নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইচ্ছে থাকিলে উপায় হয়, আমার কেবল উপায় থাকিলেই ইচ্ছে হয়

শিস্‌তালি

Stay Hungry, Stay Foolish!Stay Sexy, Stay Virgin!!!

শিস্‌তালি › বিস্তারিত পোস্টঃ

ণ-ত্ব বিধান!!!

০৫ ই জুলাই, ২০১৩ দুপুর ১২:২৪

" অশ্রুকন্যার অশ্রু কণা নাকি

অশ্রুবালিকার অশ্রুজল,

চতুরঙ্গ বসিয়া ভাবে আর ভাবিয়া বসে

সবই কি ছিল তাহার একারই ভুল!"



এক

ময়মনসিংহ শহরের জে.সি. গুহ রোড, শীতের সকালে বিসমিল্লাহ্ ফার্মেসী খুলেই কড়া এক কাপ চা'য়ের অর্ডার দিলেন মতলব চাচা। দোকানের নতুন ছেলেটা অস্থির স্বভাবের হলেও কাজগুলো বেশ গুছিয়েই করে। চাচা দোকানে আসবার আগেই আসবাবপত্রের ধুলোবালি সব পরিস্কার করে সকালে পত্রিকা নিয়ে সে হাজির। এরপর সে অপেক্ষায় থাকে কখন মতলব চাচা এসে প্রতিদিনকার মতো বলবে, জলদি এক কাপ চা আনতো জহির। আর প্রতিদিন সকালে জহিরের বানানো অসাধারণ চায়ে চুমুক দিতে দিতে সকালের পত্রিকা পড়তে না পারলে ইদানীং মতলব চাচার দিনের শুরুটা কেমন যেন অসম্পূর্ণ মনে হয়।

- 'জহির আরেক কাপ চা বানাতো।' মাথা তুলে তাকায় জহির, বোঝার চেষ্টা করে আরেক কাপ চা কার জন্য! দূর থেকে দেখতে পায় শরীফ ভাই আসছে। শরীফ ভাই ফার্মেসীতে আসে ওষুধ বিক্রি করতে কিন্তু শরীফ ভাইয়ের অবস্থা আর বাকি দশজন মেডিকেল প্রমোশন অফিসারের মতো না। অন্যান্যদের পোশাক- আষাক আর মোটর সাইকেল যেখানে নিতান্তই সাধারণ সেখানে শরীফ ভাই আসে দামী ব্র্যান্ডের শার্ট গায়ে দিয়ে পালসারে করে। মতলব চাচার কাছে শুনেছে মেডিকেল প্রমোশন অফিসারের চাকরী করলেও শরীফ ভাই নাকি বেশ শিক্ষিত আর বনেদী পরিবারের সন্তান। যদিও 'বনেদী' শব্দের আভিধানিক অর্থ ক্লাস এইট পাশ জহিরের কাছে খুব একটা পরিষ্কার নয়।

মোটর সাইকেল পার্ক করেই লম্বা সালাম দেয় শরীফ ভাই প্রতিদিনকার মতো, "আসসালামু আলাইকুম চাচা।" শুনেও না শোনার ভান করে একমনে পত্রিকা পড়তে থাকে মতলব চাচা।

- চাচাজী শরীরটা ভালো?

- ওহ্ তুমি! তা কোত্থেকে আসলা এতদিন পর? (চাচাজীর কন্ঠে খানিকটা অভিমানের সুর)

-আর বইলেন না চাচাজী। খুলনায় জমি-জমা নিয়ে একটা ঝামেলা হয়েছিল। আব্বাতো বেঁচে নাই, এখন আমাকেই সব দেখতে হয়। চাচাদের সাথে ঝামেলার কারণে ওদের কারো ওপর দায়িত্ব দিয়ে ভরসা পাইনা। বাদ দেন চাচা, আজকে একটু তাড়া আছে। কোন ওষুধ কয় কার্টন লাগবে তাড়াতাড়ি বলে ফেলেন আর এই নেন, চাচীআম্মার জন্য সুন্দরবনের মধু আনছিলাম।

-আসলাইতো কেবল! আসতে না আসতেই এত যাই যাই কর কেন? কিরে জহির এখনো চা দিলিনা!

জহির চা এনে অপেক্ষায় থাকে, প্রতিবারের মতো চা খেয়ে শরীফ ভাই "সাবাশ ব্যাটা কি চা বানাইলি" বলে তাকে দশ টাকা বখশিস দিবে সে আশায়।

জহিরের মাঝে মাঝে বেশ অবাকই লাগে, এসিআই-স্কয়ারের মতো বড় বড় ওষুধ কোম্পানীর মেডিকেল প্রমোশন অফিসারদের মতলব চাচা পাত্তাই দিতে চান না বরং কত তাড়াতাড়ি ওষুধের অর্ডার দিয়ে তাদের বিদায় করবেন সে তাড়াহুরোয় থাকেন। অথচ রেনেসা ফার্মাসিউটিক্যালসে্র এই শরীফ ভাই দোকানে আসলে মতলব চাচা যেন তাকে ছাড়তেই চান না।



দুই





- ' মা শেফালী এদিকে আয়তো। দেখে যা তোর জন্য কি আনছি!'

বাবার ডাক শুনেই শেফালী বুঝতে পারে কোন এক কারণে বাবার মনমেজাজ আজ খুব ভালো। উঠোনে এসে তার প্রমাণ পেল বাবার হাতে বিশাল বড় রুই মাছ দেখে।

মতলব মিয়ার এত তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরার উদ্দেশ্য একটাই, আজকে রাতে হইচই করে সবাই মিলে এই রুই মাছ খাওয়া হবে।

রাতে খাবার সময় শেফালী জিজ্ঞেস করে, 'সুন্দরবনের মধু কোথায় পেলে বাবা?'

