নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি মানুষ। আমি ত্বরীকতপন্থী-মুসলমান। আমি মানুষ বলে আমার ভুলত্রুটি হতেই পারে। বইপড়তে আমার ভালো লাগে। সাহিত্য ভালোবাসি। লেখালেখি আমার খুব শখের বিষয়। বাংলাদেশরাষ্ট্র ও গণমানুষের জন্য আমি লেখনিশক্তিধারণ করেছি।

সাইয়িদ রফিকুল হক

আমি লিখি “দেশ, জাতি, মানুষ আর মানবতার” জন্য। আমার লেখা কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও সমালোচনা আমার নিজস্ব ও মৌলিক রচনা। তাই, আমার অনুমতি ব্যতিরেকে এগুলো কপি বা নকল করা আইনতঃ দণ্ডনীয় অপরাধ। পৃথিবীর সকল মানুষের প্রতি আমার ভালোবাসা। জয় মানবের জয়।

সাইয়িদ রফিকুল হক › বিস্তারিত পোস্টঃ

গোয়েন্দা-গল্প: গোয়েন্দা লালভাই: অধ্যাপক-খুনের রহস্য (প্রথম পর্ব)

৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ৮:২০



গোয়েন্দা-গল্প: গোয়েন্দা লালভাই
অধ্যাপক-খুনের রহস্য (প্রথম পর্ব)

সাইয়িদ রফিকুল হক

আজকের পত্রিকা পড়ে দেখি ঢাকার অদূরে ধামরাইয়ে একজন প্রবীণ অধ্যাপক খুন হয়েছেন। খবরটা দেখে আমি আর বাসায় বসে থাকতে পারলাম না। ভাবলাম, ঘটনাটা এখনই আমাদের গোয়েন্দা লালভাইকে জানানো উচিত। আমাদের বাড়ির পাশেই লালভাইয়ের বাড়ি। সম্পর্কের দিক থেকে তিনি আমার আপন চাচাতো ভাই। আর বয়সের দিক থেকেও তিনি আমার চেয়ে বেশ বড়।

আমি হন্তদন্ত হয়ে লালভাইয়ের বাসায় ছুটে এলাম। আর দেখলাম, লালভাই খুব মনোযোগ দিয়ে আজকের পত্রিকাটা পড়ায় ব্যস্ত, এবং আজকের সব দৈনিকের শিরোনাম অধ্যাপক-খুনের বৃত্তান্ত পড়ছেন। আমি আর কিছু বললাম না। শুধু সোফার একপাশে বসে রইলাম। আমি জানি, এ-সময় কথা বললে লালভাই খুব বিরক্ত হবেন। তিনি একটি ঘটনার বিবরণ কমপক্ষে দুই থেকে তিনবার মনোযোগ দিয়ে পড়েন। কোনো-কোনো সময় তিনি এরচেয়েও বেশি পড়েন। এতে নাকি ঘটনার গভীরে যাওয়া যায়। আমাদের লালভাইয়ের তদন্ত করবার কলাকৌশলও ভিন্ন। তিনি প্রথমে ঘটনাস্থলে ছুটে যান কিংবা ঘটনাস্থলে ছুটে যেতে না পারলে পত্রিকা কিংবা বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেট্রিক মিডিয়া থেকে খবরাখবর সংগ্রহ করেন। আর প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানবন্দি শুনে ঘটনার গভীরতা ও সত্যতা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। এভাবে ঘটনার আরও গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। একসময় সবাইকে সন্দেহ করেন। শেষমেশ যারা ঘটনায় জড়িত থাকতে পারে শুধু তাদের নাম সন্দেহের তালিকায় রেখে বাকিদের বাদ দেন। ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর তিনি ঘটনা সংঘটিত হওয়ার স্থান থেকে শুরু করে আশেপাশে সবজায়গা মানে সর্বত্র খুঁটে-খুঁটে দেখেন। তারপর প্রয়োজন মনে করলে তিনি বিভিন্নজনকে জেরা করেন। সবশেষে স্থিরসিদ্ধান্তে আসেন। তিনি অতিরিক্ত দৌড়-ঝাঁপে বিশ্বাসী নন।

