নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি \'স্মৃতিকাতরতা \' নামক ভীষণ এক রোগগ্রস্ত, সেই সাথে বিষাদগ্রস্থ মানুষ। আমার চিকিৎসার প্রয়োজন।

স্বপ্নবাজ সৌরভ

আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্য মারা যাবো .......

স্বপ্নবাজ সৌরভ › বিস্তারিত পোস্টঃ

সাহসী রাশিয়ান শৈশব : বীর ছেলে কলিয়া ( শেষ অংশ )

২৪ শে নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৫:০৭



আগের অংশ পড়ে নিন।

( শেষ অংশ )

--- একটু সবুর কর । মা’কে আর বাকি সবাইকে বাঁচিয়ে দেবো আমরা। এবার ঘুমিয়ে নে।
অনুনয়-ভরা দৃষ্টিতে ছেলেটি তাকাল তাঁর দিকে :
--- ইচ্ছে নেই … পরে। আগে ওদের কথা বলে ফেলি।
তার এমন জেদী গলা শুনে ক্যাপ্টেন আর তাকে ঘুমোবার কথা বলতে ভরসা পেলেন না।
টেবিলের অন্য ধারে বসে একটি নোটবই হাতে তুলে নিলেন তিনি।
-- বেশ , বল তাহলে … তোর মতে খামারের এলাকায় কতগুলো জার্মান রয়েছে।
মাথা নেড়ে একবারও না ঠেকে ছেলেটি তাড়াতাড়ি বলে চলল :
--- এক ব্যাটালিয়ন বাভেরিয়ান ইনফ্যান্ট্রি। সাতাশ নম্বর ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন একশ’ ছিয়াত্তর নম্বর রেজিমেন্ট। হল্যান্ড থেকে এসেছে ফ্রন্টে।
--- দারুন তো ! কি করে জানলি ? --- উত্তরে য্থায্থতায় অবাক হন ক্যাপ্টেন।

--- জানব না আবার ! আমি যে ওদের ব্যাজের নম্বরগুলো দেখেছি। ওদের কথাবার্তাও শুনেছি। জার্মান ভাষা জানি , ইসকুলে পড়াশুনো ভালোই করতাম—কোম্পানিটা মোটরসাইক্লিস্ট আর সব-মেশিনগানারদের।
মাঝারি জাতের ট্যাঙ্ক প্লেটুনটা আছে শূয়োরের খোঁয়াড়ে । সবজি-ভুঁইয়ের উত্তর দিকে রাইফেল কোম্পানির বড় বড় ট্রেঞ্চ। ওখানে আছে দু’টো মজবুত ঘাঁটি। বেটারা বেশ গেড়ে বসেছে , কমরেড ক্যাপ্টেন। পুরো দশটা দিন ট্রাকে করে সিমেন্ট টেনেছে। একশ’ন’ ট্রাক ঢেলেছে। আমি জানলা দিয়ে দেখেছি সবকিছুই।

--- আচ্ছা ওই ঘাঁটিগুলো ঠিক কোথায় আছে বলতে পারিস? --- একটু সামনে হেলে জিজ্ঞেস করেন ক্যাপ্টেন। তিনি বুঝলেন যে তাঁর সামনে বসে আছে মামুলি কোন ছোকরা নয়, যে শুধু খুব সাধারন তথ্যাদি দিতে পারে , তার সামনে – অতি দূরদর্শী , বিবেকী এর নির্ভুল এক গুপ্তচর।
অবশ্যই পারবো … একটা আছে --- সবজি-ভুঁইয়ে , পুরনো ফসল মাড়াইয়ের জায়গাটার পেছনে , যেখানে আছে টিলা। আর অন্যটা ...

