নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইচ্ছে থাকিলে উপায় হয়, আমার কেবল উপায় থাকিলেই ইচ্ছে হয়

শিস্‌তালি

Stay Hungry, Stay Foolish!Stay Sexy, Stay Virgin!!!

শিস্‌তালি › বিস্তারিত পোস্টঃ

সুখনিদ্রা!!!

০৮ ই অক্টোবর, ২০১৪ সকাল ৯:৫০

এক


“Ami Maa-ke raji korate parchina, tui chesta kore dakh parish kina (আমি মাকে রাজী করাতে পারছিনা, তুই চেষ্টা করে দেখ পারিস কিনা)”- এসএমএস পেয়েই মুভি দেখা বাদ দিয়ে সাইকেল নিয়ে রিশাদের বাসায় দিলাম এক ছুট!
চানাচুর খেতে খেতে রিশাদের বাসার ব্যালকনিতে রিশাদের মাকে কনভিন্স করার চেষ্টা করতে থাকলাম
- ‘আন্টি বিশ্বাস করেন চিটাগাং ভার্সিটির ফিজিক্সের চেয়ে জাহাঙ্গীরনগরের আইবিএ’র বিবিএ অনেক বেটার অপশন’
-‘তাই বলে চার বছর সায়েন্স পড়ার পর এখন বিবিএ পড়বে? ফিজিক্সে ভাল রেজাল্ট করে ভার্সিটির টিচার হবে কিংবা বিসিএস দিবে। তাছাড়া ......
আন্টি বেশ কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে যান। আমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে আবার বলতে শুরু করেন, ‘ তাছাড়া রিশাদের বাবা বেঁচে থাকলে আমি কোন বাঁধা দিতাম না। রিশাদের বাবা যখন বেঁচে ছিলেন তখন আমি মহাউৎসাহ নিয়ে ওকে ক্যাডেট কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিতে নিয়ে যাই। কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজে চান্স পেয়েও এতটুকু ছেলে জেদ করে পড়ল না মাকে ছাড়া থাকতে হবে বলে। আর আজ মা হয়ে আমি চাচ্ছি ও আমার এখানে থেকেই পড়াশোনা করুক’
- ‘কিন্তু মা আমি ফিজিক্সে খুব ভাল রেজাল্ট না করতে পারলে টিচার হতে পারব না আবার বিসিএসও এত সহজ না তুমি যতটা ভাবছ। বিবিএ পড়লে আর যাই হোক একটা না একটা চাকরি জুটে যাবেই’- এবার রিশাদই যুক্তি দেখাল।
এরপর আমি ভার্সিটির টিচার হতে আজকাল পলিটিকাল ব্যাকআপও লাগে, জাবির আইবিএতে সেশন জ্যাম নেই, বিসিএস এর কোটা সিস্টেম আরও নানারকম অকাট্য যুক্তি তুলে ধরলাম।
অবশেষে আমাদের দুইজনের পীড়াপীড়িতে আন্টি ‘অনুরোধে ঢেঁকি গেলা’র মত করে রিশাদকে ঢাকায় পড়তে দিতে রাজী হলেন।

এবার চুপিচুপি আসল সত্যটি বলে ফেলি, এত অল্প বয়সে এত বেশি ক্যারিয়ার সচেতন কিংবা পরিবারের প্রতি এত বেশি দায়িত্ববোধ কোনটাই আমার কিংবা রিশাদের কারোরই ছিল না। রিশাদকে এত কাহিনী করে ঢাকায় নিয়ে আসার আসল উদ্দেশ্য হল, সেই নার্সারি থেকে কলেজ লাইফ পর্যন্ত দুই বন্ধু একসাথে পড়ে এসেছি। যেহেতু আমি ঢাকার ইউআইইউ’র বিবিএতে ভর্তি হয়ে গেছি তাই দুই বন্ধু দুই শহরে পড়াশোনা করব সেটা দুজনের কেউই মেনে নিতে পারছিলাম না।


