নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইচ্ছে থাকিলে উপায় হয়, আমার কেবল উপায় থাকিলেই ইচ্ছে হয়

শিস্‌তালি

Stay Hungry, Stay Foolish!Stay Sexy, Stay Virgin!!!

শিস্‌তালি › বিস্তারিত পোস্টঃ

এক যে ছিল কন্যা আমার

১৫ ই জুলাই, ২০১৪ রাত ১০:৪৫

[গল্পটি আমার প্রিয় দাবাড়ু, প্রিয় মানুষ Candidate Master & Fide instructor জাতীয় দাবাড়ু Mahtab Uddin Ahmed Robin ভাইকে উৎসর্গ করা হলো]



এক

নীতুদের বাসায় আজ ঈদের আনন্দ! সকালে ঘুম থেকে উঠেই নীতুর প্রথম প্রশ্ন, ‘মা, বাবা আজ অফিস থেকে কখন বাসায় আসবে?'

নীতুর এখনো পুরোপুরি বিশ্বাস হচ্ছে না, আজ থেকে কার্টুন দেখবার জন্য তাকে আর পাশের ফ্ল্যাটে মিতুদের বাসায় যেতে হবে না। আজ বাবা সত্যি সত্যিই অফিস থেকে আসার সময় তার জন্য রঙিন টিভি নিয়ে আসবে। নীতুর সময় যেন আর কাটতে চায় না। গুটি গুটি ছোট্ট পায়ে নীতু সারা ঘর ঘুরতে থাকে আর একটু পর পর বসার ঘরের যে জায়গাটিতে টিভি রাখা হবে তা দেখে আসে।



- ‘ জহির তোমার ব্যাংকিং ক্যারিয়ার কত বছরের যেন?’

-‘জী স্যার প্রায় আট বছর’

-‘আমার ব্যাংকিং ক্যারিয়ার কিন্তু মাত্র বারো বছরের এবং আমিও কিন্তু ক্যারিয়ারের শুরুটা তোমার মতই ক্যাশের জুনিয়র অফিসার হিসেবে শুরু করেছিলাম। এই বারো বছরে ক্যারিয়ারে এতদূর আসার পেছনে অন্যতম কারণ হল, কাজের প্রতি আমার ১০০% Attentiveness’

- ‘জী স্যার’

-‘জহির, তুমি আট বছর ক্যাশে চাকরী করছ, তোমার জুনিয়ররা এখন বিভিন্ন ব্যাংকের রিলেশনশিপ ম্যানেজার। আর তোমার এতদিনের কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকবার পরও আমার ব্রাঞ্চে একই দিনে দু’দুটো ৫০০ টাকার জাল নোট রিসিভ হয় কি করে! কি অদ্ভুত! Attentively কাজ করলে কখনোই এরকম ভুল হবার কথা না’

.................. আরও প্রায় মিনিট পাঁচেক বসের ঝাড়ি খাবার পর ব্রাঞ্চ ম্যানেজারের রুম থেকে মন খারাপ করে বেরিয়ে আসে জহির। জাল ৫০০ টাকার নোট দুটো নিজের কাছে রেখে পকেট থেকে দুটো চকচকে ৫০০ টাকার নোট বের করে সেদিনের মত ক্যাশ মিলিয়ে দেয় জহির। কড়া ব্রাঞ্চ ম্যানেজারের নিয়মানুযায়ী যার কাউনটারে জাল নোট পাওয়া যাবে তাকে সমপরিমাণ টাকা জরিমানা দিতে হবে। অহেতুক ১০০০ টাকা লস দিয়ে জহিরের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ দেখা যায়। কেননা পূবালী ব্যাংকের রাউজান শাখার ক্যাশ-ইন- চার্জ জহিরের এমনিতেই আজ ব্যয়বহুল দিন। বাসায় তার সাড়ে চার বছরের ছোট্ট মেয়ে নীতু অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, বাবা অফিস থেকে ফেরার সময় তার জন্য আজ রঙিন টিভি নিয়ে আসবে।

