নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বইমেলায় যত ভিড় হয়, তত পাঠক যদি বাংলায় থাকতো, তাহলে সমাজটা অনেকটাই বদলিয়ে যেত বলে মনে হয়। না, একথা মনে করার কোন কারণ নাই, বাংলায় কোন পাঠক নাই বা বাংলায় প্রকাশিত অধিকাংশ বইই সমাজ বদলের দিশা দেখিয়ে থাকে। বিষয়টা তেমন নয় আদৌ। বিশ্বে কোন দেশেই হয়ত তেমনটা নয়। কিন্তু একটি জাতির অধিকাংশ মানুষের ভিতর বই পড়ার তাগিদ বা অভ্যাস যত বৃদ্ধি পেতে থাকে, সেই জাতির সমাজ ব্যবস্থায় তার একটা সদর্থক প্রতিফলন প্রত্যক্ষই হোক আর অপ্রত্যক্ষই হোক দেখা দিতে বাধ্য। অন্তত উন্নত বিশ্বের জাতিসমূহের সামাজিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে তেমনটাই দেখা যাবে নিশ্চয়। তাই আমাদের এই বাংলায়, কাঁটাতারের উভয় পারেই বইমেলার বিপুল ভিড়ের সাথে বাংলার সমাজচিত্রের একটি বিপরীত সম্পর্কই দেখা যায়। বইয়ের যিনি পাঠক, যে বিষয়েরই হোক না কেন, তাঁর চিন্তা চেতনার প্রধান প্রকৃতিই হবে যুক্তিবাদীতা। অথচ আমাদের বাংলার সমাজ জীবনে বাঙালি জাতির চিন্তাচেতনার প্রধান বৈশিষ্ট কখনোই যুক্তিবাদীতা নয়। অনেকেই হইহই করে উঠবেন। ইতিহাসের পাতা খুলে মনীষীদের জীবনী মেলে ধরে এই বক্তব্য খণ্ডন করতে উদ্যত হবেন। খুবই স্বাভাবিক। কারণ সেই যুক্তিবাদীতার বিপ্রতীপে আমাদের অবস্থান। তাঁরা ভেবেও দেখবেন না, একটি জাতির পরিচয় তার সাধারণ মানুষের ভিতর দিয়েই ফুটে ওঠে। জাতির ভিতর কয়জন মনীষী জন্ম নিয়েছেন, সেই সংখ্যা কোন জাতির মূল পরিচয় নয়। জাতি হিসাবে বাঙালির প্রধান বৈশিষ্ট হলো আবেগ নির্ভর বিশ্বাসের উপর অতিরিক্ত ভরসা করার প্রবৃত্তি। এই প্রবৃত্তিই বাংলার সমাজ জীবনে ধর্মের ভিতকে এমন পরিব্যাপ্ত করে রাখে, যেখানে আবেগের প্রাবল্যে বিশ্বাস আর সংস্কারের চাপে যুক্তিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে না। এবং ঠিক এইখানেই ইউরোপের সমাজ জীবনের সাথে বাংলার সমাজ জীবনের প্রধান পার্থক্য। এই পার্থক্য যতদিন অটুট থাকবে ততদিনই বাংলা ও বাঙালি ইউরোপ আমেরিকার থেকে বহুকাল পিছনে পড়ে থাকবে। না, সমাজের বিত্তবান শ্রেণীর হাতে ইউরোপ আমেরিকায় সদ্য লঞ্চ হওয়া দামী মোবাইল ফোন থাকলেই দেশীয় সমাজ ইউরোপ আমেরিকার সমাজের সমকক্ষ বলে মনে করার কোন কারণ নাই।