দুই


জাবিতে ভর্তি হয়েই রিশাদ ডিপার্টমেন্টের বড় ভাইদের কল্যাণে খুব দ্রুত বঙ্গবন্ধু হলে সিট পেয়ে যায় আর আমি দুজন ক্লাসমেটসহ ধানমণ্ডিতে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেই। প্রায় বৃহস্পতিবারই দেখা যেত আমি ক্লাস শেষে জাবি গিয়ে রিশাদের সাথে সারারাত আড্ডা মারবার প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখনই রিশাদের এসএমএস “দোস্ত তুই নেক্সট বৃহস্পতিবার আয়, আমি কমলাপুর যাচ্ছি। আজ রাতের ট্রেনে চিটাগাং যাচ্ছি মাকে দেখতে”
আমি জানতাম পরের বৃহস্পতিবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবার সমূহ সম্ভাবনা।অবশ্য রিশাদের মা মানুষটিই সেইরকম, কি এক অদৃশ্য সুতার টানে বারবার চলে যেতে ইচ্ছে করে। ছেলে ভার্সিটিতে ভর্তি হবার পরও বাড়ি আসলে নিজ হাতে খাইয়ে দিত বেশীরভাগ সময়। অথচ আমার মা এক যুগেরও বেশী সময় ধরে হাই প্রোফাইল জব আর হাই প্রোফাইল লাইফস্টাইল মেইনটেইন করতে করতে কেমন যেন অনুভূতিহীন কর্পোরেট পুতুলের মত হয়ে গিয়েছে! আমার চিটাগাং যাওয়া আসা, সিজিপিএ বাড়াকমা কোন কিছুতেই তার কোন মাথাব্যাথা ছিল না। অথচ রিশাদের মা প্রতিবার বাস ছাড়ার সময় ছেলের জন্য কান্নাকাটি করে এক মধুর দৃশ্যের সৃষ্টি করতেন। ওনার আবেগ দেখে মনে হত ছেলেকে বোধহয় অনেক দুরের কোন দেশে পড়তে পাঠাচ্ছেন, কয়েক বছরের মধ্যে দেশে ফেরার কোন সম্ভাবনা নেই। বিদায়ের এই সময়টাতে রিশাদ খুব বিব্রতবোধ করলেও রিশাদের পাশের সিটে বসে দৃশ্যটি আমি খুব উপভোগ করতাম। আসলে রিশাদের আর কোন ভাইবোন না থাকায় মা-ছেলের ছোট্ট সংসারে দুজন দুজনের প্রতি অনেক বেশী নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। আন্টির লেখার হাতও বেশ ভাল ছিল। একদিন সকালে প্রথম আলোর ছুটির দিনে হাতে নিয়ে দেখি রিশাদকে নিয়ে ঘর-মন-জানালা বিভাগে আন্টির লেখা “আমার সন্তান যেন থাকে নিরাপদে”!


তিন


প্রথম বর্ষে প্রায় প্রতি মাসেই দুতিনবার চিটাগাং যাওয়া হলেও দ্বিতীয় বর্ষ থেকে পড়াশোনার চাপ বেড়ে যাওয়ায় সেই যাওয়া আসাটা কেমন করে যেন প্রতি দুতিন মাসে একবার হয়ে যায়। যদিও আমি জানতাম পড়াশোনার চাপ ছাড়াও নন এসি বাস ভাড়া ছয়মাসের মধ্যে ৯০ টাকা বেড়ে যাওয়াটাও অন্যতম কারণ! মা-ছেলে প্রায় প্রতিদিনই দুতিনবার করে মোবাইলে কথা বলত। অথচ আমার পুরো সপ্তাহে দুতিনবার মা’র সাথে কথা হত কিনা সন্দেহ। সবচেয়ে মজার ব্যাপার ছিল, এই ইমেইল- ইন্টারনেটের যুগেও রিশাদের মা প্রতি মাসেই রিশাদকে চিঠি লিখত। এই নিয়ে হাসাহাসি করায় একবার রিশাদ মনে কষ্ট পেয়েছিল, আমাকে চিঠি বাড়িয়ে দিয়ে বলে “নে পড়ে দ্যাখ, কি লেখা থাকে মায়ের চিঠিগুলোয়”
আগেই বলেছি, আন্টির লেখার হাত খুব ভাল। চিঠিটি পড়বার পর সেই ধারণা আরও বেড়ে গেল। চিঠির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি লাইনে পরম মায়ামমতা মেশান ছিল। চিঠি পড়ে আমার ধানমণ্ডির ফ্ল্যাটে এসে অনেকক্ষণ মন খারাপ করে বসেছিলাম। বারান্দায় এসে একাকী কিছুক্ষণ কাঁদলামও আর খোদার কাছে অনুযোগ করলাম, আমাকে কেন রিশাদের মায়ের মত মমতাময়ী মায়ের সন্তান হিসেবে পাঠালে না!

