাঘে ধরার সেই গল্প। এক ধূর্ত লোককে কেউ জিজ্ঞেস করলো ‘ আচ্ছা ভাই , বাঘে ধরলে আপনি কি করবেন?‘ সে জবাব দিলো ‘ আমি আর কি করবো? যা করার তো বাঘেই করবে! ‘অামাদের অবস্হাও তাই। যা করার তারাই করবে যারা জাতীয় এবং স্হানীয় পর্যায়ে যুগযুগ ধরে জনতার নামে, জনতার রায়ে আকামকুকাম করে যাচ্ছে। বাউল শাহ আব্দুল করিমের ভাষায় বলা যায় ‘তুমি রাখো কিবা মারো/ এই দয়া করো‘।
হতাশাবাদীদের হৈহৈ হুররের মধ্যে আশাবাদীরা আর হালে পানি পান না। নৈরাশ্যবাদীরা বিভিন্ন মাধ্যম এত প্রবল যে, আশাবাদীরা মিনমিন সুরেও জনগণকে আশার বাণী শোনাতে সাহস পায় না। এই অবস্হাকে তুলনা করতে পারি গ্রামের সেই দুই ইংরেজী মাস্টারের গল্পের সঙ্গে। একদা রনজনা আর খনজনা নামক পাশাপাশি দুই গ্রামে দুই জন ইংরেজী শিক্ষক লজিং থাকতেন। দুই গ্রামের লোকজনই গর্ব করে বলে বেড়ায় যে তাদের মাস্টার অন্য গ্রামের মাস্টারের চেয়ে বেশী ইংরেজী জানে। এ নিয়ে তাদের মধ্যে তুমুল বাদ-প্রতিবাদ-ঝগড়া-ফ্যাসাদ হতে থাকে। এলাকার লোকজন ত্যাক্ত-বিরক্ত হয়ে প্রস্তাব দিলো দুই মাস্টারের মধ্যে ইংরেজী বাতচিতের প্রতিযোগিতা আয়োজন করতে। তারা নিজেরাই দেখে কোন গ্রামের মাস্টার বেশী ইংরেজী জানে। নির্দিষ্ট দিনক্ষণে এলাকার হাজার হাজার ছেলেবুড়ো গ্রামের ময়দানে জড়ো হলেন। শুরু হলো দুই মাস্টারের ইংরেজী লড়াই। এক মাস্টার আরেক মাস্টারকে ইংরেজীতে পাল্টাপাল্টি প্রশ্ন করছেন। দুজনের সমর্থকরা পেছনে সমানে চিল্লাচ্ছেন। প্রতিটি উত্তরের সঙ্গে তারা উল্লাসে ফেটে পড়ছেন। কেহ কারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান। এক সময় খনজনা গ্রামের অপেক্ষাকৃত ধূর্ত মাস্টার অন্য মাস্টারের উদ্দেশে প্রশ্ন ছুড়লেন ‘‘বলুন দেখি, আই ডোন্ট নো অর্থ কী?‘‘ রনজনা গ্রামের সহজসরল মাস্টার নিশ্চিন্তে উত্তর দিলেন ‘‘আমি জানি না‘‘। হাজার হাজার দর্শক-শ্রোতা এক সঙ্গে চীতকার দিয়ে লাফিয়ে উঠলো ‘‘সে জানে না, সে জানে না!‘‘ অনেক চেষ্টা করেও সে আম-পাবলিককে বোঝাতে পারলো না যে তার উত্তর সঠিক ছিলো। পরদিন রাত পোহাবার আগে- কাকপক্ষী জাগার আগে রনজনা গ্রামের মাস্টার মশাই বেঁচেবর্তে যাওয়া ইজ্জ্বতআব্র আর তল্পিতল্পা নিয়ে এলাকা থেকে কেটে পড়েন। একই দশা হয়েছে আজ দেশ নিয়ে খোয়াব দেখা ইতিবাচক স্বাপ্নিকদের। দেশ নিয়ে যারা আশাবাদী হতে চান - তাদের কণ্ঠও আজ ‘বাস্তবতা এবং পরিস্হিতির শিকার‘ - এই দোহাই পাড়নেওয়ালাদের শোরগোলে হারিয়ে গেছে।
দুনিয়ার অসংখ্য মণীষী, চিন্তাবিদ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রনায়ক, রাজনীতিবিদ অনেক গুরুত্বপূর্ণ জটিল বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন। এজন্যই বলা হয় 'গ্রেইট মাইন্ডস থিংক অ্যালাইক‘। সেরকম একটা বিষয় হলো অবাধ অন্যায়-অবিচার ধীরে ধীরে সমগ্র সমাজকে গ্রাস করে। আর এ সম্পর্কে ব্যাপক জনগোষ্ঠি, বিশেষ করে সচেতন মানুষের নিরবতা সেটাকে আরো দ্রুত প্রসারিত করে। অন্য অনেকের মত অমর্ত্য সেনও তাঁর এক লেখায় বলেছেন ‘‘নিরবতা হলো সামাজিক ন্যায়বিচারের শক্তিশালী শত্রু।‘‘ এই লেখার শুরুতে উল্লেখিত নেতা যিনি মনে করেন , দেশ ভালো আছে তবে মানুষ ভালো নেই - তাদের মতো লোকদের এতে পোয়াবারে হয়। তারা বোমা আর হরতালের ভয় দেখিয়ে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে পারে তাদের - যারা দেশের মাটি ও মানুষের মধ্যে কোন তফাত খোঁজে পান না। দেশের মাটি ও মানুষের সম্পর্ক এতই গভীর এতই অবিচ্ছেদ্য যে দুটোকে স্বতন্ত্র সত্ত্বা হিসেবে বিবেচনা করার প্রশ্ন অর্থহীন, অবান্তর এবং বিভ্রান্তিমূলক। এই বোধ যদি দেশের রাজনীতিবিদদের ( বর্তমানে যারা আছেন তাদের প্রায় কেউই এই দলে পড়েন না) অন্তত নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বের একটা উল্লেখযোগ্য অংশের মধ্যে না থাকে তবে আমরা জাতি হিসেবে খুব বেশী দূর এগোতে পারবো না।
©somewhere in net ltd.