![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি বাংলাদেশি ....আমি বাঙালী....আমি মুসলিম....আমি বাংলার জন্য জীবন দিতে সর্বদা প্রস্তুত ।
২০০৭ সালের চৈত্রের প্রখর রোদ থেকে বাঁচতে রিক্সাতে করেই একুশে হলের গেট থেকে মোকাররম ভবনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। ভৌত রসায়নের ব্যবহারিক ক্লাস এক মিনিট দেরি করা যাবে না। যদিও আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ বছরে কখনো ল্যাব ক্লাসে অমনোযোগী ছিলাম না এর পরেও ভৌত রসায়নের ব্যাবহারিক ক্লাস একটু বেশিই কড়াকড়ি থাকে। ফলে ঐ ক্লাসের ব্যাপারে আরও বেশি যত্নশীল ছিলাম।
রিকশা শহিদুল্লাহ হলের কাছা কাছি আসার পরে ফুটপাথ দিয়ে এক দম্পতিকে হেটে যেতে দেখে কেন যেন মনে হল স্ত্রী কন্যার মাথায় ছাতা ধরে রাখা ব্যক্তিটি আমার পরিচিত কেউ। রিকশা আরেকটু কাছে আসতেই চিনতে পারলাম আমার পরম শ্রদ্ধেয় রণজিৎ বাড়ৈ স্যার। যিনি আমাদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন এবং আমরাই একমাত্র ব্যাচ যারা ওনার তত্ত্বাবধানে এস এস সি পাশ করি। সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি ছিল উনি ওনার দুই বছরের কম সময়ের পরিশ্রমে আমাদের স্কুলকে এস এস সি ফলাফলের ভিত্তিতে জেলাতে প্রথম স্থান অধিকার করিয়ে আনেন। সেই রণজিৎ স্যারকে ক্যাম্পাসে পেয়ে আমি আনন্দে রিকশা থামতে না বলেই নেমে দৌড়ে স্যারের সামনে গিয়ে দাড়িয়ে বললাম আদাব স্যার কেমন আছেন?
রণজিৎ স্যার আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন "আরে মাহাতাব না, তাহলে তো আমি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রয়েছি, ঠিক পথেই যাচ্ছি তাহলে"। স্যারের কথা শুনে চোখে পানি এসে গেল। প্রায় ৫ বছর পরে স্যার আমাকে দেখেছেন এর চেয়ে বড় কথা হল এই ৫ বছরে আমি কোনদিন স্যারের সাথে যোগাযোগ করতে পারি নি। অথচ ২০০১ সালের সেই মাহাতাবের চেহারার আমূল পরিবর্তন স্যারকে তাঁর ছাত্রকে চিনে নিতে একটুও বেগ পাইয়ে দেয় নি এমন কি আমি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করি এই সংবাদ টুকুনও স্যার নিজের মেমরিতে রেখেছেন! আমি সাথে সাথে স্যারের কাঁধের ব্যাগটা নেবার ব্যর্থ চেষ্টা করে ম্যাডামের হাতের ব্যাগখানা কেড়ে নিলাম এবং বললাম স্যার আপনি অনেক ক্লান্ত চলেন কোথাও বসি কিংবা আমার হলের গেস্ট রুমে আপনারা বসেন আমি সব ব্যাবস্থা করছি। উত্তরে স্যার জানালেন স্যারকে আজই ফিরতে হবে কারন স্যারের বর্তমান কর্মস্থল বরিশাল বাবুগঞ্জ হাই স্কুল থেকে স্যার মাত্র একদিনের ছুটি নিয়ে এসেছেন মেয়ের ডাক্তার দেখাতে। সুতরাং সময় নষ্ট করা যাবে না এতে করে ছাত্রদের ক্ষতি হবে। কিন্তু সমস্যা হল সদরঘাট থেকে এক রিক্সাওয়ালা স্যারকে ভুল বুঝিয়ে সহ্রেওয়ারদি হাসপাতাল নিয়ে যাবে বলে কাজী আলাউদ্দিন রোডের এক ক্লিনিকে নিয়ে আসে। সেখান থেকে স্যার হেটে আসছেন কারন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এলে স্যার চিনতে পারবেন আসলে স্যারকে কোন দিকে যেতে হবে।