দুই

রাত আটটায়ও বাবা অফিস থেকে বাসায় ফেরেনি দেখে নীতুর বেশ মন খারাপ হয়ে যায়। সে ধরেই নেয় বাবা আজও অফিস থেকে অনেক লেট করে বের হয়েছে এবং ততক্ষণে টিভির দোকানগুলো সব বন্ধ হয়ে গিয়েছে! কিন্তু রাত প্রায় নটার দিকে বাসায় সিএনজি এসে থামতেই বাবার গলা শুনে এক দৌড়ে নীচে নেমে আসে নীতু। বাবা কখনোই সিএনজি করে বাসায় আসে না, তার মানে বাবা নিশ্চয় টিভি নিয়ে বাসায় এসেছে। বাবা যখন সত্যি সত্যিই ১৭ ইঞ্চির নিপ্পন কালার টিভি নিয়ে সিএনজি থেকে নামে, নীতু তখন খুশিতে হাত তালি দিতে থাকে।

এত রাতে আর ডিশের লাইনের লোককে খবর দেওয়া যায়নি, তারপরও বাপ- বেটি মিলে রাত প্রায় বারোটা পর্যন্ত বিটিভি দেখে তারপর ঘুমাতে যায়।

রাতে শোবার পর নীতুর মা রাবেয়া জহিরকে বলে,

- ‘তোমার মেয়ে অনেক বেশী খুশি হয়েছে টিভি পেয়ে’

-‘কেন তুমি খুশী হওনি?’

-‘থাক, আমার আবার খুশী- অখুশী হওয়া’

-‘ ওভাবে বলোনা, নীতুকে প্রতিদিন কার্টুনের মাঝ পথে মিতুদের বাসা থেকে নিয়ে আসবার সময় তোমার মেয়ে এত করুণভাবে তাকিয়ে থাকত, খুব খারাপ লাগত’

-‘তারপরও কি দরকার ছিল, এতগুলো টাকা এভাবে নষ্ট করার’

-‘খুব বেশী টাকাতো না আবার একেবারে কমও না আমার জন্য! Permanent হবার ৫ বছর হয়েছে গত মাসে, Provident Fund এর টাকাটার ম্যাচুরিটি হয়েছে বলেই সাহস করে কিনে ফেললাম’

-‘আসছে জুলাইয়ে নীতুর ৫ বছর হয়ে যাবে সে খেয়াল আছে? এবারতো খরচ বাঁচানোর অজুহাতে ওকে স্কুলে দিলা না! আগামী বছর কিন্তু কোন অজুহাত চলবে না। আজকাল বাচ্চাদের পড়াশোনার খরচ কিন্তু অনেক, এটা মাথায় রেখ’

- হুম।

এই হুমের অর্থ রাবেয়ার বেশ ভালোই জানা আছে। সারাদিনের কঠোর পরিশ্রমে প্রতিদিনকার মতো আজও জহির বিছানায় শুতে না শুতেই গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে শুরু করেছে। রাবেয়া গভীর মমতা নিয়ে ঘুমন্ত জহিরকে দেখতে থাকে। তার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল জহিরকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোতে কিন্তু ঘুম ভেঙে যাবে এই আশঙ্কায় সে তার প্রবল ইচ্ছেকেও সংবরণ করল। ওপাশ ফিরে শুয়ে রাজ্যের দুশ্চিন্তা নিয়ে রাবেয়া ঘুমানোর চেষ্টা করতে থাকল। বাড়িওয়ালা আগামী মাস থেকে বাসা ভাড়া ৫০০ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে এই খবরটি আগামীকাল জহিরকে কখন আর কিভাবে দিবে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত শুয়ে শুয়ে রাবেয়া চিন্তা করতে থাকল।

তিন

-‘মা, মা............ ডিশের আঙ্কেল কখন বাসায় আসবে?’

-‘নীতু আজ মাসের ২১ তারিখ, এখন ডিশের লাইন নিলে পুরো মাসের বিল দিতে হবে। এই মাস শেষ হোক। আগামী মাস থেকে ডিশের লাইন নিব। তোমার বাবাকে এ ব্যাপারে কোন কিছু বলবে না। ঠিক আছে?’