--- দাঁড়া ! – থামিয়ে দেন ক্যাপ্টেন। – খুবই ভাল কথা যে তুই সবকিছু দেখেছিস আর মনে যে রেখেছিস। কিন্তু জানিস তো আমরা তোদের খামারে কখনও যাই নি বা থাকি নি। কোনখানে সবজি-ভুঁই , কোনখানেই বা মাড়াইয়ের জায়গা --- সব ই আমাদের অজানা। দশ-ইঞ্চি ক্যালিবারের কামান তো আর খেলার কথা নয় দোস্ত। ধর , আমরা না হয় আন্দাজী তোপ দাগলাম , কিন্তু তাতে ঝুটমুট করে ক্ষতি হতে পারে।

ওখানে তো আমাদের লোক রয়েছে … তোর মাও .. তুই সবকিছু এঁকে দেখাতে পারবি ?
ছেলেটি মাথা তুলল। দৃষ্টিতে ভ্যাবাচ্যাকা – খাওয়া ভাব। বলল :
--- আপনার কাছে কোন ম্যাপ-ট্যাপ নেই , কমরেড ক্যাপ্টেন ?
--- ম্যাপ আছে .. তবে তুই তা দেখে বুঝবি কিছু ?
--- হুহঃ কি যে বলেন ! – রাগ করে ছেলেটি, -- আমার বাবা জিওডেজিস্ট।
আমি নিজে ম্যাপ আঁকতে পারি। খুব পরিস্কার না হ ওলেও, পারি .. বাবাও এখন
আর্মিতে , স্যাপারদের কমান্ডার , ... সগর্বে বলে যায় সে।
--- দেখা যাচ্ছে তুই তাহলে মামুলি ছেলে নোস্ , তুই একেবারে হীরের টুকরো , ---

টেবিলের ম্যাপখানা বিছতে বিছতে তামাশা করেন ক্যাপ্টেন। ছেলেটি টেবিলের ওপর হাঁটুতে ভর দিয়ে ম্যাপের ওপর নুয়ে পড়ে। অনেকখন দেখল সে , তারপর মুখটি তার উজ্জ্বল হয়ে উঠল। হঠাৎ আঙুল দিয়ে ম্যাপখানার একটা জায়গায় ফুটো করে দিল সে।

--- এই যে এখানে ! – ছেলেটির চোখেমুখে খুশীর হাসি ফুটে উঠল। --- সবকিছু
যেন একেবারে আঙুলের ডগায়। ম্যাপখানা আপনার কি ভালো ! সবকিছু আছে
এতে। সবকিছুই স্পষ্ট। এই এখানে খাদের পেছনেই পুরনো মাড়াইয়ের জায়গা।
নির্ভুলভাবে ম্যাপের সমস্তকিছু বুঝতে পারে ছেলেটি , আর ক্যাপ্টেন লক্ষ্যস্থলের

চারদিকে হাতে আঁকা লাল ক্রুশচিহ্নগুলি দিয়ে ম্যাপটিকে ভরে ফেলতে লাগলেন।
ক্যাপ্টেন দারুণ খুশি। চেয়ারের পিঠে হেলান দিয়ে বসেন তিনি।
--- বাহঃ, সাবাস কলিয়া ! – ছেলেটির হাত ধরে খুব তারিফ করেন তিনি।
বলেন, -- খাসা ছেলে তুই !

প্রকৃত স্নেহের স্পর্শ অনুভব করে ছেলেটি মুহূর্তের জন্যে যেন ফিরে গেল শৈশবে , শিশুর মতো সোহাগে গলে সে তার গালটা রাখল ক্যাপ্টেনের হাতের তালুতে।
বিষণ্ণভাবে মাথা নেড়ে ক্যাপ্টেন ম্যাপটি ভাঁজ করতে লাগলেন। পরে বললেন :
--- কমরেড ভিখরভ , এবার আমাদের নিয়ম মোতাবেক ঘুমান দরকার।

ছেলেটি আর আপত্তি জানাল না। পেট ভরে খাওয়া হয়েছে তার, জায়গাটিও বেশ মোলায়েম গরম , কাজও শেষ। ঘুমে সে ঢুলছে। বুঁজে আসছে চোখের পাতা। মিষ্টি হাই তুলল সে। ক্যাপ্টেন ছেলেটিকে খাটের ওপর শুইয়ে ওভারকোট দিয়ে ঢেকে দিলেন।
সঙ্গে সঙ্গে সে ঘুমিয়ে পড়লো। নিজের স্ত্রী ও ছেলের কথা মনে পড়ে কিছুক্ষণ তার কাছে দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবলেন ক্যাপ্টেন , তারপর টেবিলে ফিরে গিয়ে বসে ছকতে শুরু করে দিলেন গোলাবর্ষণের পরিকল্পনা।
কাজে তিনি এতই ডুবে গেলেন যে সময়ের হিসেব রইল না তার। সামান্য একটা আওয়াজে হঠাৎ তার চমক ভাঙল। দেখলেন , ছেলেটি উঠে বসে আছে খাটে। মুখে তার উৎকণ্ঠার ছাপ।
--- ক’টা বাজে কমরেড ক্যাপ্টেন ?

