নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সংবর্ত

আমি এই ব্লগের নীতিমালা মেনে আমার সৃজনশীলতা বিকাশের চেষ্টা করব

সুব্রত মল্লিক

আমি একজন শিক্ষক...শিক্ষকতার পাশাপাশি পড়তে লিখতে ভালোবাসি..

সুব্রত মল্লিক › বিস্তারিত পোস্টঃ

রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শন

০২ রা জুন, ২০১৫ রাত ১০:০৪

কালের যাত্রায় আমরা এগিয়েছি বহুদূর।শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করে আমরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরণের শিক্ষা পদ্ধতি চালু করেছি কিন্তু এখন্ও সঠিক শিক্ষা পদ্ধতি বেছে নিতে পারিনি। আমাদের শিক্ষা পদ্ধতিতে যে গলদ আছে তা নিশ্চিত কারণ আমাদের দেশে যতরকম বড় অপকর্ম ঘুষ, দুর্নিীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার প্রায় সবকিছুর সাথে জড়িয়ে আছে শিক্ষিতজনরা। একজন কৃষক কিংবা একজন শ্রমিকের সামর্থ নেই বড় কোনো দুর্নীতি করা কিংবা ঘুষ খাওয়ার। উপরন্ত আমাদের শিক্ষা পদ্ধতির ভিত্তিমূল হচ্ছে বৃটিশ প্রবতির্তত শিক্ষা পদ্ধতি। ব্রিটিশরা এই দেশে যে শিক্ষা পদ্ধতি প্রবর্তন করেছিল তার মূলে ছিল তাদের ছোট কাজগুলো করিয়ে নেয়ার মতো কিছু বৃত্তিজীবী তৈরি করে। বিৃটিশদের প্রতি অনুগত কিছু নেটিভ তৈরি করা যারা ব্রিটিশদের স্বার্থ দেখবে। ভারতে প্রবর্তিত ব্রিটিশ শিক্ষা পদ্ধতির পুরোধা মেকলে বলেছিলেন, ‘ভারতবর্ষের শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে এমন এক শ্রেণি তৈরি করা, যারা শুধু চামড়ায় হবে ভারতীয়, কিন্তু মানসিকতায় হবে ইউরোপীয়।’ ফলে ব্রিটিশ পদ্ধতিতে যথার্থ মানুষ গড়ার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না তাই সে শিক্ষা ছিল না জীবন ঘনিষ্ঠ কিংবা উপমাহদেশের মানুষের জীবন ভাবনা থেকে উৎসরিত।
আমরা সবাই জানি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন স্কুল পালানো বালক। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বাল্যকাল থেকেই রবীন্দ্রনাথকে আকর্ষণ করতে পারেনি। স্কুলের কড়া নিয়মের মধ্যে থেকে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত শিক্ষকের একমুখী লেকচার প্রদান পদ্ধতি রবীন্দ্রনাথের কাছে একঘেয়ে লেগেছিল। কারণ সেখানে ছিল চিন্তার বৈকল্য।একজন শিক্ষার্থীর কল্পনা শক্তির বিকাশের সুযোগ সেখানে ছিল না। এখন্ও আমাদের বিদ্যালয়ে সেই রবি ঠাকুরের আমলের পদ্ধতিই চলে আসছে। রবি ঠাকুরের ভাষায়-“ স্কুল বলিতে আমরা যাহা বুঝি যে একটা শিক্ষা দেওয়ার কল।মাস্টার এই কারখানার একটা অংশ। সাড়ে দশটায় ঘণ্টা বাজাইয়া কারাখানা খোলে। কল চলিতে আরম্ভ হয়, মাস্টারের মুখ্ও চলিতে থাকে। চারটায় কারখানা বন্ধ হয়, মাস্টার মুখ্ও বন্ধ করেন। ছাত্ররা দু’চারপাতা কল ছাটা বিদ্যা লইয়া বাড়ি ফেরে। তারপর পরীক্ষার সময় এই বিদ্যায় যাচাই হইয়া তাহার উপর মার্কা পড়িয়া যায়।”