লালভাইয়ের পত্রিকা পড়া দেখে আমি বুঝতে পারলাম, তিনি এখন খুব মনোযোগী। এ-সময় তার সঙ্গে কথা বলতে যাওয়াটা ভীষণ বোকামি। আমি দেখতে পাচ্ছি, দৈনিক পত্রিকার এই চাঞ্চল্যকর ও লোমহর্ষক খুনের সংবাদ দেখে আমাদের গোয়েন্দা লালভাই যারপরনাই বিস্মিত হয়েছেন। তিনি সবেমাত্র সকালের নাশতা শেষ করে ‘দৈনিক বঙ্গবাণী’ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় চোখ বুলাতে শুরু করেছিলেন। প্রথমেই তার চোখ আটকিয়ে গিয়েছে আজকের হেডলাইনে। সেখানে লালকালিতে বড়-বড় অক্ষরে লেখা হয়েছে, নিজ-বাসভবনে খুন হলেন সরকারি কলেজের স্বনামধন্য সাবেক অধ্যাপক!
খবরটা নিঃসন্দেহে দারুণ চাঞ্চল্যকর, তাতে কোনো সন্দেহ নাই। কিন্তু এরচেয়ে বড় চাঞ্চল্যকর খবর হলো খুনের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছে নিহত অধ্যাপকের আপন-ভাগ্নে! খবরটা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তে লাগলেন গোয়েন্দা লালভাই।
আমাদের লালভাই পেশায় একটা বেসরকারি কলেজের অধ্যাপক। কলেজে অধ্যাপনার পাশাপাশি পরিচয়-গোপন করে তিনি গোয়েন্দাগিরিতেও ব্যস্ত এবং এব্যাপারে যথেষ্ট সিদ্ধহস্ত। বয়স তার খুব একটা বেশি নয়। মাত্র আটচল্লিশ। তবে তাকে দেখলে মনে হবে তিনি আটাশ বছরের তরতাজা যুবক। খুব স্মার্ট আর বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা তার। অধ্যাপনার পাশাপাশি এতদাঞ্চলে তিনি একজন ছদ্মবেশী প্রাইভেট ডিটেকটিভ। গোয়েন্দাগিরির প্রয়োজনে তিনি সবসময় ছদ্মবেশধারণ করে থাকেন।
তিনি ঢাকার সাভারে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। আর অধ্যাপনাও করছেন ঢাকার মোহাম্মদপুরের একটা কলেজে। শিক্ষকতার সময় তিনি অধ্যাপক লিটু মিয়া আর গোয়েন্দাগিরিতে লালভাই। এজন্য কেউই তার দুটো পরিচয় একসঙ্গে জানে না। ইতোমধ্যে এই কাজে তিনি বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন।
তিনি যখন কোনো ব্যাপারে গোয়েন্দাগিরিতে নিয়োজিত হন তখন তাকে সবাই চেনে শুধু ‘গোয়েন্দা লালভাই’ হিসাবে। তিনি খুব ফর্সা আর সুদর্শন মানুষ। তার আত্মীয় ভাইবোনেরা সবসময় তাকে এই নামেই সম্বোধন করে থাকে। আত্মীয়স্বজনের ভালোবাসায় তিনি ছদ্মবেশী গোয়েন্দা হিসাবে এই নামটি বেছে নিয়েছেন। আজ পর্যন্ত গোয়েন্দাগিরিতে তিনি ফেল করেননি।

