নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

খোট্টার মা, খোট্টি!

দ্যা গার্ল ইন ব্লু গ্লাসেস

আমি কাঠখোট্টা অসামাজিক একটা মানুষ। কথা বলার মতো বিরক্তিকর কাজ দ্বিতীয়টা নেই, তাই লেখালেখি বেছে নিয়েছি। বর্তমানে পড়াশোনা করছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগে।

দ্যা গার্ল ইন ব্লু গ্লাসেস › বিস্তারিত পোস্টঃ

ওলটপালট স্বপ্ন

৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৪:৩৫


আমি ভয়ঙ্কর কিছু স্বপ্ন দেখি। দুঃস্বপ্নগুলো দেখার পরপরই আমি আমার ডায়েরীতে লিখে রাখি। ডায়েরীর হিসাব বলে, দুঃস্বপ্নগুলো পুরনো। গত সাত-আট বছর ধরে চক্রাকারে একইধরনের এই স্বপ্নগুলো আমি বেশ কয়েকবার দেখেছি। এগুলো বাদে আমার অন্য স্বপ্নগুলো আমার মতই অত্যন্ত বেরসিক এবং সাদাকালো। ক্ষেত্রবিশেষে বস্তুবাচক ছেলেমানুষি (নাকি মেয়েমানুষি?) স্বপ্ন দেখা হয় বটে, এই যেমন অত্যন্ত পছন্দের একজনকে পরিবারের মতের উপেক্ষা করে বিয়ে করলাম, কিন্তু বিয়ের পর দেখা গেল সে আমাকে অলীক স্বপ্ন দেখিয়েছে- আদতে সে দুনম্বরি ব্যবসা করে কালোটাকার পাহাড় গড়া ও চারিত্রিক দিক থেকে কর্পদকহীন একজন পুরুষ কিংবা ধরেবেন্ধে ষাট বছরের এক জমিদারগোছের বুড়োর সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দেওয়া হলো, সে আমাকে নিয়ে চন্দ্রকথা সিনেমায় শাওনের মতো সিঁড়ি বসানো দামী পালঙ্কে শুয়ে থাকে, অবাধ্যতা করলে সুপোরি কাটার যন্ত্র দিয়ে পট করে আমার আঙ্গুল কেটে দেয় ইত্যাদি। কিন্তু এগুলো নিতান্তই নিরীহ স্বপ্ন।

"বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে" এসমাজে এরকম লেবেল পাওয়া নারী মাত্রই এধরনের স্বপ্ন/দুঃস্বপ্ন দেখবে। কাজেই হঠাৎ হঠাৎ যখন সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে টাইপের ভয়ংকর স্বপ্ন দেখি, তখন অত্যন্ত বিচলিত বোধ করি এবং স্বপ্নগুলোর মধ্যে অনাগত ভবিষ্যতের ব্যপারে কোনো বার্তা আছে কিনা, তা ভেবে ভেবে দুশ্চিন্ত হই। আমি জানি একজন শিক্ষিতা হয়ে এরকম গাঁজাখুরি হলিউডি স্টাইল স্বপ্ন দেখে তার মনগড়া অবৈজ্ঞানিক তরজমা করা ও সেই তরজমায় বিশ্বাস করাটা আমার একটা হিপোক্রেসি; কিন্তু মন থেকে অস্থিরতাটা কেন যেন যায়না। অস্থির মন বিজ্ঞান বুঝতে চায়না।
নিচে আমার রেগুলা কাস্টমার স্বপ্নগুলোর মধ্য থেকে কয়েকটি ডায়েরী থেকে উদ্ধৃত করলামঃ

