![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মহান মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে মহসিন হলের সেভেন মার্ডারের ঘটনার মতো আর কোনো ঘটনাই সেই সময়ে এমন চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খুনের ঘটনা বলতে গেলেই প্রথমেই চলে আসে ঢাবির এই ‘সেভেন মার্ডার’ এর ঘটনা। দিনের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে এই বীভৎস হত্যাযজ্ঞের সংবাদ মুখে মুখে রাজধানীতে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর রাজধানী ছাপিয়ে গোটা দেশে আতঙ্ক তখন চারদিকে। ঢাবি ক্যাম্পাস ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভে উত্তাল। সাধারণ ছাত্ররা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে হল ছাড়তে শুরু করে। রাতের বেলা ভৌতিক পরিবেশ। ৬ এপ্রিলের পত্রিকায় কালো হেডিংয়ে প্রধান শিরোনাম হয়। নিউইয়র্ক টাইমসসহ বিদেশি গণমাধ্যমগুলোতে গুরুত্ব সহকারে এ সংবাদটি প্রকাশ করে।
দিনটি ছিলো ৪ এপ্রিল, ১৯৭৪ সাল। রাতে সূর্যসেন হলের ৬৩৫ নম্বর কক্ষে গল্প করছিলেন নাজমুল হক কোহিনুর এবং তার বন্ধুরা। রাত ১২টার কিছু পরে কোহিনুরের বন্ধুরা যে যার রুমে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর সবাই ঘুমিয়ে পড়েন। রাত ১টা ২৫ মিনিট। সূর্যসেন হল থেকে প্রথম ২-৩টা গুলির শব্দ পাওয়া যায়। এ সময় ১০ থেকে ১৫ জন অস্ত্রধারী হলের ভিতর ঢুকে সিঁড়ি বেয়ে পঞ্চম তলায় উঠে আসে। প্রথমে তারা ৬৩৪ নম্বর রুমের দরজায় ধাক্কাধাক্কি করে কোহিনুরের নাম ধরে ডাকতে থাকে। ওই কক্ষের ভিতর থেকে এক ছাত্র পাশের কক্ষে যোগাযোগ করতে বলেন। অস্ত্রধারীরা পাশের ৬৩৫ নম্বর কক্ষের দরজার সামনে গিয়ে ধাক্কাধাক্কি করতে থাকে। কোহিনুরকে দরজা খুলতে বলে। কিছুক্ষণ এ অবস্থা চলতে থাকলে কোহিনুর ভিতর থেকে দরজা খুলে দেন। এরপরই অস্ত্রধারীরা তাদের ‘হ্যান্ডসআপ’ করতে বলে। কোহিনুরসহ ওই কক্ষে তখন ছিলেন চারজন। চারজনই মাথার ওপর হাত তুলে কক্ষ থেকে বের হন। অস্ত্রধারীদের অপর গ্রুপ ৬৪৮ নম্বর কক্ষ থেকে আরও তিনজনকে একই কায়দায় বের করে নিয়ে আসে। এই সাতজনের দিকে অস্ত্র তাক করে সারিবদ্ধভাবে হাঁটিয়ে ৫ তলা থেকে নিচে নামিয়ে আনে। এ সময় কোহিনুর বিষয়টি আঁচ করতে পারে। তাকে প্রাণে না মারার জন্য আকুতি মিনতি করতে থাকেন। দোতলা পর্যন্ত তারা নামার পর ২১৫ নম্বর কক্ষের সামনে গিয়ে আরও এক ছাত্রের খোঁজ করে অস্ত্রধারীরা। ওই ছাত্র বিপদ আঁচ করতে পেরে জানালা ভেঙে দোতলা থেকে নিচে লাফিয়ে পড়েন। ততক্ষণে অস্ত্রধারীরা দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে যায়। ওই ছাত্রকে না পেয়ে অস্ত্রধারীরা জানালার কাছে গিয়ে দেখতে পায় যে, কেউ দৌড়ে পালাচ্ছেন। তখন জানালা দিয়ে অস্ত্রধারীরা গুলি করে। কিন্তু ওই ছাত্রটি পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়। সাতজন হতভাগ্য ছাত্রকে যখন সূর্যসেন হল থেকে মহসিন হলের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয় তখন রাত ২টা চার মিনিট। মহসিন হলের টিভিরুমের সামনের করিডরকে বধ্যভূমি হিসেবে নির্বাচিত করে সাতজনকে সেখানে দাঁড় করানো হয়। রাত ২টা ১১ মিনিটে হতভাগ্য ওই ছাত্রদের লক্ষ্য করে ‘ব্রাশফায়ার’ শুরু হয়। গুলিবিদ্ধ ওই ছাত্ররা লুটিয়ে পড়ে ছটফট করতে করতে প্রাণ হারান। রক্তে ভেসে যায় পুরো করিডর। তাদের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পরও অস্ত্রধারীরা ফাঁকা গুলি ছুড়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। এরপর রাত ২টা ২৫ মিনিটে তারা ধীরেসুস্থে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। ভোর ৪টা ৫৫ মিনিটে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। এর অল্প সময়ের মধ্যে লাশ ময়নাতদন্তের জন্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়। ঘটনাস্থল থেকে সামান্য দূরে রয়েছে একটি পুলিশ ফাঁড়ি। অন্যদিকে পুলিশ কন্ট্রোল রুম। অস্ত্রধারীরা রাত ১টা ২৫ মিনিট থেকে তাদের তৎপরতা শুরু করে। হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়ে ২টা ২৫ মিনিটে চলে যায়। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে অস্ত্রধারীদের এমন তৎপরতায়ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেখানে যায়নি। হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশ উদ্ধার করে।
