![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
হাবিব সাহেব সরকারী চাকুরী করেন। মেজর কায়েস এর গাড়ীর ড্রাইভার তিনি।
হাবিব সাহেবের দূর্ভাগ্যের অন্ত নেই, তার কোন সন্তান হলে বেশিদিন বেঁচে থাকে না, জন্মের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তার ঠাঁই হয় রাক্ষুসে মাটির কড়ি গহ্বরে। আজ ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সাল, হাবিব সাহেবের ঘর উদ্ভাসিত করে জন্ম নিল ফুটফুটে ছেলে সন্তান। এবার বিধাতা বুঝি হাবিবের মন্দ্য ভাগ্য সুপ্রসন্ন ভাগ্যের চাকায় প্রতিস্থাপন করল। ছেলে সন্তানের বয়স দেখতে দেখতে এক বছর পেড়িয়ে গেল। বড় আদরের সন্তান, শখ করে নাম রেখেছেন বিপ্লব। বিপ্লবের বয়স এখন একবছরের বেশী। হাবীব সাহেবের স্ত্রী নূরজাহান, বিপ্লবকে নিয়ে তাদের এখন সুখের সংসার। হাবিব তার সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এ। তাদের বাড়ী থেকে খুব কাছেই মেজর কায়েস এর বিশাল বাসভবন। মেজর কায়েস পশ্চিম পাকিস্তানের লোক, মানুষ হিসেবে খুব ভালো এবং সৎ। মেজর কায়েস হাবিব সাহেবকে জরুরি তলব করেছেন, তাইতো হাবিব হন্যে হয়ে ছুটছেন মেজরের বাসভবনের দিকে। হাবিব সাহেব গাড়ী নিয়ে বের হলেন, মেজর জরুরি মিটংয়ে যোগদান করবেন বলে এত তাড়া।
পরের দিনের কথা,
হাবিব সাহেব মেজরকে অফিসে পৌছিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরছেন, এমন সময় ক্যান্টনমেন্ট এর ব্রোড এলাকায় একদল পশ্চিম পাকিস্তানী মিলিটারি হাবিবের গাড়ী থামিয়ে দিল,
তাদের মধ্যে থেকে ডাকাতে চেহারার একজন হাবিকে বলল, ” এ হাবিব, ব্রোডকে আশপাশ চাক্কার মারকে আও, তুমহারে লিয়ে তাজা পাঠা কুরবান কারকে রাখা দিয়া, জারা দেখকে আও, পাঠা লেজানেকে বাদ হামে ভি কুছ ভেজনা, হা”
মিলিটারীরা সবাই হা হা করে সমস্বরে বিদ্রুপের হাসি হেসে উঠল।
হাবিব তখন তাদের আচরণ বা কথাগুলোর অর্থ উদ্ধার করতে পারল না। কিন্তু যখন তিনি ব্রোড এলাকার পেছনের খোলা প্রান্ত পেরিয়ে যাচ্ছিলেন তখনই তিনি ঐ মিলিটারীদের কথার অর্থ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে সক্ষম হলেন। হাবিব সাহেবের ঘনিষ্ঠ বন্ধু রিপণের মৃতদেহ ঝুলছে বাশের মাচাং এর উপর। হাবিব গাড়ী থেকে নেমে মৃতের কাছে গেলেন, আশেপাশে খুশি মাছিগুলোর হই হুল্লোর চলছে, মৃতের চেহারা এতটাই বিভৎস্য যে হাবিব সাহেব তার বমি আর আটকে রাখতে পারলেন না।
অকল্পনীয় এবং অমানবিক অত্যাচার করে মারা হয়েছে তার বন্ধু রিপনকে। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়া হয়েছে সারা দেহ। নাহ, এখন আর হাবিব এসব সহ্য করতে পারছেন না মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে তার, বহু কষ্ট করে তার বন্ধুকে একাই দাফন করে দিয়ে আসলেন মাঠের একপ্রান্তে। বাসায় ফিরে আসলেন, কাউকে কিছু জানালেন না যদি তারা শঙ্কিত হয় এই ভেবে। এতকিছুর পরও হাবিব এটা কোনমতেই ঘুনাক্ষরেও বোধ করতে পারলেন না যে প্রতিদিনই তার কোন না কোন প্রতিবেশী বা প্রিয়জনের মৃত বিভৎষ্য মুখ দেখতে হবে। তবে নিজের রক্ষা এই যে, তিনি সরকারী গাড়ী চালক বলে।