বই মানুষকে যুক্তিবাদের চৌকাঠে পৌঁছিয়ে দিতে পারে। হ্যাঁ একথাও সত্য, অনেক বইই মানুষকে যুক্তিবাদের উল্টো দিকে অন্ধবিশ্বাস ও গোঁড়া সংস্কারের দিকে ঠেলে দিতে পারে অবশ্যই। কিন্তু গোটা বইমেলা ঘুরে দেখলে তেমন বইয়ের সংখ্যা যত বেশিই খুঁজে পাওয়া যাক না কেন, সেই সংখ্যা যুক্তিবাদী চেতনার স্ফূরণ ঘটানো বইয়ের সংখ্যার তুলনায় যথেষ্ট পরিমাণে নগন্য। আমাদের বাংলায় প্রতিবছর যত বই প্রকাশিত হয়, তার অধিকাংশই কিন্তু মানুষের চেতনায় যুক্তিবাদের স্ফূরণ ঘটানোর ক্ষমতা ধরে কম বেশি। অথচ এই একবিংশ শতকেও এই বাংলায় সমাজ জীবনের পরতে পরতে যুক্তিবাদের বদলে অন্ধ বিশ্বাস ও গোঁড়া সংস্কারের প্রবল পরাক্রম দেখা যায়। বস্তুত অক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন অধিকাংশ মানুষই কিন্তু সিলেবাসের বাইরে বই পড়ে না। যে কয়জন পড়ে, তার ভিতর অধিকাংশই বই পড়ে নেহাত বিনোদনের জন্য। বা বিশেষ বিশেষ বিষয় তথ্য জানার জন্য। চিন্তা চেতনার নিরন্তর চর্চাকে ধারাবাহিক ভাবে বংশ পরম্পরায় অব্যাহত রাখার তাগিদ থেকে যে বই পড়ার অভ্যাস, সেই পাঠাভ্যাস খুব কম সংখ্যক বাঙালির ভিতরের দেখা যায়। ঠিক এই কারণেই, বইমেলায় যত ভিড় হয়, তত মানুষ বই পড়ে না।
এরপর বর্তমান ইনটারনেট বিপ্লবের সুফলে বই পড়ার সময়ও মানুষের হাতে আর নাই বললেই চলে। মোবাইলে ভিডিও দেখা থেকে শুরু করে গেম খেলা, চ্যাট করার পর আর বই পড়ার সময় পাবেই বা কি করে মানুষ? না সত্যিই মানুষের হাতে বই পড়ার মতোন আর সময় অবিশিষ্ট নাই। কিন্তু তাই বলে বইমেলায় পদার্পণ করা যাবে না, না এমন ফরমান কেউ জারি করছে না। সেটি মানুষের মৌলিক অধিকারের উপর সরাসরি হস্তক্ষেপ। মানুষ বই মেলায় গিয়ে কি করবে, বা সারা বছর বই পড়বে কি পড়বে না, সেটি প্রত্যেক মানুষের মৌলিক অধিকারের বিষয়। আমাদের আলোচনা আদৌ সেই বিষয় নিয়ে নয়। আমাদের আলোচনা বাঙালির পাঠাভ্যাস নিয়ে। দুঃখের কথা, সিলেবাস নির্ভর নোট মুখস্ত করে পরীক্ষার খাতায় নম্বর তোলার যে শিক্ষা কাঠামো, সেখানে স্বাধীন ভাবে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে ওঠার কথাও নয়। এই ধরণের শিক্ষা কাঠামোয় চিন্তা চেতনার চর্চার কোন পরিসর গড়ে ওঠেও না। তৈরীও হয় না মৌলিক চিন্তা করার সক্ষমতা। এই সক্ষমতার অভাবটাই মানুষকে আবেগ সর্বস্ব বিশ্বাস নির্ভর চেতনার দিকে ঠেলে দিতে থাকে। সেই চেতনাই বদ্ধ সংস্কারের গোঁড়ামির জন্ম দেয়। সমাজের পরতে পরতে এই সংস্কারই সমাজকে সামনের দিকে এগোতে না দিয়ে পিছনের দিকে টেনে রাখে।