- শরীফ দিয়েছে তোর মা'র জন্য।খুলনায় তাদের বিশাল অবস্থা। খুব ভালো একটা ছেলে। বাপ-মা মরা এই ছেলেটাকে দেখলে মনটা কেমন যেন খারাপ হয়ে যায়।

শেফালী মা তাহেরা এবার বলে বসলো, সবসময় এত শরীফের গল্প কর, ছেলেটাকে একদিন বাসায় দাওয়াত দিয়ে দু'টা ডাল-ভাত খাওয়ালেই পারো।

মনে মনে শেফালী ঠিক একথাটিই আশা করছিল এবং সে নিজেও চাচ্ছিল ক'দিন আগে শরীফ ভাই তাকে যে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেছিল তার সামন্য প্রতিদান স্বরূপ তাকে নিজ হাতে রান্না করে ভালো-মন্দ কিছু খাওয়াতে।





তিন





- 'হ্যালো! জ্বী ওস্তাদ। আসসালামু আলাইকুম।'

-'কী সমস্যা? কয়েকদিন ধরে কোন যোগাযোগ নাই কেন? এসএমএসে'র রিপ্লাইও দেখি দাও নাই।

-'ওস্তাদ মোবাইলে সমস্যা- এসএমএস করা যায়না। তাছাড়া একটু ঝামেলায় ছিলাম।'

-'ঝামেলাতো তোমার সারাজীবনের। তা নতুন মালের খবর কি?'

-'ওস্তাদ আমাকে এবার একটু বেশী সময় দেন প্লিজ। গুছিয়ে নিতে একটু সময় লাগছে।'

-'দেখ এসব টাল্টি-বাল্টি মার্কা কথা-বার্তা আমার সাথে চলবেনা। গতবার কিরকম ঝামেলা করে আর টাকা-পয়সা খরচ করে তোমাকে তোমারে ছাড়াইসি ভুলো নাই নিশ্চয়।'

- 'জ্বী ওস্তাদ! আপনি আমার মা-বাপ। এবার যে প্ল্যান নিয়ে এগোচ্ছি আপনাকে নিরাশ করবোনা কনফার্ম।'

-'যা করার তাড়াতাড়ি করো।ক্লায়েন্ট কিন্তু ডলার হাতে নিয়ে বসে আছে। কোয়ালিটি মাল হাতে পাওয়া মাত্রই দিয়ে দিবে।'

-'ওস্তাদ আরেকটা কথা! বেনাপোলতো আমার এখান থেকে দূরে হয়ে যায়। শেরপুর দিয়ে একটা ট্রাই দিব নাকি?'

-'দেখ বেশী চালাকি করবানা আমার সাথে। অতি চালাকির ফল কিন্তু শুভ হয়না। ফারুকের পেছনে এই মাসেও ৫০হাজার খরচ করেছি। নিজের আর ফারুকের ভালো চাওতো তোমাকে অ্যাসাইনমেন্ট যেভাবে দেওয়া হয়েছে ঠিক সেইভাবে করো।'

-' জ্বী ওস্তাদ!'

-'দেখ তোমাকে একটা কথা পরিষ্কার বলে দিচ্ছি, যা করার সরকার পাল্টানোর আগেই করতে হবে। এই সময়ের মধ্যে করতে না পারলে কি রকম খারাপ হতে পারে সে সম্পর্কে ধারণা আছে নিশ্চয়। গত বছরের সোলায়মানের ঘটনা আশা করি ভুলো নাই।

-'জ্বী না, ভুলি নাই।'

-'একটা কথা সবসময় মনে রাখবা, এই রহিম শেখের সাথে বেঈমানীর পরিণতি খুব ভয়াবহ। খোদা হাফেয।'

- 'জ্বী ওস্তাদ। আসসালামু আলাইকুম।'

তেজগাঁও শিল্প এলাকার কোন এক গ্রুপ অফ কোম্পানীর ডিপো থেকে বাংলাদেশের অন্য এক শহরের এই ফোনালাপের প্রায় পুরো অংশটুকুই বনানী থানা-ইন-চার্জের মেশিনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে রেকর্ড হয়ে যায় শুধুমাত্র যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে শেষের অতি গুরুত্বপূর্ণ কয়েক মিনিট ছাড়া।





চার





-'এই যে চশমা পড়া কোকড়া চুল উঠে দাড়াও। বাড়িতে যা পড়তে বলেছিলাম পড়ে এসেছ?'- 'জ্বী স্যার।' অ্যাসিস্টেন্ট হেডমাষ্টার জহর লাল স্যারকে দেখলে এমনিতেই ভয়ে ছাত্রদের গলা শুকিয়ে যায়। তার উপর সেটি যদি হয় বাংলা ব্যাকরণ ক্লাস তাহলেতো কথাই নেই!

-'পড়ে যখন এসেছ তখন বলো, অপহরণ কোন 'ণ'?'

ছেলেটি আসলেই পড়ে এসেছিল কিন্তু জহর লাল স্যারের এই রণমূর্তি দেখে এই মুহুর্তে ভুলে গেছে। ভয়ে ভয়ে বললো,'স্যার দন্ত্য ন'।-'তাই? এবার বল খুনী কোন 'ন'?'- অনেক দ্বিধা-দ্বন্দের পর বললো, 'স্যার 'ণ'।' - 'হুম খুব ভালো পড়ে এসেছিস দেখা যাচ্ছে। ডান হাত বাড়া.... (সজোড়ে বেত্রাঘাত)...এইনে অপহরণ এর ভুল বানানের শাস্তি.....বাম হাত বাড়া.... (সজোড়ে বেত্রাঘাত)...এইনে খুনী'র ভুল বানানের শাস্তি....'

স্বপ্নটা দেখেই ঘুম ভেঙ্গে গেল শরীফের। তার গ্রামের প্রাইমারী স্কুলের ভয়ংকর বদরাগী মানুষ ছিলেন এই জহর লাল স্যার। স্যারের ব্যাকরণ ক্লাসে বিশেষ করে ণ-ত্ব বিধান নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দের কারণে প্রায়ই তাকে শাস্তি পেতে হতো। হাতের তালুর দিকে তাকিয়ে তার আসলেই মনে হতে লাগলো, বেতের আঘাতের দাগ বোঝা যাচ্ছে! জহর লাল স্যার বেঁচে আছে কিনা তার একটা খোঁজ নেওয়া দরকার সেটা ভাবতেই ভাবতেই অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসলো তার মোবাইলে!

- 'শরীফ ভাই আসসালামু আলাইকুম। আমি ঠিক করেছি এখন থেকে আর স্লামালাইকুম বলবো না! আপনার মতো শুদ্ধভাবে আসসালামু আলাইকুম বলবো। হিহিহি' (শেফালীর কন্ঠে দুষ্টুমীর সুর)

-'আরে শেফালী নাকি! কি ব্যাপার এতো রাতে হঠাৎ?'