‘আচ্ছা’ বলে নীতু মন খারাপ করে বারান্দায় চলে যায়। ABCD’র বই খুলে পড়ার চেষ্টা করে যদিও তার মন পড়ে থাকে টম এন্ড জেরির কার্টুনে। চাইলেই মিতুদের বাসায় গিয়ে সে টিভি দেখতে পারে কিন্তু আন্টি তাকে দেখামাত্রই জিজ্ঞেস করবেন, কি ব্যাপার নীতু তোমাদের না গতকাল টিভি কেনার কথা ছিল। তাই সে একা একাই বারান্দার টেবিলে পেন্সিল দিয়ে ABCD লিখতে লাগল। সেই সময় রাবেয়া রান্নাঘর থেকে বারান্দায় আসলে দেখত পেত তার অভিমানী মেয়ের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে!

রাত আটটায় বাসায় এসেই জহিরের ডাক, ‘আমার মামনি কোথায়রে?’ অন্যদিন হলে নীতু এক দৌড়ে এসে, ‘তোমার মামনি এইতো’ বলে বাবার কোলে ঝাপিয়ে পড়ত। কিন্তু আজ কোন সাড়া নেই দেখে জহির নিজেই মেয়েকে খুঁজে বের করে।

-‘কি ব্যাপার! আমার মামনির মন খারাপ কেন?’

-‘মা বলেছে ডিশের লাইন আগামী মাসে নেওয়া হবে’

-‘তাই বুঝি আমার মামনির মন খারাপ! আমি এক্ষুনি রাশেদকে ফোন দিচ্ছি’

ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই রাশেদ নীতুদের বাসায় ডিশের কানেকশন দিয়ে যায়। রাত একটা পর্যন্ত বাপ-বেটি মিলে জি সিনেমায় আমির খান আর জুহি চাওলার ‘হাম হ্যায় রাহি প্যায়ারকি’ মুভিটি দেখতে থাকে। মুভিতে আমির খানের তিন বিচ্ছু ভাগ্নে-ভাগ্নির কাণ্ডকীর্তি নীতুকে চরম আনন্দ দেয়। বাপ-বেটির এই মহানন্দে সিনেমা দেখবার দৃশ্য দেখে রাবেয়ার অনেকদিন পর নিজের বাবার কথা খুব বেশী মনে পড়তে থাকে।

চার

‘যদি পার একটু তাড়াতাড়ি বাসায় এসো। নীতুর ভয়ংকর পেট খারাপ আর প্রচণ্ড মাথা ব্যাথা’ – রাবেয়ার এই এসএমএস জহিরের মোবাইলে আসে বিকেল সাড়ে তিনটায়। কিন্তু Transaction Hour এর শেষ আধা ঘণ্টা লাইনে এত বেশী কাস্টমার ছিল, বিকেল সোয়া চারটার আগে সে সেই এসএমএস পড়বার সুযোগই পায়নি। এবং তার পূর্ব অভিজ্ঞতা বলে যতবারই সে বাসা থেকে এরকম জরুরি ফোন বা এসএমএস পাবে সেদিনই ব্যাংকে কোন না কোন ঝমেলা বাঁধবে! ক্যাশ মেলাতে গিয়ে দেখবে হয় বেশী হচ্ছে কিংবা সামান্য কম হচ্ছে নতুবা ভুল অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দেওয়া হয়েছে ইত্যাদি হাজারো ঝামেলা! আর দুনিয়া উল্টে গেলেও দুনিয়ার কোন ব্যাংকেই ক্যাশ না মেলা পর্যন্ত ক্যাশ ইন চার্জের ছুটি নেই! অবশ্য ভাগ্য সেদিন তার সুপ্রসন্ন ছিল তাই সাড়ে ছয়টার মধ্যে সে কাঁচাকলা আর ওরস্যালাইন নিয়ে বাসায় হাজির! পেট খারাপ কিংবা মাথা ব্যাথা এর কোনটা নিয়েই জহির শুরুতে খুব একটা চিন্তিত ছিল না। পেট খারাপ এই বয়সী বাচ্চাদের খুব কমন একটি রোগ আর অতিরিক্ত টিভি দেখার ফল এই মাথা ব্যাথা ধরে নিয়ে জহির নিশ্চিন্তে থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু টানা তিনদিন অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় জহির বৃহস্পতিবার ছুটি নিয়ে রাউজান থেকে চট্টগ্রামের জামালখানে এক শিশু বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যায় এবং যা ভেবেছিল, ডাক্তার শুরুতেই ওষুধ না দিয়ে পরিচিত ল্যাবে একগাদা টেস্ট করতে ধরিয়ে দিয়ে পরেরদিন শুক্রবার আবার দেখা করতে বলে।