খবরটা পড়ে লালভাইয়ের খুব মনখারাপ হয়েছে। আর হয়তো ভাবছেন, একজন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপককে মানুষ কী কারণে খুন করতে পারে? আর তার আপন-ভাগ্নেই বা কেন একজন বয়স্ক মুরুব্বিশ্রেণির আত্মীয়কে খুন করবে? এব্যাপারে তিনি কিছুতেই নিজের মনে কোনো হিসাব মিলাতে পারছেন না। এসব আমি তার মুখ দেখেই বুঝতে পারছি। তিনি দ্বিতীয়বারের মতো খবরটি পড়তে লাগলেন।

লালভাই এখনও একমনে পত্রিকা পড়ছেন। আর হয়তো পুরো ঘটনাটা চোখের সামনে ভিডিও করছেন। কিছুক্ষণ পরে তিনি পত্রিকা পড়া শেষ করে আমার দিকে চেয়ে বললেন, “কীরে সাজিদ, কখন এলি?”
আমি হেসে বললাম, “মিনিট পনেরো আগে এসেছি ভাইজান।”
লালভাই হেসে বললেন, “দেখেছি। এমনি জিজ্ঞাসা করা আরকি!”
আমাদের লালভাই খুব রসিক মানুষ। তিনি ইচ্ছে করে মাঝে-মাঝে এরকম করেন।
লালভাইয়ের মনটা ভালো আছে দেখে আমি খুব আগ্রহভরে বললাম, “ভাই, এই কেসটার একটা তদন্ত করা দরকার। আপনি না হলে তো এর সুষ্ঠু তদন্ত হবে না।”
তিনি আমার দিকে চেয়ে হেসে বললেন, “দেখি, সাহায্যের জন্য কেউ আসে কিনা। তুমি তো জানো, আমি আগবাড়িয়ে কিংবা গায়ে পড়ে কারও উপকার করার চেষ্টা করি না। যদি কেউ আসে তাহলে আমি প্রাণপণে কেসটা নিয়ে লড়তে পারবো।”

কথার একফাঁকে লালভাই আমার দিকে চেয়ে বললেন, “দৈনিক বঙ্গবাণীর নিউজটা তুই একবার পড়তো। আমি মন দিয়ে শুনি।”

আমি খুব খুশি মনে পড়তে লাগলাম: দৈনিক বঙ্গবাণীর বিশেষ সংবাদদাতা। ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, গতকাল আনুমানিক রাত সাড়ে আটটায় মানিকগঞ্জ সরকারি কলেজের ইতিহাসের সাবেক অধ্যাপক আবুল হাসান সরকার নিজ-বাসভবনে আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছেন। রাত সাড়ে আটটায় তার আপনভাগ্নে টাকাপয়সার লেনদেন নিয়ে বচসার একপর্যায়ে অধ্যাপক হাসানকে জবাই করে হত্যা করে। নিহতের ভাগ্নে ও হত্যাকারী আজাদ কালামকে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে। লোমহর্ষক এই খুনের তদন্তভার সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য ধামরাই থানার ওসি গোলাম মওলা যথেষ্ট তৎপরতার সঙ্গে কার্যক্রম চালাচ্ছেন। মরহুমের একমাত্র পুত্র পিতার ওপর রাগ করে দীর্ঘদিন অস্ট্রেলিয়া বসবাস করছেন। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে মনে করে তাকেও সন্দেহ করা হচ্ছে। নিহতের একমাত্র পুত্র প্রবাসী হলেও তার স্ত্রী, এক পুত্র ও এক কন্যা পিতার বাড়িতেই অবস্থান করছে। উল্লেখ্য যে, মরহুম অধ্যাপকের ধামরাইয়ে বিশাল বাড়িসহ ঢাকায় তার একাধিক প্লটও রয়েছে। তদন্তকর্মকর্তা গোলাম মওলা বলেছেন, খুনের মোটিভ ও খুনী শনাক্ত হয়ে যাওয়ায় দুই-তিনদিনের মধ্যে চার্জশিট দেওয়া হবে। প্রয়োজনে মামলাটি দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালে হস্তান্তর করা হবে।...
আমি এই পর্যন্ত পড়তেই লালভাই আমাকে থামতে বললেন।
আমি থামার পর তিনি বললেন, “আর পড়তে হবে না। একটা ক্লু পেয়ে গিয়েছি।”
তদন্তের স্বার্থে আমি এব্যাপারে লালভাইকে কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহস পেলাম না।