এরপর রবীন্দ্রনাথ প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতির মধ্যে যে বিষয়টির অভাব খুঁজে পেয়েছিলেন সেটি হলো বিদ্যায়তনে শিশুকে একটি গন্ডির মধ্যে আটকে রাখা হয় যেখানে আনন্দের উপকরণ খুবই নগন্য। আমরা এখন লক্ষ্য করি যে আমাদের শিশুদেরকে আমরা ছোট বেলা থেকেই শিক্ষা গলাধকরণ করানোর জন্য উঠেপড়ে লাগি। ছোট্ট শিশুটিকে তার নির্দিষ্ট সিলেবাসের মধ্যে আটকে রাখি। সিলেবাসের বাইরের বই পড়তে গেলে তাকে নিরুৎসাহিত করি। আমরা ভাবি এতে তার কোনো উপকার হবে না। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়্ও একই চিত্র লক্ষ্য করা যায়। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, “ বাল্যকাল হইতে আমাদের শিক্ষার সহিত আনন্দ নাই। কেবল যাহাকিছু নিতা্ন্ত আবশ্যিক তাহাই কণ্ঠস্থ করিতেছি। তেমনি করিয়া কোনোমতে কাজ চলে মাত্র কিন্তু বিকাশ লাভ হয় না। হাওয়া খাইলে পেট ভরে না, আহার করিলে পেট ভরে কিন্তু আহারটি রীতিমতো হজম করিবার জন্য হাওয়া খাওয়ার দরকার। তেমনি একটা শিক্ষাপুস্তককে রীতিমতো হজম করিতে অনেকগুলি পাঠ্যপুস্তকের সাহায্য আবশ্যক। আনন্দের সহিত পড়িতে পড়িতে পড়িবার শক্তি অলক্ষিতভাবে বৃদ্ধি পাইতে থাকে; গ্রহণশক্তি, ধারণাশক্তিকে চিন্তাশক্তি বেশ সহজে এবং স্বাভাবিক নিয়মে বললাভ করে..।” এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ আরও বলছেন, “ আমাদের দেহ সাড়ে তিন হাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ, কিন্তু তাই বলিয়া ঠিক সাড়ে তিন হাত পরিমান গৃহ নির্মাণ করিলে চলেনা। স্বাধীন চলাফেরার জন্য অনেকখানি স্থান রাখা আবশ্যক, নতুবা আমাদের স্বাস্থ্য ও আনন্দের ব্যাঘাত হয়। শিক্ষা সম্বন্ধেও এই কথা খাটে। যতটুকু কেবলমাত্র শিক্ষা অর্থ্যাৎ অত্যাবশ্যক তা্হারই মধ্যে শিশুদিগকে একান্ত নিবদ্ধ রাখিলে কখনোই তাহাদের মন যথেষ্ঠ পরিমানে বাড়িতে পারে না। অত্যাবশ্যক শিক্ষার সাথে স্বাধীন পাঠ না মিশাইলে ছেলেরা ভালো করিয়া মানুষ হইতে পারে না-বয়ঃপ্রাপ্ত হইলেও বুদ্ধিবৃত্তি সম্বন্ধে সে অনেকটা পরিমানে বালক থাকিয়া যায়।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা ও মননশীলতার বিকাশের ওপর গুরুত্বারোপ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থার কথঅ চিন্তা করেছিলেন যেখানে একজন শিক্ষার্থী আনন্দের সাথে তার কল্পনাশক্তির প্রয়োগের মধ্য দিয়ে সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটাতে পারবে। মুখস্থ বিদ্যা নয় আত্মস্থ করার বিদ্যাশিক্ষার উপর রবীন্দ্রনাথ জোর দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর শিক্ষার বাহন প্রবন্ধে বলছেন, “ মুখস্থ করিয়া পাশ করাইতো চৌর্যবৃত্তি। যে ছেলে পরীক্ষাশালায় গোপনে বই লইয়া যায় তাকে খেদাইয়া দেওয়া হয়; আর যে ছেলে তার চেয়েও লুকাইয়া লয় অর্থ্যাৎ চাদরের মধ্যে না লইয়া মগজের মধ্যে লইয়া যায় সেই বা কী করিল? সভ্যতার নিয়ম অনুসারে মানুষের স্মরণশক্তির মহলটা ছাপাখানা অধিকার করিয়াছে। অতএব, যারা বই মুখস্থ করিয়া পাশ করে তারা অসভ্যরকম চুরি করে, অথচ সভ্যতার যুগে পুরষ্কার পাইবে তারাই?”