‘শালা তুই মানুষ না কসাইরুপী ডাক্তার’- মনে মনে ডাক্তারকে গালি দিতে থাকে জহির! প্রায় ২০০০ টাকার টেস্ট করিয়ে সিএনজিতে বাসায় ফেরার পথে রাবেয়া বলতে থাকে, কতবার বলেছিলাম টিভি কিনে এতগুলো টাকা নষ্ট করো না। বিপদ আপদের জন্য কিছু টাকা সেভিংস রাখ। বউয়ের কথা না শুনে আজ পর্যন্ত কেউ জীবনে উন্নতি করতে পারেনাই এটা সবসময় মনে রাখবা।

বাবার কোলে মাথা রেখে চুপচাপ শুয়ে থাকা ছোট্ট নীতু মার কথার অর্থ পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও সে এটা বেশ বুঝতে পারছিল তার কারনেই বাবা-মা’র এত কষ্ট হচ্ছে। তার খুব বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল, মা দেখ আমি সুস্থ হয়ে গেছি!

পরদিন রিপোর্টগুলো নিয়ে একা একাই জহির ডাক্তারের সাথে দেখা করতে আসে। বেশ অনেকক্ষণ রিপোর্টগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবার পর ডাক্তার চশমা খুলে জহিরের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসি দিয়ে বলে, ঘাবড়ানোর কিছু নেই। আমি বেশ কিছু ওষুধ লিখে দিচ্ছি। আরও দুটো নতুন টেস্ট দিলাম। এর মধ্যে টেস্ট দুটো করিয়ে রিপোর্ট নিয়ে আগামী শুক্রবার আমার সাথে দেখা করবেন মেয়েসহ।

ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়েই জহিরের প্রচণ্ড মন খারাপ হতে শুরু করে। যদিও ডাক্তার বিস্তারিত কিছু বলেননি তারপরও কেন জানি জহিরের মনে কুডাক দিতে থাকে। জামালখান থেকে ৩০ টাকা রিকশাভাড়া দিয়ে সে গরীবুল্লাহ শাহ মাজারে আসে। মাজারের মসজিদে বিকেল তিনটায় একাকী নফল নামায পড়ে আল্লাহর দরবারে ‘আমার মেয়ে, আমার মেয়ে’ বলে অসহায়ের মত আর্তনাদ করতে থাকে।



পাঁচ

এক সপ্তাহ পর শিশু বিশেষজ্ঞ ডাঃ এস আর খানের চেম্বারে নতুন দুই টেস্টের রিপোর্টসহ নীতুকে নিয়ে আসে জহির আর রাবেয়া। এই এক সপ্তাহে নীতুর পেটের অবস্থার বেশ কিছুটা উন্নতি হলেও মাথার তীব্র ব্যাথাটা আরো বেড়েছে। সেই সাথে চোখের নীচে কালি পড়া, ওজন ও ঘুম দুইটাই হ্রাস পাওয়া এবং ইউরিন ইনফেকশন হওয়া রাবেয়া – জহিরের ঘুম হারাম করে দেবার জন্য যথেষ্ট ছিল।

ডাক্তার বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে নীতুকে পরীক্ষা করবার পর সর্বশেষ রিপোর্ট দুটো বেশ অনেকক্ষণ ধরে দেখলেন। এরপর গম্ভীরভাবে রাবেয়াকে বললেন নীতুকে নিয়ে পাশের রুমে অপেক্ষা করতে। তিনি জহিরের সাথে কিছুক্ষণ একাকী কথা বলতে চান।