স্যারকে বললাম তাহলে স্যার ডাব নেই পানি খেয়ে একটু ঠাণ্ডা হন এর পরে আমি আপনাকে নিয়ে পৌঁছে দিব। এখানেও স্যারের আপত্তি। শেষে স্যারের মেয়েটিকে একটা ডাব কিনে দিয়ে বললাম তুমি খাও আমি দেখি স্যারকে কীভাবে সহজে যাওয়ার ব্যাবস্থা করা যায়। স্যারকে বললাম স্যার সি এন জি নিয়ে দেই, স্যার হেসে দিয়ে বলল "বাবারে আমি একজন শিক্ষক, এ শহরে সি এন জি ভাড়া দিয়ে ঘুরা আমার জন্য বিলাসিতা" পরে বললাম তাহলে বাসেই যাব চলেন স্যার। আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি বললেন "তুমি ক্লাসে যাচ্ছিলে মনে হয়, সুতরাং এখন আমি তোমার কাছ থেকে সর্বোচ্চ যেটুকুন সার্ভিস নিব সেটা হল আমাকে একটা বাসে তুলে দাও যে বাস কলেজগেট যাবে, এর পরে তুমি ক্লাসে চলে যাও।"আমি স্যারকে নিয়ে রওয়ানা দিলাম ৭ নম্বর বাসে তুলে দেবার জন্য। যেতে যেতে বললাম স্যার আপনি আমাকে চিনলেন কীভাবে? স্যার বললেন "শিক্ষক দের এই ক্ষমতা থাকতে হয়, যদি কখনো দেখ তোমার এই ক্ষমতা নেই, তুমি তোমার ছাত্রদের নিজের সন্তান মনে করতে পারছ না তবে কখনো শিক্ষকতা পেশাতে আসবে না।" আমি মাথা নেড়ে সায় দিয়ে স্যারকে গাড়িতে তুলে দিয়ে ক্লাসে চলে গেলাম।
ক্লাসে আমার জন্য শিক্ষক সম্পর্কে নতুন এক তথ্য অপেক্ষা করতেছিল তা আমি ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করি নি। ক্লাসে ঢুকার সাথে সাথে জনৈক শিক্ষক আমাকে ডাকলেন। শিক্ষকঃ কোথায় ছিলে?
আমিঃ স্যার দুঃখিত আমি তো কখনো দেরি করি না আজ একটা জরুরী কাজে দেরি হয়ে গেছে।
শিক্ষকঃ শুনি কি আপনার জরুরী কাজ যে কাজ করতে গিয়ে আমাদের মত মানুষদের ক্লাসে আসতে আপনার এত দেরি হল? দেখি আমরা বেশি ব্যাস্ত নাকি আপনারা, বলেই সতীর্থ শিক্ষকদের দিকে তাকিয়ে এক দিগ্বিজয়ী হাসি দিলেন।
আমিঃ স্যার আমার স্কুলের প্রধান শিক্ষক স্যারের সাথে হঠাৎ দেখা হল, এবং উনি পথ হারিয়ে ফেলেছিলেন তাই ওনাকে সঠিক বাসে তুলে দিয়ে আসতে একটু দেরি হয়ে গেল।
শিক্ষকঃ তো তোমার স্কুলের প্রধান শিক্ষক কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোফেসর? যে এতো গুলো (নিজেদের দিকে আঙুল তুলে) পি এইচ ডি করা প্রোফেসরদের ক্লাসের চেয়ে ওনাকে বাসে তুলে দেয়া জরুরী মনে হল?
আমিঃ প্রমোদ গুনলাম, এই মূর্খের সাথে তর্কে যাওয়ার চেয়ে চুপ চাপ গালি খাওয়া অনেক ভালো। খেলাম নাহয় রণজিৎ স্যারের জন্য একঘণ্টা গালি, তাতেও আমার কিছু যায় আসে না।
উনি আমাকে শাস্তি স্বরূপ পরের গ্রুপের সাথে এই ক্লাস করতে বললেন। ক্লাসটা করেছিলাম এবং ঐ ক্লাসে যা শিখিয়েছে তার তুলনাতে কয়েক হাজারগুন শিখেছিলাম রণজিৎ স্যারের সাথে দশ মিনিট হেটে এবং তাঁর শেষ বাক্যটিতে। ঐ বাক্যটির দ্বারাই বুঝে গিয়েছিলাম ঐ জনৈক শিক্ষক আসলে শিক্ষকতার চাকুরী করে পেশাজীবী নয়। এসকল প্রোফেসররা জানেই না নামের আগে প্রোফেসর এবং একটা টয়োটা গাড়িতে ঘুরতে পারলেই কেউ তাদের শিক্ষক হিসেবে সম্মান কিংবা শ্রদ্ধা করবে না বরং করুনা কিংবা ঘৃণা করতেই পছন্দ করবে।