১লা মার্চ, ১৯৭১ তারিখ হাবিব দেখেছিলেন তার বন্ধু রিপনের মৃতদেহ, তেমনি করে হাবিবের এই বিষাদ অভিজ্ঞতা চলল ৬ মার্চ পর্যন্ত, মনে মনে ভাবলেন সুযোগ পেলে এর একটা উত্তর দিয়ে দেবেন এই হারামীর বাচ্চাদের। সবকিছু ভাবতে ভাবতে নিজের অজান্তেই হাবিবের আখি পল্লব বানের জলে প্লাবিত হল। এখন দেশের অবস্থা খুবই ভয়াবহ,
এমনিতেই ১৯৭০ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক আইনসভায় নিরঙ্কুশ
সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। পূর্ব পাকিস্তানের কোটার ২ টি আসন ছাড়া বাকি সবগুলোতে জয়ী হওয়ার
জন্য জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠতাও অর্জন করে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনের ফলাফল পাকিস্তানের
দুই অংশের মধ্যে মেরুকরণ সৃষ্টি করে। পশ্চিম পাকিস্তানের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের নেতা
জুলফিকার আলি ভুট্টো, মুজিবের স্বায়ত্বশাসনের নীতির প্রবল বিরোধীতা করেন। ভুট্টো এ্যাসেম্বলি
বয়কট করার হুমকি দিয়ে ঘোষণা দেন যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান মুজিবকে সরকার গঠনের জন্য
আহ্বান জানালে তিনি সে সরকারকে মেনে নেবেন না।
রাজনৈতিক অস্থিশীলতার মধ্যে ইয়াহিয়া খান সংসদ ডাকতে দেরি করছেন। বাঙালিরা এতে বুঝে
ফেলে যে, মুজিবের দলকে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও সরকার গঠন করতে দেয়া হবে না।
৭ই মার্চ, ১৯৭১ সাল, হাবিব সাহেব বঙ্গবন্ধুর ভক্ত তিনি লোকমুখে খবর পেয়েছেন আজ রেসকোর্স ময়দানে জনসভার আয়োজন করা হয়েছে।
হাবিব সাহেব আজ মেজর কে না জানিয়ে গাড়ী নিয়ে চুপিসারে বেরিয়ে পড়লেন রেসকোর্স ময়দানে যাবার উদ্দেশ্যে, তার সাথে আরো এলাকার কয়েকজন যোগ দিল সেই ভাষণ শোনার জন্য। পথে কোন সমস্যা হল না সরকারী গাড়ী বলে, ঠিক সময়ই হাবিবরা পৌঁছে গেল ময়দানে, তাদের কর্ণে ধ্বনিত হল শেখ মুজিবুর রহমানের দরাজ কণ্ঠের ভাষণ,
ভাইয়েরা আমার,
আজ-দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি......
মনে রাখবা, ''রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ''।
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম''। জয় বাংলা।
ভাষণ শুনে হাবিব যুদ্ধে যাবার জন্যে অনুপ্রাণিত হল।
ভাষণ শেষে হাবিব গাড়ী নিয়ে মেজর এর বাড়ী এলেন এবং জানিয়ে দিলেন তিনি আর এই চাকুরী করছেন না।
মেজর-
হাবিব, তুমি আজ ঠিক কাজটিই করেছ, মুজিবের ভাষণ শুনতে গিয়ে তুমি ভুল করনি। এখন সত্যিই তোমাদের দেশ রক্ষা করা প্রয়োজন। আর আজই তুমি তোমর স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে আমার বাড়িতে চলে এসো, যেকোন সময় তোমার উপরও নির্যাতন শুরু হয়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক না।
হাবিব-
স্যার আপনাদের কি কিছু করার নেই, কেন এই অন্যায় অত্যাচার চালাচ্ছে আপনার স্বদেশীরা? কেউ কি নেই যারা এই ঘৃণ্য কাজ গুলোর বিরোধিতা করবে?
