নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি মানুষ। আমি ত্বরীকতপন্থী-মুসলমান। আমি মানুষ বলে আমার ভুলত্রুটি হতেই পারে। বইপড়তে আমার ভালো লাগে। সাহিত্য ভালোবাসি। লেখালেখি আমার খুব শখের বিষয়। বাংলাদেশরাষ্ট্র ও গণমানুষের জন্য আমি লেখনিশক্তিধারণ করেছি।

সাইয়িদ রফিকুল হক

আমি লিখি “দেশ, জাতি, মানুষ আর মানবতার” জন্য। আমার লেখা কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও সমালোচনা আমার নিজস্ব ও মৌলিক রচনা। তাই, আমার অনুমতি ব্যতিরেকে এগুলো কপি বা নকল করা আইনতঃ দণ্ডনীয় অপরাধ। পৃথিবীর সকল মানুষের প্রতি আমার ভালোবাসা। জয় মানবের জয়।

সাইয়িদ রফিকুল হক › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প: মহাভিক্ষুক

০৭ ই আগস্ট, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:৫৩



গল্প:
মহাভিক্ষুক

সাইয়িদ রফিকুল হক

কলেজের ক্লাস শেষ করে নাহিদ সাহেব খুব তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরছিলেন। এমন সময় তিনি শ্যামলী-ওভারব্রিজের ওপর এক আজব-প্রকৃতির ভিক্ষুকের দেখা পেলেন। লোকটাকে দেখলে প্রথমে কারও ভিক্ষুক মনে হবে না। কিন্তু তিনি একটা অভিনব-কায়দায় যেন ভিক্ষা করছেন! অবশ্য এটাকে ভিক্ষা না বলে অন্যকিছুও বলা যায়। কিন্তু নাহিদ সাহেব যে দেখলেন, লোকটা ভদ্রবেশী ভিক্ষুকের মতো লোকের কাছে টাকা চাইছেন! তবে তিনি সাধারণ ভিক্ষুকের মতো নীরস ও লোভীদৃষ্টিতে কারও দিকে তাকান না। তার মধ্যে কেমন যেন সম্ভ্রম জাগানো মার্জিত একটা ভাব রয়েছে।

অল্প সময়ের মধ্যে নাহিদ সাহেব বুঝতে পারলেন, লোকটা কারও কাছে ঠিক ভিক্ষুকের মতো ভিক্ষা চান না। তার আশপাশ দিয়ে কোনো লোক হেঁটে গেলে তিনি প্রথমে তাদের সালাম দেন। এতে কেউ সালামের জবাব দিলে তিনি তার উদ্দেশ্যে খুব সুন্দর করে হেসে বলেন, “আপনার কাছে মাত্র দশটি টাকা হবে?”
তার কথা শুনে প্রথমে যেকোনো লোক থমকে যেতে পারে কিংবা অনেকে আবার এটাকে পাত্তা নাও দিতে পারেন। কারণ, এই শহরে অনেকে এটাকে ভিক্ষার আধুনিক কৌশল মনে করে তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন। কিন্তু কারও-কারও কাছে এটা আবার আচমকা একটা ভাবনা-ঢিল ছুঁড়ে মারার মতো। তাই, এরা একটুখানি তার দিকে ফিরে তাকান। আর কোনোরকম প্রশ্ন না করে দশটি টাকা লোকটার হাতে গুঁজে দিয়ে নীরবে হেঁটে চলে যান।