--- ঘুমো তো। সময়ের কথা গুলি মার্। আমরা তোকে ঠিক সময়ে জাগিয়ে দেব।
কিন্তু ছেলেটি প্রবোধ মানল না এতে। মুখখানা তার কালো হয়ে এল। জেদ ধরে তাড়াতাড়ি সে বলল:
--- না , না। আমাকে ফিরতে হবেই। মা’কে আমি কথা দিয়েছি। মা ভাববেন আমাকে হয়তো মেরে ফেলেছে। সন্ধ্যে হলেই আমি চলে যাব।
ক্যাপ্টেন তো অবাক। তিনি ভাবতেই পারেন না যে রাতের স্তেপে ছেলেটি আবার পাড়ি দেবে ভয়ঙ্কর এক পথ , যা একবার দৈবাৎ অতিক্রম করতে পেরেছে। ক্যাপ্টেনের মনে হল , হয়তো তাঁর অতিথির ঘুম এখনও ঠিক মতো ভাঙে নি , হয়তো সে ঘুমের ঘোরেই কথা বলছে।

--- কী বাজে বকছিস ! – বলেন তিনি। – কে তোকে ছাড়বে ? জার্মানদের হাতে যদি না-ও পরিস , তো খামারে পৌছে হয়তো আমাদের গুলিতেই খতম হয়ে যাবি। হুঁহঃ , দেখছি শেষকালে তোকেই আমার মারতে বাকি ! পাগলামি রাখ তো। ঘুমো।
লাল হয়ে উঠে ছেলেটি কপাল কোঁচকালো :
--জার্মানদের হাতে আমি পড়বো না। রাত্তিরে ওরা বেরয় না। বেটাদের ভীষণ শীতের ভয় , খুব নাক ডাকায়। আর আমার সব পথ একেবারে মুখস্ত। দোহাই আপনার , আমায় ছেড়ে দিন।

অক্লান্ত অনুনয় করে কল সে, অনেকটা যেন ভয় পেয়েছে . ক্ষণিকের জন্যে ক্যাপ্টেনের একবার মনে হল : ‘ আচ্ছা , ছোকরাটির এখানে আবির্ভাব আর তার গল্প কোন মনগড়া কমেডি বা ছলনা নয় তো ?’
কিন্তু তার উজ্জল করুন চোখের দিকে তাকিয়ে নিজের এমনতরো সন্দেহের জন্যে নিজেরই লজ্জা হল ক্যাপ্টেনের।
--- আপনি তো জানেন , কমরেড ক্যাপ্টেন , জার্মানরা কাউকে খামার ছেড়ে যেতে দেয় না। হঠাৎ হয়তো এসে দেখবে –
আমি বাড়িতে নেই। তখন মা’কে আর আস্ত রাখবে না।







বিষণ্ন তার কণ্ঠস্বর। তাতে ছেলেমানুষির চিহ্ন মাত্র নেই। বোঝা গেল , সত্যি যে সে মায়ের জন্য চিন্তিত। -চিন্তা করিস না। সব ই বুঝেছি , -- ঘড়ি বের করে বলেন ক্যাপ্টেন , --- মা'র কথা যে ভাবছিস সে খুব ই ভাল কথা।
এখন বিকেল সাড়ে চারটে। চল , আমরা মাচানে উঠে আর ও একবার সবকিছু দেখে নিই। কথা দিচ্ছি , সন্ধ্যে হতেই আমাদের ছেলেছোকড়ারা তোকে যতদূরে পারে পৌঁছে দিয়ে আসবে। বুঝলি?

