নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

লিখি,পড়ি, ঘুরি-ফিরি, দেখি, শিখি- অবিশ্রান্ত।

সুমন রহমান

একেই তো এই জীবন ভরে কাজের বোঝাই জমে... আজ পৃথিবীর ভালোবাসার সময় গেছে কমে একটু ফাগুন আগুন দিয়ে না জ্বেলোনা... সুন্দরী গো দোহাই দোহাই মান করো না

সুমন রহমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

সুন্দর কথামালা (প্রবাদ প্রবচন)-১

২৫ শে আগস্ট, ২০২৫ বিকাল ৫:৩৭



(বাংলা প্রবাদ প্রবচন- শ্রীসুশীলকুমার দে সম্পাদিত গ্রন্থ থেকে উৎসারিত)

• বাংলা শব্দগুলির পৌনঃপুনিক প্রয়োগ-প্রাচুর্য্যের (word frequency-র) ইহা একটা মোটামুটি ধারণা দিবে।
• প্রবাদগুলি বহু বর্ষ ধরিয়া বহু লোকের মুখফেরতা হইয়া, অথবা প্রস্তাবানুযায়ী রূপান্তরিত হইয়া, অনেক সময় বহু বিচিত্র আকার ধারণ করিয়াছে।
• পুস্তক-সংগ্রহাদির দ্বারা সহৃদয়তা দেখাইয়াছেন।
• যাহা নিত্য দৃষ্ট ও নিতান্ত পরিচিত, তাহা ভূয়োদর্শন, তাহাই যে বিশুদ্ধ সত্য হইবে, এমন নয়; কিন্তু তাহাই আধিকাংশ প্রবাদের খোরাক যোগায়। প্রবাদের মধ্যে যে সত্য নিহিত থাকে, তাহা প্রায়ই আপেক্ষিক সত্য--তত্ত্বের সত্য নয়, তথ্যের সত্য। প্রবাদের অনেক দিক আছে, কিন্তু প্রবাদ মুখ্যতঃ বাস্তবঘেঁষা-ইহা পথঘাটের প্রাজ্ঞতা, প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতার স্বচ্ছন্দ প্রকাশ-'a short sentence drawn from long experience'! সেইজন্য ইহা চট্ট করিয়া মনে লাগিয়া যায়, এবং প্রয়োজন হইলে চট্ করিয়া বাহিরে লাগানো যায়। এমন খুব কম প্রবাদ-বাক্য আছে, যাহা বর্দ্ধমান রাজবাটীর মহাভারতের মত বুঝাইয়া না দিলে বুঝিতে পারা যায় না। সহজবোধ্যতা ও সহজপ্রয়োগ প্রবাদের লোকপ্রিয়তার ও লোকস্মৃতিতে লুপ্ত না হইবার একটি প্রধান কারণ। কিন্তু প্রবাদের মধ্যে যে সত্য বা তথ্য নিহিত থাকে তাহা অনেক সময়ে শুধু নিরতিশয় সহজ নয়, নিতান্ত সাধারণ ও সামান্য, যাহাকে ইংরেজীতে platitude বলে। অনেকের ধারণা, এই বিষয়বস্তুর তুচ্ছতা বা দৈন্যের জন্যই প্রবাদে পটু ও কটু রসিকতা, ছড়ার ছন্দ, মিলের পারিপাট্য ও অনুপ্রাস প্রভৃতি শব্দালঙ্কারের ভঙ্গিমা প্রয়োজনীয় হইয়া পড়িয়াছে। সেইজন্য তাঁহারা প্রবাদ-বাক্যকে মস্করা, ভাঁড়ামি বা চাষাড়ে ইয়ারকির চটকদার রূপান্তর বলিয়া মনে করেন।
• গ্রামের জীবন হইতে আসিয়াছে বলিয়া, যাহাকে bucolic wit বলে, তাহা বাংলা প্রবাদে সুস্পষ্ট; কিন্তু প্রায় সকল দেশের প্রবাদেই ইহা অল্পবিস্তর দেখা যায়, এবং যাহা গ্রামের তাহাই গ্রাম্য নয়।
• অভ্যস্ত প্রবাদের যথাতথা ব্যবহার মৌলিক চিন্তা বা ভাবপ্রকাশের পরিচয় দেয় না, অক্ষম ও অলস মনের সুলভ উপায় বা আবরণ হইয়া দাঁড়ায়।