[একনজরে নিহতদের পরিচয় :
*নাজমুল হক কোহিনুর, সোশিওলোজি এমএ ২য় পর্ব, গ্রাম বৈলা, রূপগঞ্জ।
*মো. ইদ্রিস, এমকম ১ম পর্ব, ১১৫/১১৬ চক মোগলটুলী, ঢাকা।
*রেজওয়ানুর রব, প্রথম বর্ষ (সম্মান), সোশিওলোজি, ৩৯/২, পাঁচ ভাই ঘাট লেন, ঢাকা। *সৈয়দ মাসুদ মাহমুদ, প্রথম বর্ষ (সম্মান) সোশিওলোজি, ৩৪ ঠাকুর দাস লেন, বানিয়ানগর, ঢাকা।
*বশিরউদ্দিন আহমদ (জিন্নাহ), এমকম ১ম পর্ব, ২৯ ডিস্ট্রিলারি রোড, ঢাকা।
*আবুল হোসেন প্রথম বর্ষ (সম্মান) সোশিওলোজি, পাইকপাড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
*এবাদ খান, প্রথম বর্ষ (সম্মান) সোশিওলোজি, পাইকপাড়া, ধামরাই।]
বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল মহসিন হলের এই বীভৎস সেভেন মার্ডার। সেই হত্যাকান্ডের নেতা হিসেবে ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধানকে অবিলম্বেই গ্রেপ্তার করে বিচারের সম্মুখীন করা হয়েছিল। বিচার শেষে মিস্টার প্রধান ফাঁসির দন্ডই পায়। এরই মধ্যে ক্ষমতার পালাবদলে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হন জেনারেল জিয়া। ফাঁসি কার্যকর করার আগেই জেনারেল জিয়া মিস্টার প্রধানকে প্রাণভিক্ষা দেন, আজীবন রাজনৈতিক মিত্রতার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে অর্থাৎ বিএনপিতে যোগদানের শর্তে ক্ষমা ঘোষণা করে মুক্তি দেওয়া হয়। প্রধান সাহেব কথা রেখেছেন, এখনও বেগম জিয়া আর ফখরুল সাহেবগণ মিস্টার প্রধানকে পাশে বসিয়ে রেখে বিষ-দলীয় জোটের সভা করেন।
পুরোনো কাসুন্দি অনেক ঘাটাঘাটি হলো, ফিরে যাই মূল ঘটনায়। সেভেন মার্ডার এর মূল আসামী হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সরকার যখন শফিউল আলম প্রধানকে গ্রেপ্তার করেন, তখন সেই গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে ও শফিউল আলম প্রধানের অবিলম্বে মুক্তির দাবীতে অনশন শুরু করে কয়েকজন "তথাকথিত" ছাত্রনেতা। সেই অনশন কর্মসূচী বঙ্গবন্ধুর জন্য আরও রাজনৈতিক ক্ষতির যোগান দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর সরকারের বিরুদ্ধে সেই অনশনকারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ওবায়দুল কাদের। হ্যা, ঠিকই শুনেছেন। আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
শফিউল আলম প্রধানের বাপ হাই প্রফাইল কালারড রাজাকার। তার বাপ ছিলো পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের স্পিকার।
এই নাজায়েজের পোলা শফিউল আলম প্রধান ক্যামনে ছাত্রলীগের লিডার হয়ে গেল, ক্যামনে বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে ঘনিষ্ট তরুণ নেতাদের একজনের গ্রুপ রাজনীতির অংশ হিসাবে সেভেন মার্ডারের মতো চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটিয়ে ফেললো - সেইসব ইতিহাসের পর্যলোচনা বাংলাদেশে কোনোদিন হয়নি। না ছাত্রলীগ, না আওয়ামী লীগ কেউই এ ইতিহাসকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেনি।
একটা রাজাকারের ছেলেকে বুদ্ধিজীবী হিসাবে গন্য করা হচ্ছে, যে সাতটা খুন করে ফাঁসির আসামী হয়েও খালাস পাইলো, সোনা ডাকাতির পরেও গায়ে বাতাস লাগাইলো, তারপরে বিএনপির সাথে যুক্ত থেকে দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব টাইপ একটা কিছু হয়ে গেল। এভাবেই দিন শেষে শফিউল আলমরাই বিজয়ী হয়।
এই নাজায়েজের লাশ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা মানে দেশের সব বুদ্ধিজীবীদের অপমান করা। আশা করি নূন্যতম আত্মসম্মান থাকলে পূর্বসুরীদের হত্যাকারীর লাশ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে ঢুকতে দিবে না ছাত্রলীগ।
©somewhere in net ltd.