মেশিন উঠে ক্যাপ্টে বসলেন দুরুত্ব-মাপা যন্ত্রের কাছে। তিনি দেখতে পান , গিরিখাতে বাতাসে-নিয়ে-আসা তুষারের ধূসর-হলদে ঢেউয়ে ঢাকা ক্রিমিয়ার বন্ধুর স্তেপ . স্তেপের ওপর মিলিয়ে আসছে গোধূলির রক্তিম আভা। দিগন্তে অন্ধকার বিলীন হয়ে যাচ্ছে খামারের সরু সারিবদ্ধ বাগিচা। অনেকখন ধরে ক্যাপ্টেন তাকিয়ে রইলেন বাগানগুলির দিকে। তাদের ফাঁকে ফাঁকে চোখে পড়লো এখানে-ওখানে ছড়ানো শাদা ছোট ছোট বাড়ি। ছেলেটাকে কাছে ডাকলেন।
--- দেখ দেখি। মা’কে দেখতে পান কিনা....

ঠাট্টা বুঝে ছেলেটি হাসল। মাথা নুইয়ে সে আইপিসের ভেতর তাকাল। অতিথিকে তার ঘরবাড়ির দৃশ্য দেখানোর জন্যে ক্যাপ্টেন ধীরে ধীরে দিগন্ত বরাবর যন্ত্ৰটি ঘোরাতে থাকলেন। সহসা ছেলেটি বিস্মিত হয়ে আইপিস থেকে চোখ সরিয়ে পেছনে হটে গেল আর ক্যাপ্টেনের আস্তিন ধরে টানতে শুরু করলো।
--- পাখির বাসা ! আমার পাখির বাসা , কমরেড ক্যাপ্টেন। মাইরি বলছি।

বিস্মিত ক্যাপ্টেন তাকালেন আইপিসে। যারা পপলার আর মরচে-ধরা সবুজ ছাদের চেয়েও উঁচুতে লম্বা খুঁটির ওপর অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে ছোট্ট একটা বাক্স।
ধূসর-কালো মেঘের গায়ে ক্যাপ্টেন পরিস্কার দেখতে পেলেন বক্সটি। অবশেষে মাথা তুলে ভুরু কুঁচকে বসে রইলেন কয়েক মিনিট।
পাখির বাসা দেখায় তার মাথায় এক ঝাপসা চিন্তার উদয় হল ও তা ক্রমশই তাঁকে অভিভূত করতে লাগল। ছেলেটিকে হাত ধরে একপাশে টেনে নিয়ে গিয়ে তিনি তাকে চুপিচুপি কী যেন বললেন।
--- বুঝলি? – কথা শেষ হলে জিজ্ঞেস করেন ক্যাপ্টেন। ছেলেটি একেবারে উজ্জল হয়ে উঠে মাথা নাড়ায়।
আকাশ অন্ধকার হয়ে এলো। সমুদ্র থেকে বইলো শীতের হাড়-কাপানো কনকনে ঠান্ডা বাতাস। ক্যাপ্টেন ছেলেটিকে নিয়ে গেলেন কোম্পানির কমান্ডারের কাছে। কমান্ডারকে সংক্ষেপে সমস্ত ব্যাপার বুঝিয়ে দিলেন তিনি , তারপর বললেন ছেলেটিকে গোপনে খামার অবধি পৌঁছে দিয়ে আসতে। দু’জন নৌসেনা ছেলেটিকে সঙ্গে অন্ধকারে অদৃশ্য হইতে গেল। যতক্ষণ না ছেলেটির নতুন বুটজোড়া চমকানি বন্ধ হল, ক্যাপ্টেন তাকিয়ে রইলেন তাদের দিকে। চারিদিকে নৈঃশব্দ্য, তবুও ক্যাপ্টেন আতংক নিয়ে কান পেতে দাঁড়িয়ে থাকলেন --- হঠাৎ কোন গুলির আওয়াজ শোনা যায় কিনা। আধঘন্টা অপেক্ষা করে অবশেষে তিনি চলে গেলেন।