• আজকাল আমরা সভ্য হইয়াছি, সেইজন্য সহজ কথা সহজ করিয়া বলিতে পারি না। কৃত্রিম সভ্যতার একটি অঙ্গ হইতেছে-ইহার বাহিরের ফিৎফাট চাকচিক্য। ভিতরে ছুঁচোর কীর্ত্তন হউক না কেন, বাহিরে কোঁচার পত্তন থাকিলেই হইল। ভাষাগত কুরুচিতে আমরা শিহরিয়া উঠি, কিন্তু ভাবগত কুরুচি, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আকারে ও ইঙ্গিতে, গোপন বিষবিসর্পের মত ওতঃপ্রোত থাকিলে আমাদের রুচিধ্বজিতার ব্যাঘাত হয় না। রাস্তার নীচে প্রচ্ছন্ন পূতিগন্ধময় শৌচস্রাব থাকিলে কি হইবে, আধুনিক সভ্য নগরীর উপরত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট, পার্ক-ময়দান, ইলেকটিক আলো ও ব্যাণ্ডষ্ট্যাণ্ড রহিয়াছে। সেকালে রাস্তার উপরেই একধারে পয়ঃপ্রণালী থাকিত, যাহারা পথ চলিত তাহারা ইহাকে প্রত্যক্ষভাবে দেখিয়াই পরিহার করিত। কিন্তু এখন আমরা সভ্যতার উৎকর্ষে উঠিয়া, সমস্ত বিষস্রাবকে মুক্ত জগতের আলো ও বাতাস হইতে বিচ্চিন্ন করিয়া, গুপ্তভঙ্গীর সুড়ঙ্গে চালাইয়া দিয়া, আরও ভয়াবহ রোগের আমদানি করিয়াছি। সেকালের রসিকতা, বাঙালীর বারওয়ারীতলায়, অন্য রসের মধ্যে বা পশ্চাতে, অনেক সময় উলঙ্গ হইয়া নামিত, অথবা আসরে নামিয়া নাচিতে নাচিতে উলঙ্গ হইত। কিন্তু আজকালকার রুচিসম্মত রসিকতা, বিনয়াভিমানী সুক্ষাচার-নিষ্ঠতার আবরণে, ড্রয়িংরুমের আদব-কায়দার গুঢ়তায়, অর্দ্ধনগ্নতার ভঙ্গী ও ইঙ্গিতে, লোভয়িত্রী বিষকন্যার মোহিনী মূর্ত্তি ধারণ করিয়াছে। প্রবাদের cynic বলিয়াছেন-'সবাই জানে সব তত্ত্ব, কাপড়খানা মধ্যস্থ'। কিন্তু আধুনিক সভ্যতা, কাপড়খানি নহে, কাপড়ের ভগ্নাংশটুকু, কি ভাবে মধ্যস্থ রাখে তাহা সর্ব্বজনবিদিত।
• আর্ট-সর্ব্বস্ব ভদ্রসাহিত্য ও রুচি-সর্ব্বস্ব ভদ্রসমাজ যতই ভ্রূকুটি বা নাসিকা-কুঞ্চন করুক না কেন, বাংলা প্রবাদগুলি বাঙালী জনসাধারণের নিতান্ত নিজস্ব ও চিরন্তন সম্পদ, যাহা তাহাদের প্রাত্যহিক ভাষায়, সুলত জ্ঞান ও সহজ রসিকতার উপায় হিসাবে, অন্তর্ভূত হইয়া গিয়াছে।
• তেমনই প্রবাদের রূপ ও রস তাহার বলিবার ভঙ্গীতে; চাক্ষুষ না দেখিলে বা কানে না শুনিলে, তাহার সম্পূর্ণ আস্বাদ পাওয়া যায় না। যাহারা প্রাচীনাদের মুখে -
অবাক করলে নাকের নথে, কাজ কি আমার কানবালাতে॥
আয়েশ লুকুবি বয়েস লুকুবি, গালভাঙা তোর কোথায় থুবি।
কোথা থেকে এল শাঁখ, শাঁখের মেক্সমেকানি দেখ॥
আহ্ললাদী যায় মরতে, তিনকুল যায় ধরতে।
ও আহলাদী মরিস্ নি, লোক-হাসানো করিস্নি ॥
কারে এলি শেখাতে, কাঁচকলা দিয়ে কান বেঁধাতে ॥
ওদের বউ নথ পরেছে, সাত সাঙ্গাতে বয়।
নাকে কেমন রয়, না, ওরাই শুধু কয়।
প্রভৃতি সরস মেয়েলী টিপ্পণীগুলি, অনুরূপ মুখ, স্বর ও অঙ্গভঙ্গীর সহিত শুনিয়াছেন, তাঁহারাই ইহাদের রস-ব্যঞ্জনা স্পষ্ট অনুভব করিতে পারিবেন;