আমরা যখন কেসটা নিয়ে লড়ার জন্য কারও একটা অনুরোধের অপেক্ষায় বসে রয়েছি তখনই দেখলাম, আমাদের লালভাইয়ের সাড়াজাগানো অনলাইন গোয়েন্দা-পেইজে একটা মেসেজ এসেছে। আমরা উৎসাহিত হয়ে উঠলাম।
লালভাইয়ের নির্দেশে আমি হুমড়ি খেয়ে মেসেজটা পড়তে লাগলাম:

প্রিয় গোয়েন্দা লালভাই,

শুভেচ্ছাসহ নিবেদন করছি: গতরাতে আমার মামা অধ্যাপক আবুল হাসান সরকার কুচক্রীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন। অথচ, প্রকৃত খুনী ও ষড়যন্ত্রকারীদের আড়াল করতেই আমার আপন বড়ভাই ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আজাদ কালামকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমিও পুলিশের ভয়ে পালিয়ে রয়েছি। আমার যারপরনাই অনুরোধ: আমার নির্দোষ ও নিরপরাধ ভাইটিকে বাঁচানোর জন্য আপনি কেসটা হাতে নিয়ে লড়াই করবেন। সত্যের পক্ষে তদন্ত করবেন। আপনার প্রাপ্য সম্মানী আমরা পরে দিবো। আর-একটা কথা: আপনারা ধামরাই নেমে ডানদিকের একটা রাস্তা ধরে কিছুটা অগ্রসর হলেই দেখবেন সরকারপাড়া। সেখানেই আমার মামা অধ্যাপক আবুল হাসান সরকারের বাড়ি। আর বাড়ির নাম ‘নিঝুম সন্ধ্যা।’ শুভকামনা।

বিনীত নিবেদক
আজাদ রায়হান
মোবাইল: ০১৭২৬ ৩৬৬৮...

আমি মেসেজটা পড়ে শেষ করতেই লালভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুই রেডি তো?”
আমার ভিতরে এখন বিরাট উত্তেজনা। যেন আমরা কোনো যুদ্ধজয়ে যাচ্ছি। প্রতিটি কেসের সময় আমার এরকম হয়। এ-সময় আমি বেশি কথা বলতে পারি না। তাই, আমি শুধু বললাম, “জ্বি।”

লালভাই দ্রুত তার ছদ্মবেশধারণ করে নিলেন। তার জমিদারি গোঁফ ও ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি লাগাতে বেশি সময় লাগেনি।
তিনি দ্রুত সঙ্গে নিলেন তার সবসময়ের সঙ্গী ম্যাগনিফায়িং গ্লাস, শক্তিশালী টর্চ, একটা কাপড়ের ব্যাগে কী যেন পেঁচিয়ে নিলেন, আর ডায়েরি-কলম।
আমরা দ্রুত ধামরাইয়ের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। লালভাই তার এক বন্ধুকে দ্রুত ফোন করে সাভার-বাসস্ট্যান্ডে আসতে বললেন।
আমাদের বাসে যেতে হবে। কারণ, আমাদের লালভাইয়ের কোনো গাড়ি নাই। অনেক কষ্টে এই সাভারে তিনি একটা বাড়ি করেছেন মাত্র।
বাসস্ট্যান্ডে এসে দেখি, লালভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু আতিকুর রহমান তালুকদার ওরফে আতিক তালুকদার দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তিনি আমাদের দেখে একটু দূর থেকেই হাসলেন। তিনি স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, এবং বিশিষ্ট সমাজকর্মী। আমরা একসঙ্গে ধামরাইয়ের একটা গাড়িতে উঠে পড়লাম।
আমাদের তৃতীয় সঙ্গী আতিক তালুকদার ভাই লম্বা-চওড়া দশাসই মানুষ। তার গায়ে প্রচণ্ড শক্তি রয়েছে। বুঝতে পারলাম, লালভাই কাজের জন্যই তাকে সঙ্গে নিয়েছেন। অবশ্য লালভাইয়ের গোয়েন্দাগিরিতে তিনি বেশিরভাগ সময়ই তার সঙ্গে অবস্থান করেন।

