নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সবার জন্যে শিক্ষা। আমার জন্যে তো বটেই। নিজে আগে শিক্ষা নিয়ে আরেকজনের মাঝে তা ছড়িয়ে দেওয়া...এটাই থাকবে আমার লেখাগুলোর উদ্দেশ্য।
''দেখ দেখ, ব্যাটা কি ছোঁচা। মেডেলটাই মুখে পুরে দিয়েছে।'' দাঁত দিয়ে পদক কামড়ানো অলিম্পয়ানের ছবি টিভিতে দেখে আমার ছোটবেলায় এক বন্ধু'র করা এ মন্তব্য এখনো কানে বাজে। অলিম্পিক যারা দেখছেন, তারা হয়তো খেয়াল করেছেন যে স্বর্ণ জেতা এথলেটরা প্রায়ই তাদের পদকে দাঁত দিয়ে এক কামড় বসিয়ে দেন। এটা শুধু অলিম্পিকে না, অন্যান্য প্রতিযোগিতাতেও হর-হামেশাই দেখা যায়। ছোট কালে অবাক ভাবতাম এটা কেন করেন তারা? উনাদের মা-বাবারা কি শিখাননি যে- খাওয়া ছাড়া অন্য কিছু মুখে দেওয়া উচিৎ না, তাতে পেট খারাপ হতে পারে! নাকি তাদের খাদ্যদ্রব্য কেনার টাকা নেই বলেই ঐ সোনার পদকটা খাওয়ার চেষ্টা করে ক্ষিধার জ্বালা মিটান? আচ্ছা ঐ সোনার পদক খেতে কি রকম? টক, ঝাল না মিষ্টি? বন্ধুমহলে এসব নিয়ে তখন তুমুল আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠতো।
এরকম কত শত প্রশ্ন যে মনের অলি-গলিতে ঘুরপাক খেত তখন! বেচারাদের জন্য খুব মায়াও হতো খুব। আহা, ওরকম ভুখা-নাঙ্গা হয়েও তারা কেমন সোনার পদক পেয়ে যায়, আর আমি কিনা এতো খেয়েও স্কুলের বার্ষিক দৌড় প্রতিযোগিতায় বাকি সবাইকে খেদিয়ে সবার পিছনে দৌড়ে ফিনিশিং লাইন টাচ করি! এরকমই যখন আমার চিন্তা জগতের দৌড়, তখন একদিন জানতে পারলাম যে, মানুষ নামক প্রাণীটি শুধু খাওয়ার জন্যেই মুখে কিছু তুলে না, আরো অনেক কারণই আছে যা দায়ী এর পিছনে! আর সেরকম কোন একটি কারণেই হয়তো মাইক টাইসন প্রতিদ্বন্দ্বীর কানে রাম কামড় বসিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্ত কথা হচ্ছে,
''টাইসনের কাজ টাইসন করেছে, কামড় দিয়েছে কানে।
তাই বলে কি অলিম্পিক জয়ীদের,
সোনাতে কামড় দেওয়া মানে?''