রাত্রে ঘুম এল না তার। ঘন ঘন চা খেলেন আর কাগজপত্র পড়তে লাগলেন। ফর্সা হওয়ার আগে উঠলেন গিয়ে মেশিন।আর যে মুহূর্তে আসন্ন দিনটির ধূসর পূর্বাভাসে চোখে পড়লো খুঁটির ওপর বসানো কালো বাক্সটি , সঙ্গে সঙ্গে তাঁর জঙ্গি মেজাজ উঠল চাঙ্গা হয়ে। হুকুম দিলেন তিনি। নিশানা ঠিক করে ছোড়া একঝাক গোলার প্রচণ্ড শব্দে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল স্তেপের নিস্তব্ধতা। শূন্য স্তেপের ওপর অনেকখন ভেসে রইল সেই শব্দ।
ক্যাপ্টেনের দৃষ্টি তখন আইপিসে নিবদ্ধ। তিনি পরিষ্কার দেখতে পান , খুঁটির ওপর কালো বাক্সটি বেশ একটু দুলে উঠল। দু’বার …
তারপর সামান্য থেমে আরও একবার।


--- গোলা নিশানা ছাড়িয়ে ডাইনে চলে গেল, --- বলেন ক্যাপ্টেন। তারপর নিশানা ঠিক করে নিতে হুকুম দেন।
এবার পাখির বাসটি আর দুললো না। দুটি কামান থেকে ক্যাপ্টেন গোলা দাগতে লাগলেন।
গোলন্দাজের স্বভাবসিদ্ধ সজাগ দৃষ্টিতে তিনি দেখলেন , অসংখ্য বিস্ফোরণের ফলে কিভাবে উর্দ্ধমুখে ছুটে চলেছে কড়ি বড়গা আর কংক্রিটের চাঁই। অল্প একটু বাঁকা হেসে আরও তিন ঝাঁক গোলা দাগলেন , তারপর
নিশানা বদলালেন। আবারও পাখির বাসটির সঙ্গে হয় তাঁর দিলখোলা আলাপ।
একমাত্র তিনিই বোঝেন তার ভাষা। তৃতীয়বার গোলা পড়ল গিয়ে ঠিক সেই জায়গাটায় যেখানে রয়েছে তেল আর গোলা-বারুদের গুদাম। এবার আর ক্যাপ্টেনের নিশানা ভুল হয় না --- প্রথমবারেই লক্ষ্যভেদ। দিগন্ত ছেঁয়ে গেল প্রশস্ত অনুজ্জ্বল অগ্নিশিখায়।
নিচের ধূ-ধূ আগুনে আলোকিত ধোয়ায় সারি সারি ছাইরঙা , বাদামি কুন্ডলী দিগন্ত বেয়ে উঠতে লাগলো আকাশে। গাছপালা , বাড়ির ছাদ , পাখির বাসা --- সবকিছুই ডুবে গেল তাতে। বিস্ফোরণে ভূমিকম্পের মত কেপে উঠল মাটি। ক্যাপ্টনের আশংকা হল, তাঁর গোলাগুলিতে না জানি খামারের কত ক্ষতিই হয়েছে।

টেলিফোন বেজে উঠল। তোপ দাগা বন্ধ করতে বলা হচ্ছে। এবার নৌসেনারা আক্রমণ শুরু করল , ছুটল জার্মান ট্রেঞ্চ গুলোর দিকে।
ক্যাপ্টেন তখন কবুজকে দিলেন সৈন্য পরিচারণার ভার , আর নিজে মোটরসাইকেলে লাফিয়ে উঠে তা হাকালেন খোলা মাঠে। তাঁর আর তর সইছিল না। খামার থেকে ভেসে আসছিল মেশিনগান আর বোমা-ফাটার শব্দ . ব্যাটেলিয়নের শক্তি আর অব্যর্থ নিশানায় হতবুদ্ধি জার্মানরা আশ্রয়স্থল হারিয়ে পিছু হটছিল তখন , --- প্রায় কোনরকম প্রতিরোধই করছিল না তারা। মোটর সাইকেল চড়ে ক্যাপ্টেন এবার মাঠের ওপর দিয়ে ছুটলেন খামারের দিকে। তিনি এমন পথ ধরলেন যেখানে আগে মানুষের আবির্ভাব ছিল বিপজ্জনক।

খামারে পতপত করে উড়ছে লাল নিশান। তা থেকে বোঝা গেল যে শত্রুরা সব সরে পড়েছে। বাগানের ওপর ভাসছে জ্বলন্ত পেট্রোলের রুপোলি ধোয়া , থেকে থেকে কানে আসছে আগুনের মধ্যে গোলা-বারুদ ফাটার চাপা শব্দ। ক্যাপ্টেন ছুটছেন মাথা-ভাঙা পপলারের সারির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা একটি সবুজ ছাদ লক্ষ্য করে। দূর থেকেই বেড়ার আগড়ের কাছে তিনি দেখতে পান স্কার্ফ - পরা এক মহিলা কে।