কিন্তু মায়ে পোয়ে সংঘর্ষ, অথবা বউয়ের সোহাগে মাকে অবহেলা বাস্তৰ সংসারের দুগ্রহ। তাই শুনিতে পাই-
মায়ের গলায় দিয়ে দড়ি, বউকে পরাই ঢাকাই শাড়ি ॥
মায়ের পেটে ভাত নেই, বউয়ের গলায় চন্দ্রহার।
গিন্নীর হাতে রাঙা পলা, বউয়ের হাতে সোনার বালা ॥
বাছার কি দিব তুলনা, মায়ের হাতে তুলার দাঁড়ি, মাগের কানে সোনা ॥

এরূপ নিতান্ত স্ত্রৈণ পুত্রের প্রতি অস্বাভাবিক নয় মায়ের সতর্ক দৃষ্টি, পাছে বত্রিশনাড়ী-ছেঁড়া ধন আপন সন্তান পর হইয়া যায়, কারণ
সন্তান বুকে খেয়ে মুখে মারে ॥
যতক্ষণ দুধ, ততক্ষণ পুত ॥
মায়ের পুত নয়, শ্বাশুড়ীর জামাই
॥ মাগ মাগ মাগ, মাগ আগে খাক।
মাগ মাগ মাগ, মাগ মাথার পাগ ॥
মা বাপ ঢেওঢেকনা, শালাশালাজ নে' ঘরকন্না।
ঘরে আছেন সিদ্ধেশ্বরী, তার কথা নে' কর্ম্ম করি
বেটা বিয়লাম বউকে দিলাম, ঝি বিয়লাম জামাইকে দিলাম।
আপনি হলাম বাঁদী, পা ছড়িয়ে ব'সে কাঁদি ॥
কি করবে পুতে, নিত্যি সে ত কান-ভাঙানীর কাছে যায় শুতে॥
আজকের মাগ তুমি, কেঁদো না, কেঁদো না।
চাল চিবিয়ে খাব আমি, রেধো না, রেধো না ।
সুতরাং, শ্বাশুড়ীর বাক্য-যন্ত্রণা গিয়া পড়ে পিতৃগৃহ হইতে সঙ্গোবিচ্ছিন্না নববধূর উপর-
মাগের ইচ্ছা ভাতারটি ॥
শুন ভাই কলির অবতার কোণের বউড়ী বলে-ভাতার ভাতার ॥
মা চায় আঁত পানে, মাগ চায় ভাত পানে
অতএব সুন্দরী বধূ না আনাই ভাল
ঘর বাঁধো খাটো, গরু কেনো ছোটো।
বিয়ে কর কালো, তাই গেরস্থের ভালো ॥
কিন্তু 'যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা',সুতরাং উঠিতে বসিতে বউয়ের চালচলনের ব্যাখ্যার অবধি নাই; মাতৃহৃদয়ের স্নেহের ধারা যেন এই বচনগুলির মধ্যে লুপ্ত হইয়া গিয়াছে-
বউয়ের চলন-ফেরন কেমন, তুর্কী ঘোড়া যেমন।
বউয়ের গলার স্বর কেমন, শালিখ কেঁকায় যেমন ॥
সেই কড়ি ক্ষয়, তবু বউ সুন্দর নয়।
কোনালে বউ রূপসী।
জাড়কালে বউয়ের জাড়-কাঁটা, গরমকালে ঘামাচি ॥
বউ নয়-বোবা, বউ নয়-বাবা ॥
………….
মেয়ে চির কালই ভাল, বউ মন্দ, তাই মায়ের আক্ষেপ
পদ্মমুখী ঝি আমার পরের ঘরে যায়।
খেঁদানাকী বউ এসে বাটায় পান খায়।

সুতরাং শ্বাশুড়ী-বউয়ের কুরুক্ষেত্রে ননদের খোঁটা ও পড়শীদের বচন বউয়ের গায়ে হুল বিধিতে ছাড়ে না-
যেমন দাদা গুণমণি, তেমনি বউ রাসমণি ॥
কাছের গোড়ায় শোয়, কানের গোড়ায় কয়।
তার কথা কি কখনো লঙ্ঘন হয় ॥
মায়ে বিয়লে, মাগে পেলে, কার ধন কার।
গরু আর হাল বেচে ভাতার, কিনলেন মাগের গলার হার।
আদর বিবির চাদর গায়, ভাত পায় না ভাতার চায় ॥
কাঁখে কলসী চড়কপাক, গিল্পী হবার বড় জাঁক ॥
বউ গিন্নী হ'লে তার বড় ফরফরানি।
মেঘভাঙা রোদ্দর হ'লে বড় চড়চড়ানি ॥
কলির কথা কই গো দিদি, কলির কথা কই।
গিন্নীর পাতে টক আমানি, বউয়ের পাতে দই॥
শ্বশুরকে ভাত দিয়ে পড়ল মনে,
আমানি নিয়ে বউ ছোঁচাল কোণে॥
দেখে দেখে লাগল ধাঁধা, পেত্নীর পোঁদ পেতলবাঁধা॥
ঠাকরুণ গো ঠাকরুণ, তুমি কোট চালুতা, আমি কুটি লাউ।
আর গতরকুড়ী বউকে বল ধান ভানতে যাউ ॥
সুতরাং এ কথা নিরর্থক নয় যে,
লোহা জব্দ কামারবাড়ী, বউ জব্দ শ্বশুরবাড়ী ॥
শেষোক্ত ছড়ার উপভোগ্য ন্যাকামিটুকু কখনো কখনো হৃদয়হীনতার চরমে উঠে। মেয়ের শ্বাশুড়ী মৃত্যুশয্যায়, মেয়ের মা বলিতেছেন
একলা ঘরের গিন্নী হলি নাকি মা।
মেয়ে প্রত্যুত্তর দিতেছে-
নিশ্বাসকে বিশ্বাস নেই নড়ছে দুটো পা ॥
অর্থাৎ স্বাশুড়ীর নিশ্চিত মৃত্যুর এখনও বিলম্ব রহিয়াছে বলিয়া খেদ!
ননদকে ঘাট হইতে কুমীরে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে, তবুও যেন এমন কিছু দুর্ঘটনা হয় নাই, এইভাবে স্বাশুড়ীর কাছে বউয়ের ব্যাজোক্তি শুনিতে পাই
ভাল কথা মনে পড়ল আঁচাতে-আঁচাতে।
ঠাকুরঝিকে নিয়ে গেল নাচাতে-নাচাতে।
ঠাকরুণ গো ঠাকরুণ, জলের ভেতর তোমাদের কি কুটুম আছে ॥