দাঁতের আসল কর্ম, সাংবাদিকরাই বুঝিলো মর্ম:
অনেক দিন ধরে বিস্তর ভেবেও উপরের মহাজাগতিক প্রশ্নের কোন কুল-কিনারা করতে না পেরে যখন প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম, গতকাল হঠাৎ করেই ইন্টারনেটে এর একটি যুৎসই জবাব পেয়ে গেলাম। লেখাটা পড়ে যা জানতে পারলাম, সেইটা এরকম-
১. অলিম্পিক জয়ীরা খাদ্য দ্রব্যের অভাবে মুখে সোনার পদক পুরে দেন না।
২. এর প্রধান কারণ হচ্ছে- উপস্থিত ফোটো সাংবাদিকদের নিছক অনুরোধের ঢেকি গিলেই উনারা এ কাজটি করেন।
আবারো সেই সাংবাদিক! ইনারা এমনই চিজ যে অলিম্পিয়ানদেরও সোনার পদক চাবাতে বাধ্য করেন! মনের মধ্যে এ নিয়ে একটু কাতুকুতু শুরু হয়ে যাচ্ছিলো আবার, ভাগ্যিস বাকি লেখাগুলোও চোখে পড়েছিলো! সেগুলো পড়ে আরো যা জানতে পারলাম, আসলে শুধু সাংবাদিকদের অনুরোধেই এ কাজটি করেন না এথলেটরা। এর পিছনে আছে প্রাচীন এক ইতিহাস।
স্বর্ণ চিনতে দাঁতের ব্যবহার:
যার শুরু সেই উনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে। স্বর্ণের তখন রমরমা ব্যবসা। তাহলে কি হবে, এর মাঝেও ছিলো এক মহা দুর্বিপাক। স্বর্ণ আসল না নকল তা চিনতে বিশাল সমস্যায় পরতে হতো ব্যবসায়ীদের। আর সে সুযোগে অসাধু বেনিয়ারা উপরে স্বর্ণের পাতের প্রলেপ দেওয়া ধাতুকে স্বর্ণ বলে চালিয়ে দিয়ে খদ্দেরদের প্রায়ই ঠকাতো তখন। এতে করে মহা মুশকিলে পড়ে স্বর্ণ ব্যসায়ীরা। কি করা তাহলে? ব্যবসা যে লাটে উঠার অবস্থা! এরকমই এক ক্রান্তি কালে তারা একটা উপায় আবিস্কার করেন আসল স্বর্ণ চেনার। স্বর্ণতে কামড় দিয়ে তা পরীক্ষা করার এই যুগান্তকারী উপায়টিই তখন বাঁচিয়ে তাদের দেয় অসাধু বেনিয়াগোষ্ঠী'র হাত থেকে। আর সেই থেকেই স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের স্বর্ণের বারে কামড় দিয়ে সেইটা খাঁটি কিনা পরীক্ষা করার প্রচলন শুরু হয়। যদি আসল না হয়ে শুধু সোনার প্রলেপ দেওয়া থাকতো, তাহলে একটু জোরে কামড়ে ধরলেই উপরের প্রলেপটা উঠে চলে আসতো। আর খাঁটি হলে শুধু দাঁতের দাগটাই বসতো, অন্য কিছু হতো না।
কৌতুহলীদের জন্যে এখানে বলে নেওয়া প্রয়োজন, দাঁতের এনামেলের কাঠিন্য স্বর্ণ ও রৌপ্যের চেয়ে অনেক বেশি। জার্মান বিজ্ঞানী ফ্রেডেরিখ মোহ-এর মিনারেল কাঠিন্যের স্কেইল অনুযায়ী সোনার ও রুপার কাঠিন্যের মান যেখানে যথাক্রমে ২.৫ ও ২.৭(প্রায়), দাঁতের এনামেলের কাঠিন্য মান প্রায় দ্বিগুণ- ৫ (পাঁচ)! দাঁতের কাঠিন্য এমনকি স্টিল বা প্লাটিনামের (৪-৪.