- ‘দেখুন জহির সাহেব, হায়াত-মউত- সুস্থ- অসুস্থ থাকাটা পুরোপুরিই কিন্তু ওপরওয়ালার উপর নির্ভরশীল। আমরা ডাক্তাররা আমাদের সাধ্যের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করে যেতে পারি কেবল। NEUROBLASTOMA নামে এক বিশেষ ধরনের ক্যান্সার আছে যা সাধারণত দশ বছরের কম বয়সী শিশুদের হয়ে থাকে। যত বেশী আর্লি স্টেজে এ রোগ ধরা পড়বে প্রতিকারের সম্ভাবনা ততই বেশী। আপনার দুর্ভাগ্য আপনার একমাত্র সন্তানের এ কঠিন অসুখ হয়েছে আবার আশার ব্যাপার হচ্ছে, একদম শুরুতেই নীতু মামনির এই রোগ ধরা পড়েছে বলে সেরে উঠার সম্ভাবনা খুব বেশী। প্রথম চার টেস্টের রেজাল্ট দেখেই আমি সন্দেহ করেছিলাম, কিন্তু এই রোগটি আমাদের দেশে এখনও নতুন বলে নিশ্চিত হবার জন্য আমি সর্বশেষ টেস্ট দুটো দেই। এবং আমি যা ধারণা করেছিলাম তাই সত্য হল। NEUROBLASTOMA’র NEURO শব্দটা এসেছে নার্ভ থেকে আর BLASTOMA মানে হচ্ছে যা সেল এর স্বাভাবিক বৃদ্ধিকে বাঁধা দেয় ......... ............... ...............’

ডাক্তারের শেষ কথাগুলো জহির আর শুনতে পায়না। পুরুষ মানুষের কান্নার দৃশ্য নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে অসুন্দর দৃশ্যগুলোর একটি কিন্তু একমাত্র মেয়ের জন্য বাবার চোখ দিয়ে নীরবে পানি গড়িয়ে পড়বার মত পবিত্রতম দৃশ্য বোধহয় আর একটিও নেই।

ছয়

এরপরের কয়টা দিন রাবেয়া আর জহিরের বেশ ব্যস্ততায় কেটে যায়। তাদের সর্বপ্রথম কাজ হয় নীতুকে মানসিকভাবে উৎফুল্ল রাখা। পরদিনই অফিস থেকে আসার সময় জহির অনেকগুলো খেলনা কিনে নিয়ে আসে নীতুর জন্য।

আর দুপুর বেলা জহির যখন অফিসে তখন জহিরকে না জানিয়েই রাবেয়া যায় তার বিয়ের গয়নাগুলো বিক্রি করতে। প্রথমবার যেদিন রাবেয়াকে দেখতে আসে সেদিনই জহিররা রাবেয়াকে আংটি পরিয়ে দেয়, স্মৃতি হিসেবে স্রেফ সেই আংটিটি নিজের কাছে রেখে দেয়।

অপরদিকে জহিরের Provident Fund এ চার লাখ টাকার মত জমেছে। সে তাই ব্যাংকের HR সাথে যোগাযোগ করল Provident Fund কে সিকিউরিটি হিসেবে রেখে কত দ্রুত সাড়ে তিন লাখ টাকা স্টাফ লোন পাওয়া যায় সে ব্যাপারে খোঁজ নেবার জন্য।

ব্রাঞ্চ ম্যানেজার আসিফ কারণে অকারণে জহিরকে বকাবকি করলেও এ দুঃসময়ে ২০ হাজার টাকা দিয়ে তার পাশে এসে দাঁড়ালো। আর ব্রাঞ্চের বাকি কলিগরা সবাই মিলে জোগাড় করল আরও ৩০ হাজার টাকা! জহিরের দীর্ঘদিনের পরিচিত কাস্টমার কোটিপতি ব্যবসায়ী হাফিজ সাহেব তাকে অবাক করে দিয়ে তাকে অনেকটা জোর করে ৫০ হাজার টাকা নিতে বাধ্য করল!

