![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
রামানুজের নাম বেশি মানুষ জানে না।সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত হতে হলে যেসব আকর্ষণের দরকার হয় তার কিছুই রামানুজের কাছে নেই।মাদ্রাজের এক গরিব গোঁড়া হিন্দু পরিবারে জন্ম, পড়াশুনা বেশি নয়,ম্যাট্রিক পাশ করে ছিলেন কিন্তু কলেজ পর্যন্ত যেতে পারেনি।ছোটখাটো মানুষ পোশাক পরিচ্ছেদে নজর নেই।তাই সাধারণ মানুষ রামানুজের নাম জানে না।রামানুজের নাম জানে গণিতবিদেরা।রামানুজের নাম শুনে শ্রদ্ধার সাথে মাথা নত করে।
রামানুজ ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গণিতবিদ।রামানুজের গল্প নিয়ে একটা কথা প্রচলিত আছে।তার বাবা মায়ের কোনো সন্তান ছিল না বলে হিন্দু ধর্মের এক দেবীর নামগিরি'র কাছে সন্তানের জন্য প্রার্থনা করেন।তার কিছু দিন পর, ১৮৮৭ সনে ২২ শে ডিসেম্বর রামানুজের জন্ম হলে তার মা বাবা সেটিকে দেবীর আর্শীবাদ হিসেবে বিশ্বাস করে নেয়।
রামানুজের পুরো নাম- শ্রীনিবাসা রামানুজ আয়েংগার।বড় হলে নামকরা গণিতবিদ হবেন তাই খুবই স্বাভাবিক ছেলেবেলা থেকেই তার অংকে ঝোঁক দেখা দেয়।স্কুলে থাকতেই পাই-এর বা দুই এর বর্গমূল দশমিকের পর যতখুশি ঘর পর্যন্ত বলে তার বন্ধুদের অবাক করে দিতেন।
রামানুজের বয়স যখন পনেরো তখন তার এক বন্ধু তাকে "সিনোপসিস অফ পিওর ম্যাথমেটিক্স" নামে একটি বই জোগাড় করে দেয়।বইটি এমন কিছু আহামরি বই নয়,অংক শেখার জন্য তো নয়ই।সেটিতে এলজেবরা,জ্যামিতি,ত্রিকোনমিতি আর ক্যালকুলাসের ছয় হাজার থিওরেম একত্র করে দেওয়া ছিলো।রামানুজ বসে বসে সে গুলো পড়তেন আর সেগুলো পড়তে পড়তে তার প্রতিভার দ্বার খুলে গিয়েছিল।
রামানুজ ছাত্র হিসেবে বেশ ভালো ছিলেন।ম্যাট্রিক পরীক্ষায় পাশ করেছিলেন স্কলারশীপ পেয়ে।কিন্তু ভারতবর্ষ তখন ইংরেজী উপনিবেশ-তাই প্রভু ইংরেজের মুখের ভাষা ইংরেজী না জানলে পড়াশুনা করা যায় না।সেটিকে রামানুজের মোটেও উৎসাহ নেই।ফলস্বরূপ তিনি আর কিছুতেই কলেজ পাস করতে পারলেন না।এক সময় সব কিছু ছেড়ে দিয়ে তিনি অংক নিয়ে ব্যস্ত হয় গেলেন।
সংসারের কিছুতেই তার উৎসাহ নেই।দিনরাত শুধু অংক আর অংক।মা-বাবা ভাবলেন ছেলেকে বিয়ে দিলে সংসারে মন হবে।তাই বাইশ বছর বয়সে তাকে বিয়ে করানো হলো।রামানুজ হঠাৎ-ই আবিষ্কার করলেন তার একটি সংসার আছে।সংসার চালানোর জন্য তাকে টাকা উপার্জন করতে হবে।অংক নিয়ে ডুবে থাকলে চলবে না।তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো।তিনি যে অংক ছাড়া আর কিছুই জানেন না! পড়াশুনা ম্যাট্রিক পর্যন্ত কি করবেন তিনি? সবাই বলল,চাকরি খোঁজ,কিন্তু কি চাকুরি করবেন তিনি?একজন রামানুজকে বুদ্ধি দিল রামচন্দ্র রায় নামে একজন ক্যালেক্টরের সাথে দেখা করতে।ভদ্রলোক নাকি রামানুজের মত অংক ভক্ত।রামানুজ তার অংকের খাতা বগলে নিয়ে রামচন্দ্রের সাথে দেখা করতে গেলেন।তাকে মুগ্ধ করার জন্য রামানুজ তার বড় বড় আবিষ্কার গুলো বুঝানোর চেষ্টা করলেন।লাভের মাঝে লাভ কিছুই হলো না।রামচন্দ্র রামানুজের কোনো কথাই বুঝতে পারলেন না।রামানুজ হাল ছাড়লেন না।