-'কেন আপনার কাছে রাতে ফোন করা মানা নাকি?'

-'নাহ্ তা হবে কেন! আচ্ছা ওই বদমাশটা আর ঝামেলা করে নাইতো কোন?'

-'আরেহ্ নাহ্! আপনি যে শিক্ষা দিয়েছেন.....ব্যাটার সামান্য লজ্জা থাকলেও আর কোন দিন আমার ধারে-কাছে আসবেনা আর আসলেও আমাকে আম্মাজান বলে ডাকবে। হিহিহি' (শেফালীর আবারো খিল খিল হাসি)

-'বাহ্! তোমার হাসিতো অনেক সুন্দর।'

-'তাই নাকি? আপনি মোবাইলে হাসি দেখতে পান? হিহিহি।'

-'না দেখতে পাইনা তবে বুঝতে পারি।'

-'হয়েছে এবার যে জন্য ফোন করেছি তা বলি। ঝটপট আপনার পছন্দের রান্না কি কি বলে ফেলুনতো।'

-'কেন বলোতো?'

-'ওমা বাবা আপনাকে এখনো বলে নাই? আগামী সোমবার রাতে আমাদের বাসায় আপনার দাওয়াত।'

-'তাই নাকি?'

-জ্বী জনাব।'

-'তার মানে আর তিনদিন পর তোমার সাথে আমার দেখা হচ্ছে! খাওয়া-দাওয়াতো আর আসল কথা না তোমার সাথে আবার দেখা হচ্ছে সেটাই আসল!'

- 'থাক হয়েছে! এতই দেখা করার ইচ্ছে থাকলে মাঝে মাঝে আমার কলেজে আসলেওতো পারেন।'

-'কি করবো বল? তোমার কলেজের ওদিকে যেসব ফার্মেসী আছে সেগুলো আমার আন্ডারে না, আরেক এরিয়া ম্যানেজারের আন্ডারে।'

-'হায় খোদা! আমি কি আপনাকে ওষুধ বিক্রি করবার জন্য আমার কলেজে আসতে বলেছি নাকি?'

-'হাহাহা। ভালো বলেছ।

এরপর আরো প্রায় আধা ঘন্টা জুড়ে শেফালী-শরীফের প্রথম ফোনালাপ চলতে থাকে। শেফালী কিন্তু জানেনা শরীফ প্রায়ই তাদের কলেজে যায়। কেন যায়, কখন যায় আর কার কাছেইবা যায় সেটা জানবার আগে আমরা বরং জেনে নেই, যে রুমে শুয়ে শুয়ে শেফালী শরীফের সাথে কথা বলছিল তার ঠিক পাশের রুমেই শুয়ে শুয়ে মতলব মিয়া আর তাহেরা বেগম নিজেদের মধ্যে শেফালী-শরীফের বিয়ের আলাপ করছিল।





পাঁচ





বিসমিল্লাহ ফার্মেসীতে মতলব চাচার সামনে বসে আছে শরীফ।

- 'বাবা শরীফ, তোমার চাচীআম্মা মধু পেয়ে অনেক খুশী হয়েছে। আগামী সোমবার বাদ এশা আমাদের বাসায় তোমার দুইটা ডাল-ভাত খাওয়ার দাওয়াত।'

শরীফ জানে চাচাজীকে 'না' বললেও লাভ হবেনা। তাই রাজী হয়ে গেল। তাছাড়া সে আসলেই খুব তাড়াহুড়োয় আছে। যা হবার খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেলেই ভাল হয়। চিকিৎসার জন্যও খুব দ্রুত অর্থ জোগাড় করতে হবে। কার চিকিৎসা, শরীফের নিজের নাকি অন্য কারও, সেটা আমরা যথাসময়েই জানতে পারবো। এখন সোমবারের আগের ও পরের সব কাজ পরিকল্পনামাফিক হলেই হয়।





ছয়





বুধবার, রাত ১২-২৬; পরিচিত রিংটোনে ঘুম ভেঙ্গে গেল শরীফের।

-'শরীফ ভাই, আসসালামু আলাইকুম। আপনি এত কম খান কেন বলেনতো!'

- 'কে আমি? কই নাতো! সত্যি বলতে কি তোমার আর চাচীআম্মার রান্না এত বেশী মজার চাইলেও কম খাওয়া সম্ভব না। তবে সেদিন আসলেই কিছুটা কম খেয়েছি।'

-'তাই নাকি! কেন কেন? রান্না মজা হয়নি বুঝি!'

-'না তা হবে কেন? তোমাকে দেখেই আসলে পেট অর্ধেক ভরে গিয়েছিল।'

-'হয়েছে আর বলতে হবেনা।' (শরীফ- শেফালী দুজনেই টেলিটক থ্রীজি আর স্মার্ট ফোন ব্যবহার করলে শরীফ হয়তোবা দেখতে পেত এই মুহূর্তে শেফালী কেমন যেন লজ্জা পাচ্ছে)

-'সরি, আমারই আসলে তোমাকে ফোন করে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত ছিল এত সুন্দর আয়োজনের জন্য।'

-'সত্যিই ধন্যবাদ দিতে চান?'

-'হুম চাইতো।'

-'তাহলে এক কাজ করেন কাল সকালে আমার কলেজে চলে আসেন।'

-'কেন বলতো?'

-'আপনার পঙ্খীরাজে করে পুরো ময়মনসিংহ শহর ঘুরবো। অনেকদিন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় যাইনা। ওদিকটায় যাবো যদি আপনার মহামূল্যবান সময় হয়।'

-'হুম কষ্ট করে হয়তো ম্যানেজ করতে পারবো।কিন্তু কাল তাহলে আমার ওষুধ বিক্রি করবে কে ম্যাডাম? তুমি জানো না, তোমার এই শরীফ ভাই সামান্য বেতনের ওষুধ বিক্রেতা মাত্র।'

-'ছি এভাবে বলবেন না। বাবা বলে আপনারা মেডিকেল প্রমোশন অফিসাররা কোন অংশে ডাক্তারের চেয়ে কম না। আপনারা সময় মতো ওষুধ বিক্রি করেন বলেই না আমরা এত সহজে রোগমুক্তি লাভ করি।'

-'হাহাহা বেশ ভালোই বলেছ। তা ম্যাডাম কাল কয়টায় তোমার কলেজে আসতে হবে?'