৫) চেয়েও বেশি! সেজন্যে, দাঁতে কেটে সোনা বা রুপায় দাগ কাটা মোটেই কঠিন কোন বিষয় নয়। এখানে কৌতুহলীদ্দিপক একটি বিষয় হচ্ছে- কোন বস্তু'র কাঠিন্যের মান অন্যটি'র চেয়ে কিছুটা বেশি হলেই এটা বুঝায় না যে, বস্তু দুটির কাঠিন্য কাছাকাছি ধরণের। মোহের স্কেইল অনুযায়ী ডায়মন্ডের কাঠিন্যের মান ১০, অন্য দিকে কোরানডামের (corundum) মান ৯। মানের দিক থেকে মাত্র 'এক' বেশি হলেও ডায়মন্ড কিন্তু, কোরানডামের চেয়ে চার গুণ বেশি কঠিন।
এটা জেনে আবারো একটা ভাবনার উদয় হলো হঠাৎ। কোন কিছু'র খাটিত্ব বা দাম বুঝাতে আমরা স্বর্ণের সাথে আর কাঠিন্য বুঝাতে স্টিল বা প্লাটিনামের সাথে তুলনা দিয়ে থাকি। সেই যে গানটা-
''ওগো সোনার চেয়ে খাঁটি, আমার দেশের মাটি।''
আচ্ছা, এখানে গানটির লেখক কেন দাঁতের সাথে তুলনা দিলেন না! 'খাঁটি' অর্থ যদি 'যাতে কোন ভেজাল নেই' বুঝায় আর কোন কিছুর খাটিত্ব পরীক্ষার যদি কোন মাপকাঠি থেকে থাকে (যেমন: মোহ-এর মিনারেল কাঠিন্যের স্কেইল), তাহলে তো বলতে হয় আমাদের দাঁত স্বর্ণের চেয়ে বেশি খাঁটি। তাই না? তাহলে তো গানটা এমনো হতে পারতো- ''ওগো দাঁতের চেয়ে খাঁটি, আমার দেশের মাটি।'' তা না বলে জন্মভূমির মাটিকে স্বর্ণের সাথে তুলনা দিলেন কেন তিনি! নাকি খাঁটিত্ব নিরুপনে কোন কিছু'র কাঠিন্যতা কোন প্রভাব ফেলে না? ঠিক বুঝতে পারছি না। আরো গভীর ভাবে একটু ভাবতে হবে এ নিয়ে।
সোনার মেডেল স্বর্ণের তৈরী নয়!:
এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, তবে কি অলিম্পিয়ানরা তাদের পদকের সোনার খাটিত্ব সম্পর্কে সন্দিহান হয়েই এমনতরো কাজ করে থাকেন? আসলে কিন্ত তা না। যদিও অলিম্পিকের সোনার মেডেল নিরেট স্বর্ণ দিয়ে তৈরী নয়। ৩ মিলিমিটার পুরু আর ৬০ ডায়ামিটার বিশিষ্ট মেডেলগুলো আসলে 'স্টারলিং রুপা' দিয়ে বানানো হয়। প্রতিটি সোনা ও রুপার পদকের ৯২.৫% অংশই এই রুপার ধাতু দিয়ে তৈরী হয়। আর সোনার পদকগুলো মোড়া থাকে মাত্র ২৪ কেরেট (৬ গ্রাম) স্বর্ণের পাত দিয়ে ! তবে, ১৯০৪-১২ সালের তিনটি অলিম্পিকে ইভেন্টগুলো'র বিজয়ীদের কিন্তু নিরেট স্বর্ণের পদক দেওয়া হয়েছিলো, যদিও সেগুলো আকারে ছিলো বেশ ছোট। এর আগে, ১৯০০ সালের অলিম্পিকের বিজয়ীরা পেয়েছিলেন ট্রফি বা কাপ। আর, ১৮৯৬ সালের গ্রীষ্ম অলিম্পিকের বিজয়ীদের দেওয়া হয়েছিলো রুপার তৈরী পদক আর দ্বিতীয় স্থান অধিকারীরা পেয়েছিলেন তামা'র (ব্রোঞ্জ) পদক। ১৯১২ সালের সুইডেনে অনুষ্ঠিত অলিম্পিকেই শেষ নিরেট স্বর্ণের তৈরী পদক দেওয়া হয়, এরপর থেকেই স্বর্ণের নামে রুপার পদক হাতে ধরিয়ে দেওয়ার প্রচলন শুরু। সোনার নামে রুপা! এবারে কেমন যেন ভাওতাবাজী'র গন্ধ পাচ্ছি মনে হলো!