পরের দিন আবারো গিয়ে হাজির হলেন।এবার শুরু করলেন সহজ জিনিস দিয়ে।আস্তে আস্তে কঠিন জিনিসের দিকে গেলেন।"ইলিপাটকেল ইনট্রেগাল হাইপার জিওমেট্রিক সিরিজ" সবশেষে "ডাইভারজেন্স সিরিজ"।পৃথিবীর মানুষ তখনও সেটার কথা জানতো না।রামচন্দ্র হতবাক হয়ে গেলেন।তিনি বুঝতে পারলেন তার সামনে বসে থাকা এই বেকার ছেলেটি একজন অসামান্য প্রতিভাবান গণিতবিদ।তিনি রামানুজকে জিজ্ঞাসা করলেন তার কি প্রয়োজন? রামানুজের প্রয়োজন খুব কম।তিনি গণিতবিদের সম্মান বা প্রতিষ্ঠা চান না।কোনোভাবে শুধু খাওয়া পরার ব্যবস্থাটা করতে চান।যেন নিজের মনে অংক নিয়ে ডুবে থাকতে পারেন।
কিন্তু ব্যাপারটা এত সহজ হলো না।রামানুজ কারো জন্য বাধা-ধরা কাজ করতে পারেন না।তাই রামচন্দ্র অনেক চেষ্টা করেও রামানুজের জন্যে একটা বৃত্তির ব্যবস্থা করতে পারলেন না।রামানুজ বাধ্য হয়ে মাদ্রাজের পোর্ট ট্রাস্টে একটা কেরানির চাকুরি নিলেন।চাকরির ফাঁকে ফাঁকে যতটুকু সময় পাওয়া যায় তিনি তার অংক নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন।বয়স যখন তেইশ বছর,তখন "জার্নাল অফ ইন্ডিয়ান ম্যাথমেটিক্যাল সোসাইটিতে" তার প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়।এদিকে রামচন্দ্র অনেককে রামানুজের অসামান্য প্রতিভার কথা গল্প করেছেন।সবাই মিলে ঠিক করলেন রামানুজের কেমব্রিজের অংকের অধ্যাপক জি,এইচ হার্ডিকে চিঠি লেখা উচিত।হার্ডি তখন ট্রিনিটি কলেজের ফেলো জগৎজোড় তার নাম।রামানুজ ভয়ে ভয়ে একটা চিঠি লিখলেন।তার ইংরেজী খুব খারাপ ছিল।তাই তার বন্ধু বান্ধব চিঠির ভুল ত্রুটি শুধরে দিল।চিঠিটা অনেকটা এইরকম,
"জনাব,
অধীনের বিনীত নিবেদন এই যে,আমি মাদ্রাজের পোর্টট্রাস্টে একজন কেরানি।মাসিক বেতন দেড় পাউন্ড।আমার বয়স তেইশ(আসলে তখন তার বয়স ছিল ২৫ বছর)।আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা বেশি নয় কিন্তু আমি অবসর সময়ে অংক চর্চা করিয়া থাকি।আমি "ডাইভারজেন্স সিরিজের" ওপরে একটু কাজ করিয়াছি।তার ফলাফল স্থানীয় গণিতবিদরা "অসাধারণ" বলিয়া মনে করিতেছেন।আমি আপনাকে আমার কিছু ফলাফল লিখিয়া পাঠাইলাম।আমি অত্যন্ত দরিদ্র।তাই যদি এগুলোর কোনো প্রকার গুরুত্ব রহিয়াছে মনে করেন আপনি তাহা প্রকাশের দায়িত্ব নিলে কৃতজ্ঞ থাকিব।আমার অভিজ্ঞতা অত্যন্ত অল্প তাই আপনার উপদেশ আমার কাছে অত্যন্ত মূল্যবান বলিয়া বিবেচিত হইবে।
আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করিবার জন্য আন্তরিক দুঃখিত।
নিবেদক
আপনার একান্ত অনুগত
রামানুজ
(চিঠির শেষে হাতে লেখা ১২০ টা থিওরেম!)