ডাক্তার বলেছেন শুরুতে সাত আট লাখ টাকার মত জোগাড় করতে। নীতুর অবস্থার অবনতি হলে প্রয়োজন হতে পারে আরও অনেক বেশী টাকার।

ঢাকার আহসানিয়া ক্যান্সার হাসপাতালে নীতুর অ্যাডমিশনের ব্যবস্থা করিয়ে জহির ১৫ দিনের Mandatory Annual Compliance Leave সহ প্রায় ৩০ দিনের ছুটি নিল।

প্রকৃতি মানুষের নানারকমভাবে পরীক্ষা নেয়। চরম দুঃসময়ে ভালো মানুষদের খুব সম্ভবত প্রকৃতি নানা অদ্ভুত উপায়ে আরও বেশী করে পরীক্ষা নেয়। নাহয় ছুটি শুরু হবার আগের দিন কেনইবা জহিরের কাউনটারে এক লাখ টাকা বেশী পাওয়া যাবে তার কোন যুক্তিযুক্ত ব্যাখা আর হতে পারে না! আট লাখ টাকার মধ্যে মাত্র ছয় লাখ টাকা জোগাড় হয়েছে বলে এমনিতেই জহিরের টেনশনের শেষ ছিল না। অতিরিক্ত টেনশনেই কোথাও কোন ভুল হয়েছে কিনা সেটা চেক করবার জন্য জহির বারবার তার সব ভাউচার চেক করতে লাগল। কিন্তু কোথাও কোন ভুল না পেয়ে জহিরের টেনশন বহুগুণ বেড়ে গেল। আট বছরের ক্যারিয়ারে জহিরকে অনেকবার সততার পরীক্ষা দিতে হয়েছে। খাতুনগঞ্জে জুনিয়র অফিসার থাকবার সময় এমনও হয়েছে স্বল্পশিক্ষিত পাইকারি ব্যবসায়ী ১০০ টাকার বান্ডিলের সাথে ভুল করে একটি ৫০০ টাকার বান্ডিল দিয়ে দিয়েছে কিংবা ভুলে ৫০০০০ হাজার টাকা জমা দিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে ভাউচারে শুন্য একটা কম লিখেছে! প্রতিবারই জহির কাস্টমারকে ডেকে এনে হিসেব বুঝিয়ে দিয়েছে।

আবার বিপরীত চিত্রও আছে, ক্যারিয়ারের শুরুতে এক লোককে ৫০হাজার টাকা বেশী দিয়ে ফেলায় নিজের পকেট থেকে পুরো ৫০হাজার টাকা লস দিতে হয়েছিল তাকে। অথচ সে সময় ৫০হাজার টাকা ছিল তার চার মাসের বেতনের সমান।

দিন শেষে Counting এর সময় যখন জহির ৫০০ টাকার দুটো বান্ডিল অতিরিক্ত পায় সিদ্ধান্ত নেবার জন্য খুব বেশী সময় তার হাতে ছিল না! সাধারণ নিয়ম ক্যাশ বেশী পাওয়া গেলে তা সাসপেন্স অ্যাকাউনটে miscellaneous item হিসেবে দেখানো হয়। একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করে এরপর তা GL (General Ledger) এ ব্রাঞ্চের প্রফিট হিসেবে দেখানো হয়। ক্যাশ ইন চার্জ হওয়ায় জহিরের যে সুযোগ ছিল অন্য কোন ক্যাশ অফিসারের সে সুযোগ ছিল না! ৫০০ টাকার অতিরিক্ত বান্ডিল দুটো হাতে নিয়ে জহিরের বারবার নীতুর মুখের কথা মনে পড়তে লাগলো। যা করবার তাকে খুব দ্রুত করতে হবে, খুব দ্রুত!!!