লোকটার মধ্যে কোনোপ্রকার জড়তা বা লজ্জা নাই। তিনি খুব স্বাভাবিকভাবে আপনজনের মতো করে লোকজনের কাছে বারবার এই প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেন। এতে অনেকে একটুখানি থমকে দাঁড়ান। লোকটাকে টাকা না-দিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করেন। এরা কী ভাবেন কে জানে? কিন্তু অনেকে তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে যে টাকা দিচ্ছেন—তা নাহিদ সাহেব দেখতে পেলেন।
একটু আগে নাহিদ সাহেবও দ্রুত হেঁটে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ লোকটার এই প্রশ্ন শুনে আর সবার মতো তিনিও থমকে দাঁড়ালেন। তারপর লোকটার বেশভূষা দেখে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তার কাছে গিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে বললেন, “দশ টাকা দিয়ে আপনি কী করবেন?”
এবার ষাটোর্ধ্ব লোকটা খানিকক্ষণ কী যেন ভেবেচিন্তে খুব কাঁচুমাচুভঙ্গিতে বললেন, “একটা কাজ আছে। আমার নিজের জন্য নয়, সমাজের কাজে টাকাটা ব্যয় করবো। এতে সবার মঙ্গল হবে।”
লোকটা আপাততঃ এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে রাজী হলেন না। এটা দেখে নাহিদ সাহেব তাকে আর কোনো প্রশ্ন করলেন না। কিন্তু তার কথাটা শুনে নাহিদ সাহেবের যেন মাথাটা ঘুরে গেল! আজব ব্যাপার তো! মানুষের কাছে টাকা চেয়ে কেউ সমাজের কাজ করে নাকি! তিনি খুব অবাক হলেন। শেষমেশ আর কোনো প্রশ্ন না করে লোকটার হাতে দশ টাকার একটা নোট গুঁজে দিলেন। কিন্তু তিনি সটকে পড়লেন না। লোকটার সঙ্গে তিনি কথা বলতে চান। তিনি জানতে চান, তার কী এমন সামাজিক কাজ?

আজ তার বাসায় ফেরাটা এত জরুরি নয়। খানিকটা পরে গেলেও এমন কোনো অসুবিধা হবে না। তিনি বিস্মিত হয়ে লোকটার কার্যকলাপ দেখছেন। তার ভদ্রোচিত ব্যবহারে অনেকেই দশ টাকা দিচ্ছে। আবার কেউ টাকা বেশি দিতে চাইলেও তিনি নিচ্ছেন না। শুধু দশ টাকা নিচ্ছেন। এসব ব্যাপার লোকটাসম্পর্কে নাহিদ সাহেবকে আরও কৌতূহলী করে তুললো। তিনি এই রহস্যভেদ না করে আজ ছাড়বেন না। এটা তার জীবনের অন্যতম একটা বিস্ময়কর ঘটনা। এই শহরে তিনি এমন একটা আজব ব্যাপার খুব কমই দেখেছেন। ধাপ্পাবাজির সমাজে লোকের কাছে টাকা চেয়ে কেউ সমাজের মঙ্গল করতে পারে—তা কিছুতেই তার বিশ্বাস হচ্ছিলো না। আবার তিনি লোকটাকে কিছুতেই অবিশ্বাসও করতে পারছিলেন না। উভয়ক্ষেত্রে কেমন যেন একটা অদ্ভুত ভালোলাগা রয়েছে। একসময় তিনি লোকটাকে বিশ্বাস করলেন। এই শহরে কত মানুষকে তিনি বিশ্বাস করে ঠকেছেন। আজ না-হয় আরেকটা মানুষকে বিশ্বাস করে ঠকবেন। তবুও তিনি লোকটাকে অবিশ্বাস করবেন না।
নাহিদ সাহেব একটু আড়ালে ঘণ্টাখানেক দাঁড়িয়ে রইলেন। তিনি একটু ফাঁক পেলে লোকটার সঙ্গে আলাপ জমাবেন।

লোকটা ভালোই পসার জমিয়েছেন। অনেকেই খুশি হয়ে তাকে দশ টাকা দিচ্ছেন। নাহিদ সাহেব এবার লোকটার কাছে এগিয়ে গিয়ে তাকে আবার দশটি টাকা দিলেন।
এতে লোকটা তার দিকে চেয়ে মোলায়েম হাসিতে বললেন, “আপনি আবার দিলেন স্যার!” তারপর একটু থেমে লোকটা বললেন, “আপনি বুঝি আমার সঙ্গে কথা বলতে চান?”
এতে নাহিদ সাহেব উৎসাহিত হয়ে বললেন, “জ্বি, আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।” এসময় নাহিদ সাহেব আরও লক্ষ্য করলেন, তার মনের অজান্তেই তিনি যেন লোকটাকে সম্ভ্রমের চোখে দেখতে শুরু করেছেন। এটাও তার কাছে কম বিস্ময়কর মনে হলো না। তার আরও মনে হলো, লোকটার ওপর মহান আল্লাহর খাস রহমত রয়েছে।
লোকটা নাহিদ সাহেবের কথা শুনে খুব সুন্দর করে হেসে বললেন, “আপনি আর-একটু দাঁড়ালে আমার কাজ আজকের মতো শেষ হবে। তখন দু’জনে কোথাও বসে একসঙ্গে কথা বলতে পারবো।”
একথা শুনে নাহিদ সাহেব তাকে বললেন, “আপনি নিজের কাজ করুন। আমার কোনো তাড়াহুড়া নাই। আমি অনেক সময় দাঁড়াতে পারবো।”
আরও খানিকটা পরে আশেপাশের মসজিদ থেকে জোহরের নামাজের আজান ভেসে আসতে লাগলো। এবার লোকটা উঠে পড়লেন। আর নাহিদ সাহেবকে ইঙ্গিত করে বললেন, “আপনি আমার সঙ্গে আসেন।”