সুদূর ভারতবর্ষের এক কোনা থেকে লেখা অচেনা একজন কেরানির এই চিঠি পেয়ে হার্ডির আক্কেল গুডুম। তিনি নিজে অসাধারণ গণিতবিদ।থিওরেমগুলিকে একবার চোখবুলিয়েই বুঝতে পারলেন পৃথিবীতে একজন অসাধারণ গণিতবিদের আবির্ভাব হয়েছে।রামানুজের থিওরেমগুলির কোনো কোনটিই তিনি আগে দেখেছেন।কোনো কোনটিই পৃথিবীর অন্য বড় গণিতবিদেরা প্রমান করে গেছেন।রামানুজ জানতেন না বলে নিজে আবার করেছেন।কয়েকটা থিওরেম হার্ডি নিজে অনেক কষ্টে প্রমাণ করে দেখলেন।কিন্তু বেশির ভাগই তার নাগালের বাইরে।সবকিছু দেখে তিনি স্তম্বিত হয়ে গেলেন।তিনি তাড়াতাড়ি রামানুজের সাথে যোগাযোগ করলেন।
শেষ পর্যন্ত দেশে রামানুজের খানিকটা স্বীকৃতি দেয়া হল।এই উপমহাদেশের শিক্ষিত সমাজ সাদা চামড়ার বড় ভক্ত।তাই হার্ডির স্বীকৃতি পাওয়ার পর তাদের টনক নড়ল।তারা তাড়াতাড়ি রামানুজকে একটা বৃত্তি পাইয়ে দিলেন।নোবেল প্রাইজ পাবার আগে কবি রবীন্দ্রনাথেও এই দেশে অনেক জ্বালা যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে।এখন এটি কমে যাওয়ার কথা কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তা সত্যি নয়।
চেষ্টা করতে থাকলেন রামানুজকে কেমব্রিজ নিয়ে আসতে।কিন্তু রামানুজ কিছুতেই রাজি হন না।তিনি গোঁড়া হিন্দু,সমুদ্র পাড়ি দিলে জাত নষ্ট হবার ভয় আছে।সমস্যাটার সমাধান হল আশ্চর্যভাবে।তার মা স্বপ্নে দেখলেন নামগিরি দেবী তার ছেলেকে আর্শীবাদ করে বিদেশ যেতে বলছে! রামানুজ কেমব্রিজ হাজির হলেন।
রামানুজকে স্বচক্ষে দেখে হার্ডির দ্বিতীয়বার আক্কেল গুডুম হলো।এতবড় একজন গণিতবিদ কিন্তু আধুনিক গণিতশাস্ত্রের কিছুই তিনি জানেন না।হার্ডির নিজের ভাষায় এটা হচ্ছে একটা মস্ত বড় ধাঁধাঁ!?
তাকে আধুনিক অংক শাস্ত্র কীভাবে শেখানো যায়?রামানুজের অংকে যে পরিমান দখল সে পরিমাণ দুর্বলতা।এই যে ব্যক্তিটি,যে মডুলার ইকুয়েশান সমাধান করতে পারেন,অচিন্তনীয় সূক্ষ্মভাবে কমপ্লেক্স গুণণ করতে পারে,চলমান ভগ্নাংশের যার জ্ঞান পৃথিবীর যে কোন গণিতবিদের কল্পনার বাইরে,যে নিজে নিজে জেটা ফাংশনের কাংযকরী সমীকরণ বের করেছে যে নাম্বার থিওরির অসংখ্য বিখ্যাত সমস্যা সমাধান করেছে সেই একই ব্যক্তি ডাবল পেরিওডিক ফাংশান বা কশির থিওরেম নাম শুনেনি,কমপ্লেক্স ভেরিয়েবলের মতো সাধারণ ব্যাপার সম্পর্কে যার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই!গাণিতিক সমাধান কি জিনিস সে সম্পর্কে তার নিজের ধারণা ভীষণ অস্পষ্ট!তার সমস্ত গাণিতিক সমাধান তা নতুন হোক আর পুরাতন হোক।ভুল হোক আর শুদ্ধ হোক সব সময়েই করা হয়েছে আশ্চর্য গোলমেলে একটা জগাখিচুড়ি জাতীয় যুক্তিতর্ক দিয়ে।ভাসাভাসা অনুমান আর আন্দাজ দিয়ে।সবচেয়ে মজার কথা হল সে নিজে পরিষ্কার করে কখনো কাউকে সেটা বুঝাতে পারেনি।
রামানুজ অন্যকে বুঝাবেন কি করে!অনেক সময় তিনি নিজেই বুঝেন না তিনি সেটা কিভাবে করেছেন।প্রায়ই ঘুম থেকে উঠে একটা কাগজে লিখে রেখেছেন-ঘুমের মাঝে তাকে না কি নামগিরি দেবী এসে বলে গেছেন!