সাত

গরীবুল্লাহ শাহ মাজারের নিকটবর্তী ইউনিক বাস কাউনটার থেকে বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে দশটায় রাবেয়া- জহির আর নীতু ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। বাস ছাড়বার আগ মুহূর্তে জহির তার লাইন ম্যানেজার ও রিপোর্টিং বস ব্রাঞ্চ অপারেশন ম্যানেজার জয়াকে বিশাল এক এসএমএস করে। জয়া তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে অদ্ভুত এসএমএস পেয়ে সাথে সাথেই ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে জহিরের পার্সোনাল ড্রয়ারে দুটো ৫০০ টাকার বান্ডিল দেখে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে এবং বান্ডিল দুটো নিজের কাছে রেখে অপেক্ষায় থাকে Transaction Hour শেষ হবার আগেই কেউ না কেউ এসে উপযুক্ত প্রমাণ দিয়ে বান্ডিলদুটো তার কাছ থেকে নিয়ে যাবে। নাহয় দিনশেষে সাসপেন্স অ্যাকাউনটে ট্রান্সফারের আগ মুহূর্তে ব্রাঞ্চ ম্যানেজারকে সব কিছু জানাতে হবে।

ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম সেরা ও নলেজেবল অপারেশন ম্যানেজারকে সব কিছু জানাতে পেরে জহিরের নিজেকে খুব হালকা মনে হতে থাকে। কারণ তার দৃঢ় বিশ্বাস জয়া আপু অদ্ভুত দক্ষতায় সবকিছু ম্যানেজ করে ফেলবে। সে তার মামনির মাথায় হাত বুলাতে থাকে আর নীতুর প্রিয় গল্প ‘আলীবাব চল্লিশ চোরের’ কাহিনী আস্তে আস্তে শোনাতে থাকে।

জহির-রাবেয়া বিয়ের পর থেকে অনেকবারই প্ল্যান করেছিল ঢাকায় বেড়াতে আসবে। সংসদ ভবনের সামনে দাড়িয়ে ছবি তোলার শখ রাবেয়ার সেই ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু প্রতিবারই খরচের কথা চিন্তা করে শেষ মুহূর্তে তারা সেই পরিকল্পনা বাদ দেয়।

আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ইউনিক বাসটি তার গন্তব্যে পৌছে যাবে। আগেই বলেছি, প্রকৃতির প্রিয় খেলা হল মানুষদের সময়ে অসময়ে নানারকম অদ্ভুত সব পরীক্ষা করা। প্রিয় পাঠক, প্রথমবারের মত স্বপরিবারে জহির ঢাকায় পৌছানোর আগে আগেই চলুন আমরা সবাই প্রার্থনা করি, জহিরের মত সততার পরীক্ষায় যারা বারবার পাশ করে প্রকৃতি যেন তাদের প্রিয় মানুষকে বড় অসময়ে তাদের কাছ থেকে কখনোই কেড়ে না নেয়!!!

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ১৬ ই জুলাই, ২০১৪ রাত ১২:১৪

is not available বলেছেন: নতুন ধরণের ছোট গল্প-অসাধারণ!

১৬ ই জুলাই, ২০১৪ রাত ৮:১৯

শিস্‌তালি বলেছেন: ধন্যবাদ!!!!!!!!! খুশী হলাম

২| ১৬ ই জুলাই, ২০১৪ রাত ১২:১৮

সচেতনহ্যাপী বলেছেন: কিন্তু একমাত্র মেয়ের জন্য বাবার চোখ দিয়ে নীরবে পানি গড়িয়ে পড়বার মত পবিত্রতম দৃশ্য বোধহয় আর একটিও নেই। ভয়ে,খুব ভয়ে, পুড়োটা পড়লাম। না দেখে খুশিতে আপনার দোয়াই করে বসলাম। ধন্যবাদ।।

১৬ ই জুলাই, ২০১৪ রাত ৮:৪৭

শিস্‌তালি বলেছেন: অসাধারণ মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ

৩| ১৬ ই জুলাই, ২০১৪ রাত ১২:৩১

অথৈ শ্রাবণ বলেছেন: গল্পে +++++

১৬ ই জুলাই, ২০১৪ রাত ৮:৫১

শিস্‌তালি বলেছেন: :)))))))))))))))))))))))))))))

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.