বাস থেকে নেমে আমরা একটা ভ্যানে সরকারপাড়ায় চলে এলাম। দেখি, আমরা তিনজন ‘নিঝুম সন্ধ্যা’ নামক বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছি। বিশাল একটা বাড়ি। চারদিকটা দশফুট উঁচু দেওয়ালে ঘেরা। এর গেইটটা খুবই দর্শনীয়। জমিদার-আমলের মতো নকশাখচিত গেইট।
লালভাই সবার আগে। আমরা দুজন একটু পিছনে। গেইটের কাছে আসতেই একজন পুলিশ কনস্টেবল এগিয়ে এসে বললো, “কাকে চাই?”
লালভাই বললেন, “আমি একজন প্রাইভেট গোয়েন্দা। আর এরা আমার সঙ্গী। তদন্তের কাজে ভিতরে যাবো।”
তবুও পুলিশটা কর্কশকণ্ঠে বললো, “ভিতরে যাওয়া নিষেধ।”
লালভাই বললেন, “আমাকে ভিতরে যেতেই হবে। আপনাদের অফিসারকে ফোন করে এখনই আমার কথা জানান।”
এবার দেখলাম, পুলিশটা একটু কাঁচুমাচু হয়ে বললো, “স্যার, আপনার নাম?”
লালভাই বললেন, “গোয়েন্দা লালভাই।”
লোকটা কেমন যেন ভ্যাবাচাকা খেয়ে কিছুক্ষণ আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। শেষে একটু দূরে গিয়ে হয়তো ওসিসাহেবকে ফোন করলো। তারপর এসে গেইট খুলে দিলো।

লালভাইয়ের পিছনে আমরা দুজনও ভিতরে ঢুকলাম। লালভাই পুলিশ কনস্টেবলকে গেইটের পাহারায় রেখে আমাদের দুজনকে সঙ্গে নিয়ে অধ্যাপকসাহেবের বসতবাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন। এটাকে বাড়ি বলা ভুল হবে। রীতিমতো একটা রাজপ্রাসাদ। লালভাই কলিংবেল চাপলেন।