ভার্সিটি লাইফের শুরুর সেই বয়সটাতে কি পরিমাণ ছেলেমানুষই না ছিলাম, ভাবলে নিজের কাছেই কেমন অদ্ভুত লাগে!


চার


বঙ্গবন্ধু হলের রুম নং ৪২৮।


ছাত্রনেতা তুহিনের রুমে রিশাদকে ডেকে নিয়ে যায় লিমনসহ আরো কিছু জুনিয়র ছাত্র।
- কিরে রিশাদ, তুই নাকি আমাদের লিমনের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিস!
- তুহিন ভাই, তুমিতো আমাকে তিন বছর ধরে চিন। আমি নিজে থেকে কখনোই কারো সাথে ঝামেলায় জড়াই না। ঢাকা ভার্সিটি থেকে আমার ফ্রেন্ড আসিফ আসছিল তার গার্লফ্রেন্ড ৩৫ এর নাফিসার সাথে দেখা করতে। লিমন সেখানে গিয়ে ওদেরকে বিরক্ত করা শুরু করে। আমি বাঁধা দিতে গেলে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে হালকা ধাক্কাধাক্কি হয়, এর বেশিকিছু না।
- আর সিরাজের দোকানে লিমনকে সবার সামনে অপমান করলি কেন?
- আরে ভাই। সিরাজ ভাইয়ের দোকানে লিমন প্রায় দুই মাস বাকিতে খায়। সেদিন দুপুরের খাওয়া শেষে সিরাজ ভাই টাকা চাইলে সে রেগে গিয়ে যাতা বলে গালাগালি করতে থাকে। অন্য ডিপার্টমেন্টের হলেও যেহেতু আমি লিমনের এক বছরের সিনিয়র তাই ওকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম, এটা ঠিক নয়।

এইবার হুট করেই তেড়ে যায় লিমন। সিনিয়রিটির তোয়াক্কা না করে তুই তোকারি করতে থাকে, সিরাজের দোকানে বাকিতে খাইসিতো, তোর বাপের কি? তোর বাপের হোটেলেতো খাইনাই!

বাপ তুলে কথা বলায় রিশাদের আর সহ্য হয় না। তুহিনের সামনেই লিমনকে সজোরে চড় মেরে এক ঝটকায় বেরিয়ে আসে রিশাদ!

আফসোস, বরাবরের চাপা স্বভাবের রিশাদ একবারও যদি আমাকে বলত ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতাদের সাথে হলে তার ঝামেলা চলছে!