- ঠিক দশটায়।'

প্রিয় পাঠক, শরীফ ও শেফালী পরদিন মোটর সাইকেলে চড়ে পুরো ময়মনসিংহ শহর ঘুরতে থাকুক, অতিঅবশ্যই জে.সি. গুহ রোড ও বিসমিল্লাহ্‌ ফার্মেসীর আশেপাশের এলাকা ছাড়া। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুজনে সুন্দর একটা সময় কাটিয়ে বাড়ি ফেরার আগেই আমরা বরং ততক্ষণে শরীয়তপুরের হারুন মাস্টারের বাসা থেকে একটু ঘুরে আসি।





সাত





'প্রিয় আব্বাজান,

সালাম নিবেন। আপনার শরীর এখন কেমন? কাশি কি কমেছে কিছুটা? আপনি নিয়মিত ওষুধ খাবেন মনে করে। আমি মোটামুটি আছি। চলে যাচ্ছে দিনকাল বেশ ভালভাবেই। পরসমাচার এইযে, আমি আপনাদের দোয়ায় একটা ছোটখাটো চাকরী পেয়েছি। মাসে পনের হাজার টাকা বেতন। আমার জন্য চিন্তা করবেন না। এখানে কাজের পরিবেশ খুব ভালো। আমি প্রতি মাসে রিমার পড়ালেখার আর আপনার ওষুধ কেনার জন্য কিছু টাকা পাঠাবো। ভালো থাকবেন আর আমার জন্য দোয়া করবেন।

- ইতি আপনার লিমা'

'প্রিয় রিমা,

কেমন আছিস তুই? তোর কথা অনেক বেশী মনে পড়ে। আমি ভালো নাইরে। কষ্টে আছি, অনেক বেশী কষ্টে! তোকে যা বলছি ভুলেও কাউকে বলিস না। যাকে বিশ্বাস করে অনেক আশা নিয়ে তোদের ছেড়ে এসেছিলাম, সেই আমাকে সবচেয়ে বড় ধোঁকা দিয়েছে। কায়দা করে আমাকে বেনাপোল দিয়ে বর্ডার পার করে দিয়েছে। আমি এখন ভারতে। খুব খারাপ কিছু লোকের সাথে এখন আমাকে সারাদিন কাটাতে হয়। তুই মন খারাপ করিস না। তোর সাথে যেদিন দেখা হবে সেদিন বিস্তারিত বলবো। এসব কথা কারও সাথে শেয়ার করিস না। শুধু আমার জন্য দোয়া কর। তোর বুবু যেন তোর কাছে আবার ফিরে আসতে পারি। আমরা দুই বোন যেন আবার শুয়ে শুয়ে এক সাথে গল্প করতে পারি।

- তোর বুবু লিমা'

- 'মা রিমা শুধু আমাকে লেখা চিঠিটাই পড়ে শুনালি, তোকে লেখা চিঠিটা পড়বি না?'

-' না বাবা, আমাকে যে চিঠিটা লিখেছে সেটা দুই বোনের গোপন কথা! আপনাকে বলা যাবে না। আপনি আরাম করে ঘুমান আর বুবুর পাঠানো টাকা থেকে আমার এইচএসসি'র টেস্টের ফীস এর টাকাটা সরিয়ে রাখেন।'

হারুন মাস্টারের ঘরে আজ আনন্দের বন্যা। তার বড় মেয়ে আজ তাকে জীবনের প্রথম আয়ের টাকা পাঠিয়েছে। লিমার মা বেঁচে থাকলে আজ কি আনন্দটাই না পেত। ছেলে জন্ম দিতে না পারার আজীবনের দুঃখটা আজ আনন্দঅশ্রু হয়ে হারুন মাস্টারের দুচোখ ক্রমাগত ভিজিয়ে দিচ্ছে।





আট





একটার পর একটা সিগারেট টানছে শরীফ আর ক্রমাগত ঘামছে। একবার ভাবলো তেজগাঁওয়ে তার ওস্তাদের কাছে ফোন দিয়ে পরামর্শ চাইবে আবার পরক্ষণেই সে চিন্তা বাদ দিল। সমাধান যা করার নিজেকেই করতে হবে। গত পাঁচ বছর ধরে এই কঠিন কাজটি সে সফলতার সাথে করে এসেছে। যত বাধাবিপত্তিই আসুক সে সাহসিকতার সাথে মোকাবেলা করেছে। যদিও সে জানেনা শরীয়তপুরের লীমা, গোপালগঞ্জের পারভীন, যশোরের সালমা কিংবা ফরিদপুরের আসমা এখন কোথায় আছে কেমন আছে। অবশ্য এসব নিয়ে শরীফের কোনরকম অনুশোচনাও নেই। বোকা মেয়েগুলো তাদের বোকামীর খেসারত দিয়েছে। মিডিয়ায় কাজ করার লোভ সামলাতে না পারায় বাস্তব জীবনেই হয়তোবা তাদের এখন আরও অনেকের লোভ-লালসার শিকার হতে হয়। যেই ওস্তাদ এতিম অবস্থায় শরীফ আর ফারুককে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে তার জন্য শরীফ সবকিছু করতে পারে! সবকিছু!