নাহিদ সাহেব কোনো কথা না বলে লোকটার পিছনে হাঁটতে লাগলেন। কয়েক মিনিট হাঁটার পরে লোকটা শ্যামলী শাহী মসজিদের বারান্দায় এসে বসলেন। তারপর কোনোরকম ভূমিকা না করে বলতে শুরু করলেন:

“আমার বাড়ি উত্তরবঙ্গের শেষ-জনপদে। আশা করি, চিনতে পেরেছেন? আমি শহরে খুব একটা আসি না। চাকরি করতাম সরকারি প্রাইমারি স্কুলে। বছরখানেক হলো অবসরগ্রহণ করেছি। আমার দুই ছেলে ও এক মেয়ে আছে। ওদের ভালো জায়গায় বিয়ে ও চাকরি দিয়েছি। ওরা বেশ সুখেশান্তিতে আছে। কিন্তু আমাদের গ্রামের বেশিরভাগ মানুষই বড় গরিব। তাদের অনেককিছু নাই। আজকাল গ্রামে কিংবা পাড়ায়-পাড়ায় ইন্টারনেট-সেবা-সেন্টার বা ভিডিও-ক্লাব গড়ে উঠেছে। কিন্তু সেই তুলনায় কোনো লাইব্রেরি বা পাঠাগার গড়ে উঠছে না। কিন্তু আমি দেখেছি, অনেকের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ভালো-ভালো বই পড়তে পারছে না। আমি জানি, একটা ভালো বই যেকোনো মানুষকে বদলে দিতে পারে। তাই, আমি আমার থানার মানুষকে নিয়মিত বই কিনে দেই। আর তাদের বইপাঠে উৎসাহিত করছি। কিন্তু এতদিন আমি চাকরি করতাম। তাই, কাজটা মোটামুটি করতে পারতাম। কিন্তু এখন আমার চাকরি না থাকায় পেনশনের সামান্য টাকা দিয়ে এই কাজটা আর করতে পারছি না। নিজের ছেলেমেয়ের কাছ থেকেও কিছু সাহায্য নিয়েছি। কিন্তু আরও টাকার প্রয়োজন। তাই, আমি যেখানে যখন বেড়াতে যাই সেখানে মানুষের কাছ থেকে কিছু টাকা চেয়ে নিয়ে গরিব মানুষকে বই কিনে দেই। আর এখন টাকা সংগ্রহ করছি একটি আধুনিক পাঠাগারের জন্য। কাজটি অনেকদূর গড়িয়েছে। আমাদের থানায় বড় একটি পাঠাগার হলে এলাকার সব মানুষ উপকৃত হবে। আমি মনে করি, এই ডিজিটাল-যুগেও মানুষের কাগজের বই পড়া জরুরি। এগুলো হলো মানুষের আত্মার প্রধান খাদ্য। আর এই কাজটি করার জন্য আমি এই ভিক্ষাবৃত্তির পথ বেছে নিয়েছি। আমার এই কাজকে লোকে খারাপ ভাবলেও তা আমাকে করতেই হবে। আমাদের অন্ধকারাচ্ছন্ন গ্রামে একটা আলোকিত পাঠাগার চাই। বাংলাদেশের অন্তত একটি গ্রামে জ্বেলে দিতে চাই চিরস্থায়ী জ্ঞানের মশাল। মানুষ আবার বই পড়বে, বই কিনবে, আর বই পড়তে শিখবে। মানুষের মধ্যে আবার জাগবে দেশপ্রেম, মনুষ্যত্ব ও মানবতা। ইনশা আল্লাহ, এভাবে একদিন গড়ে উঠবে সোনার বাংলাদেশ।”