দেওরের সঙ্গে স্পষ্ট রসিকতার মধ্যেও ননদকে খোঁটা দেওয়া বাদ পড়ে না-
দেওরা রে দেওরা এর বেওরা কি।
নন্দাইএর কোলে কেন শোয় না ঠাকুরঝি॥ সু
তরাং শ্বাশুড়ী-ননদহীন নিরঙ্কুশ ঘরসংসারই সকল বধূর কাম্য
একলা ঘরের গিন্নী হব, চাবিকাঠি ঝুলিয়ে নাইতে যাব ॥
কিন্তু দাম্পত্য-জীবনের বিঘ্ন ও অন্তরায় শুধু ইহাই নয়, আরও রহিয়াছে- এক দিকে নির্ব্বোধ স্বামীর অপদার্থতা, অন্য দিকে সতীন ও সতীন-কাঁটার জ্বলা। নূতন প্রেমে নূতন মধু, কিন্তু পুরাতন হইলে-
নূতন নূতন তেঁতুলের বীচি, পুরানো হলে আতায়-বাতায় গুঁজি ॥
পিরীত যখন জোটে, ফুটড়াই ফোটে।
পিরীত যখন ছোটে, ঢেঁকিতে ফেলে কোটে ॥
অবশ্য সব দোষই স্বামীর, সুতরাং সতীলক্ষ্মীদের উক্তিগুলি খুবই স্পষ্ট-
পুরুষের ভালরাসা, মোল্লার মুরগী পোষা ॥
যার কাছে ব্যবস্থা, সেই করে তিন অবস্থা ॥
এত ক'রে করি ঘর, তবু মিনে বাসে পর ॥
যার জন্যে বুক ফাটে, সে আমারে এঁকে কাটে॥
যার জন্যে করলাম জো, সেই বলে পৈথানে শো॥
যার জন্য বনবাসী, সেই দেয় গলায় ফাঁসি ॥
মিনমনে পিদ্দিম,আর পিটপিটে ভাতার ॥
ঠাকরুণের গর্ভ চমৎকার, বিইয়েছেন বাঁদর অবতার ॥
কাজে কুড়ে খেতে দেড়ে, বচনে মারে তেড়ে-ফুঁড়ে ॥
ঢেঁড়ো শাক সিজাব কত, হাবা ভাতারকে বোঝাব কত ॥
অবুঝে বুঝাব কত, বুঝ নাহি মানে।
ঢেঁকিরে বুঝাব কত, নিত্য ধান ভানে ॥
ভাতারে কিবা সুখ, পোষ মাসে ভাতের দুখ ॥
ভাত দেয় না ভাতারে, ভাত দেয় গতরে ॥ ভাত দেবার ভাতার নয়, কিল মারবার গোঁসাই ॥
উপোসের কেউ নয়, পারণের গোঁসাই ॥
মাগের কাছে পাগের বড়াই॥
যৌবনের টস্টসানি নেইক কোন রস।
কেবল পুরান টোলে কষ ॥
রঙ গেল, ঢঙ গেল, রস গেল দূর।
নির্ধনের হাতে পড়ে দর্প হল চুর ॥
গুণের কথা বল্ব কত, কুম্ভকর্ণ নিদ্রাগত
শেজে-মুতো রাতকানা, দুর্ব্বাক্য বিষের পানা ॥
এক তোলো কচুশাক, এক তোলো পানি।
বাপে-পুতে সলা ক'রে পেয়েছ রাঁধুনী॥
দরবারে মুখ না পায়, ঘরে এসে মাগ ঠেঙায় ॥
খোঁড়া ভাতার, বুড়ো বেহাই, কোন দিকে সুখ নাই॥
পড়েছি দজ্জালের হাতে, জঞ্জাল জড়ায় দিন রাতে॥
পড়েছি মোগলের হাতে, খানা খেতে বলে সাথে ॥
ভাতারে পোঁছে না, মোর নাম সোহাগী ॥
মাগ কাটে কাট্টনা, ভাতারের দেখ নাচনা॥

কিন্তু 'যেমন হাঁড়ি তেমনি শরা', 'রাজার রাণী, কানার কানী', 'যেমন রাধা তেমনি কামু'; সুতরাং স্বামীটিও দু-চার কথা শুনাইতে ছাড়েন না-

বুঝলাম তোমার গিরীপনা, তেল থাকে তো মুন থাকে না ॥
ভাল দেখে বউ আনলাম ঘরে, বাঁশ দেখে বউ বাজি করে
পান থেকে চুন খসে না, এমনি হল গিরীপনা ॥
আপনি গিরী স্বয়ংবরা, কি বিলায় মোর খই কলা ॥
রান্নায় জুড়োয় প্রাণ, গা-ময় হলুদ।
ছিঁড়ে-কুটে কাটুনী, পুড়ে-ঝুড়ে রাঁধুনী ॥
ঘর-সর্বস্ব তোমার, চাবিকাঠিটি আমার ॥
বেঁচে থাক মোর চুড়ো-বাশী, মিলবে রাধা হেন দাসী ।
মা নয় যে তাড়িয়ে দেব, বাপ নয় যে ভাত দেব না,
পরের মেয়ে রাখি কোথা?

প্রতিকার যে স্ত্রীর হাতে নাই, তাহা নয়, কারণ,
'যেমন দেবা তেমনি দেবী',
'যেমন নেড়া, তেমনি নেড়ী,
বনপুঁই শাক ছড়া হাঁড়ি',

সুতরাং-
নির্গুর্ণ মিনর তিন গুণ মাগ ॥
কুড়ে ভাতারের পাটকেল শিথান ॥
ওরে আমার তুমি, তোমার জন্যে চাল ভিজিয়ে চিবিয়ে মরি আমি ॥
পাস্তাভাত 'ভক্ষণ, এই ত পুরুষের লক্ষণ।
আমি অভাগী তপ্ত খাই, কোন্ দিন বা ম'রে যাই॥
ঈশ্বর যদি করেন, কর্তা যদি মরেন, তবে ঘরে ব'সেই কেত্তন শুনব ॥

তবু সব ঝগড়াঝাঁটির মধ্যেও-

যারে যেমন গড়েছে বিধি, সেই ভাতারের পরম নিধি ॥

যেন বাহিরের দ্বন্দ্বকলহ না থাকিলে ভিতরের প্রীতি জমে না, তাই দাম্পত্য-প্রহসনেরও অভাব নাই-
বর-সোহাগী নাচন চায়, মাগ-সোহাগী ঝাঁটা খায়