কখনোই সম্পর্কগুলোকে বিয়ে পর্যন্ত গড়াতে দেয়নি শরীফ, তার আগেই কায়দা করে বর্ডারে ওস্তাদের লোকের হাতে তুলে দেয়। এরপর বাকি কাজটা যা করার আন্তর্জাতিক পাচার চক্রের সদস্যরাই করে থাকে। কিন্তু এবারের অবস্থা ভিন্ন। আগেরবারে সবগুলো মেয়েই ছিল স্বল্প-শিক্ষিত এবং নিতান্তই দরিদ্র পরিবারের সন্তান আর এবার আনন্দমোহন কলেজে গিয়ে শরীফ যখন শেফালীকে তার পরবর্তী শিকার হিসেবে ঠিক করে তখন থেকেই মতলব চাচার সাথে সে খাতির করার চেষ্টা করে। পরিকল্পনার শেষ পর্যায়ে এসে ধাক্কা খেল, মতলব চাচা হুট করে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে ফেলাতে। বিয়ে না করলে হয়তোবা শেফালীকে নিয়ে মহাপরিকল্পনার এখানেই পরিসমাপ্তি ঘটবে।





নয়





মতলব চাচার চাপে পড়ে বাধ্য হয়ে শরিফকে খুব তাড়াহুড়ো করে আকদ্‌ এ রাজী হয়ে যেতে হলো এবং সব ঠিক থাকলে শরীফের আত্মীয়-স্বজনরা ছয় মাস পর খুলনা থেকে ময়মনসিংহ আসলে তখন বড় করে প্রোগ্রাম হবে। আত্মীয়-স্বজন বলতে শরীফের কাল্পনিক চাচা-চাচী আর ফুফু -ফুফা যাদের সাথে জমিজমার বিরোধের কারণে শীতল সম্পর্কের কথা বলে শরীফ আগেই মতলব চাচার কাছে গল্প ফেঁদেছিল।

শরীফ ভেবে দেখে ছয় মাস বেশ লম্বা একটা সময়। তার পূর্ব অভিজ্ঞতা বলে চাইলে এই ছয় মাসের অর্ধেক সময়েই তার পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়ন সম্ভব। আর বাড়তি হিসেবে এই কয়েকদিন শেফালীকে যদি একান্তে পাওয়া যায় ......... নাহ্‌, এসব নিয়ে শরীফ একেবারেই ভাবতে চায়না। অপরাধ জগতের বাসিন্দা হয়েও চরিত্রের এ স্পর্শকাতর দিকটি শরীফকে কখনও দুর্বল করতে পারেনি। অনেকের সাথেই এর আগে অনেকবার অনেকরকম সুযোগ পেলেও এসব ক্ষেত্রে মনকে কখনই প্রশ্রয় দেয়নি। তবে এবারের প্রেক্ষাপট কিছুটা হলেও ভিন্ন, কেননা প্রথমবারের মত শরীফ তার পরবর্তী শিকারের প্রতি কিছুটা হলেও আকর্ষণ অনুভব করছে।





দশ





জানালা দিয়ে পাড়ার গলির দিকে তাকিয়ে আছে ফারুক। তার সমবয়সী ছেলেরা ক্রিকেট খেলছে, হইহুল্লোর করছে আর তাকে দোতলার জানালা দিয়ে দর্শক হয়ে থাকতে হচ্ছে। কেউ সজোরে চার মারলে খুশী হয়ে দুহাতে তালি দেবার মতো অবস্থাও তার নেই। জন্ম থেকেই ফারুকের ডান হাত বাম হাতের চেয়ে অনেক ছোট আর অকেজো এবং বাম পায়ে কোন শক্তি নেই। ফারুককে জন্ম দিতে গিয়েই শারীরিক জটিলতায় তার মা মারা যায়। এরপর বাবা মারা যায় তার বয়স যখন তিন। তাই বাবা-মায়ের কোন স্মৃতিই ফারুকের নেই। জ্ঞান-বুদ্ধি হবার পর থেকে শরীফই তার বাবা-মা-বড় ভাই সব। দূর থেকে সমবয়সী কয়েকজন ছেলেকে সাইকেল চালাতে দেখে ফারুকের মন অনেক খারাপ হয়ে যায়। ফারুকের মন ভালো করতেই বুঝি ঠিক সেই মুহূর্তেই শরীফের ফোন আসে তার কাছে। কিন্তু বিছানায় রাখা মোবাইল তুলতে গিয়ে ক্রাচ পড়ে যায় ফারুকের। রতন নামের যে পিচ্চি ছেলেটা সবসময় ফারুকের সাথে থাকে সে ছুটে এসে সাহায্য করে ফারুককে। বিয়েতে কবুল বলবার কয়েক ঘণ্টা আগে শরীফের হঠাৎ করে ফারুকের সাথে খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছিল। যদিও বিয়ের কথাটি ফারুককে সে জানায়নি, আর জানাবেই বা কেন! যে মেয়ে শরীফের জীবনেই আছে হাতে গোনা আর কয়েকটা দিন মাত্র, তার সাথে কেনইবা সে শুধু শুধু ছোট ভাইয়ের পরিচয় করিয়ে দিবে।যদিও ফারুকের নাম্বার চুপি চুপি শরীফের মোবাইল থেকে নিয়ে শেফালী একবার ফারুকের সাথে কথা বলেছিল। শেফালীর সাথে প্রথমদিন কথা বলেই তাকে অনেক পছন্দ হয়ে গিয়েছিল ফারুকের। ভাইয়া কিছু না বললেও সে ঠিকই আন্দাজ করতে পেরেছিল, এই মিষ্টি কণ্ঠের মেয়েটিই হয়তোবা তার একমাত্র ভাবী হতে যাচ্ছে।





এগারো





‘শরীর সবকিছু ভুলাইয়া দেয়’- কথাটি যেন কার লেখা! কার লেখা! বাংলায় বরাবরের দুর্বল ছাত্র শরীফ কিছুতেই সেটা মনে করতে পারছেনা। আকদ্‌ এর চারদিন হয়ে গেল আজ। মফস্বল শহরগুলোয় আকদ্‌ এর পর স্বামী-স্ত্রী’র একসাথে থাকাটাই বোধহয় নিয়ম। যদিও শরীফ জোর আপত্তি তুলেছিল নতুন বাসা নেবার আগ পর্যন্ত তারা যেন আলাদাই থাকে। কিন্তু কে শোনে কথা! কিছু সুখস্মৃতি যদি শেফালী- শরীফের ভাগ্যে আগে থেকেই লেখা হয়ে থাকে তাহলে শরীফের আর কিইবা করার আছে! শরীর আক্ষরিক অর্থেই সবকিছু ভুলাইয়া দিলেও ওস্তাদের দেওয়া অ্যাসাইনমেন্ট শরীফ এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারছে না। নাহ, মনকে আর প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। খুব দ্রুত কাজ শেষ করতে হবে খুব দ্রুত! খুব দ্রুত কাজ শেষ করবার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আকদ্‌ এর দশদিনের মাথায় নতুন বাসা ভাড়া নিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু ফার্নিচার আর আসবাবপত্র কিনে ফেলল শরীফ। শুরু হল শেফালী- শরীফের নিজেদের সংসার।