হার্ডি অনেক চিন্তা করলেন রামানুজকে নিয়ে।তাকে আধুনিক অংকশাস্ত্র শেখাতেই হবে।কারণ অনেক সাধারণ জিনিস তিনি জানেন না।ফলস্বরূপ প্রাইম সংখ্যার উপর তার অনেক ভুল বেরিয়েছে।কিন্তু আধুনিক অংকশাস্ত্র শেখাতে গিয়ে যদি তার রহস্যময় ক্ষমতার কোনো ক্ষতি হয়?হার্ডি সেই ঝুকি নিয়েই সাবধানে রামানুজকে আধুনিক অংক শাস্ত্র শেখাতে শুরু করলেন হার্ডির নিজের ভাষায়।তাকে আর শিখিয়েছি কতটুকু,আমি শিখেছি তার কাছ থেকে।হার্ডির চেষ্টার ফল পাওয়া গেল সাথে সাথেই রামানুজ তার নতুন জ্ঞানের সাথে নিজস্ব রহস্যময় প্রতিভা একত্র করে চমকপ্রদ কাজ শুরু করলেন।পৃথিবীর গণিতবিদরা বিস্মিত হয়ে এই আশ্চর্য মানুষটিকে লক্ষ্য করতে থাকে।
১৯১৭ সালে বসন্ত কালে তিনি রামানুজ অসুস্থ হয় পড়েন।এরপর তিনি আর পুরোপুরি সুস্থ হননি।তার বেশির ভাগ সময় কেটেছে বিভিন্ন স্যানিটরিয়ামে।মাঝে মাঝে বের হয়ে এসেছেন অনেক উৎসাহ নিয়ে তারপর আবার অংকে ডুবে গেছেন।তার জীবণের কতগুলি শ্রেষ্ঠ কাজ এই সময়ে করা হয়েছিল।পৃথিবীর সব গণিতবিদেরা এই রুগ্ন মানুষটিকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গণিতবিদ হিসেবে মেনে নিয়েছেন তাকে বলা হয় "গণিতবিদদের গণিতবিদ"! রামানুজ নিজে কখনও সম্মান বা স্বীকৃতির জন্য ব্যস্ত ছিলেন না কিন্তু পৃথিবীর গুণীজন তাকে স্বীকৃতি দেওয়ার সম্মানটুকু হারাতে চাইলেন না।অনেক জাঁকজমকের সাথে তাকে রয়াল সোসাইটির মেম্বার এবং ট্রিনিটি কলেজের ফেলো করা হল।
১৯১৯ সালে দেশে ফিরে এসে এক বছরের মাঝে যক্ষ্মায় গণিতের এই মহারথী মাত্র তেত্রিশ বছর বয়সে মারা যায়।রামানুজের শেষ জীবণের একটি ছোট ঘটনা-রামানুজ তখন বিষণ অসুস্থ তাই রামানুজকে হার্ডি দেখতে আসলেন।রামানুজ সংখ্যা নিয়ে খেলা করতে খুব ভালোবাসতেন।হার্ডি তাই কথা প্রসঙ্গে বললেন,আমি যে ট্যাক্সিতে এসেছিলাম সেটার নাম্বার ১৭২৯,কী সাধারণ একটা সংখ্যা! রামানুজ সাথে সাথে প্রতিবাদ করে বললেন-কে বলেছে এটা সাধারন সংখ্যা? এটি হচ্ছে সেই ক্ষুদ্রতম সংখ্যা যেটি দুইভাবে দুটি সংখ্যার কিউবের সমষ্টি হিসেবে লেখা যায়।যদিও এটি চমৎকার একটি গল্প কিন্তু এটি রামানুজের প্রতিভার উপযুক্ত গল্প নয়।রামানুজের সংখ্যা নিয়ে হিসেব করার যে অসাধারন ক্ষমতা ছিল এটি তার প্রমাণ মাত্র।কিন্তু কেউ যেন মনে না করেন সেটাই তার প্রতিভা।তার সত্যিকার গাণিতিক প্রতিভা অনুভব করতে পারেন শুধুমাত্র গণিতবিদেরা।তাইতো-"রামানুজ সর্বকালের শ্রেষ্ঠ গণিতবিদ হয়েও সাধারণ মানুষের কাছে এখনো এত অচেনা!"
©somewhere in net ltd.