নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সংক্রান্তির সলতে। লেখক সম্পাদক ওয়েব প্রকাশক

শ্রীশুভ্র

ফ্রীল্যান্স লেখক

শ্রীশুভ্র › বিস্তারিত পোস্টঃ

ঈশ্বরবিশ্বাসের আবর্ত!

১৯ শে অক্টোবর, ২০১৫ দুপুর ২:১২


“I believe the simplest explanation is, there is no God. No one created the universe and no one directs our fate. This leads me to a profound realization that there probably is no heaven and no afterlife either. We have this one life to appreciate the grand design of the universe and for that, I am extremely grateful.”
― Stephen Hawking


ঈশ্বরের অস্তিত্ব মানুষের অন্ধবিশ্বাসের গোঁড়ামীর অচলায়তনে! বস্তুত মানুষের জ্ঞানের পরিসীমার যেখানে শেষ, সেইখান থেকেই শুরু ঈশ্বর বিশ্বাসের। এই কারণেই অজ্ঞ নিরক্ষর সাধারণ মানুষের সাথে অনেক বিজ্ঞ পণ্ডিত মানুষদের মধ্যেও এই অন্ধ ঈশ্বরবিশ্বাসের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। যার যতটুকু জ্ঞানের পরিসীমা, তার বাইরেই তার ঈশ্বরবিশ্বাসের ভিত্তিভুমি। এই যে অজ্ঞানতার সাথে ঈশ্বরবিশ্বাসের সমানুপাতিক সম্পর্ক, এইটাই ঈশ্বরবিশ্বাসের মূল ভিত্তিভুমি। আমরা যে যে পরিমানে অজ্ঞ সে সেই পরিমানেই ঈশ্বরবিশ্বাসী। কিন্তু যিনি প্রকৃত জ্ঞানী তিনি অলীক ঈশ্বরবিশ্বাসের মিথ্যে কুহকে ভোলেন না। ভোলান না কাউকে।

বস্তুত এই বিরাট বিশ্বে প্রতিটি ব্যক্তি মানুষের প্রধান সমস্যা হল তার সাধ্য সীমিত কিন্তু সাধ অসীম। এই দুইয়ের টানা পোড়েনের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানে ঈশ্বরবিশ্বাসের মধ্যে দিয়েই অধিকাংশ মানুষ মনের শান্তি খুঁজে পেতে প্রয়াসী হয়, কারণ এটিই সবচেয়ে সহজ উপায়। নিজেকে ভুলিয়ে রাখার। নিজের দূর্বলতাকে সুসহ করে তোলার। উত্তরহীন প্রশ্নের আবিরাম খোঁচা থেকে আত্মরক্ষা করার। ঠিক এই কারণেই আবিশ্ব শাশ্বত কালব্যাপি মানুষের মনে ঈশ্বরবিশ্বাস একটি সহজাত প্রবৃত্তি হয়ে উঠেছে। আর সেই প্রবৃত্তিকে পুঁজি করেই আবিশ্ব ধর্মব্যবসার এত রমরমা!

মানব সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই সমস্ত উত্তরহীন প্রশ্নগুলির পেছনে মানুষ এক একটি ঈশ্বরের কল্পনায় নিজেকে প্রবোধ দেওয়ার প্রয়াসে ব্যপৃত থেকেছে। আর এই প্রয়াসই কালক্রমে অন্ধবিশ্বাসের অচলায়তনরূপে জন্ম দিয়েছে এক একটি সাম্প্রদায়িক ধর্মের। সেই ধর্মের পুরোহিতরাই আবার তাদের পেশাগত স্বার্থে আবিশ্ব ঈশ্বরবিশ্বাসের মন্ত্রে দীক্ষিত করতে চেয়েছে আপামর জনসাধারণকে। এবং সাম্প্রদায়িক সেই ব্যবসাই নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে সামাজিক পরিবেশে আবদ্ধ মানুষের বিশ্বাসের ভুবনকে। যে কোনো বিষয়ে একবার বিশ্বাসের ভুবনের বাসিন্দা হয়ে গেলেই মানুষ আর প্রশ্ন করতে চায় না। প্রশ্নহীন আনুগত্যের অন্ধ আবেগই তখন তাকে চালিত করতে থাকে। যুক্তির পথ, চেতনার পথ, আলোর পথ তখন টানে না তাকে আর। বিশ্বাসের এই অসলায়তনেই বন্দী হয়ে পড়ে ঈশ্বরবিশ্বাসীরা নিজ নিজ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর ঘেরাটোপে।

ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়, সভ্যতার যে ঊষালগ্ন থেকে মানুষের যে প্রশ্নগুলি কোনো সদুত্তোর খুঁজে না পেয়েই জন্ম দিয়েছিল ঈশ্বরভাবনার, সেই ঈশ্বরবিশ্বাসের অন্ধানুগত্যই পরবর্তীতে ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষকে প্রশ্নহীন স্তাবকতা ও আনুগত্যের অচলায়তনে বেঁধে ফেলেছে এক একটি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীতে। মানুষ তখন আর কোনো প্রশ্ন করে না নিজেকে। সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর প্রচলিত বিশ্বাসগুলিকেই অন্ধ আনুগত্যে মেনে নিয়ে শান্তি পাওয়ার চেষ্টা করে। এই যে শান্তি, তা কার্যত নেশাগ্রস্ততার সুখতৃপ্তির বেশি কিছু নয়। তা মানুষকে কোনো রকম সদর্থক শক্তি যোগায় না। কোনো উচ্চতায় পৌঁছিয়ে দেয় না। চালিত করে নানান রকম সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হতে। এই কারণেই সাম্প্রদায়িক অপশক্তিগুলি ধর্মীয় পতাকার ছত্রছায়ায় আরও বেশি করে মানুষকে ঈশ্বরমুখী করে তোলার নানান রকম ফাঁদ পাতে। যে ফাঁদে বন্দী হতে দেরি হয় না স্বভাব ভীরু মানসিক দূ্র্বল অজ্ঞ ও নিরক্ষর মানুষদের।

একটু তলিয়ে দেখলেই দেখা যায় অশিক্ষা যেখানে যত ব্যাপক, ঈশ্বরবিশ্বাসের সেখানে তত নিরঙ্কুশ আধিপত্য। আবার তথাকথিত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পেশাগত শিক্ষাও মানুষকে প্রকৃত জ্ঞানের দীক্ষায় দীক্ষিত করে তুলতে অক্ষম। সেই শিক্ষা মানুষকে অর্থনৈতিক সাফল্যের পথে এগিয়ে দিতে পারলেও মানুষের চিন্তা চেতনার সামর্থ্যকে বিশেষ পরিপুষ্ট করে তুলতে পারে না। পারে না একজন মানুষের সামগ্রিক বিকাশের পথকে সুগম করে তুলতে। পারে না বলেই অনেক বড়ো বড়ো ডিগ্রীধারী পণ্ডিতমন্য ব্যক্তিও ব্যক্তিগত জীবনে অন্ধ ঈশ্বরবিশ্বাসের অচলায়তনে বাস করেন পরম নিশ্চিন্তে।

এখন দেখা যাক এই যে ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষ, যারা বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় গোষ্ঠীতে বিভক্ত, তারা ঈশ্বর বলতে কি বোঝেন। এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, মানুষের জীবনে ঈশ্বরবিশ্বাস গড়ে ওঠে মূলত তাঁর সম্প্রদায়গত গোষ্ঠী সংস্কৃতির আদলে। এই কারণেই একজন মুসলমানের ঈশ্বর নিরাকার আল্লাহ। একজন হিন্দুর ঈশ্বর তাঁর উপগোষ্ঠীর আরাধ্য দেবতার প্রচলিত ভাবধারার অনুসারী। এই যে কারুর ঈশ্বর সাকার আর কারুর ঈশ্বর নিরাকার এই ধারণাগুলি, বিশ্বাসগুলি মূলত সাম্প্রদয়িক গোষ্ঠীভিত্তিক চেতনার অনুসারী মাত্র। এবং অধিকাংশ প্রচলিত ধর্মমতে প্রতিটি মানুষের জীবনের নিয়ন্ত্রক সেই গোষ্ঠীর আরধ্য ঈশ্বরই। আর ব্যক্তি মানুষ যখন বিশ্বাস করতে শুরু করে তার জীবনের জন্ম মৃত্যু সাফল্য ব্যর্থতা সবই তাঁর সম্প্রদায়ের সর্বশক্তিমান ঈশ্বর কর্তৃক নিয়ন্ত্রীত তখনই সেই মানুষটি তার চেতনার ঘরে তালাচাবি দিয়ে বিশ্বাসের অন্ধকার আবর্তে ঘুরপাক খেতে থাকে। কোনো যুক্তি তর্কই তখন তাকে সেই অন্ধকার আবর্ত থেকে আর উদ্ধার করতে পারে না। মৃত্যু হয় একটি মানুষের স্বাধীন সত্ত্বার। অবরুদ্ধ হয় একটি মানুষের সামগ্রিক বিকাশের সমস্তরকম সুবর্ণ সম্ভাবনাগুলি। এইভাবেই ঈশ্বরবিশ্বাস মানুষের চেতনাকে অবরুদ্ধ করে প্রতিহত করে তার আত্মিক উন্নতিকে।