"আমি যেই বিশাল বহুতল অট্টালিকায় কাজ করছি, সেটা হঠাতই ভয়ংকরভাবে কেঁপে উঠল। মানুষজন দৌড়ে নিচে নামা শুরু করল- এতো বড় বিল্ডিং, কয়েকটি এলিভেটর ও লিফট আছে, কিন্তু সেগুলোর সবগুলোতে ভিড় হয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে। মানুষ নিজের জীবন বাঁচানোর আদিম তাগিদে আরেকজনকে ধাক্কিয়ে ফেলে পায়ের নিচে পিষতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করছেনা। আমি পরিচিত দুজন ছেলেকে নিয়ে বহু কষ্টে একটা লিফটে উঠতে পারলাম- কিন্তু লিফটটা নিচে নামার সময় হঠাৎ তার ছিড়ে প্রচণ্ড গতিতে নামতে শুরু করে। আমি হাটু গেঁড়ে লিফটের ফ্লোরে বসে পড়ি আর আমার সঙ্গীরা লিফটের দেয়ালগুলো ধরে আতঙ্কিত হয়ে অপেক্ষা করতে থাকে নিশ্চিত মৃত্যুর জন্য। কিন্তু লিফটটা হুট করে থেমে যায়-সেই ধাক্কায় সেকেন্ডকয়েকের জন্য আমরা সবাই শুন্যে উঠে যাই। তারপর আবার মাধ্যাকর্ষণের টানে লিফটের ফ্লোরে হুমড়ি খেয়ে পড়ি। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, থেঁৎলে-মেতলে যেরকম গুরুতর আহত হবার কথা আমাদের, সেরকম কিছুই হলোনা। বিন্দুমাত্র ব্যথা টের পেলাম না। উপরে তাকিয়ে লিফটের মনিটরে দেখি, গ্রাউন্ড ফ্লোরে চলে এসেছি আমরা। লিফট থেকে বের হতেই বোঝা গেল, বিল্ডিঙে হামলা শুরু হয়েছে- এটা ভূমিকম্প ছিলনা। আতংকে লোকজন এদিক সেদিক হুটোপুটি করছে। থেকে থেকে বিচিত্র একধরনের অপরিচিত শব্দ হচ্ছে চারপাশে। শব্দটা ঠিক গুলি নাকি অন্য কিছু, বুঝতে পারলাম না। আমি আর আমার সঙ্গীরা একটা কক্ষে আশ্রয় নিলাম।
আমার সঙ্গীরা কিভাবে যেন টের পেয়ে যায় যে যারা হামলা করেছে, তারা ঠিক মানুষ নয়... কম্পিউটার প্রোগ্রামড কিছু একটা! সাধারণ অস্ত্র দিয়ে এদের মোকাবেলা করা যাবেনা। আমার সঙ্গীদের মধ্যে একজন ছেলে আবিশকার করে ফেলল কিভাবে এই কম্পিউটার প্রোগ্রামের ভেতরে ঢুকে এদের সাথে মোকাবেলা করার মতো অস্ত্র নিয়ে আসা যায়। সে অস্ত্র নিয়ে এলে আমরা যুদ্ধ করতে থাকি। এই যুদ্ধ বড় বিচিত্র, ঠিক বাস্তব ও নয়, আবার ভার্চুয়াল ও নয়। একের পর এক ওরা আসতে থাকে, আমরা এঘর থেকে ওঘরে পালাতে পালাতে ওদের ঠেকাতে ঠেকাতে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। একসময় হুট করে ওদের সংখ্যা কমে যায়। আমরা উপরের তলার একটি কক্ষে পালিয়ে আশ্রয় নিই। এখানে একটা ব্যালকনি আছে, আমি সঙ্গীদের নিয়ে সেই ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াই।
এইখানে দাঁড়িয়ে পুরো শহরের একটা বড় অংশ দেখা গেল; chaos শুরু হয়েছে। মানুষজন যে যেদিকে পারছে পাগলের মতো ছুটছে, হুমড়ি খেয়ে পড়ছে, আবার টেনে হিঁচড়ে শরীরটাকে উপরে তুলে দৌড়ুচ্ছে। শহরের সবচে বড় অট্টালিকাগুলোর গোড়াতে এমনভাবে বোমা ফেলা হচ্ছে যে বিল্ডিংগুলো ধ্বসে না পড়ে কাত হয়ে একটা আরেকটার গায়ের উপর ভেতরের মানুষ, আসবাবপত্র- সবকিছু নিয়েই ভেঙ্গেচুরে গড়িয়ে পড়ছে। আশেপাশের ছোট বাসাবাড়ি ছেড়ে মানুষজন বের হয়ে রাস্তার উপর চলে এসেছে। কিন্তু রাস্তায় দাঁড়ানো আরও বিপদজনক; বৃষ্টির মতো ইট-সুরকি, ভারী আসবাবের অংশবিশেষ, মানুষের দেহাবশেষ নেমে আসছে। মানুষ আতংকে কোথায় পালাবে বুঝতে পারছে না।
এরই মধ্যে মূল রাস্তার হুম হুম হুম ধ্বনি তুলে কারা যেন মার্চ করে এগিয়ে আসছে। আমার চশমা ঝাপসা হয়ে গিয়েছে, অতো উপরের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট তাদের দেখতে পাচ্ছিনা। কিন্তু যে রক্তশীতল করা শব্দটা করতে করতে তারা এগিয়ে আসছে, সেটা ঠিক মানবীয় নয়... ঝাপসা চশমা দিয়েই আবছা করে দেখতে পারলাম, লোকজন দিগ্বিদিক অসহায়ের মতো ছুটছে। কারা যেন চিৎকার করে অন্যদের বলছে কার্জনের দিকে পালাতে, ওখানে খুব সম্ভবত একটা প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে। কয়েকজন দুঃসাহসীকে দেখা গেল লাঠিসোঁটা হাতে, খালি পায়ে খোলা রাস্তার 'পারে দাঁড়িয়ে থাকতে। অমানবীয় শক্তির বিরুদ্ধে লাঠিসোঁটা হাতে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন মানুষ কি করে পারবে? আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, বুকের ভেতরে হৃদযন্ত্রটা যেন প্রচণ্ড জোরে জোরে ধাক্কা মেরে খাঁচা ভেঙ্গে বের হয়ে আসতে চাইছে। শহরটার উপরে আকাশ একটা কুৎসিত ধূসর ধোয়াশার চাদর বিছিয়ে রেখেছে। পুরো আধিভৌতিক দৃশ্যপটটাই যেন একটা ক্রোম লেন্স দিয়ে দেখছি আমি, এইরকম মনে হচ্ছে। স্বপ্নটা ভাঙ্গার পর আমি চোখ খুলেই প্রথম দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকালাম। নটা বেজে দশ। বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস শব্দে হৃদযন্ত্রটা ঢাক পিটিয়ে চলছে। এ কীসের ঢাক? ধাতস্থ হতে আমার মিনিট পাঁচেক সময় লেগে গেল। পুরো দুস্বপ্নটার মধ্যে এমন একটা ক্যাটাক্ল্যাজমিক ব্যপার আছে, যেটা আমার সমস্ত মনস্তত্ত্বে একটা অনাগত অশনি সঙ্কেতের মতো করে বাজতে থাকল।"