বারো





“ ভাইয়া তোমার ওস্তাদ আজ আমার সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছে। তুমি নাকি কয়েকদিন ধরে তার ফোন রিসিভ করছ না। ওষুধ শেষ হয়ে গেছে বলবার পর আমাকে ধমক দিয়ে বলেছে আর টাকা দিতে পারবেনা।”- সকালে শরীফের ঘুম ভাঙলো এই এসএমএস পেয়ে। তারপর থেকে শরীফের মুড এতটাই অফ হয়ে আছে আজ সারাদিনেও মনমেজাজ ভালো হবার কোন সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয়না। মাথার মধ্যে কেবল বেঈমানী, খুন, অপহরণ এইসব শব্দ ঘুরছে। আর তিনটি শব্দেই ‘ন’ কিংবা ‘ণ’ থাকার কারণেই হয়তোবা বেরসিকের মতো জহরলাল স্যারের রণমূর্তির কথাও মনে হচ্ছিল বারবার।

নাহ, সময় বেশ দ্রুত চলে যাচ্ছে। ইমোশনকে আর প্রশ্রয় দেওয়া যাবেনা। চূড়ান্ত পরিকল্পনার দিকে এগোনোর এখনই চূড়ান্ত সময়। সবার আগে শরীফ যে কাজটি করলো তা হলো ওস্তাদকে ফোন দিয়ে শান্ত করলো আর মাত্র এক মাসের সময় চেয়ে নিল। পাকা অভিনেতা শরীফের জন্য ওস্তাদকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করাটা খুব একটা কঠিন হলোনা। তাছাড়া শরীফের একটা বিশ্বাস সমসময়ই ছিল, যে রহিম শেখ এতিম দুভাইকে ছোটবেলা থেকে বড় করেছে সে আর যাই হোক তাদের দুভাইয়ের বড় কোন ক্ষতি করবেনা আর রহিম শেখেরও মনে বিশ্বাস ছিল, অপরাধ জগতের পুরো দুনিয়া বেঈমানী করলেও শরীফ কখনো তার সাথে বেঈমানী করবেনা।

- ‘প্রতিদিন এসব ঢং ভালো লাগেনা!’, ইচ্ছে করেই বিরক্তির ভাব দেখাল শরীফ সকালে কাজে বের হবার সময়।

- ‘ঘর থেকে বের হবার আগ মুহূর্তে আয়াতুল কুরসি পড়ে স্বামীর বুকে ফুঁ দেওয়াকে তুমি ঢং বলছ! কি হয়েছে তোমার হঠাৎ করে?’, মনে মনে বেশ আঘাত পায় শেফালী।

কোন কিছু না বলেই এরপর বের হয়ে যায় শরীফ। প্রতিদিনকার মতো সেদিন দুপুরে খেতেও আসেনা শরীফ ইচ্ছে করে। এমনকি সারাদিনে একবার ফোনও দেয়না শরীফ। শরীফ আসলেই চাইছে তার অবহেলার কারণে তার প্রতি শেফালীর ভালবাসা যেন কিছুটা হলেও কমে। নাহয় প্রকৃত সত্য যেদিন শেফালীর সামনে প্রকাশিত হবে সেদিন বেচারী আসলেই অনেক কষ্ট পাবে! কিন্তু শরীফের সেদিনের সে চেষ্টা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে সেটা সে বুঝতে পারে অনেক রাত করে বাইরে খেয়ে এসে বাসায় ফেরার পর। ফ্রিজ খুলেই শরীফ বুঝতে পারে সারাদিন হয়তোবা শেফালী কিছুই মুখে দেয়নি। তার উপর চিরায়ত বাঙালী নারীর মত কেঁদেকেটে চোখ-নাক ফুলিয়ে লাল করে ফেলেছে। শরীফের মধ্যে কাব্য প্রতিভা থাকলে হয়তোবা তখনই সে ‘অশ্রুবালিকা’ নামে কোন কবিতা লিখে ফেলত। শরীফের বেশ খারাপ লাগলেও সেটা প্রকাশ না করে নির্জীব গলায় শুধু বললো, আমি বাইরে খেয়ে এসেছি, তুমি খেয়ে শুয়ে পড়।

গভীর রাত পর্যন্তও দুজনের কারো চোখেই ঘুম ছিলনা কিন্তু দুজনে দুপাশ ফিরে শুয়ে ছিল সারারাত। যদিও শরীফের খুব ইচ্ছে হচ্ছিল শেফালীর রাগ ভাঙাতে আর শেফালীও মনে মনে খুব চাইছিল, শরীফ যেন আদর-ভালবাসায় শেফালীর রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করে এবং সে যেন অভিমানী স্ত্রীর মতো শুরুতে রাগ করে শরীফকে দূরে সরিয়ে দেবার সুযোগটুকু পায়। কিন্তু সারারাত দুজনের কারও মনের ইচ্ছেই আর পূরণ হলোনা। যদিও শরীফ সারারাত ঘুমানোর ভান করে শুয়েছিল।

পরদিন সকালে শেফালী শরীফের হাতে একটা গিফটের প্যাক ধরিয়ে দিল। কি আছে এতে জানতে চাইলে শেফালী জানালো, হোটেল আমির ইন্টারন্যাশনাল এর পাশের মার্কেট থেকে ফারুকের জন্য এই শার্টটি সে কিনেছে। শরীফ যেন আজকেই তার ভাইকে কুরিয়ার করে দেয়। কঠিন হৃদয়ের শরীফকেও এইবার আর আবেগ না ছুঁয়ে পারলনা, সে অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারলনা দুই ঈদ ছাড়া শেষ কবে সে ভাইকে কিছু গিফট করেছে। আবেগকে প্রশ্রয় না দিয়ে প্রথমবারের মত শেফালীকে ‘আয়াতুল কুরসি’ পড়ার সুযোগ না দিয়েই ফারুকের শার্টটি নিয়ে খুব দ্রুত বেরিয়ে গেল। আজ তার অনেক কাজ। মোটরসাইকেলের গতি দ্রুত বাড়িয়ে দেয় শরীফ।