যে ঘাটেতে জল নেই, পাথর কেন ভাসে।
যার সঙ্গে ভাব নেই, সেই বা কেন হাসে।
ভাবের ঘটাঘটি, না দেখলে থাকতে নারি, দেখলে চটাচটি॥
ওলো আমার কমলীলতা, জল শুকোলে রইবি কোথা ॥

এইরূপ স্বামীস্ত্রীর সুখে-দুঃখে দিন কাটিলেও, স্বামীর জ্যেষ্ঠ বা কনিষ্ঠ ভ্রাতা চিরকালই শ্রদ্ধা বা স্নেহের পাত্র। 'দেবর লক্ষ্মণ' কথাটি ব্যঙ্গোক্তি হিসাবে প্রযুক্ত হইলেও, ইহা দেবরের প্রতি নিঃসঙ্গ ভ্রাতৃবধূর পক্ষপাতিত্বেরও নিদর্শন। তেমনি আবার অন্য দিকে-

ভাসুর মেগেছেন ভাত, সে তত্ত্বে আছি।
সকালবেলায় তুলি শাক, সন্ধ্যেবেলায় বাছি॥
এত ডাল দিয়েছি ভাতে, তবু নেই বট্টাকুরের পাতে॥
এত কলাই ভাতে, ছোট্টাকুরের পাতে ॥

ভাসুর-ভাদ্দরবউয়ের সাক্ষাৎ কথাবার্তা নিষেধ, কিন্তু মাঝখানে 'কাঁথখান' (দেওয়াল) আড়াল রাখিয়া বউ বলিতেছেন

কাঁথখান, কাঁথখান, বটাকুর কি পাঁকাল মাছ খান ॥
বটাকুর জবাব দিতেছেন
খান, খান, খান, খান পাঁচ ছয় খান।
এখন একটু তেল পেলে নাইতে যান ॥

বড় বউ বড়ালের ঝি, কোণে ব'সে কর কি?
মেজ বউ মেঝের মাটি, সকল কথায় ঝাঁঝের আঁটি।
সেজ বউ সেজুনী, সব কাজেতে এগুনী।
ন' বউ নত্তা, সকল ঘরের কত্তা।
নূতন বউ নথনী, শেওড়াগাছের পেত্নী।
ছোট বউ আতরের শিশি, ছোট্টাকুরপোর গোঁফে ঘষি।

তেমনই বউয়ে বউয়ে কোঁদলের নমুনা খুবই বাস্তবকি বলব ভাসুর ঘরে, নইলে তোর ছেলে মোর ছেলে মারে। কিন্তু সতীনের জ্বালা হইতেছে সবচেয়ে বড় জ্বালা। বৈদিক যুগ হইতেই সতীনের ঘর করা আমাদের দেশের মেয়েদের দুর্ভাগ্য ও অভিশাপ।
সতীনের চেয়ে সতীনের ছেলে-সতীন-কাঁটা-এমন কি, সতীনের আত্মীয়বর্গ আরও অসহ্য-
সতীনের পুত, সুন্দরও ভূত
সতীনের পুত হোক্, পড়শীর ভাত হোক্ ॥
সতীনের ঘা সওয়া যায়, সতীন-কাঁটা চিবিয়ে খায় ॥
জালা দিতে নেই ঠাই, আলা দেয় সতীনের ভাই ॥
ইহার উপর যদি বোন-সতীন হয়, তাহা হইলে ত কথাই নাই
আন্-সতীনে নাড়ে-চাড়ে বোন-সতীনে পুড়িয়ে মারে ॥
নিম তেতো, নিসিন্দা তেতো, আর তেতো খ'র।
তার চেয়ে অধিক তেতো বোন সতীনের ঘর ॥

সুতরাং, সপত্নী-বিদ্বেষ যে চরমে উঠিবে তাহা বুঝা যায়-
যমকে ভাতার দিতে পারি, সতীনকে তবু দিতে নারি॥
তাই 'সতীনের বাটিতে গু গুলিয়া খাওয়া' হইতেছে, 'নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গের' মত, এই হিংসাপ্রবৃত্তির অপরূপ অভিব্যক্তি। হাজার ভাল হইলেও, সতীনকে কোনদিন বিশ্বাস নাই-
সতীনের হাত সাপের ছোঁ, চিনি দিলে তুলে থো।
সতীনের ডাক নিশির ডাক, তিন ডাকে চুপ ক'রে থাক ॥

এবং সপত্নী-বিনাশের উৎকট আনন্দের তুলনা নাই-
অশথ কেটে বসত করি, সতীন কেটে আলতা পরি ॥
বাঙালী-ঘরের এই যে দুঃখের জীবন, তাহার চিত্র প্রাচীন বাংলা সাহিত্যেও বিরল নয়। সুতরাং ভারতচন্দ্র নারীদের কথায় যে বলিয়াছেন-'সতিনী বাধিনী, শাশুড়ী রাগিণী, ননদী নাগিনী বিষের ভরা', তাহা একেবারেই অতিরঞ্জিত বা নিরর্থক নয়। সৎমা ও সৎমায়ের ব্যবহার উপলক্ষ্য করিয়া যে সব প্রবাদ প্রচলিত রহিয়াছে, তাহাও ইহার সলে ধরিতে হইবে। 'বাপের উপরোধে সৎমার পায়ে গড়' করিতে হইলেও, 'বিমাতা বিষের ঘর'-
সৎমার ছেদ্দা পাস্তা ঘি, মাথাটা মুড়িয়ে এস তেল-পলাটা দি'॥
যাহারা দোজবরে, তাহাদের 'নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরা' নির্ব্বোধ আসক্তিও কৌতুকের বিষয়-
ছেঁড়া কচুর পাত, এক মাগকে ভাত দেয় না,আবার মাগের সাধ ॥
দোজবরে ভাতারের মাগ, চতুৰ্দ্দশীর চোদ্দ শাক॥
একবরের মাগ হেলা-ফেলা, দোজবরের মাগ গলার মালা ॥
দোজবরের মাগ গঞ্জরা হাতী, ভাতারকে মারে তিন লাথি।
দোজবরের মাগ সোঁদরবনের বাঘ ॥
একবরের মাগ নাড়ে-চাড়ে দোজবরের মাগ পুড়িয়ে মারে ॥