আমি থাকি আটতলায়, একটি তিন বেডরুমের ন'শ স্কয়ারফিটের একটি এপার্টমেন্টে। আশেপাশে এর সমান উঁচু বিল্ডিং কম থাকাতে শহরের এই পাশটার অনেকখানি এলাকা আর প্রধান সড়কের উল্লেখ্য একটা অংশ নির্বিঘ্নে দেখা যায় আমার এপার্টমেন্টের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালে। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শহরের ব্যস্ততা দেখে আমি অভ্যস্ত। আমি সবাইকে দেখতে পাই, কিন্তু আমায় কেউ দেখতে পায়না- এই ব্যপারটার মধ্যে একটা পারভেসিভ আনন্দ আছে।
আমি লক্ষ করেছি, ক্যাটাক্ল্যিজমিক এইস্বপ্নগুলোর অধিকাংশতেই আমার ভিউপয়েন্ট থাকে মাটি থেকে বেশ উঁচুতে এমন একটা সুবিধাজনক জায়গায় যেখানে দাঁড়ালে আমি সবাইকে সহজেই দেখতে পাই, কিন্তু আমাকে সহজে দেখা যায়না। মানুষ যেখানে বাস করে, সেই আবাসস্থলকে ঘিরে বা অনুরূপ পরিচিত দৃশ্যপটেই যে সে স্বপ্ন দেখবে, তা অস্বাভাবিক নয়।