আমাদের আগমনের সংবাদ পেয়ে নিহত অধ্যাপকের পুত্রবধূ কাজের মেয়েটাকে সঙ্গে নিয়ে মেইন গেইটের কাছে এসে বললো, “কাকে চাই?”
লালভাই দ্রুত বললেন, “আমি একজন প্রাইভেট গোয়েন্দা। গতরাতে নিহত অধ্যাপক আবুল হাসান সরকারের মার্ডার-কেসটা নিয়ে তদন্ত করতে এসেছি। প্রথমে আমরা লাশটা দেখতে চাই। তারপর আপনাদের সঙ্গে কথা বলবো।”
মহিলা খুব বিরক্ত হয়ে বললো, “লাশ কোথায়? তাকে তো আজ সকালেই বাড়ির পাশে একটা গোরস্থানে দাফন করা হয়েছে। আর সকালে তার ঘরটাও পরিষ্কারপরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। বুঝতেই পারছেন, মরা-বাড়ি। দুটো ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে আমাকে থাকতে হয়। তাই, ভয়ে সবকিছু সাফ করেছি।”
মহিলার কথা শুনে আমরা যেন আকাশ থেকে পড়লাম। লালভাই বললেন, “এতো রীতিমতো অন্যায়। মামলার চূড়ান্ত তদন্ত হওয়ার আগেই লাশ দাফন করা হয়েছে! আবার হত্যাকাণ্ডের স্থানও ধুয়েমুছে সাফ করা হয়েছে! লাশের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট কোথায়? এভাবে আলামত বিনষ্ট করা বেআইনি। এতো খুনের ওপর খুন!”
মহিলা খুব সাহসের সঙ্গে বললো, “দেখেন, আপনাদের কোনো কথা থাকলে ওসিসাহেবকে বলেন। তিনি সবকিছু ঠিকঠাক করেই লাশ দাফন করেছেন। আর লাশের ময়নাতদন্ত গতরাতেই সম্পন্ন হয়েছে। আর হত্যাকাণ্ডের স্থান এভাবে রেখে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। খুনি হাতেনাতে ধরা পড়েছে। বাড়ির সবাই দেখেছে তাকে খুন করতে। আপনাদের তদন্তের কী প্রয়োজন?”
কথা শেষ করে মহিলা দ্রুত বাড়ির মেইন গেইটটা সশব্দে বন্ধ করে দিলো। আর কোনোপ্রকার ভদ্রতার লেশমাত্র তার মধ্যে ছিল না। আমরা তিনজন প্রচণ্ড হতাশ হয়ে সেখানে আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম।

মহিলাকে অনেক অনুরোধ করা সত্ত্বেও সে সদর দরজা খুললেন না, এবং আমাদের ভিতরেও ঢুকতে দিলো না।
উপায়অন্তর না দেখে লালভাই ওই কনস্টেবলের নিকট থেকে ওসির ফোন-নাম্বার নিয়ে তাকে ফোন করলেন। কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করলেন না।
লালভাই আমাদের দিকে তাকিয়ে কিছুটা চিন্তিতমুখে বললেন, “তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার ফোন রিসিভ করছেন না। এমনটি তো হওয়ার কথা নয়! একজন পুলিশ-অফিসার কেন ইচ্ছাকৃতভাবে ফোন রিসিভ করবেন না! পুলিশদের তো কখনো এমনটি করার কথা নয়! এ-তো রীতিমতো বেআদবি আর ধৃষ্টতা। দেশের কোনো আইনশৃঙ্খলা-রক্ষাবাহিনীর নিকট থেকে এমন অদ্ভুত আচরণ কারও কাছে প্রত্যাশিত নয়। এখানে, কোনো ঘাপলা আছে মনে হয়। কেসটা মনে হচ্ছে আমাদের ভোগাবে। এই খুন-ঘটনার একেবারে গভীরে ঢুকতে হবে। প্রথমে এটাকে যত সহজ কেস মনে করেছিলাম, আসলে তা নয়।”
লালভাই এখন কেসটা নিয়ে খুব মাথা ঘামাচ্ছেন। তাই, আমরা কেউ কোনো কথা বলছি না। তিনি ‘নিঝুম সন্ধ্যা’ মঞ্জিলের সামনে আরও কিছুক্ষণ একাকী পায়চারী করে শেষে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “চলো, আজকে আমরা ফিরে যাই। প্রথম দিনে ওদের সঙ্গে কোনো ঠোকাঠুকিতে যাওয়া ঠিক হবে না। চলো, বাসায় ফিরে একটা সুবুদ্ধি বের করতে হবে।”