তের





শরীফ যাবার সময় ‘আয়াতুল কুরসি’ পড়ে বুকে ফুঁ দিতে না পারায় শেফালীর কেমন যেন অস্থির লাগতে থাকে। শরীফ বের হবার পরপরই তাই দুই রাকাত নফল নামায পড়ে শরীফের জন্য দোয়া করে শেফালী। সেই নফল নামাযের কারণেই হোক কিংবা হেলমেট থাকার কারণে, বাসা থেকে বের হবার দুঘণ্টার মধ্যেই ভয়ংকর দুর্ঘটনার হাত থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পায় শরীফ। রাস্তা পার হতে গিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকা কোঁকড়া চুলের চশমা পড়া এক প্রাইমারী স্কুলছাত্র শেষ মুহূর্তে দৌড় দিলে তাকে বাঁচাতে গিয়ে শরীফের মোটরসাইকেল খাঁদে পড়ে যায়, হেলমেট থাকায় ও পরে একটি বড় গাছের সাথে ধাক্কা খায় বলে রক্ষা। কাকতালীয় ভাবে ক্লাস ফাইভে থাকতে কোঁকড়া চুল আর চশমা নিয়ে স্কুলে যাবার সময় শরীফের কারণে এক মোটরসাইকেল আরোহীকে প্রায় একইরকম দুর্ঘটনায় পড়তে হয়েছিল।

জ্ঞান ফিরে নিজেকে হাসপাতালে আবিষ্কার করে শরীফ আর দেখতে পায় মতলব মিয়া, তাহেরা বেগম আর শেফালী গভীর ভালবাসা আর মায়ামমতা নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। জানতে পারল এই বুড়ো বয়সে মতলব মিয়া তাকে এক ব্যাগ রক্ত দিয়েছে। এমনকি জহিরও ফার্মেসী বন্ধ করে এসে একমনে হাসপাতালের বারান্দায় নফল নামায পড়ছে শরীফের সুস্থতা কামনা করে। রাতের বেলা ফারুক ফোন করে অনেক কান্নাকাটি করলো। দুর্ঘটনার ব্যাপারে ওস্তাদকে যেন ফারুক কিছু না বলে সেজন্য বারবার সতর্ক করে দিল শরীফ।





চৌদ্দ





সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ফেরার পরদিনই ওস্তাদের ফোন পেল শরীফ।

-‘তোমার একমাস শেষ হতে কিন্তু আরমাত্র দুই সপ্তাহ বাকি আছে।‘

-'জ্বী ওস্তাদ। আমার মনে আছে।‘

-‘তোমার নতুন মালের যে ছবি পাঠিয়েছ শেফালী না রুপালী কি যেন নাম, ক্লায়েন্টের খুব মনে ধরেছে। অধীর আগ্রহে ডলার নিয়ে অপেক্ষা করছে তার জন্য।‘

শুনে রাগে কেমন যেন শরীফের লোম খাড়া হতে শুরু করে। শুধু মৃদুভাবে জবাব দেয়, ‘হুম।’

- ‘ফারুকের ডান হাত আর বাম পা দুইটাতেই কিন্তু পচন ধরে যাবার মতো অবস্থা। আগামী দু’তিন মাসের মধ্যে অপারেশান করাতে না পারলে কিন্তু দুটোই কেটে ফেলতে হতে পারে।

-'জ্বী ওস্তাদ।’

-‘আর ঢাকার ট্রমা সেন্টারে অপারেশান কতটা ব্যয়বহুল সে সম্বন্ধে ধারণা আছে নিশ্চয়।’

-'জ্বী আমি জানি।’

- সো অ্যাসাইনমেন্ট সফল হওয়া আমার চেয়েও বেশী জরুরী তোমার জন্য।একটা কথা সবসময় মনে রাখবা, এই রহিম শেখের সাথে বেঈমানীর পরিণতি খুব ভয়াবহ। খোদা হাফেয।'

রহিম শেখের সাথে কথা শেষ হবার পর থেকে শরীফের বারবার ফারুকের নিস্পাপ চেহারার কথা মনে হতে লাগলো। মুহূর্তের মধ্যেই তার সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব দূর হয়ে যায়। শরীফ জানে শেফালী তার জীবন থেকে চলে গেলে ভবিষ্যতে হয়তোবা আরো অনেক শেফালী তার জীবনে আসবে কিন্তু অর্থের কারণে ফারুকের চিকিৎসা করাতে না পারলে নিজেকে সে কখনও ক্ষমা করতে পারবেনা। মনে মনে শেফালীর কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেয় শরীফ।





পনের





শেফালীর মনে আজ অনেক আনন্দ। বিয়ের পর প্রথমবারের মতো আজ সে স্বামীর সঙ্গে কোথাও ঘুরতে যাচ্ছে। প্রথমবারের মতো আজ সে খুলনায় যাবে। শরীফ বলেছে সে তাকে সুন্দরবনও নিয়ে যাবে। শেফালী যদি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারতো সুন্দরবনের নাম করে তাকে কি অসুন্দর একটা উদ্দেশ্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। শরীফ কোত্থেকে যেন একটা সাদা জীপ গাড়ি জোগাড় করেছে। সে নিজেই নাকি ড্রাইভ করবে। তারা প্রথমে ঢাকায় যাবে। সেখানে শরীফের কিছু কাজ সেরে বাসে করে যশোর হয়ে খুলনা যাবে।

বাহ, তার নায়ক শুধু পালসারই নয়, গাড়িও বেশ ভালো ড্রাইভ করতে পারে। শরীফের চালানো দেখে কিছুক্ষণ পরই শেফালীর এই অনুভুতি হতে থাকে। জার্নিতে শুনবার জন্য কিছু রোমান্টিক গানের সিডি নিয়ে এসেছে শেফালী। একটু পরেই প্রথম সিডিটি ছেড়ে দেয়। সিডির ১ম গানটি ছিল, ‘আমি তোমার মনের ভেতর একবার ঘুরে আসতে চাই .........’। প্রিয় পাঠক, শেফালী যদি সত্যি সত্যিই এ মুহূর্তে শরীফের মনের ভেতর ঢুকতে পেত, তাহলে খুব অবাক হয়ে দেখত কি পরিমাণ সিদ্ধান্তহীনতার ঝড় বইয়ে যাচ্ছে শরীফের ভেতর দিয়ে। নার্ভাসনেসের কারণে গাড়িতে এসির মধ্যেও ঘামতে লাগলো শরীফ। এই অদ্ভুত সময়েও মাথার মধ্যে একবার জহরলাল স্যার আরেকবার ফারুকের চেহারা ভেসে উঠতে থাকলো। হঠাৎ করেই ক্রমাগত বাজতে থাকা মোবাইলটি জানালা খুলে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিল শরীফ। -‘কি হয়েছে তোমার?’, খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে শেফালী। জবাব না দিয়েই সুখী মানুষের মতো একটা হাসি দিয়ে গান পাল্টে দেয় শরীফ। এই গানটি শরীফের এখনকার মনের অবস্থার সাথে বেশ ভালভাবেই যায়, ‘বাহির বলে দূরে থাকুক, ভেতর বলে আসুকনা ............’