পাঁচ


বুধবার রাতে পবিত্র শবে বরাতের নামাজ শেষে রুমে এসে বাতি নিভিয়ে শুয়ে থাকে রিশাদ। টানা তিনদিনের ছুটি পেয়ে রুমমেটরা এবং হলের বেশীরভাগ ছেলেরাই সেদিন রাতেই বাড়ি চলে গিয়েছিল। রিশাদেরও পরদিন সকালে চিটাগাং যাবার কথা ছিল। একবার ভেবেছিলাম সেদিন রাতে আমিও জাবি গিয়ে রিশাদকে সঙ্গ দিব কিন্তু রিশাদই এসএমএস দিয়ে এত দূরে কষ্ট করে আসতে মানা করে যেহেতু পরদিন সকালেই চিটাগাং যাচ্ছে। আহা সেদিন যদি রিশাদের নিষেধ না শুনে সত্যি সত্যিই ওর সাথে থাকতে যেতাম। এই আফসোস আমার সারা জীবনেও শেষ হবে না!

কেননা রিশাদকে রুমে একাকী পেয়ে কে বা কারা যেন হকিস্টিক আর চাপাতি দিয়ে অমানুষের মত পিটিয়ে অজ্ঞান করে ফেলে। সেই জ্ঞান রিশাদের আর কোনদিন ফিরেনি। আমাদের দুর্ভাগ্য জ্ঞান না ফেরায় মারা যাবার আগে সে পুলিশকে কারো নাম বলে যেতে পারেনি।
রিশাদের মাকে এই ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদ জানানোর গুরুদায়িত্বটি আমাকেই পালন করতে হয়! কি কষ্ট!! কি কষ্ট!!!


ছয়


রিশাদের লাশ এর গাড়ি নিয়ে আমরা যখন চিটাগাংয়ে ওনাদের বাসায় পৌছাই আন্টি পুত্রশোকে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিল। আমাকে দেখেই আমার শার্টের কলার ধরে চিৎকার করতে লাগলেন, রোহান আমি রিশাদকে ঢাকায় পাঠাতে চাইনি। আমার মানিকরে তুই কইইইইইইইইইইইইই?

নিজেকে খুব বেশী অপরাধী মনে হচ্ছিল। বাবার পাশে রিশাদকে চিরনিদ্রায় শুইয়ে দিয়ে এসে একরাশ মন খারাপ নিয়ে ঢাকায় চলে আসি।

আমি ঢাকায় ব্যাক করার ঠিক দশদিনের মাথায় আন্টি বিশাল বড় ব্যাগ নিয়ে আমার ফ্ল্যাটে এসে হাজির।
আগেই বলেছিলাম, আন্টি আর দশজন সাধারণ মায়ের মত নন, ওনার আসার উদ্দেশ্য জানতে পেরে আমার সিঙ্গেল রুমটা ওনাকে ছেড়ে দিয়ে আমি পাশের রুমে চলে যাই।

পরদিন সুপার বাসে করে সকাল সকাল আমরা জাবির উদ্দেশ্যে রওনা দেই।


সাত


জাবি গিয়েই আমরা সর্বপ্রথম আইবিএ’র ডিরেক্টর ডঃ বখতিয়ার রানা স্যারের সাথে দেখা করি। ইন্সটিটিউট থেকে খুনিদের দ্রুত বিচারের জন্য সবরকম চাপ প্রয়োগ করা হবে এই আশ্বাস পেয়ে আমরা ওনার অফিস থেকে বের হই। আইবিএ’র ছাত্রছাত্রীরা রিশাদের জন্য একটি অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেছে। রিশাদের বিভিন্ন ছবি আর রিশাদকে নিয়ে সবার স্মৃতিচারণগুলো পড়ে আন্টি চশমা খুলে চোখ মুছলেন বেশ কয়েকবার। আইবিএ ১৬ ব্যাচের পলক বলল, রিশাদ ভাই আমাদের সবার খুব প্রিয় বড় ভাই ছিল। আমরা প্রয়োজনে আমরণ অনশনসহ ভিসির অফিসের সামনে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচী করব।

দুপুরের ভাতটা আমরা রিশাদের প্রিয় বটতলার সিরাজের দোকানে খেলাম। যতটুকু জানি সেই ঘটনার রাতে সিরাজের দোকান থেকেই রিশাদের রুমে ভাত দেওয়া হয়েছিল যেই ভাত খাবার সুযোগ রিশাদকে দেওয়া হয়নি। সিরাজ ভাইয়ের দোকানের পিচ্চিকে এক পাশে ডেকে এনে ৫০ টাকা দিয়ে বখশিশ দিয়ে বললাম, তুই রিশাদের রুমে সাড়ে দশটার দিকে প্লেট আনতে গিয়ে কাকে দেখিছিলি? শুনেই ৫০ টাকা ফেরত দিয়ে সেই ছেলে বলল, মামা বিশ্বাস করেন আমি কাউরে দেহি নাই!