লালভাই হাঁটতে লাগলেন। আর আমরা দুজন তার অনুগামী হলাম।

‘সন্ধ্যা-মঞ্জিলে’র বাইরে এসে আমরা বাসায় ফেরার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠিনি। লালভাইয়ের হাবভাব দেখে বুঝতে পারলাম, তিনি আরও কিছুটা সময় এর আশেপাশে থাকতে চাচ্ছেন। তার ইশারায় আমরা সরকারপাড়া পেরিয়ে পাকা-রাস্তা ধরে আরেকটু ভিতরের দিকে হাঁটতে লাগলাম। এদিকটা একেবারে গ্রামের মতো। কিন্তু খুব উন্নত গ্রাম। ইউরোপের আধুনিক গ্রামগুলোর মতো এর সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। বাংলার গ্রাম এখন আর অবহেলিত নয়। এর আশেপাশের সবজায়গায় ইলেকট্রিসিটি রয়েছে। এদিকটায় ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে আরেক শহর। দেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার গ্রামউন্নয়নে খুব আগ্রহী ও মনোযোগী।
কিছুদূর হেঁটে লালভাইয়ের নির্দেশে একজায়গায় আমরা থামলাম। দেখি রাস্তার ডানদিকে বিশাল এক গোরস্থান। এর গেইট খোলাই ছিল। গেইটের উপরে বড়-বড় হরফে বাংলায় লেখা: সরকারপাড়া কবরস্থান।
লালভাই এর ভিতরে ঢুকতে আমাদের ইঙ্গিত করলেন। তিনি সবার আগে। আর আমরা তার পিছনে।
একটা নতুন কাঁচামাটির কবর দেখে তিনি থামলেন। আমরা তার সঙ্গে সেখানে দাঁড়িয়ে পড়লাম।
লালভাই আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এটাই মনে হয় নিহত অধ্যাপকসাহেবের কবর।”
আতিক তালুকদার ভাই বললেন, “আমারও তা-ই মনে হচ্ছে। কবরটা একেবারে নতুন। খুব তাজা।”
লালভাই তার কাজে নেমে পড়লেন। তিনি এই কবরের আশেপাশে খুব মনোযোগ দিয়ে সবকিছু দেখতে লাগলেন। কয়েক জায়গায় থমকে দাঁড়ালেন। শেষে আমাদের দিকে চেয়ে বললেন, “কিছু কি দেখতে পাচ্ছো? এখানে, পুলিশের বুটের ছাপ রয়েছে। পুলিশের তত্ত্বাবধানেই লোকটাকে কবর দেওয়া হয়েছে। আর সমস্ত আলামত নষ্ট করা হয়েছে। আর কবরস্থানে সাধারণ মানুষের পায়ের ছাপ খুব কম! হয়তো এলাকাবাসীকে এখানে আসতে দেওয়া হয়নি। এখানে, পুলিশ একটা গেম খেলছে।”
লালভাই কবরের আশেপাশে আরও কিছু খুঁজছেন। এই সুযোগে আতিক তালুকদার ভাই কবরের পিছনে একটা ঝোপের দিকে হাঁটতে লাগলেন। এই জায়গাটা বড়সড় ঝোপঝাড়ে পরিপূর্ণ। মনে হয়, এখানে পুরাতন কোনো কবর ছিল। বড় অযত্নে তাই এখানে বেড়ে উঠেছে আগাছা-পরগাছার ঘন জঙ্গল।

আমি লালভাইয়ের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিলাম। তার সঙ্গে থাকতেই আমার ভালো লাগে। এমন সময় আতিক ভাই চিৎকার করে উঠলেন, “অধ্যাপক এদিকে একবার আসো তো। দেখে যাও, এটা কী জিনিস!”
আতিক ভাইয়ের চিৎকার শুনে লালভাই পড়িমড়ি করে সেদিকে ছুটতে লাগলেন। আর প্রবল একটা উত্তেজনায় আমিও ছুটছি তার পিছনে।


(চলবে)


সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
১৬/০১/২০১৯

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ৮:৩২

রাজীব নুর বলেছেন: খুব সুন্দর।
লাল ভাইকে লাল সালাম।

০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ৮:২৯

সাইয়িদ রফিকুল হক বলেছেন: আপনি পড়েছেন, এজন্য কৃতজ্ঞ।

অনেক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা আপনাকে।
আর শুভকামনা।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.