এবং যাহারা তৃতীয় বা চতুর্থ বার বিবাহ করেন, তাহাদের ব্যাখ্যা শুনিতে পাই-

একবরে ভাতারের মাগ চিংড়িমাছের খোসা।
দোজবরে ভাতারের মাগ নিত্যি করেন গোসা।
তেজবরে ভাতারের মাগ সঙ্গে বসে খায়।
চারবরে ভাতারের মাগ কাঁধে চড়ে যায় ॥

সুতরাং 'বুড়ো বয়সে দুধতোলানি' যেমন বিসদৃশ, তেমনই হইতেছে বৃদ্ধের তরুণী ভার্য্য্যা-

বুড়ো বয়সে নবীন নারী, জ্বর বিকারে বিলের বারি।
আধমরা হয় নয়নবাণে, দেখতে পায় না চোখে কানে।
বুড়ো বয়সে বিয়ে, পুরানো কাপড় সিয়ে॥
সাঁজ গেলে দীয়া, বয়স গেলে বিয়া ॥
ঝড় গিয়ে ঝাঁপি, বয়স গিয়ে বিয়ে।

সন্তান-স্নেহ জীবনের সৌভাগ্য; 'ঘরের গাছা পেটের বাছা'-দুই সমান প্রিয়, তাই 'কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন' বা 'গোগা ছেলের নাম তর্কবাগীশ' হওয়া স্বাভাবিক। সুন্দরী বধূ যদি পুত্রবর্তীও হয় তবে গরবের সীমা নাই—
একে গোরা গা', তায় পোয়ের মা।
পুত্রবর্তী হওয়ার কামনা কিরূপ তাহা একটি সাধারণ প্রবচন হইতে বুঝিতে পারা যায়। সধবা স্ত্রার পুনরায় পুত্রসম্ভাবনা রহিয়াছে বলিয়া পুত্র বিগত হইলেও মৃত বলিতে নাই; বলিতে হয়
এয়োতীর পুত খেলতে যায়।
কিন্তু এক সন্তান দুর্ভাবনার বিষয়-
এক পুতের আশা, বালুর তীবে বাসা॥
এক পুত পুত নয়, এক কড়ি কড়ি নয়, এক চোখ চোখ নয় ॥
কিন্তু এক সন্তান-'আলালের ঘরের দুলাল'-কিরূপ 'আদরে বাঁদর' হইতে পারে, তাহাও অজ্ঞাত নয়,
পুত, না ভূত ॥
হয় ত পুত, না হয় ত ভূত ॥
এক মায়ের এক পুত, খায় দায় যমের দূত ॥
যেমন কপাল, তেমনি গোপাল ॥
একলা মায়ের ঝি, গরব করব না ত কি ॥
অপদার্থ সন্তানের প্রতি মর্মান্তিক বিদ্রূপও বিরল নয়—
অনেক কালের ছিল পাপ, ছেলে হল সতীনের বাপ ॥
বাছা আমার ছিরিখণ্ডী, বসে আছেন বড়াই-চণ্ডী ॥
বাছার কিবা মুখের হাঁই, তবু হলুদ মাখেন নাই ॥
বাছার আমার কিবা রূপ, খুঁটে ছায়ের নৈবিদ্যি খেংরাকাঠির ধূপ ।
বাছা আমার ভরমের টাটি, কাঁকালে পাঁচছয় চাবিকাটি ॥
বাছা আমার বাঁচলে বাঁচি, বাছার আমার ছধে অরুচি ॥
কিবা মেয়ের ছিরি, বাঁশবনের প্যারী॥
বাছার আমার বাড়াবাড়ি, ছ' আনা কাপড়ে ন' আনা পাড়ি ॥
যাহার অনেকগুলি সন্তান তাহার জ্বালাও অনেক -
অভাগীর দুটা পুত, একটা দানা, একটা ভূত ॥
এক ছেলে তার ফুলের শয্যা, পাঁচ ছেলে তার কাঁটার শয্যা ॥
অনেক সন্তান যার, পাপের সাজা তার !!
যে করে পাপ, সে হয় সাত বেটার বাপ ॥
কারণ, 'পাঁচ আঙ্গুল সমান নয়', তাই
এক লাউয়ের বীচি, কেউ বা করে কচর-কচর, কেউ বা আছে কচি ॥
এক ঝাড়ের বাঁশ, কোনটিতে হয় দুর্গার কাঠামো, কোনটিতে হয় হাড়ীর ঝুড়ি ॥
কিন্তু আমাদের দেশে অতি প্রাচীনকাল হইতে ছেলের আদর, মেয়ের অনাদর
পুতের মুতে কড়ি, মেয়ের গলায় দড়ি ॥
গাইয়ের বেটী, বউয়ের বেটা, তবে জানবে কপাল গোটা।