বাংলার ছাত্রী শেফালীর বাংলাদেশের মানচিত্র সম্পর্কে খুব একটা ভালো ধারণা নেই। অবশ্য ভালো ধারণা থাকলেও এই রোমান্টিক বৃষ্টির মধ্যে শেফালী বুঝতে পারতো কিনা সন্দেহ, শরীফ একদম হুট করেই ঢাকাগামী গাড়িটা ঘুরিয়ে জামালপুরের দিকে যাত্রা শুরু করেছে। মানচিত্র সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকলে হয়তোবা শেফালীর এটাও জানা থাকতো, ময়মনসিংহ থেকে জামালপুর হয়ে শেরপুর যাওয়া যায়, রাজধানী ঢাকা নয়।





ষোল





পাচারচক্রের সাথে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত শরীফের শেরপুর দিয়ে ভারত যাবার ব্যবস্থা করতে খুব একটা বেগ পেতে হলোনা। জমিজমার বিরোধের কারণে শত্রুতার জের ধরে এই মুহূর্তে তার দেশে থাকা নিরাপদ নয়, সেকথা বুঝিয়ে শেষবারের মত শেফালীর কাছে মিথ্যে বললো শরীফ। সহজ-সরল শেফালীও কোনরকম সন্দেহ না করে নতুন দেশে গিয়ে নতুন করে সংসার সাজানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। বেশ ভালভাবেই কেটে যাচ্ছিল শেফালী- শরীফের নতুন জীবনের শুরুর দিনগুলো। আর কদিন পরই ফারুককে কৌশলে বাংলাদেশ থেকে ভারতে নিয়ে আসার জন্য চূড়ান্ত পরিকল্পনা ও লোকজনও ঠিক করে ফেলেছিল শরীফ সেখানে থেকেই। এখন শুধুই অপেক্ষা, ভারতে নিয়ে এসে ফারুকের উন্নত চিকিৎসা করিয়ে তাকে পুরোপুরি সুস্থ করে ফেলবে। অপেক্ষার প্রহর শেষ হবার আগেই একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথম-আলো’র ওয়েবসাইটে ঢুকে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলনা শরীফ! একদম শেষের পাতায় খুব ছোট করে ছাপা হয়েছে, খুলনায় প্রতিবন্ধি বালক খুন। সতেরো বছর বয়সী ফারুককে খুন করার পেছনে শীর্ষ সন্ত্রাসী রহিম শেখের হাত রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পুলিশের ধারণা, ফারুকের বড় ভাই জামিনে মুক্তিপ্রাপ্ত ভারতে পলাতক আসামী শরীফের সাথে রহিম শেখের বিরোধের জের ধরেই এ হত্যাকাণ্ড। দুঃসংবাদটি পড়েই হতবিহবল শরীফের কেবল ফারুকের শেষ আব্দারের কথাই মনে পড়তে লাগলো, ভাইয়া অপারেশানের পর আমার হাত-পা ভালো হয়ে গেলে আমাকে সাইকেল কিনে দিতে হবে কিন্তু।

রহিম শেখ ঠিকই তার কথা রেখেছে। বেঈমানীর কঠিনতম শাস্তির ব্যবস্থাই সে করেছে। কিন্তু একমাত্র ছোট ভাইকে দেওয়া শেষ কথাটি শরীফ রাখতে পারলনা। সে চাইলেও আর কোনদিন তার ভাইকে শখের সাইকেল কিনে দিতে পারবেনা। সেদিনের পর থেকে জহরলাল স্যারের ব্যাকরণ ক্লাসের স্বপ্নটি আর দেখেনি শরীফ। বরং এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই ঘুমের মধ্যে শরীফ পরিষ্কার দেখতে পেত, পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ফারুক খুব দ্রুত গতিতে সাইকেল চালিয়ে হাসিমুখে তার কাছে ফিরে আসছে।



----- ০-----



[গল্পটি আমার দুলাভাই ফয়সাল ভাইকে উৎসর্গ করা হলো। He was one of my most regular readers, best critics & true inspirations of my writing! I wish he could read this! I wish I could say few words to him]

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ০৫ ই জুলাই, ২০১৩ দুপুর ১:২৫

ভিটামিন সি বলেছেন: গল্প ভালো লেগেছে। কিন্তু আমার ময়মনসিংহ নিয়ে গল্প ফেঁদেছেন, খাইছি আপনারে। জে.সি গুহ রোডে কি আসলেই ফার্মেসী আছে? ওখানে তো ....... ফার্মেসি তো দূর্গাবাড়ী রোডে।

০৫ ই জুলাই, ২০১৩ দুপুর ২:৩৮

শিস্‌তালি বলেছেন: হাহাহা। থ্যাংকু.... ফার্মেসী আছে কিনা সেটাতো মনে নাই ;)

২| ০৫ ই জুলাই, ২০১৩ দুপুর ২:৫৫

ইরফান আহমেদ বর্ষণ বলেছেন: ভাল লাগলো!!!!!!!!!!



:) :) :)

০৫ ই জুলাই, ২০১৩ বিকাল ৩:২৪

শিস্‌তালি বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই

৩| ০৫ ই জুলাই, ২০১৩ রাত ১১:৪২

আমিনুর রহমান বলেছেন:



অসাধারণ লিখেছেন +++

০৬ ই জুলাই, ২০১৩ রাত ২:০৪

শিস্‌তালি বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই। খুশী হলাম :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.