এরপর রিশাদের রুমে গেলাম আমরা। রিশাদের বালিশ, চাদর আর বইপত্র জড়িয়ে আন্টি কান্নাকাটি করলেন বেশ কিছুক্ষণ। অতি হ্রদয়বিদারক দৃশ্য। রিশাদের রুমমেট ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি কল্লোল বণিক বললেন, আন্টি আপনি চিন্তা করবেন না। প্রশাসন যেন কোনভাবেই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ক্যাডারদের প্রশ্রয় না দিতে পারে সেজন্য আমরা লাগাতার কর্মসূচী দিব।

পরদিন আমরা হল প্রভোস্ট আসরার স্যারের সাথে এবং জাবির প্রক্টর কামরুল আহসান স্যারের সাথে দেখা করি। হল প্রভোস্ট এমনভাবে কথা বললেন মনে হল রিশাদের মৃত্যুতে উনি সত্যি সত্যিই পুত্রশোকে কাতর। বললেন পলাতক আসামীদের হলে দেখা যাওয়া মাত্র উনি অ্যাকশান নিবেন।

প্রক্টর স্যার আবার রিশাদ হত্যার তদন্ত কমিটির প্রধান। উনি বললেন, দেখুন খুনিদের বিরুদ্ধে হলের একটি ছেলেও সাক্ষী দিতে রাজী হয়নি। রিশাদও মারা যাবার আগে কারো নাম বলে যেতে পারেনি। এবং রিশাদের মৃত্যু হয়েছে হসপিটালে নেবার প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর। যদি হলের রুমেই মারা যেত তাহলে কেইসটা আরও অনেক বেশী স্ট্রং হত। তারপরও তদন্তে যাদের নাম আসবে আমরা তাদের সবাইকে আজীবনের জন্য বহিষ্কারের সুপারিশ করব। এইবার চিৎকার করে উঠলেন আন্টি, কসম খোদার! সন্তানহারা মা এরকম প্রহসনের তদন্ত হলে আপনাদের কোনদিন মাফ করবে না!
হঠাৎ করে আন্টির এরকম রণমূর্তি দেখে প্রক্টর স্যার বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন।

আমরা দুজনই বেশ মন খারাপ করে সেদিন বিকালের বাসে জাবি থেকে ঢাকায় ফিরে আসলাম।


আট


পরদিন আমরা ভিসির সাথে দেখা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু উনি নানা কাজে অনেক ব্যস্ত মানুষ। তাই প্রোভিসি’র সাথে দেখা করেই আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হল।
এরপর জাবি সাংবাদিক সমিতির সভাপতি শফিকুর রহমান জিকো ভাইয়ের সাথে দেখা করলাম আমরা। উনি কথা দিলেন হত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত জাতীয় দৈনিকে রেগুলার মিডিয়া কাভারেজ দেবার। তবে ওনাকে দেখে আমাদের মনে হয়েছিল রিশাদের খুনিদের বিচারের চেয়ে অনেকদিন পর জাবি নিয়ে এরকম একটি ব্রেকিং নিউজ পাওয়া গেছে তা নিয়েই উনি বেশী উত্তেজিত!

সর্বশেষ আমরা দেখা করেছিলাম ছাত্রনেতা তুহিনের সাথে। উনি কি অদ্ভুতভাবে বলে বসলেন লিমন নামের কাউকে উনি চিনেন না। ওনার ধারণা প্রতিপক্ষ রিশাদকে মেরে ওনার দলের নাম বলছে ইচ্ছে করে ওনাদের ফাঁসানোর জন্য!