একবার স্বপ্নে দেখলাম, ঢাকায় এলিয়েনরা আক্রমণ করেছে। আমার ব্যালকনিটাতে দাঁড়ালে বিস্তীর্ণ একটা আকাশ দেখা যায়। সেই আকাশ থেকে বুদ্ধ পূর্ণিমার সময়ে ওড়ানো ফানুসগুলোকে জ্বলজ্বল করতে করতে নেমে আসতে দেখা যেত। নিচের দিকে নামার সময় সেগুলো ভুসভুস করে নিভে পুড়ে ছাই হওয়া কতগুলো উত্তপ্ত কৃষ্ণকায় বস্তার মতো এবাসার ছাদে, ওবাসার বারান্দায় লটকে যেত, এর মাথায়, ওর ঘাড়ে পড়ত। ঠিক একইভাবে কতগুলো সিলিন্ডার আকৃতির ক্যাপসুলের মতো বিরাটাকার বস্তু রাতের অন্ধকার আকাশ আলো করে নামতে শুরু করল শহরের বিভিন্ন জায়গায়। যেখানে নামে, সেখানেই মিনিটখানেকের মধ্যে মানুষের আর্তনাদ ভেসে আসতে শুরু করে। এলিয়েনেরা ঠিক শান্তির বার্তা শোনাতে এতো কাঠখড় (কিংবা অন্য কোনো ধরনের জ্বালানি) পুড়িয়ে আজি হতে শত আলোকবর্ষ দূরের সুন্দর এই গ্রহে এসে নামেনি। তারই মধ্যে ওরকম একটা একদম আমার বিল্ডিয়ের গা ঘেঁসে নামতে শুরু করল। আটতলা বরাবর এসে মেরে দিলো গোটা কয়েক বিধংসী মিসাইল। বিল্ডিংএর গা এফোঁড় ওফোঁড় করে বেরিয়ে গেল সেগুলো; আমার কিছুই হলোনা।

স্বপ্ন যতই ভয়ঙ্কর বা বিভীষিকাময় হোক, ব্যক্তি আমি কোনো যন্ত্রণা টের পাইনা, আমার কিছুই হয়না। হলে সিনেমার দর্শকের মতই যুদ্ধের ময়দান থেকে অক্ষতভাবে আমি বেরিয়ে আসি।