মেজর-
শোন হাবিব, আমি সরকারী কর্মকর্তা। আমি যা আদেশ প্রাপ্ত হব আমি তাই করতে বাধ্য। তবে আমি আমার স্বজাতিকে শ্রদ্ধা করি তবে তাদের অন্যায় কাজগুলোকে নয়। দেখছই তো আমাকে দিয়ে সরকারের কোন কাজ হচ্ছে না, আমি অন্যায় সহ্য করতে পারিনা, আমিও নিরীহ মানুষের রক্ত দেখে হাপিয়ে উঠেছি। আমি পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যাচ্ছি আর রক্তের খেলা দেখতে চাইনা।
রাতেই,
হাবিব মেজরের বাসায় তার স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে চলে এসেছে। মেজর হাবিবের ছেলে বিপ্লবকে আদর করে কিছু চকলেট দেয়, বিপ্লব হাতে চকলেট নিয়ে বলতে থাকে ”ভুট্টু খাই”। মেজর বিপ্লবের কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে হাবিবকে জিজ্ঞেস করে ওকে এই কথা কে শিখিয়েছে। হাবিব বলে, স্যার ও কাবলু বুট খেতে পছন্দ করে আর উচ্চারণ ঠিক মত করতে না পেরে বলে ভুট্ট খাই। মেজর হাবিবকে সাবধান করে দিয়ে বলে ভুলেও যেন বিপ্লব কোন পশ্চিম পাকিস্তানিদের সামনে এই কথা না বলে।
৮ ই মার্চ, সকাল ভোরে মেজর কায়েস হাবিবকে বলে, হাবিব দেশের অবস্থাতো দেখছই, এই অবস্থাতে তোমার ঢাকা ত্যাগ করাই ভাল হবে, এই মুহূর্তে তোমার পরিবারের নিরাপত্তা প্রয়োজন। তুমি গাড়ি নিয়ে চলে যাও, দেখ কতদূর যেতে পার। আর যদি পার গাড়ী নিয়েই তোমাদের গ্রামে চলে যেও।
হাবিব তার পরিবার নিয়ে গাড়ীতে চড়ে রওনা দিল সদরঘাটের দিকে, সদরঘাটের কাছাকাছি এসে চেকপোস্টের সামনে গাড়ী থেকে নামতে হল তাদেরকে। বিপ্লব তার মায়ের কোলে, এদিকে একজন মিলিটারী তাদের দিকে এগিয়ে আসছে কেমন যেন নৃশংস ভাব তার চেহারায়। হাবিবকে মিলিটারী পুলিশ নির্দেশ দিল গাড়ী রেখে চলে যেতে।
চলে যাবার সময় হঠাৎ বিপ্ল্ব বলে উঠল ভুট্ট খাই ভুট্ট খাই, এই কথা শুনে রাগে ক্রুদ্ধ হয়ে মিলিটারী পুলিশটি বিপ্লাবের বুকে বন্দুকের বেয়নেটের এক ঘা লাগতেই বিপ্লবের বুকের তাজা বিপ্লবী রক্ত তার সারা শরীর ভাসিয়ে দিল আর সাথে রইল যন্ত্রণাকাতর চিৎকার, বিপ্লবের মা আকস্মিকতায় বোবা হয়ে গেল। এই নৃশংস দৃশ্য দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারলনা হাবিব, গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে সেই পুলিশটিকে সে আঘাত করতে ধাবিত হল, কিন্তু তার আগেই তার হৃৎপিন্ড বরারবর চলল কাপুরুষ বুলেট। লুটিয়ে পড়ল হাবিবের দেহ। তিনটি প্রাণের দুটি এখন মর্তলোকের উর্ধে, আর জিবীত একটি প্রাণের ভাসছে শুধু সম্ভ্রম বাঁচাবার চিৎকার।
বিপ্লব
[শওকত শাওন/২৯-০৩-২০১৪]
©somewhere in net ltd.