পুত্র ও কন্যার মধ্যে তারতম্য থাকিলেও, উভয়কে মানুষ করার দায়িত্ব সমান-
ঝিয়ের আলা বুকের খোঁচা, পুতের জ্বালা ভূতের বোঝা।
ছেলে নষ্ট হাটে, ঝি নষ্ট ঘাটে॥
আবালে না নোয়ালে বাঁশ, পাকলে করে ট্যাশ-ট্যাশ
পাখ, পায়রা, পাঁচালী, তিনে ছেলে মজালি॥
পড়াবি ত পড়া পো', না পড়াবি ত সভায় থো।

কিন্তু পুত্রের চেয়ে কন্যা আমাদের গৃহে একটি মস্ত দায়
মেয়ে মেয়ে মেয়ে, তুষ করলে খেয়ে।
হরিভক্তি উড়ে গেল মেয়ের পানে চেয়ে
সুতরাং 'মেয়ের মায়ের পাঁচটা প্রাণ' এই প্রবাদ-বাক্য তাহার সহিষ্ণুতার নিদর্শক। মেয়েকে যত শীঘ্র পাত্রস্থ করা যায়, তত শীঘ্র এই দায়িত্ব হইতে উদ্ধার পাওয়া যায়, কারণ 'মেয়ে মানুষের বাড়, কলাগাছের বাড়'। কিন্তু কন্যাকে অপাত্রে দানের মত আর পারিবারিক দুর্ঘটনা নাই। অতএব
অন্ন দেখে দেবে ঘি, পাত্র দেখে দেবে ঝি।
ভাল মেয়ে হইলেই যে ভাল ঘরে পড়িবে, এমন নয়
অতিবড় ঘরণী না পায় ঘর, অতিবড় সুন্দরী না পায় বর।
অতিচতুরের ভাত নেই, অতিসুন্দরীর ভাতার নেই।
ভাত-ঘর দেখে দিলে কাঠ-ঘর হয়।
কাঠ-ঘর দেখে দিলে ভাত-ঘর হয়।
যেমন কন্যা রেবতী, তেমনি পাত্র গদাহাতী (= বলরাম)॥
গৌরী লো ঝি, তোর কপালে বুড়ো বর আমি করব কি।
সকল মেয়ের সুখ-সমৃদ্ধি সমান নয়-
সকল মেয়েই মেয়ে, কেউ যায় পালকি চ'ড়ে, কেউ বা থাকে চেয়ে ॥
কিন্তু বিবাহের পর মেয়ের বাপের বাড়ী থাকাও বিপজ্জনক ও অযশঙ্কর

বাপের বাড়ী ঝি নষ্ট, পান্তাভাতে ঘি নষ্ট।
সোনা নষ্ট বেনের বাড়ী, মেয়ে নষ্ট বাপের বাড়ী॥
কথায় কথা বাড়ে, জলে বাড়ে ধান।
বাপের বাড়ী থাকলে মেয়ের বাড়ে অপমান।
দেইজির উঠান ঝাঁট সেও ভাল হয়।
বাপের বাড়ী দাস-দাসী তবু ভাল নয়।
তথাপি মেয়ে নিজের নয়, পরের। মেয়েকে শ্বশুরবাড়ী পাঠানো নিশ্চিস্ত হইবার উপায় হইলেও, আমাদের দেশের একটি চিরন্তন অন্তর্ব্বেদনা-
মেয়েছেলে কাদার ঢেলা, ধপাস্ করে জলে ফেলা ॥
মেয়ের নাম ফেলী, পরে নিলেও গেলি, যমে নিলেও গেলি।
শশুরবাড়ী যাইবার সময় মাকে কাঁদিতে দেখিয়া মেয়ের সান্ত্বনা-
কেঁদে কেন মর, আপনি ভাবিয়া দেখ কার ঘর কর।
কিন্তু 'যথা স্ত্রীণাং তথা বাচাং সাধুত্বে দুর্জনো জনঃ'-মেয়ের সুখ্যাতি জীবদ্দশায় নাই, মৃত্যুর কঠিন নিকষে তাহার যাচাই হয়-
পুড়ল মেয়ে উড়ল ছাই, তবে তার গুণ গাই॥
ঘরের মধ্যে, ভাইয়ে ভাইয়ে যেমন ভাব-
মার পেটের ভাই, কোথা গেলে পাই ॥
ভাই ভাই, মেরে যাই ত ফিরে চাই॥
ভাইয়ের ভাই, বাঁ হাত দিলে ডান হাত পাই॥
রাম লক্ষ্মণ দুটি ভাই, রথে চ'ড়ে স্বর্গে যাই॥
তেমনই আবার দ্বন্দ্ব
ভাই ভাই ঠাঁই ঠাই।
রামের ভাই লক্ষ্মণ আর কি॥
ঘরের শত্রু বিভীষণ ॥
ভাইয়ের তুল্য মিত্র নেই, ভাইয়ের তুল্য শত্রু নেই ॥
ভাই-বোনের টান স্বাভাবিক, কিন্তু তাহাতেও পার্থক্য আছে-
শশা খেয়ে যেমন জলকে টান, তেমনি ভাইয়ের বোনকে টান।
'গুড় খেয়ে যেমন জলকে টান, তেমনি বোনের ভাইকে টান॥
ভাইয়ের প্রতি বোনের দরদ বেশি হইলেও, ভাইয়ের মুখাপেক্ষী হইয়া থাকা বাঞ্ছনীয় নয়-
ভাই রাজা ত বোনের কি?
ভ্রাতৃজায়ার হাততোলা হইয়া থাকা আরও কষ্টকর=
ভাইয়ের ভাত, ভাজের হাত॥
তবে অনেক সময়ে যেমন ভাই, তেমন বোনও হয়-
আমার ভাই রাবণ রাজা, আমি শূর্পণখা।
ধরামাঝে এমন জোড়া পারিস্ যদি দেখা॥
বাংলা গার্হস্থ্য-জীবনের এই সুখদুঃখের চিত্র অসম্পূর্ণ থাকিয়া যায়, যদি পাড়ার যিনি প্রতিবেশী, বিশেষতঃ প্রতিবেশিনী, তাহার কথা এখানে না বলা হয়। বিপদে-আপদে প্রতিবেশীর প্রয়োজনীয়তা আছে। 'পাড়া-পড়শীর গুণে বেঁড়ে গরুও বিকিয়ে যায়'; কিন্তু
এক ঝিকরে মাছ বেঁধে না, সেই বা কেমন বঁড়শি।
এক ডাকেতে সাড়া দেয় না, সেই বা কেমন পড়শী।

