নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইচ্ছে থাকিলে উপায় হয়, আমার কেবল উপায় থাকিলেই ইচ্ছে হয়

শিস্‌তালি

Stay Hungry, Stay Foolish!Stay Sexy, Stay Virgin!!!

শিস্‌তালি › বিস্তারিত পোস্টঃ

My First Book Review

১৮ ই এপ্রিল, ২০২১ রাত ৯:০০

বই- ’ ৭১ এর রোজনামচা
লেখক- আহসান হাবীব
প্রকাশক- বর্ষাদুপুর প্রকাশনী
পৃষ্ঠাসংখ্যা ৯৬, মূল্য ২০০ টাকা
প্রথম প্রকাশ- একুশে বইমেলা ২০১২
‘বিহারী লাল নামে এক হিন্দুকে পাকরাও করল হানাদার পাক আর্মী।
- তোমহারা নাম কিয়া?
হিন্দু ভদ্রলোক ভাবলেন। এমনেও মরছি ওমনেও মরছি। মরার আগে আর মিথ্যে বলব না। আসল নামই বলব,
দৃঢ় স্বরে বললেন- মেরা নাম বিহারী লাল হ্যায়
- ওহ তোম বিহারী হ্যায়… যাও যাও…
মূর্খ পাক আর্মী ছেড়ে দিল বিহারী লালকে। বেঁচে গেলেন সে যাত্রায় বিহারী লাল।‘
শেষটা এই কৌতুক দিয়ে শেষ করলেও পুরো বইটি কিন্তু এরকম হাস্যরসাত্মক কাহিনীতে ভরপুর ছিলনা বরং বইয়ের পাতায় পাতায় ছিল দুর্দান্ত লেখনীতে ৭১ এর মর্মান্তিক, লোমহর্ষক, করুণ কাহিনী আর কঠিন দিনলিপিগুলোর হৃদয় ছুয়ে যাওয়া হাহাকার।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার আগ্রহের শেষ নেই, এই আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক বিশ্লেষণ নয় বরং আমার কৌতূহল সর্বদা সেই কঠিন সময়ে টেকনাফ থেক তেতুলিয়া পর্যন্ত গ্রামবাংলার আপামর জনতার কষ্টকর অভিজ্ঞতাগুলোর স্বরুপ অন্বেষণে আর এই বইটি আমার সেই তৃষ্ণা মেটাতে পুরোপুরি সার্থক!
একাত্তরে লেখক ছিলেন ক্লাস সিক্সের ছাত্র, সেই বয়সেই মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন অনেক ভয়ংকরভাবে- অনেক লোমহর্ষক ঘটনার স্বাক্ষী হিসেবে। চেস্টা করেছিলেন একাত্তরে ডায়েরী লেখার… সেই ডায়েরী পরবর্তীতে হারিয়ে যায়। হারিয়ে যাওয়া সেই ডায়েরীর স্মৃতির আলোকেই এই বই।
মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করায় এক বাবাকে হত্যা করতে নিয়ে গেল পাকবাহিনী। চোখ বাঁধা বাবাকে গুলি করবার আগমূহুর্তে কোত্থেকে ছেলে এসে বাবাকে জরিয়ে ধরে চিৎকার করে, বাবাকে মেরোনা, আমার বাবাকে মেরো না! ছেলেকে বারবার টেনে হিঁচড়ে সরিয়েও আটকানো যাচ্ছিল না, সে বারবার ছুটে গিয়ে বাবাকে জরিয়ে ধরে। অবশেষে বাবা-ছেলেকে একসাথে গুলি করে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হল।
লোহাগাড়াতে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সবাই দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে পালাচ্ছে, এক মা তার শিশুকন্যাকে কাথায় জরিয়ে ধরে পালাল। নিরাপদ আশ্রয়ে গিয়ে আবিষ্কার করল, ভুলে কোলবালিশ নিয়ে এসেছে কাঁথায়… পাগলের মত ছুটে গেল বাড়িতে… তিনমাস বয়সী শিশুকন্যা ততক্ষণে পুড়ে ছাই!
বাসস্টপে দাঁড়িয়ে ছিল গ্রামের এক নববধূ আর তার স্বামী… হুট করে মূহুর্তেই পাকবাহিনী এসে নববধূকে তাদের গাড়িতে তুলে নিল, এরপরই ঘটল এক ভয়ংকর ঘটনা, এক আর্মী তখনও গাড়িতে উঠেনি- সেই নববধূর গোবেচারা স্বামী ক্ষেপে গিয়ে সেই আর্মীর মাথা ইট দিয়ে থেতলে দিল। সাথেসাথেই গুলিতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল তরুণ স্বামী- নববধূ বিস্ময়ে হতবাক। সেই বেচারীর কপালে কি ভয়ংকর অত্যাচার জুটেছিল তা আর ইতিহাসের পাতায় লেখা হয়নি।
এক পাকিস্তানী আর্মিকে মুক্তিযোদ্ধাদের হাত থেকে বাঁচিয়ে নিজগৃহে আশ্রয় দিয়েছিল এক বিহারী মেয়ে। মুক্তিযোদ্ধারা চলে যেতেই সেই পাক আর্মী মেয়েটিকে ধর্ষণ করে! পরদিনই অবশ্য মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে সেই বেঈমান আর্মি।
আবার এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে পাবনাতে, মুক্তিযোদ্ধা ছোট ভাইকে হত্যার প্রতিশোধ নিতে অপর মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরা এক পাক আর্মীকে ধরে এনেছে মায়ের সামনে তাকে জবাই করে ভাতৃহত্যার প্রতিশোধ নিবে, মমতাময়ী মা সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেই পাক আর্মীকে জরিয়ে ধরে বলে আজ থেকে এই আমার সেই হারিয়ে যাওয়া বাবুল! সেই পাক আর্মী সেই মায়ের আশ্রয়েই পাবনাতে থেকে গেল এবং বিয়েশাদী করে পরবর্তীতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও বেশ ভাল ভূমিকা রেখেছিল!