একবার দেখলাম, ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দেখছি, প্রধান সড়ক দিয়ে টলতে টলতে জম্বিবাহিনী চলছে। বাস-গাড়ি সব জট পাকিয়ে রাস্তা ব্লক করে ফেলেছে, মানুষজন সেগুলো থেকে নেমে চিপাচাপা দিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে। জম্বিবাহীনি রাস্তায় যাকে পাচ্ছে, ত্যাছড়াতে ত্যাছড়াতে দৌড়ে তাকে ধরেই গায়ের মাংস কামড়ে খুবলে ছিঁড়ে খাচ্ছে; সড়কে রক্তের স্রোত। বাসাবাড়ি আর এপার্টমেন্টগুলোর ভেতরেও জম্বিরা ঢুকে পড়েছে। দরজা বন্ধ করে রক্ষে হচ্ছেনা, জানালা দিয়ে ঢুকে পড়ছে। চতুর্দিকে মানুষের shrill চিৎকার! আমি বাসার ভারী সেগুন কাঠের দরজাখানার এপাশে আলমারিটা ঠেসে দিয়েছি, হাতে একখানা চাইনিজ কুড়াল! আটতলা পর্যন্ত কি জম্বিরা উঠতে পারবে? ওরা লিফটের বোতাম টিপতে পারবেনা নিশ্চই। সিঁড়ি বেয়ে এত উপরে উঠা হয়তো সম্ভব নাও হতে পারে। আর যদি উঠতে পারেও, সেক্ষেত্রে কুড়াল দিয়ে কতকটা আত্মরক্ষা করতে পারব জানিনা। হাত কাঁপছে, পা কাঁপছে। কিন্তু চেষ্টা করতে দোষ কি?
আরেকবার দেখলাম, বিরাট এক রোবট বাসার সামনে নবনির্মিত ফ্লাইওভারখানার বারোটা বাজিয়ে দিয়ে রণাঙ্গনে চলেছে। তার সুবিশাল একেকখানা পদক্ষেপে ফ্লাইওভার ভেঙ্গেচুরে দেবে পড়ছে, উপরে থাকা মানুশবাহী মুড়ির টিনগুলো মুড়িমুড়কীর মতো করে ঝরে পড়ছে নিচে। রোবটের হঠাৎ কি খামখেয়াল হলো, একহাত তুলে ধাক্কা দিতেই রাস্তার পাশের বিল্ডিংগুলো চিতকাত হয়ে তাসের তুরুপের মতো একে আরেকের গায়ে গড়িয়ে পড়ে কেলেঙ্কারি হতে থাকল। মানুষের রক্ত হিম করা চিৎকার স্বপ্নের মধ্যে, কিন্তু ঘুম ভাঙ্গার পরেও দেখি আমার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে রয়েছে এবং আমি দরদর করে ঘামছি।

আমার মার ধারণা, আমি যে সব অবিশ্বাস্যকর হলিউডি সিনেমা দেখি, সেগুলোই দুঃস্বপ্ন হয়ে আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। হলিউডের "পাপভোক্তা" আমি, পাপ তো আমাকে তাড়িয়ে বেড়াবেই!

কয়েকবছর আগে একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম, সেটা অনেকটা এরকম যে, উত্তরা এয়ারপোর্টের পাশে যে একটুখানি সবুজ, সেই সবুজের ভেতরে হাঁটতে হাঁটতে আমি গভীর একটা জঙ্গল আবিষ্কার করলাম। সেই জঙ্গলের কূলকিনারা নাই। আমি হাঁটতে হাঁটতে বেলা গড়িয়ে এলো, হাল ছেড়ে দিয়ে এখানেই বনবাসের সিদ্ধান্ত নেবো কিনা চিন্তা করছি, এমন সময় একটা অদ্ভুত জলাশয়ের দেখা মিলল। জলাশয় জুড়ে বিশাল বিশাল সব পাথর বসে আছে। পাথরের চিপাচাপা দিয়ে পাহারী ঝরনার মতো কুলকুল করে শীতল স্বচ্ছ জলস্রোত বয়ে চলেছে, অথচ আশেপাশে কোথাও কোনো ঝরনা নেই! সমতলের জঙ্গল, এইখানে পাহাড়ী ঝরণা আসবে কোথা থেকে? বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে পাড় বেয়ে অগভীর পানিতে পা দিতেই পা আটকে গেল চোরাবালিতে। কি আশ্চর্য! যতই আছরেপাছড়ে শরীরটাকে টেনে উপরে তুলতে যাই, ততই আমার নিম্নাঙ্গ আরো বেশী চোরাবালিতে আটকে যায়। আমি আতংকে চিৎকার করতে শুরু করি, কিন্তু এই গহীন জনপ্রানহীন অরণ্যে আমার আর্তনাদ কে শুনতে পাবে?