তথাপি ইহাদের অপরিসীম কৌতূহল প্রবাদের কৌতুকদৃষ্টি এডায় নাই-
পড়শী নয়, বঁড়শি ॥
পড়শী নয়, আরসি ॥
পড়শীর সঙ্গে পিরীত রাখো,
তার বেড়া কিন্তু নেড়ো না'ক॥
খল পড়শী, নাতান ভাই,
তার সাথে বসত নাই ॥

সব ঘরের সব কিছুর খবর রাখা, 'পরের ভাতে কাটি দেওয়া' ইহাদের জীবনযাপনের একমাত্র উপায়।
ঘাটে গেছল জায়ের মা, দেখে এল বাঘের পা।
সে দেখল, আমি শুনলাম, মরি বর্তি বাঘ দেখলাম ॥
যার ঝি তার জামাই, পাড়াপড়শীর কাটনা কামাই।
যার ঝি তার পোড়া, পাড়াপড়শীর কান খাড়া ॥
মা বিয়ল, না, বিয়ল মাসী, ঝাল খেয়ে ম'ল পাড়াপড়শী ॥
মায়ের পোড়ে, না, মাসীর পোড়ে, পাড়াপড়শীর ধবলা ওড়ে ॥
যার ভাতার তার ভাতার, কেঁদে মরে হরে ছুতার ॥
খাইয়ে পরিয়ে রাখলাম দাসী, কিন্তু সে হল পাড়াপড়শী ॥
আমি খাই ভাতারের ভাত, তোর কেন গালে হাত ॥

ইহাদের মধ্যে নাকি জ্ঞাতি-শত্রুই বড় শত্রু-
মিত্রের শ্রেষ্ঠ জ্ঞাতি ভাই, তার বাড়া শত্রু নাই।
জ্ঞাতি-শত্রু সবখান, কুকুরেরও হয় না গঙ্গাস্নান ॥
জ্ঞাতি-শত্রু পথে পথে, মক্কায় পারে নাক যেতে ॥
থাকলে জ্ঞাতি ভাতে খায়, মরলে জ্ঞাতি কাঁধে যায় ।
তাই 'আপনি মরিয়া জ্ঞাতির হাঁড়ি ফেলান' স্বজন-প্রীতির উৎকট উদাহরণ!
এহেন শুভানুধ্যায়ী পাড়াপড়শীর সকল বিষয়ে মাথা গলানো সত্ত্বেও
আটে-কাটে দড় বড় শক্ত মেয়ে যেই।
পাড়াপড়শীর বুকে ব'সে ঘর করছি তেই ॥
Love thy neighbour-অতি উচ্চ আদর্শ, কিন্তু প্রাত্যহিক জগতে
হলুদ জব্দ শিলে, বউ জব্দ কিলে।
পাড়াপড়শী জব্দ হয় চোখে আঙুল দিলে ॥
এই সব প্রতিবেশিনীদের মধ্যে যিনি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, তিনি হইতেছেন পাড়াকু দুলী; তাঁহার চিত্র খুবই পরিস্ফুট-
মিনসের কোলে ছেলে দিয়ে মাগী যায় লড়ায়ে ধেয়ে।

তিনি কোঁদল ভিন্ন থাকিতে পারেন না। যদিও 'কোঁদলে জাত নষ্ট,
রোগেতে রূপ নষ্ট', তবুও
কুদুলে নাড়ী কোঁ-কোঁ করে, কোঁদল নইলে থাকতে নারে ॥
নিয়ে আয় ত বউ নোড়া, যাই কোঁদলের পাড়া।
আর চাই না বউ নোড়া, পেয়েছি কোঁদলের গোড়া ॥
পেয়েছি কোঁদলের গোড়া, আর যাব না উত্তর পাড়া ॥
কি দিব কি দিব খোঁটা, গয়াতে মরেছে বাপবেটা ॥
গেছলাম তোর বাপের দেশ, দেখে এলাম তোর মায়ের বেশ ॥
কিন্তু কোঁদলের অন্ত নাই, কারণ
ঝগড়াটে লোক যারা ঝগড়া নাহি পায়।
বেনাগাছে পোঁদ চুল্কে গড়াগড়ি যায় ॥

(চলিবে..)

মন্তব্য ১ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ২৫ শে আগস্ট, ২০২৫ রাত ৮:০৬

বিজন রয় বলেছেন: আপনি কি বাংলার ছাত্র।

দারুন কালেকশান।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.