পদক কামড়ে দেওয়ার আরো কিছু কারণ:
পদক স্বর্ণের তৈরী কি রৌপ্যের, বিজয়ী এথলেটরা বোধকরি এ নিয়ে তেমন একটা চিন্তা-ভাবনা করেন বলে মনে হয় না। সম্মানটাই বড় এখানে। আসলে পদকে কামড় দেওয়ার আরো কিছু কারণ আছে, শুধু সাংবাদিকদের দিয়ে ক্যামেরার সামনে পোজ দিয়ে ছবি তুলাটাই সব কিছু নয়। ট্রেকের কিংবদন্তী উসাইন বোল্ট বা সাঁতারের রাজা ফেলপসে'র মত অনেকেই আছেন যারা অলিম্পিক কি অন্যান্য প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকারকে অভ্যেসে পরিণত করে ফেলেছেন। এখন, ১০০ বা ২০০ মিটার দৌড়ে যদি একই মানুষ প্রথম হয়ে সোনার পদক পান, বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পর কিভাবে করে বুঝবেন কোনটা কোন ইভেন্টের পদক? আর এরজন্যেই কিন্তু অনেক বিজয়ীরা এ কান্ড করে থাকেন যাতে করে পদক চেনা সহজ হয়। তবে, কিভাবে উনারা নিজেদের দাঁতের কামড় দেখে সেইটা নির্ণয় করেন, এটা জিজ্ঞেস করে বসলেই কিন্তু মুশকিল! প্রশ্নটা যে আমারও!
দাঁতের কামড়ের কিন্তু আরেকটি বিশেষ মাহাত্য আছে। আর তা হচ্ছে, কখনো যদি পদক চুরি হয়ে যায় আর পরে সেইটা পাওয়া যায় কোন ভাবে, এথলেটদের দাঁতের কামড় বিশ্লেষণ করেই কিন্তু প্রমাণ করা যাবে সেইটা কার পদক। আর সেইজন্যেও কিন্তু এথলেটরা হাসি মুখে তাতে দিব্যি কামড় বসিয়ে দেন।
পরিশেষ:
অনেক কিছুই তো জানা হলো অলিম্পিকের সোনার পদক সম্পর্কে! এবারে অপেক্ষার পালা, কবে আমাদের দেশ থেকে একজন সেইটা গলায় ঝুলিয়ে নিয়ে দেশে পাড়ি জমাবেন। ব্লগারদের মাঝে আছেন কি এমন কোন সাহসী ব্যক্তিত্ব যিনি বুক ফুলিয়ে বলতে পারেন- ''পারি কি না পারি, আগামী অলিম্পিকে অন্ততঃ একটি ইভেন্টে হলেও স্বর্ণ পদকের জন্যে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি''? পরের অলিম্পিক চার বছর পর। হাতে এখনো কিন্তু বিস্তর সময়। এভারেস্ট বিজয়ের পর এবারে সময় হয়েছে অলিম্পিকে কিছু একটা করে দেখানোর পালা। আমি এমন দিনের স্বপ্ন দেখি যখন আমাদের দেশের রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানকে ''বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ যারা কখনো অলিম্পিকে কোন পদক জেতেনি'' এই পরিচয়ে পরিচিত করিয়ে দেওয়া হবে না। তাদের এই পরিচয় শুনে লজ্জায় আমাদের নত মাথা আরো নত হয়ে যাবে না আর কোন দিন। আশা করি বাংলাদেশের আর্চার, জুডোকার আর শ্যুটাররা আমাদের হতাশ করবেন না। সেই আশাতেই বুক বেধে থাকলাম।
সূত্র:
১. জন পারকার (২০১২), Top five odd Olympic questions answered, ইয়াহু স্পোর্টস।
২. ডেভেন হিস্কি (২০১২), Why do olympians bite their medals?, টু ডে আই ফাউন্ড আউট।
৩. এনি মেরি হেলমেনস্টিন (২০১২), What Are Olympic Medals Made Of?, এবাউট ডট কম।
৪. উইকিপিডিয়া
১২ ই জুলাই, ২০১৫ রাত ১২:৩৯
শাইয়্যানের টিউশন (Shaiyan\'s Tuition) বলেছেন: আপনাকেও ধন্যবাদ।
©somewhere in net ltd.
১| ১১ ই জুলাই, ২০১৫ রাত ১০:৩৯
শহুরে আগন্তুক বলেছেন: দাঁতের কাঠিন্যর মজার তথ্যটা নতুন জানলাম । ধন্যবাদ