ফলে দেখা যাচ্ছে বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থা ও তার পরিকাঠামো যুক্তিবাদী চিন্তাচেতনার পরিসরকে অবরুদ্ধ করে রাখার বিষয়ে যথেষ্টই সফল। এর সাথে রয়েছে ধর্মের সরাসরি প্রভাব। অন্ধ বিশ্বাস আর বহমান সংস্কারের ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারকে ধর্মই রক্ষা করে। ফলে একদিকে ভ্রান্ত শিক্ষা ব্যবস্থা ও অন্য দিকে সমাজের উপর ধর্মের যাঁতাকল এই দুইয়ের সংযোগে মৌলিক চিন্তা চেতনার চর্চা ও প্রসার সম্ভব হয় না। ফলে সমাজ দাঁড়িয়ে থাকে স্থবির হয়ে। সে সামনের দিকে এগোতে ভয় পায়। একমাত্র যে এই ভয় কাটিয়ে দিতে পারতো, সেই বইকেই বাঙালি প্রতিদিনের জীবনে নির্বাসিত করে রাখে। এই যে প্রতিদিনের জীবনে বইকে নির্বাসিত করে রাখা, এই কারণেই বাংলায় বইয়ের বাণিজ্য খুব একটা লাভজনক ব্যাবসা নয়। সেই বাণিজ্যকে অক্সিজেন যোগাতেই তাই বইমেলার আয়োজন। এই আয়োজনটুকু না থাকলে অধিকাংশ প্রকাশককেই অন্য ব্যবসার দিকে ঝুঁকতে হতো। তাই বইমেলা নিয়ে এই সমারোহ। তবু মরা মরা করতে করতে রাম নাম নেওয়ার মতো যদি কিছু বই বইমেলা উপলক্ষ্যেই বিক্রী করা সম্ভব হয়। আর সেটি সম্ভব হয় বলেই বছর বছর এত বইমেলার আয়োজন।
বই কেনা বিষয়টি বাঙালির জীবনে নিত্যপ্রয়জনীয় নয় আদৌ। এমনকি বই বাঙালির জীবনে লাক্সারি আইটেমও নয়। সত্যি বলতে কি, নোট সর্বস্ব লেখা পড়ায় বই সিলেবাস শেষ করার জন্যও আর অপরিহার্য নয় ততটা। এই যেখানে সমাজ বাস্তবতা, সেখানে যুক্তিবাদী চিন্তা চেতনা চর্চার পরিসরে বইয়ের ভুমিকা যাই থাকুক না কেন, এই বাংলা ও বাঙালির সমাজ জীবনে বইয়ের কার্যকরিতা বিশেষ কিছু নয়। তাই বই মেলায় ভিড় যত বেশিই হোক না কেন, বাঙালি জাতি হিসাবে বইকে আজও তার সঠিক স্থানে অধিষ্ঠিত করতে পারে নি। পরে নি বলেই, আজ যদি কাউকে প্রশ্ন করা হয়, গত সপ্তাহে আপনি কোন বইটি পড়লেন, অধিকাংশ বাঙালিই নিরুত্তর থাকবেন। এমন কি গত বছর কে কয়টি বই পাঠ করেছে, এমন প্রশ্নের মুখে পড়লেও বাঙালিকে লজ্জায় পড়তে হতে পারে। লজ্জা বিশেষ করে এই কারণেই যে, কাঁটাতারের উভয় পারেই অক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন বাঙালির সংখ্যার অনুপাতে বইয়ের নিয়মিত পাঠকের সংখ্যা সমুদ্রের তুলনায় গোস্পদের জলের ন্যায়। বই বইমেলা ও বাঙালির এই সম্পর্ক থেকে বেড়িয়ে আসার একটি মাত্রই পথ। বই পড়া ও পড়ানো।
১৭ই মাঘ’ ১৪২৬
কপিরাইট শ্রীশুভ্র কর্তৃক সংরক্ষিত
২| ০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ১:০৪
চাঁদগাজী বলেছেন:
বেশীর ভাগ বাংগালী লেখকের বইতে ভুল ধারণা, ভুল পর্যবেক্ষণ, ভুল উপসংহার থাকার প্রচুর সম্ভাবনা; ফলে, গড়ে বই পড়া যে সব সময় সাহায্য করছে তা সঠিক নয়।
©somewhere in net ltd.
১| ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ১০:৩৫
রাজীব নুর বলেছেন: দিন শেষে যারা বই পড়ছে তারা লাভবান হচ্ছে। যারা পড়ছে না তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।