এই ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরের সময়ের, এক প্রবাসী বাঙালী আমেরিকায় এক পাকিস্তানী ট্যাক্সি ড্রাইভারকে মুক্তিযুদ্ধে তার দুই ভাই শহীদ হয়েছে জানালে সেই ট্যাক্সি ড্রাইভার ট্যাক্সি থামিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে আর বলে, আমাকে ক্ষমা কর, আমিও সেসময় পাকিস্তানী সোলজার ছিলাম আর এখন বুঝি আমরা খুব অন্যায় করেছিলাম তোমাদের সাথে!
পাবনায় এক হিন্দু হোটেলের মালিকের দুই সুন্দরী মেয়েকে ধরে নিয়ে গিয়ে অনেকদিন ভোগ করবার পর পাকবাহিনী কন্যাদ্বয়ের বাবাকে প্রস্তাব দিল, দুই মেয়েকেই ছেড়ে দিবে বিনিময়ে তাদের তিনবেলা করে হোটেল থেকে প্রতিদিন খাবার দিতে হবে। বাবা সেই প্রস্তাব নাকচ করে দেওয়ায় বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয় তাঁকে।
আমরা অনেকেই জানি, কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদকে পাকবাহিনী ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করে কিন্তু তিনি কখনোই তাঁর সাথে কি করা হয়েছিল সে প্রসঙ্গে বিস্তারিত বলেননি এবং এই বইতেও এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, মিলিটারিদের হাত থেকে নিস্তার পাবার পর হুমায়ুন আহমেদ এর সাথের একজন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন আর হুমায়ুন আহমেদ রাতে দুঃস্বপ্নে বহুদিন অত্যাচার করা সেই পাক আর্মীকে দেখে এরপর সারারাত ঘুমাতে পারতেন না!
এই বইতে আরো কিছু করুণ ও দুঃসাহসিক কাহিনী আছে যেমন পাক আর্মীদের হাত থেকে বাঁচতে বাবামেয়ের এক সাথে লঞ্চ থেকে লাফ দিয়ে নদী সাতড়ে বেঁচে যাওয়ার ঘটনা, ছেলেমেয়েসহ মাঝনদীতে সাঁতরানো অবস্থায় নিজে ও একসন্তানকে বাঁচাতে এক অসহায় বাবার স্বেচ্ছায় অপর সন্তানকে মৃত্যুর কাছে সমর্পণ করা কিংবা যেই ঘটনা বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানকে উদ্বুদ্ধ করেছিল সময়ের সাহসী বীরযোদ্ধা হতে অথবা কুকুরকে বাঁচাতে গিয়ে এক মুক্তিযোদ্ধার শহীদ হওয়া এবং মনিবের মৃত্যুতে জিমি নামের আরেক কুকুরের ভালবাসার পাগলামির কথা!
খালি বাসায় এক তরুনী মা তাঁর একমাত্র কোলের সন্তানকে নিয়ে লুকিয়ে ছিল যখন পাকবাহিনী ঘরে ঢুঁকে তল্লাশী চালায়, বাচ্চা কেঁদে উঠবে বলে মুখ চেপে ধরেন তিনি কিন্তু আর্মীরা যাবার পর দেখা যায় দম বন্ধ হয়ে সে বাচ্চা মারা গিয়েছে আগেই!
সেরকমই আরেক দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছিল ঢাকায় নভেম্বর মাসে, বাবা মা আর শিশুকন্যা পালাতে না পারায় সারাদিন বাসায় নিশ্চুপ থাকতেন যেন রাজাকাররা টের না পায় বাসায় কেউ আছে। শিশুটি রাতে কাঁদত বলে ধরা পড়ে যাবার ভয়ে মা বাচ্চাকে দুধের সাথে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিলেন, ওষুধের ডোজ বেশী হওয়ায় সেই শিশুটির ঘুম আর ভাঙেনি কখনোই।
শেষ করব আল্লাহ্‌ রাখা খান নামের এক অদ্ভুত পাকিস্তানীকে দিয়ে… ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তিনি কি মনে করে পাবনা শহরে চলে এসে থিতু হয়ে গিয়েছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধে তিনি পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। একসময় পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়বার পর তাঁকে গাদ্দার আখ্যায়িত করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। আফসোস বাংলার ইতিহাস হয়তোবা সেই আল্লাহ্‌ রাখা খানের আত্মত্যাগের কথা মনে রাখেনি কিন্তু বাংলার মাটি নিশ্চয়ই এই বীরকে মনে রেখেছে সযত্নে।
বাঙালী জাতির সাথে পাকবাহিনী যে নিষ্ঠুর আচরণ করেছিল মানবসভ্যতার ইতিহাসে তা খুব বিরল কিন্তু স্বজাতি হয়েও রাজাকার আলবদর বাহিনী যে ভয়ংকর অন্যায় করেছিল বাংলা মায়ের দামাল সন্তানদের সাথে এর চেয়ে ঘৃণ্য কাজ আর হতে পারেনা। এই বইয়ের বিভিন্ন কাহিনীতে রাজাকারদের বিভিন্ন ঘটনা পড়বার পর আমার মনে এটাই বারবার প্রশ্ন আসছে, তাদের বেশীরভাগই হয়তোবা এখন বেঁচে নেই- মৃত্যুর পর সেইসব রাজাকার আলবদররা এখন কেমন আছে, তারা কি তাদের সেই সময়ের ভুমিকার জন্য অন্তত এখন আদৌ অনুতপ্ত!
আমি সাধারণত খুব ধীরে সুস্থে আয়োজন করে কদিন সময় নিয়ে যেকোন বই পড়ি কিন্তু এই বইটি এক বসাতেই এক টানে শেষ করেছি কিন্তু একদিনে একবারেই বইটি শেষ করলেও এই অসাধারণ বইটির রেশ আরও বহুদিন বহুক্ষণ আমার মনে রয়ে যাবে সে ব্যাপারে সন্দেহের কোনই অবকাশ নেই। সবাইকে এই সুখপাঠ্য বইটি পড়ে দেখবার আমন্ত্রণ রইল।