আমার এক বন্ধুকে এইস্বপ্নকথন শোনাবার পর সে ব্যতিব্যস্ত হয়ে ইন্টারনেটের আশ্চর্য জগত ঘেটে এক বিখ্যাত সাইকোলজিস্টের চেম্বারের ঠিকানা বের করে আমাকে দিয়ে বলল, "ইউ নিড হেল্প!" এই সাইকোলজিস্ট প্রায়শই দেশের বাইরে থাকেন। তার দেখা পাওয়া আর বহুদিন আগে তীর্থে যাওয়া সাধুর দেশে বেঁচে ফিরে আসার মতই অত্যন্ত বিরল ঘটনা। মাসখানেক অনবরত চেষ্টা ও বিভিন্নদিকে সুতো ধরে টানবার পর একদিন আমি একটা এপয়েন্টমেন্ট ম্যানেজ করতে পারলাম।

সমস্যা জানবার আগে উনি আমার হিস্টোরি, কোথায় কি করি, সম্পর্ক, ছেলেবেলা, বুড়োবেলা- কোথাও ট্রম্যাটিক কিছু ঘটেছে কিনা সেই সমস্তকিছু জানতে চাইলেন। কোনোকিছুই যেন রাখঢাক করে তার সময়ের অপচয় না করি, সে ব্যপারে কঠোর নির্দেশ দিলেন। সবকিছু খুলে বলা হলো।
ট্রম্যাটিক বলতে ছোটবেলায় পর পর দুবার এক প্রতিবেশী বুড়োর হাতে মলেস্টেড হয়েছিলাম, বাপমা কাউকে কিছু বলার আগেই টুপ করে মুখে ফেনা উঠে বজ্জাত বুড়ো একরাতে পটল তুলল, ফ্ল্যাটের আরসবার সাথে আমাকেও ওই বুড়োর জন্য করা দোয়ামাহফিলে অংশ নিতে হয়েছিল- ওইটুকু কি গণনার মধ্যে পড়ে? এসব নোংরামো তো এদেশের সত্তরভাগ মেয়েশিশু (এবং কম করে হলেও বিশভাগ ছেলের) সাথে হয়! নতুন কিছু নয়। এদেশের মানুষের কাছে এগুলো এখন ডালভাত হয়ে গিয়েছে।

আর ভার্সিটি জীবনে প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম এক বিপ্লবী ছাত্রনেতার। তার চে গুয়েভারার মতো কাঁধ সমান চুল আর অবাধ্য শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখখানি, শুষ্ক ঠোঁটের কোণে আঠার মতো লেগে থাকা বিষের ধোঁয়া কুন্ডলী পাকিয়ে পাকিয়ে আকাশ ছুঁয়ে দিতে চাইত, বুক-পেট-নাড়ি ফেটে বের হয়ে আসা পরিবর্তনের গর্জন, বলিষ্ঠ পদক্ষেপ, কাউকে তোয়াক্কা না করা, বিন্দুমাত্র প্রাণের ভয় না থাকা, তেজস্বী ব্যক্তিত্ব - সবকিছু এতো প্রবলভাবে কাছে টেনেছিল যে স্বপ্নে দেখা চোরাবালির মতই আটকে পড়েছিলাম। যতই নিজেকে টেনে তুলতে চাই, ততই আরো গভীরভাবে বিপদে পড়ি। (এজন্যই বুঝি লোকে "falling in love" কথাটা বলে? পতন নিশ্চিত জানা সত্ত্বেও পড়তেই থাকা!) বিপ্লবীরা যে উত্তপ্ত কড়াই, ও কড়াইয়ে হাত দিয়ে ছ্যাঁক খাওয়াটা যে উন্মাদিনীর কম্ম- তা বোঝার মতো হিতাহিত জ্ঞান তখন ছিলনা। ছ্যাঁক খেয়ে তাই দুনিয়াজগতের সাথে যোগাযোগ কেটে দিয়েছিলাম সপ্তাহকয়েক। বেঁচে থেকেও অর্ধমৃতের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। উলটাপালটা কিছু করে বসব নিশ্চিত জেনে বাবামা চব্বিশ ঘন্টা ঘরে পাহারা বসালেন, চোখে চোখে রাখতেন। জীবন অর্থহীন হয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু এটাও অস্বাভাবিক না। জীবনে ওরকম প্রেম অন্তত একবার সবারই আসে; কালবৈশাখী সর্বনাশা ঝড়ের মতো ক্ষণিকের তরে এসে ঘরের ছাদ উপড়ে দিয়ে সমস্তকিছু ওলটপালট করে আবার হুট করেই চলে যায়। বাকিটা জীবন এই ধ্বংসস্তূপটাকে আবার গুছিয়ে উঠে নতুন করে ঘরের খুটি বাঁধবার চেষ্টা।