তার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে একটি ছেলে। ক্যাপ্টেন কে ছুটে আসতে দেখে ছেলেটি দৌড়ে এলো তাঁর দিকে। ছুটন্ত অবস্থাতেই ক্যাপ্টেন তুলে নিলেন ছেলেটিকে , শূন্যে ছুড়ে লুফে নিয়ে চুমু দিতে লাগলেন তার গালে , ঠোঁট আর চোখে।
তবে খুব সম্ভব ওই মুহূর্তে ছেলেটির আর নেহাত বাচ্চা হয়ে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। সে সর্বশক্তিতে ক্যাপ্টেনের বুকে হাতের ঠেকো দিয়ে নিজেকে তফাৎ করে রাখল আর চেষ্টা করতে লাগল তার আলিঙ্গন থেকে মুক্ত হতে। অবশেষে ক্যাপ্টেন তাকে ছেড়ে দিলেন।
.কলিয়া সরে দাঁড়াল . তারপর স্যালুট করে সগর্বে বললো :
--- কমরেড ক্যাপ্টেন , গুপ্তচর কলিয়া ভিখরভ সামরিক কর্তব্য পালন করেছে।
--- সাবাস, কলিয়ে ভিখরভ , -- বলেন ক্যাপ্টেন , -- বহুত শুকরিয়া !
মহিলাটি এবার কাছে জাগিয়ে এলেন। চোখে তাঁর নির্যাতনের চাপ , হাসিতে ক্লান্তি। লাজুক ভাবে হাতটি বাড়িয়ে দেন ক্যাপ্টনের দিকে।
--- ও তোমাদের জন্যে কি অপেক্ষাটাই না করেছে ! .. সবাই আমরা তোমাদের পথ চেয়ে ছিলাম। বেঁচে থাকো , বাপেরা !


ক্যাপ্টেনকে তিনি আন্তরিক রুশী অভিবাদন জানালেন। মা’র ওপর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে কলিয়া এবার ক্যাপ্টেনের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল।
---কাজটা কিন্তু করেছিস খাসা! ... গোলাগুলির ছোটার সময় চিলেকোঠায় থাকতে ভয়-টয় করে নি তো ? – জিজ্ঞেস করেন ক্যাপ্টেন।
--- বাপরে বাপ! সে যে কি ভয়ঙ্কর , কমরেড ক্যাপ্টেন , --- অকপটে বলে ছেলেটি ,-- পয়লা গোলা যেই পড়লো অমনি সবকিছু বলতে লাগল, ভাবলাম সব বুঝি ভেঙে পরবে। অল্পের জন্যে আমি ছুট দিই নি চিলেকোঠা থেকে। তবে লজ্জাও হল দারুন।
কাঁপছি আর নিজেই নিজেকে বলছি তখন : ‘বোস ! বসে থাক ! বেরনো মানা !’
তাই বসে থাকলাম যতক্ষণ না গোলা –বারুদের গুদামে আগুন লাগল ... নিজেরই মনে নেই কিভাবে শেষ পর্যন্ত নিচে গড়িয়ে পড়েছে।

প্রবল আবেগে অভিভুত আর অপ্রতিভ হয়ে ক্যাপ্টেনের ওভারকোট মুখ গুঁজে দিল ছোট্ট এই রুশী মানুষটি , তেরো বছর বয়সের বীর কলিয়া। তবে মানুষটি ছোট হলেও তার প্রাণটি কিন্তু ছিল বড়। এটা তার জাতিরই প্রাণ।
মে , ১৯৪২ সাল।




--------------------------------------------------
আরো সোভিয়েত শৈশব :