আর তখনই ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষের ঈশ্বরভাবনা আবর্তিত হতে থাকে তাঁরই ব্যক্তিগত জীবনের ক্ষুদ্র স্বার্থের পরিমাপে। এই বিষয়টি খুব সহজেই বোঝা যায় মানুষের ঈশ্বর আরাধনার আলোকে। কি চায় সাধারণত একজন ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষ তাঁর বিশ্বাসের ঈশ্বরের কাছ থেকে? যে মানুষটি নিয়মিত মন্দিরে গিয়ে দেবতার পায়ে পূজা দিয়ে আসে, যে মানুষটি নিষ্ঠা ভরে মসজিদে গিয়ে পাঁচওয়াক্ত নামাজ পড়ে প্রতিদিন, যে মানুষটি বাইবেল আঁকড়ে গীর্জায় গিয়ে উপাসনা করে নিয়ম করে; কি চায় সেই মানুষগুলি তাঁর আরাধ্য বিশ্বাসের দেবতদের কাছ থেকে? নিজ সংসারেরে সুখ সমৃদ্ধি ছাড়া? পুত্রকন্যার কল্যান কামনা ছাড়া? আর্থিক ক্ষমতার উন্নতির প্রার্থনা ছাড়া? এবং ক্ষেত্র বিশেষে শত্রুর বিনাশ সাধন ছাড়া? এই সবই তো নিজ নিজ ক্ষুদ্র স্বার্থ সংশ্লিষ্ট জাগতিক সুখ সুবিধের খতিয়ান। যেগুলি নির্ভর করে রাষ্ট্র সমাজ সংসারে ব্যক্তি মানুষের কর্ম দক্ষতা, সুচারু বুদ্ধিবৃত্তি ও সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিকাঠামোর উপর। আবার এইগুলির বরাত ঈশ্বরেরে উপরে দিয়েও কোনো মানুষই তো নিশ্চেষ্ট নিশ্চল হয়ে বসেও থাকে না। তবু কেন তাঁর ঈশ্বরবিশ্বাস তাকে এই ভাবে এক ঘোরতর অন্ধকারেরে দিকে ঠেলে দিয়ে তাঁরই কল্পনার আরাধ্য দেবতার কাছে গিয়ে ব্যক্তিস্বার্থসংশ্লিষ্ট এইসব ক্ষুদ্র প্রার্থনাগুলি করতে প্ররোচিত করে? করে তার মানসিক দূর্বলতার কারণেই। করে তাঁর জীবনে প্রকৃত জ্ঞানের অভাবজনিত অপশিক্ষার অভিশাপের কারণেই। করে আজন্ম লালিত সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী সংস্কৃতির প্রচলিত ঘরানাতেই।

এই ভাবেই ঈশ্বরবিশ্বাসী একটি মানুষ যখন মন্দিরে গিয়ে আরাধ্য দেবতার পূজা করেন বা নিজ বাড়িতে নিয়মিত সন্ধ্যাহ্নিক করেন, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েন আজানের সময়ে প্রার্থনায় বসেন, গীর্জায় গিয়ে বাইবেল হাতে উপাসনায় বসেন সেই মানুষগুলি কিন্তু সেই মূহুর্ত্তে কেউই তাঁর বিশ্বাসের ঈশ্বরের কথা ভাবেন না আদৌ। ভাবেন কেবল নিজের প্রতিদিনের জীবনের সাধ ও সাধ্যের কথাই। ভাবেন পরিবার পরিজনের বিভিন্ন জাগতিক স্বার্থের কথাই। ভাবেন স্বামীর পেশাজীবনের উন্নতির কথা। স্ত্রীর শরীর স্বাস্থ্যের কথা। পূত্রকন্যা নাতি নাতনীর জাগতিক সুখ সমৃদ্ধির কথা। ভাবেন কি উপায়ে আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের সেই জীনের মতোই তাঁর বিশ্বাসের ঈশ্বর জগতের সকল ধনৈশ্বর্য নিয়ে হাজির হবেন কেবলমাত্র তাঁরই জীবনে। এইভাবেই সাধারণ মানুষ তাঁর ঈশ্বরবিশ্বাসকে ধরে রাখেন ব্যক্তি স্বার্থের প্রতিদিনের লোভলালসার ইহজাগতিক গণ্ডীতেই।

আর তাই মানুষের ব্যক্তিজীবনের এই অলঙ্ঘনীয় লোভ লালসার আবর্তই মানুষের জীবনে ঈশ্বরবিশ্বাসের অন্ধকারচর্চার ধারাটিকে শাশ্বত করে তুলেছে আবহমান কালব্যাপি। সাম্প্রদায়িক ধর্মব্যবসায়ীদের কাছেই সেটাই অনন্ত পুঁজি। তাই সেই জন্যেই প্রতিটি দেশে প্রতিটি কালে মানুষের মনে ঈশ্বরবিশ্বাসের ধারাটিকে আরও শক্তিশালী ও স্থায়ী করে তুলতেই তাদের যাবতীয় কর্মতৎপরতা।

শ্রীশুভ্র

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.