রবীন্দ্রনাথের মতে শিক্ষার আরেকটি লক্ষ্য হলো মানুষের ধ্যান-ধারণা ও রুচির উন্নতি করা। অর্থ্যাৎ যিনি শিক্ষিত হবেন তিনি হবেন উন্নত ধ্যান-ধারণা ও রুচিশীল ব্যক্তিত্বের অধিকারী। কিন্তু আমরা প্রায় ক্ষেত্রেই তার উল্টোটা দেখতে পাই। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ তাঁর মেঘনাদ বধকাব্য নামক প্রবন্ধে বড় খেদের সঙ্গে বলছেন, “বঙ্গদেশে এখন এমন এক সৃষ্টিছাড়া শিক্ষা প্রণালী প্রচলিত হইয়াছে যে তাহাতে শিক্ষিতের বিজ্ঞান দর্শনের কতগুলি বুলি এবং ইতিহাসের সাল ঘটনা ও রাজাদিগের নামাবলি মুখস্থ করিতে পারিয়াছেন বটে কিন্তু তাহাতে তাহাদের রুচিরও উন্নতি করতে পারে নাই বা স্বাধীনভাবে চিন্তা করতেও শেখেন নাই।”
রবীন্দ্রনাথের চোখে মানুষ মোট তিনটি স্তরে জীবন ধারণ করে। শরীর, মন ও আত্মা।এই তিন জগতে মানুষের বিচরণ। শরীর চিন্তা মানুষের পার্থিব কর্মকান্ডের মূল-অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান শরীরকে কেন্দ্র করেই আবর্তন করে। দ্বিতীয় স্তরে মন। এই স্তরে থাকে চিন্তা, বুদ্ধিবৃত্তিক জগৎ যেখানে মানুষ জ্ঞান আহরণ ও সঞ্চয় করে। তৃতীয় স্তরটি হলো আত্মার। এটি আধ্যাত্মিক জগৎ। এ স্তরের অস্তিত্ব প্রেমে, ঐক্যে ও অসীম সত্ত্বায়।
অম্লান দত্ত বাংলা একাডেমির বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শনের ওপর এক আলোচনায় উল্লেখ করেন যে, রবীন্দ্রনাথ শিক্ষার ক্ষেত্রে তিনটি সম্পর্কের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছেন। মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক, মানুষের সঙ্গে প্রতিবেশীর সম্পর্ক, মানুষের সঙ্গে বিশ্বমানবের সম্পর্ক-এই রকম কতগুলো সম্পর্কের ধারণা রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শনের মূলে আছে। প্রকৃতির সাথে গড়ে ওঠা সম্পর্ক আমাদেরকে এই বিশ্বলোকের নিয়মকানুন সম্পর্কে অবহিত করে এবং আমাদেরকে বিশ্ব প্রকৃতি সম্পর্কে গড়ে ওঠা কুসংস্কারকে দূরে সরাতে সহায়তা করে। প্রতিবেশীর ভিতর ব্যক্তি নিজের আত্মাকে প্রসারিত করে। আক্ষরিক অর্থে এবং দার্শনিক অর্থে আত্মীয়তার এটাই অর্থ। যদিও আত্মীয়তার গ্রাম্য অর্থ রক্তের সম্পর্ক, তবুও তার দার্শনিক অর্থ যার ভিতর দিয়ে আমার আত্মার সম্পর্ক প্রসারিত হয়েছে। আর শেষ পর্যন্ত আমাদের লক্ষ্য থাকে সংকীর্ণতাকে দূরে সরিয়ে বিশ্ব নাগরিক হওয়ার যেখানে মূল ভিত্তি হলো বিশ্ব মানবতা।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ০২ রা জুন, ২০১৫ রাত ১১:২৯

পুলহ বলেছেন: লেখার বিষয়টি খুব চমতকার ! লেখককে ধন্যবাদ :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.