এরপর আরও একদিন আমরা সাভারে যাই, তবে জাবিতে নয়। এবার যাই সাভার থানায় লিমন ও তার দুই বন্ধুর নামে মামলা করবার জন্য। কিন্তু সেই দুই বন্ধুর একজন সরকার দলীয় এমপি’র ভাতিজা হবার কারণে তারা মামলা নিতে চায়নি। যুক্তি দেখাল জাবি প্রশাশন ইতিমধ্যে একটি অপমৃত্যু মামলা করেছে তাই এখন আর নতুন মামলা নেওয়া যাবে না।

পরের দিন আমার মোবাইলে তুহিনের ফোন আসে, আমাকে বলা হয় আর কোনদিন যদি আমাকে জাবি ক্যাম্পাসে দেখা যায় তাহলে আমার পরিণতিও নাকি রিশাদের মতোই হবে!

রিশাদের মৃত্যুর পর আন্টির শরীর অনেকটাই ভেঙ্গে পড়েছিল। কিন্তু কি অদ্ভুত জীবনী শক্তি তাঁর। চিটাগাং থেকে ঢাকা, তারপর প্রতিদিন জাবি গিয়েই উনি ক্ষান্ত হননি! পরের শুক্রবার উনি আমাকে নিয়ে গাইবান্ধা রওনা হলেন লিমনের মায়ের সাথে দেখা করবার জন্য! অজপাড়াগা থেকে পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স পাওয়ায় লিমনকে মেধাবীই বলতে হবে। আফসোস ছাত্র রাজনীতি লিমনের মত আরও কত নাম না জানা মেধাবীর জীবন শেষ করে দেয়। লিমনের অর্ধশিক্ষিত মা আমাদের দিকে কেমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। উনি কিছুতেই বিশ্বাস করলেন না, ওনার ছেলে কাউকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারে। বরং আমাদের কারণে ওনার ছেলেকে নির্দোষ হয়েও পুলিশের ভয়ে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে এজন্য মৃদু তিরস্কার করলেন।

আসলেই মমতাময়ী মায়েদের কাছে সন্তান সবসময় নিষ্পাপ থেকে যায়!


নয়


প্রায় দশদিন ঢাকায় থাকবার পর আন্টির সাথে আমিও সোহাগ বাসে করে রাতের বেলা চিটাগাং রওনা দেই। পুরো বাস জার্নিতে আন্টি এক মিনিটের জন্যও ঘুমাননি। সারা রাস্তায় শুধু রিশাদের স্মৃতিচারণ করলেন। বেস্ট ফ্রেন্ড হয়েও রিশাদের এতসব মজার ঘটনা আমার অজানা ছিল জেনে বেশ অবাক হলাম।

‘সাত বছর বয়সে মুসলমানি করবার পর অনেকদিন লুঙ্গি পড়ে থাকতে হয়েছিল। একটু এদিক সেদিক হলেই ব্যাথায় আম্মু বলে চিৎকার দিয়ে উঠত। আমার সেই সোনার টুকরা ছেলেটাকে ওরা পিটিয়ে মেরে ফেলল। ইয়া খোদা তুমি ওদের বিচার করবা’- বলেই আমার কাঁধে মাথা রেখে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগলেন আন্টি!