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১৮ ই এপ্রিল, ২০২১ রাত ১১:৪৫

রাজীব নুর বলেছেন: ৯৬ পৃষ্ঠার বই ২০০ টাকা আপনার কাছে বেশী মনে হচ্ছে না?
৯৬ টাকা হলে ভালো হতো।

১৯ শে এপ্রিল, ২০২১ রাত ৩:০৩

শিস্‌তালি বলেছেন: এটা কাভার মূল্য ভাই। ২৫% ডিসকাউন্টে ১৫০/- আবার বইমেলায় বিকাশে দিয়ে ১০% ক্যাশব্যাক টাি ১৩৫/- পড়েছে মূল্য

২| ১৯ শে এপ্রিল, ২০২১ সকাল ৭:৩৪

লাতিনো বলেছেন: আপনি যে আল্লারাখা খানের কথা বললেন, সে কি আসলেই গাদ্দার ছিলনা? আপনার কি মনে হয়?

আমার মনে হয় সে ছিলনা। অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোটাই জিহাদ। অন্যায় কে করল সেটা দেখার বিষয় নয়। নিজের বাবাও যদি অন্যায় করে, তবে তার বিরুদ্ধেও জিহাদ করা ওয়াজিব।

১৯ শে এপ্রিল, ২০২১ দুপুর ১২:০৩

শিস্‌তালি বলেছেন: জ্বী অবশ্যই গাদ্দার ছিল না, সে ন্যায়ের পক্ষে ছিল।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.