![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
তখন আমি ক্লাশ টেনে পড়তাম। খুব দূরন্তপনার বয়স ছিল সেটা। দূরন্তপনার মধ্যে সবচাইতে বেশি যে কাজটা করতে পছন্দ করতাম, স্কুলের টিফিন পিরিয়ডে বা ফাঁকি দিয়ে প্রায়ই দল বেঁধে সাইকেল নিয়ে এখানে-ওখানে ঘুড়ে বেড়াতে। সে সময়টাতে কত জায়গায় যে ঘুড়ে বেড়িয়েছি, তার কোন ইয়াত্তা নেই।
এমনই একদিন টিফিন পিরিয়ডে সাইকেল নিয়ে আমাদের পাশের এলাকায় ঘুড়তে যাই। সেখান থেকে ফেরার পথে একটা হাই স্কুল পরে। আমরা যখন সে পথ ধরে ফিরছিলাম, সে স্কুলের এক মেয়ে আমাদের ভেংচি কাটে। আমি সে দিকে তাকানোর জন্য যখন সাইকেলটা একটু স্লো করি, তখন আমার পিছনে থাকা বন্ধুর সাইকেলটা আমাকে ধাক্কা দেয় আর আমরা দু'জনই পরে গিয়ে খুব ব্যাথা পাই। মেয়েটা তা দেখে এক ভৌ-দৌড় দিয়ে স্কুলের ভিতরে চলে যায়।
তার কিছুদিন পর আবার সে দিকে ঘুড়তে যাই। ফেরার পথে সেদিনও সেই মেয়েটার সাথে দেখা হয়। তবে সেদিন আর ভেংচি কাটা মুখে নয়, হাত দিয়ে ইশারা দেয় সাইকেল থামানোর জন্য। ভেবেছিলাম সেদিনের ঘটনার জন্য মেয়েটাকে ইচ্ছেমত বকবো, কিন্তু আমাদের অবাক করে দিয়ে সাইকেল থামিয়ে কাছে যাওয়ার পর মেয়েটা সেদিনের ঘটনার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে, খুব বিনম্র ভাবে মাথা নিঁচু করে ক্ষমা চেয়েছিল মেয়েটি। লজ্জাবনত সে মুখ দেখে আর বকা দেয়ার ইচ্ছে জাগে নি। তখন তার নাম জিজ্ঞেস করার পর বলল জান্নাত, ক্লাশ এইটে পড়ে।
সেদিন থেকেই মেয়েটার প্রতি যেন কি এক আকর্ষণ বোধ করতাম। প্রায়ই ওদের স্কুলের সামনে যেতাম। মাঝে মাঝে দেখা হতো, কেমন আছো, লেখাপড়ার কি খবর টুকটাক কথা হতো। এভাবে কয়েকদিনের মধ্যে আমাদের মাঝে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। তারপর থেকে প্রায় প্রতিদিন টিফিনে ওদের স্কুলের সামনে যেতাম, কথা বলতাম।
এভাবে চলতে চলতে একটা সময় আমরা দু'জন দু'জনের বেস্ট ফ্রেন্ডে বলতে গেলে তার চাইতেও বেশি কিছু হয়ে যাই। এক জন আরেক জনকে না দেখলে যেন একদিনও থাকতে পারতাম না।
আমার স্কুল ছিল এক শিফটের। তাই ছুটি দিত ৪ টা বাজে আর জান্নাতের স্কুল দু'শিফটের হওয়ার কারনে ছুটি হতো ৫ টায়। ছুটির পর প্রাইভেট পড়ে বাসায় না গিয়ে সাইকেল নিয়ে জান্নাতের স্কুলে চলে যেতাম। তারপর দু'জন একসাথে পায়ে হেঁটে গল্প করতে করতে ওকে ওর বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে তারপর আমি বাসায় ফিরতাম। ওদের স্কুলের খুব কাছেই নদী ছিলো। মাঝে মাঝে ছুটির পর বাসায় না ফিরে দু'জন নদীর পাড়ে বসে গল্প করতাম তারপর সূর্য যখন দিগন্ত রেখা ছুঁই ছুঁই করতো, তখন বাসায় ফিরতাম।
জান্নাত বেলী ফুল খুব পছন্দ করতো। কিন্তু ওদের নিজেদের কোন বেলী ফুল গাছ ছিলো না। একদিন ও পাশের বাসার গাছ থেকে ফুল চুরি করতে যায় আমাকে মালা গেঁথে দেয়ার জন্য। কিন্তু ফুল চুরির সময় পাশের বাড়ির আন্টি ওকে দেখে ফেলে খুব বকাঝকা করে। ও আমাকে সেই ঘটনা বলছিল আর ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছিল। ওর চোখের চল মুঁছে দিয়ে বলেছিলাম "কাল তোমাকে একটা বেলী চারা এনে দিবো, তুমি তখন নিজের গাছের ফুল দিয়ে আমাকে মালা গেথে দিও"। একথা শুনে ওর মুখে অদ্ভুত সুন্দর এক হাসি ফুঁটে ওঠে আর তারপর আমার গাল টানতে থাকে, যেটা ও খুশি হলে সব সময় করতো।