ঝলমলে সোভিয়েত শৈশব: বিপদ তারণ পাঁচন
রাশিয়ান শৈশব: ছবি ব্লগ ( বাচ্চা এবং বাচ্চাদের বাবা মায়েদের জন্য )
রুটির ফুল --- আমার সোভিয়েত শৈশব (আমার শৈশবের স্কুল !)
সাত বন্ধু ইয়ুসিকের - ( আমার সোভিয়েত শৈশব )
রূপের ডালি খেলা - (আমার সোভিয়েত শৈশব)
জ্যান্ত টুপি (আমার সোভিয়েত শৈশব)
সভ্য হওয়া - (আমার সোভিয়েত শৈশব)
মালপত্র (আমার সোভিয়েত শৈশব)
ঝলমলে সোভিয়েত শৈশব: আপেল
শেয়ালের চালাকি ১ (আমার সোভিয়েত শৈশব)
মোরগ ভাইটি (আমার সোভিয়েত শৈশব)
বীরব্রতী ভাসিয়া -- আমার সোভিয়েত শৈশব (আমার শৈশবের স্কুল !)
আমার সোভিয়েত শৈশব - আমার শৈশবের স্কুল !
শুনছি , ঘাস বাড়ছে...

মন্তব্য ১৮ টি রেটিং +৫/-০

মন্তব্য (১৮) মন্তব্য লিখুন

১| ২৪ শে নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৫:১৯

রাজীব নুর বলেছেন:

এখান থেকে পড়েছি।

২৪ শে নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৫:৩২

স্বপ্নবাজ সৌরভ বলেছেন: ওখানে তো পেনসিল আর সর্বকর্মার অ্যাডভেঞ্চার কথা বলা আছে।

২| ২৪ শে নভেম্বর, ২০১৯ রাত ৯:১১

নুরহোসেন নুর বলেছেন: আপনার রাশিয়ান গল্পের প্রতিটি পোস্ট পড়েছি, অসম্ভব ভাল লাগলো।
এরকম আরো কিছু পর্ব ধারাবাহিক লিখুন, শুভ কামনা রইলো।

২৫ শে নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ৯:৩৭

স্বপ্নবাজ সৌরভ বলেছেন: মন্তব্য অনুপ্রেরণা মূলক। ধন্যবাদ জানবেন। আমার রাশিয়ান শৈশব আরো সমৃদ্ধ করার ইচ্ছা আছে। ভালো থাকবেন।

৩| ২৪ শে নভেম্বর, ২০১৯ রাত ৯:৪০

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: বাহ!

ছোট্ট কমরেডতো সত্যিই খাসা বীরত্ব দেখাল :)

ভাল লাগলো বীর উপাখ্যান!
এমন জাতির প্রাণ হয়ে উঠলে সে জাতি থাকে নির্ভার।

++++

২৫ শে নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ৯:৩৯

স্বপ্নবাজ সৌরভ বলেছেন:

তবে মানুষটি ছোট হলেও তার প্রাণটি কিন্তু ছিল বড়। এটা তার জাতিরই প্রাণ। --- এই লাইনটা আমার খুব মনে ধরেছে। মন্তব্যে রুশী অভিবাদন।

৪| ২৪ শে নভেম্বর, ২০১৯ রাত ১০:২৮

জুল ভার্ন বলেছেন: খুব ভালো লেগেছে।

২৫ শে নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ৯:৪০

স্বপ্নবাজ সৌরভ বলেছেন: রুশী অভিবাদন গ্রহণ করুন। ভালো থাকবেন।

৫| ২৪ শে নভেম্বর, ২০১৯ রাত ১০:৩৬

রাজীব নুর বলেছেন: লেখক বলেছেন: ওখানে তো পেনসিল আর সর্বকর্মার অ্যাডভেঞ্চার কথা বলা আছে।
জানি। ওটাও পড়েছি।

২৫ শে নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ৯:৪১

স্বপ্নবাজ সৌরভ বলেছেন: পেনসিল আর সর্বকর্মার অ্যাডভেঞ্চার আমার জান।

৬| ২৪ শে নভেম্বর, ২০১৯ রাত ১১:৩১

শের শায়রী বলেছেন: ছোট বেলায় রুশদেশের উপকথা নামে এক ঢাউস মোটা বই পড়ছিলাম, এখনো সে বইর গল্পগুলো অনেক কিছু মনে আছে। আপনার গল্পটাও পড়লাম। ভালো লাগা জানিয়ে গেলাম।।