আন্টিকে সান্তনা দেবার ভাষা আমার জানা ছিল না। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল আন্টিকে বলি, আন্টি এক ছেলে গিয়েছেতো কি হয়েছে আপনার আরেক ছেলে এখনো বেঁচে আছে। কিন্তু কেন জানি বাকি জার্নির পুরোটা সময় আমি নিশ্চুপ হয়ে বসে ছিলাম।


দশ


আন্টিকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে বিদায়ের আগে কিছু অনুরোধ করলাম, নিয়মিত ওষুধ খাবার জন্য আর রেগুলার ডাক্তার চেকআপ আর টেস্টগুলো যেন করান। পরক্ষনে নিজের কাছেই খারাপ লাগল খুব, আগেতো প্রায় শুক্রবার চিটাগাং এসে রিশাদ এসব দায়িত্ব পালন করত।

আন্টিকে বললাম প্রস্তুত থাকতে, আসছে ঈদের দিন সকালে সর্বসাধারণ এর সাথে আমরা প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে যাব এবং ওনাকে অনুরোধ করব রিশাদের খুনিদের যেন খুব দ্রুত বিচার হয়। আমার পাগলামির কথা শুনে অনেক অনেকদিন পর আন্টির মুখে হাসি দেখলাম, যদিও সেই হাসির মধ্যে কোন প্রাণ ছিল না!

তখনও জানতাম না আন্টির সেই হাসিই আমার দেখা ওনার শেষ হাসি হবে। পুত্রশোক সইতে না পেরে ছেলে মারা যাবার তিন মাসের মাথায় হার্ট অ্যাটাক করে আন্টিও চিরনিদ্রায় চলে যান।

জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত উনি ছেলে হত্যার বিচারের আশায় ছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত শেষ বিচারের দিন খোদার ফয়সালাই তাঁর শেষ নিয়তি হল। স্বামী মারা যাবার পর একমাত্র ছেলেকে আগলে ধরে উনি সব শোককে শক্তিতে পরিণত করেছিলেন কিন্তু সেই ছেলেও বড় অসময়ে চলে যাওয়ায় সেই শোক আর কাটিয়ে উঠতে পারেননি তিনি।


বাবা ও ছেলের পাশে আন্টিকে নিজ হাতে শুইয়ে দিয়ে আসি।


পাশাপাশি তিনটি কবর দেখলে মনে হয় ছেলেকে মাঝখানে রেখে বাবা মা পরম আদরে দুপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছেন, যেন একটি ছোট্ট সুখী পরিবার পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে চিরদিনের জন্য!


যখনই চিটাগাং যাই প্রতিবারই ওনাদের তিনজনের কবর জিয়ারত করি আর প্রিয় বন্ধুর কবর ছুঁয়ে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সর্বস্ব দিয়ে হলেও প্রিয় বন্ধুর খুনিদের ফাঁসির জন্য লড়াই করে যাব!

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ০৮ ই অক্টোবর, ২০১৪ সকাল ১০:৪৯

ব্ল্যাক পাইরেট বলেছেন: আমরা এমনি অভাগা দেশে জন্মেছি যে দেশে খুনিরা মুক্তভাবে ঘুরে বেড়ায় যাদের থাকার কথা ছিল কিনা জেলে বা কবরে আর সেখানে আজ নিষ্পাপ দুটি প্রাণের অপমৃত্যু, ধিক্কার জানাই.। কিন্তু কাকে জানাবো ধিক্কার, সেযে বারবার নিজের উপরেই এসে পরে।

০৯ ই অক্টোবর, ২০১৪ রাত ৮:৫০

শিস্‌তালি বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই অনেক সুন্দর মন্তব্যের জন্য

২| ০৮ ই অক্টোবর, ২০১৪ সকাল ১০:৫০

শেরজা তপন বলেছেন: কষ্ট পেলাম -ভীষন কষ্ট!!! লেখার মুন্সীয়ানার জন্য ভাললাগা

০৯ ই অক্টোবর, ২০১৪ রাত ৮:৫২

শিস্‌তালি বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই! অনুপ্রানিত হলাম

৩| ০৮ ই অক্টোবর, ২০১৪ রাত ৯:৩৪

অপূর্ণ রায়হান বলেছেন: কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না , খুব খারাপ লাগলো :(

ভালো থাকবেন আপনি ।

০৯ ই অক্টোবর, ২০১৪ রাত ৮:৫২

শিস্‌তালি বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই! অনুপ্রানিত হলাম

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.