লোকটা যেন একনিঃশ্বাসে এত কথা বলে একটু থামলেন। তার মুখে এখনও আগের মতো সেই সুন্দর হাসি! সেখানে কোনো অবিশ্বাস ও কৃত্রিমতার কোনো বালাই নাই। সেখানে শুধু আত্মতৃপ্তি ও প্রশান্তির ছাপ। আর শ্রদ্ধা-জাগানো মনুষ্যত্বের বিরাট চিহ্ন।

নাহিদ সাহেব কী বলবেন তা যেন তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। সব শুনে তিনি যেন একেবারে বাকরুদ্ধ। তিনি মুগ্ধতার চোখে লোকটার দিকে আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। শেষে খুব ভক্তিভরে বলে উঠলেন, “আপনি অনেক বড়মাপের একজন মানুষ স্যার। আপনি আমার চেয়েও অনেক বড়। আমাদের চেয়ে অনেক বেশি যোগ্য।”
কথা শেষ করে তিনি পকেট থেকে চারখানা পাঁচশ’ টাকার নোট লোকটার হাতে গুঁজে দিলেন। তারপর বললেন, “আপনার নামটি জানতে পারি?”
লোকটা এবার নিজের জিভে কামড় দিয়ে বললেন, “আমার নাম বলতে ভুলে গিয়েছি। আমার নাম সুলতান মাহমুদ। খুব সাধারণ একজন মানুষ আমি। তাই, সবার কাছে সহজে আমার নাম বলি না।”

আবার সেই বিনীত হাসি!

নাহিদ সাহেব এবার উঠে পড়লেন। তিনি আবার বাসার দিকে হাঁটতে লাগলেন। একটা সময় তার মনে হলো, মাহমুদ সাহেব সাধারণ কোনো ভিক্ষুক নন। তিনি কখনো ভিক্ষুক নন। তিনি হলেন সমাজের মহাভিক্ষুক। এঁরাই সত্যিকারের মানুষগড়ার কারিগর। এঁরাই জাতির নমস্য। শ্রদ্ধা এঁদের জন্য। মানুষের মঙ্গলের জন্য এঁরা নিজেকে সমাজের চোখে ছোট করতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেননি। কী মহৎপ্রাণ এঁদের!


সাইয়িদ রফিকুল হক
১১/০১/২০১৯

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ০৭ ই আগস্ট, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৫৭

চাঁদগাজী বলেছেন:



আমাকে ঢাকাতে ভিক্ষার অভিজ্ঞতা নেয়ার দরকার।

০৭ ই আগস্ট, ২০২০ রাত ১০:৫৬

সাইয়িদ রফিকুল হক বলেছেন: ঢাকায় অনেকরকম ভিক্ষুক আছে।
তবে মহাভিক্ষুক একেবারে নগণ্য।

অশেষ ধন্যবাদ আপনাকে।
শুভেচ্ছা নিরন্তর।

২| ০৭ ই আগস্ট, ২০২০ রাত ৮:২৮

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: অসাধারণ একটা গল্প।

০৭ ই আগস্ট, ২০২০ রাত ১০:০৭

সাইয়িদ রফিকুল হক বলেছেন: অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া।

পাশে থাকায় কৃতজ্ঞ।
অশেষ শুভকামনা।
আর শুভেচ্ছা নিরন্তর। ;)

৩| ০৭ ই আগস্ট, ২০২০ রাত ৯:১৪

শেরজা তপন বলেছেন: দুর্দান্ত ! @ সোনাবীজ ভাই বলেছেন অসাধারন গল্প।
কাহিনী ও লেখার মধ্যে কি যেন একটা বিষয় আছে যা আমকে বেশ খনিকটা আবেগী করে ফেলল। এইসব মহান মানুষের হাত ধরেই এগুবে বাংলাদেশ

১০ ই আগস্ট, ২০২০ সকাল ১০:০২

সাইয়িদ রফিকুল হক বলেছেন: অনেক সুন্দর বলেছেন।
সময়মতো উত্তর না দেওয়ার জন্য দুঃখিত।

আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ আর শুভেচ্ছা।

৪| ০৭ ই আগস্ট, ২০২০ রাত ১১:৩৫

রাজীব নুর বলেছেন: গল্প ভালো লাগলো।
আকর্ষন করার মতো উপাদান যথেষ্ঠ আছে।

০৮ ই আগস্ট, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:৩০

সাইয়িদ রফিকুল হক বলেছেন: আপনার ভালো লাগায় আনন্দিত। ;)

অশেষ ধন্যবাদ আপনাকে।
আর শুভেচ্ছাসহ শুভকামনা।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.