সে যাই হোক, জাপান আসার পূর্বে সময় কম থাকাতে অনেকের সাথেই দেখা করতে পারি নি। রণজিৎ স্যারের সাথে কথা টুকুনও বলতে পারি নি। পরে চিন্তা করলাম এসে স্যারকে ফোনে জানাব। কিন্তু দুর্ভাগ্য স্যারের নাম্বার হারিয়ে ফেললাম। গত তিন বছর (প্রায়) চেষ্টা করেছি স্যারের নাম্বার যোগাড় করার জন্য কিন্তু স্যারের নাম্বার পাচ্ছিলাম না। গত পরশুদিন (২১/০৭/২০১৬) জানতে পারলাম আমার হলের এক বড় ভাই (আশরাফ ভাই) বাবু গঞ্জের এসি ল্যান্ড। ফেসবুকে ওনাকে মেসেজ দিলাম উনি যেন অনুগ্রহ করে আমার এই প্রিয় শিক্ষকের মোবাইল নাম্বার খানা আমাকে যোগাড় করে দেন।
কিছুক্ষণ পরেই উনি আমাকে ফোন নাম্বার দিলেন আমিও কাল বিলম্ব না করেই স্যারকে ফোন দিলাম। স্যার কল রিসিভ করার পরে আমি বললাম স্যার আমি মাহাতাব। আমাকে আর কিছু না বলার সুযোগ দিয়েই উনি বললেন, "তাই তো বলি এত বড় নাম্বার কেন। কি অবস্থা তোমার তো পি এইচ ডি শেষের দিকে তাই না। জাপান থেকে আসবে নাকি অন্য কোথাও যাওয়ার চেষ্টা করছ?" আমি আবারো লজ্জিত এবং হতবাক। যে শিক্ষকের সাথে আমি আসার আগে একটু দেখা করার সুযোগ পেলাম না তিনি মোটামুটি আমার জাপান আসার দিনক্ষণ গুনে বসে আছেন। স্যারের সাথে কথা বলে ফোন রেখে চিন্তা করলাম।
আসলে ওনারাই শিক্ষক এবং শিক্ষক হবার যোগ্য মানুষ। শিক্ষক নাম ধারী বিবেকহীন প্রানি গুলোর ওনাদের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। হ্যাঁ আমার রণজিৎ স্যারের পি এইচ ডি নেই কিন্তু তাঁর পেশাদারিত্ব শিখতে হলে তোমাদের পি এইচ ডি ধারীদের তাঁর নিকট নতুন করে পি এইচ ডি করতে হবে। এবং এটাই সত্য।
পরিশেষে মহান রাব্বুল আলামিনের নিকট প্রাথনা তিনি যেন আমাকে স্যারের মত একজন শিক্ষক হবার তৌফিক ডান করেন। আর আমাদের শিক্ষক সমাজ কে এই ঘটনা গুলো হতে কিছু শেখার তৌফিক দাণ করেন। আমীন।
২৩ শে জুলাই, ২০১৬ সকাল ৯:০৮
শেখ এম উদ্দীন বলেছেন: ধন্যবাদ
হয়ত আমরা শিক্ষকরা ঐ জায়গাটা থেকে ছাত্রদের কাছে যেতে পারিনা। এর সাথে অনেক শিক্ষার্থীর পিতামাতা তাদের কে শিক্ষকদের কিংবা অন্য কাউকে শ্রদ্ধা করতে শেখাতে চান না। দুটোই হয়ত কারন হবে।
২| ২৩ শে জুলাই, ২০১৬ রাত ৮:২৩
আহমেদ জী এস বলেছেন: শেখ এম উদ্দীন ,
বর্তমানের শিক্ষকদের সম্পর্কে যে সত্যটি বলার তা বলেছেন এখানে - আমিঃ প্রমোদ গুনলাম, এই মূর্খের সাথে তর্কে যাওয়ার চেয়ে চুপ চাপ গালি খাওয়া অনেক ভালো।
আর একজন সত্যিকারের শিক্ষক বলতে যা বোঝায়, তার চিত্র আপনি এঁকেছেন আপনার শ্রদ্ধেয় রণজিৎ স্যারের চরিত্রে ।
তাই প্রাসঙ্গিক হবে বলে এই লিংকটি দিলুম - শিক্ষক” একটি অবহেলিত প্রানীর নাম…..(?)
২৪ শে জুলাই, ২০১৬ ভোর ৪:৫১
শেখ এম উদ্দীন বলেছেন: ধন্যবাদ
কিন্তু যদি বর্তমানের শিক্ষক বলেন তাহলে রণজিৎ স্যার আমি এমন আরও অনেকেই এই সাধারণীকরণের আওতাতে পরে যায়।
এখনো অনেক ভালো মানুষ রয়েছেন এ পেশাতে যার ফলে আমরা কিছু ভালো মানুষ পাচ্ছি সকল পেশা কিংবা চাকুরিতে।
©somewhere in net ltd.
১|
২৩ শে জুলাই, ২০১৬ সকাল ৯:০৩
হাইপেশিয়া লিজা বলেছেন: খুবই দরদ দিয়ে লিখাটি লিখেছেন।পড়ে খুব ভাল লাগলো। বড় বড় ডিগ্রী থাকলেই যে সে মানুষ হিসেবে ভাল হবে এমন আশা করাটা ভুল ।আজকাল ছাত্রদের মধ্য শিক্ষকের প্রতি তেমন শ্রদ্ধা ভক্তি দেখা যায় না । হয়ত আমরা শিক্ষকরা ঐ জায়গাটা থেকে ছাত্রদের কাছে যেতে পারিনা।