পরদিন বিকেলে ওর সাথে দেখা করতে যাওয়ার সময় নার্সারি থেকে একটা বেলী ফুল চারা কিনি। জানতাম ও খুব খুশি হবে। মনের মধ্যে বারবার তখন ওর সেই হাস্যেজ্জল মুখটাই ভেসে উঠছিল। ভাবতে ভাবতে এক হাতে সাইকেল চালাচ্ছিলাম, অন্য হাতে ওর জন্য কেনা যত্নের সে বেলী চারা। কিছুতে যেন দেরী সইতে পারছিলাম না। তাই খুব তাড়াহুড়ো করে যাচ্ছিলাম।
হঠাৎ করেই সব ভাবনা যেন কোথায় মিলিয়ে গেল। সব কিছু যেন মূহুর্তেই অদৃশ্য হয়ে গেল। তারপর আবার ক্ষণিকের জন্য দৃশ্যমান হলো। কি হলো কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখি সাদা শার্টটা লাল হয়ে গিয়েছে, রাস্তা থেকে ছিটকে পাশে চলে এসেছি, সাইকেলটা দুমড়ে-মুচড়ে অনেক দূরে পরে আছে, আর বেলী চারাটা রাস্তার অপর পাশে গড়াগড়ি খাচ্ছে। তারপর আর কিছুই জানি না।
যতদূর মনে পরে, ১২ দিন পর যখন জ্ঞান ফিরে, আমি তখন প্রথম সেই বেলী চারাটাই খুঁজেছিলাম। কিন্তু ক্ষণিক পরে সম্বিত ফিরে পেলাম। আশপাশের পরিবেশ, আর মাথায়, হাতে আর বুকের বাম পাশে ব্যান্ডেজ দেখে মনে পড়লো আমার সাথে এর মাঝে কি হয়েছে। জান্নাত দেখতে আসেনি জিজ্ঞেস করতে সবাই চুপ হয়ে গেল। সবাই চুপ কেন চিৎকার করে জিজ্ঞেস করতেও কেউ উত্তর দিচ্ছিল না। জোড় করে হাসপাতালের বেড ছেড়ে যখন উঠে যাবো, যা শুনলাম তা আমায় দ্বিতীয় বারের মত অজ্ঞান করে দিলো।
আমার এক্সিডেন্টের খবর জান্নাতের কানে পৌঁছানোর সাথে সাথে ও হাসপাতালে আসে। আমি এতটা গুরুতর ভাবে আহত ছিলাম যে, ডাক্তারেরা বলে দিয়েছিলেন আমি হয়তো আর বাঁচবো না। সে কথাটা জান্নাতের কানেও চলে যায়। আর তারপর বিন্দুমাত্র দেরী করে ও হাসপাতালের ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করে।
আত্মহত্যা করার আগে ও একটা চিরকুট রেখে যায়। তাতে লেখা ছিলো। "সব সময় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকতাম, কখন আসবে তুমি। আজ কেন তুমি আমার আগে চলে গিয়ে আমার অপেক্ষায় থাকবে? তার চাইতে আমিই আগে চলে যাচ্ছি, জানি তুমি আসবে। অপেক্ষায় থাকবো"।
আজ আমি আর সাইকেল চালাই না, স্কুল থেকে যখন ছেলে গুলো সাইকেল নিয়ে বের হয়, দৌড়ে গিয়ে বলি "বেলী চারা নিয়েছ, বেলী চারা? নিয়ে যেও কিন্তু। ও তোমার অপেক্ষায় থাকবে"। ওদের কেউ কেউ আমায় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়! তুচ্ছ-তাচ্ছল্য করে, হাসাহাসি করে। কারন, আমি যে আজ একটা বদ্ধ পাগল...
(এ গল্পটা লেখার পিছে কোন শিক্ষামূলক উদ্দ্যশ্যে ছিল না। তবে লেখা শেষ করে যখন নিজেই নিজের গল্প পড়ছিলাম, তখন একটা শিক্ষনীয় বিষয় পেলাম।
জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না। এ জীবন অনেক মূল্যবান, একবার গেলে আর কখনও ফিরে আসবে না। জান্নাত আমার জন্য আত্মহত্যা করলেও আমি কিন্তু আত্মহত্যা করার সুযোগ পাইনি। কারন জান্নাতের মৃত্যু সংবাদ আমার সব কিছুকে বিস্মৃত করে দেয়। আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখো, প্রার্থনা করো, সে নিশ্চয়ই তোমাকে তোমার সেরাটা দিবেন। তবে সে জন্য তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে। আত্মহত্যা কোন সমাধানের পথ নয়। সেদিন যদি জান্নাত আত্মহত্যা না করতো, তবে আজও আমরা হাত ধরে পথ চলতে পারতাম।)
©somewhere in net ltd.
১|
৩০ শে মে, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:৪৭
এইচ এম শরীফ উল্লাহ বলেছেন: গল্প সুন্দর হয়েছে।
আরও ভালোলেগেছে
শিক্ষণীয় শেষ কথা।