২৫ শে নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ৯:৫০

স্বপ্নবাজ সৌরভ বলেছেন: ধন্যবাদ প্রিয় ব্লগার। রুশদেশের উপকথা এর কোন গল্পটা শুনতে চান? আগামীতে পোস্ট করবো আপনার জন্য। ভালো থাকুন শৈশব বেঁচে থাকুক।


চাইলে আমার অন্যান্য রাশিয়ান শৈশব পড়তে পারেন।

৭| ২৫ শে নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১২:৫২

সোনালী ডানার চিল বলেছেন:

আপনার লেখাটি দেখে ছোটবেলায় পড়া প্রগতি প্রকাশনীর বইগুলোর কথা মনে পড়ে গেল-
মালকাইটের ঝাপি, ফিবোনক্সি রাশিমালা- আর মনে পড়ছে না!!

এই পোষ্ট দেখে খুব ভালো লাগলো- পড়তে শুরু করলাম.....

২৫ শে নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১:০৮

স্বপ্নবাজ সৌরভ বলেছেন: মালাকাইটের ঝাঁপি --- অসাধারণ এক বই। আমার শৈশবের আরো একটি বই।
রুশী অভিবাদন নিন। ভালো থাকবেন।

৮| ২৫ শে নভেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:১৮

রূপম রিজওয়ান বলেছেন: মন্তব্যের ঘরে সবাই তো দেখছি ছোটবেলায় কিংবা বড়বেলায় রুশ উপকথা পড়েছেন। হায় হায়! আমার কেন পড়া হলো না! পড়তে হবে।
ভালো লাগা++
শীঘ্রই নতুন সিরিজ আনবেন আশা করি।

২৬ শে নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ৯:২৪

স্বপ্নবাজ সৌরভ বলেছেন: ১৯৮২ সালের পরে প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেছে। ১৯৯৫-১৯৯৬ এর দিকেও বই গুলো পাওয়া যেত। এখনও মাঝে মাঝে নীলক্ষেত কিংবা পুরোনো বইয়ের দোকানে ঢুঁ মারি আশাহত হই।

নতুন গল্প নিয়ে আসবো শিগ্রী। সাথেই থাকুন। পুরোনো গুলা কি পড়েছেন ?

আরো সোভিয়েত শৈশব :

ঝলমলে সোভিয়েত শৈশব: বিপদ তারণ পাঁচন
রাশিয়ান শৈশব: ছবি ব্লগ ( বাচ্চা এবং বাচ্চাদের বাবা মায়েদের জন্য )
রুটির ফুল --- আমার সোভিয়েত শৈশব (আমার শৈশবের স্কুল !)
সাত বন্ধু ইয়ুসিকের - ( আমার সোভিয়েত শৈশব )
রূপের ডালি খেলা - (আমার সোভিয়েত শৈশব)
জ্যান্ত টুপি (আমার সোভিয়েত শৈশব)
সভ্য হওয়া - (আমার সোভিয়েত শৈশব)
মালপত্র (আমার সোভিয়েত শৈশব)
ঝলমলে সোভিয়েত শৈশব: আপেল
শেয়ালের চালাকি ১ (আমার সোভিয়েত শৈশব)
মোরগ ভাইটি (আমার সোভিয়েত শৈশব)
বীরব্রতী ভাসিয়া -- আমার সোভিয়েত শৈশব (আমার শৈশবের স্কুল !)
আমার সোভিয়েত শৈশব - আমার শৈশবের স্কুল !
শুনছি , ঘাস বাড়ছে...

৯| ২৭ শে নভেম্বর, ২০১৯ রাত ১১:১২

রূপম রিজওয়ান বলেছেন: জ্বি,পড়লাম এখনো প্রথম ৭ টা। কাহিনীগুলো কি দারুণ! একসাথে সবগুলোর লিংক দেবার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনি বোধহয় রুশ গল্পকাহিনীর একনিষ্ঠ ভক্ত।

২৮ শে নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ১০:০২

স্বপ্নবাজ সৌরভ বলেছেন: ঠিক ধরেছেন ! আমার পুরো শৈশব রুশময়।আমার শৈশবের ইশকুল। তবে বড় কালেও রুশ ছাড়তে পারিনি। ধন্যবাদ জানবেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.