সাইকোলজিস্ট মশাই সব শুনলেন। তার কপালে গভীর কয়েকটি ভাঁজ পড়ল। সমস্যা বলা শেষে উনি কয়েকটা পরীক্ষা করলেন, কতগুলো কুইজ ফিলাপ করতে দিলেন, অনেকগুলো জটিল প্রশ্ন করলেন। আড়াই ঘন্টা ধরে সেশন চলল। সবশেষে উনি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে যা বললেন তার সারবস্তু এই যে আমি অত্যন্ত ক্রিয়েটিভ একজন মানুষ। অত্যন্ত ক্রিয়েটিভ মানুষরা ট্রাবলড হয়ে থাকে, আমিও ট্রাবলড। তারপর বললেন, উনি ধারণা করছেন কি যেন একটা ডিজঅর্ডার যেন আমার আছে এবং একজন নামকরা অধ্যাপিকার কার্ড দিয়ে দ্রুত তাঁর শরণাপন্ন হতে বলে আমাকে বিদেয় করলেন। উনার চেম্বার থেকে বেরিয়ে রিকশা নিলাম। রাস্তার ধারে উন্মুক্ত একটা ডাস্টবিন দেখে সেখানে ছুঁড়ে ফেললাম অধ্যাপিকার কার্ডখানা। আমার প্রিয় কবির প্রিয় একখানা উক্তিখানা মনে পড়লঃ

"Is there no way out of the mind?"


(ইহা পুরোটাই একখানা ফিকশন। বাস্তবে কাহারো সহিত মিলিয়া গেলে সেজন্য লেখিকা দায়ী নন)

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৪:৪১

রক বেনন বলেছেন: অনেক বড়। রাত্রে সময় করে পড়ব।

২| ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৫:০৪

কথার ফুলঝুরি! বলেছেন: ঘুমের মধ্যে দেখা দুঃস্বপ্ন গুলো ওলটপালট হয় আর জেগে থেকে জীবনকে নিয়ে দেখা কিছু স্বপ্ন জীবনকেই ওলটপালট করে দেয় ।

আপুর ওলটপালট স্বপ্ন লেখা ভালো লেগেছে ।

৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৫:১৫

দ্যা গার্ল ইন ব্লু গ্লাসেস বলেছেন: বাহ! আপনার কথাটাও বেশ ভালো লাগল!

৩| ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৫:৩৭

পাঠকের প্রতিক্রিয়া ! বলেছেন: প্রথমে মনে হল এগুলো অ্যাকশান মুভি দেখার ফল, কিন্তু পরে এসে মোড় ঘুরে গেল। তবে ফিনিশিং হল লেখিক স্বপ্ন নিয়ে চলার মত একটা ফিকশান গল্প লিখেছে।

গতসপ্তাহে আমিও একটা হরর স্বপ্ন দেখেছি। সময়করে রঙচঙ মাখিয়ে একটা গপ্পো লিখিতে হইবে।

৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:১৩

দ্যা গার্ল ইন ব্লু গ্লাসেস বলেছেন: লিখে ফেলুন। স্বপ্ন মাত্রই লেখকের জন্য উৎকৃষ্ট ম্যাটেরিয়াল।

৪| ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:১৪

আতোয়ার রহমান বাংলা বলেছেন: স্বপ্ন তো স্বপ্নই
ভালো থাকবেন
ধন্যবাদ

৫| ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ৯:০৮

সনেট কবি বলেছেন: কিছুটা পড়লাম।

৬| ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ৯:২৪

রাজীব নুর বলেছেন: স্বপ্ন দেখা ভালো। তবে ঘুমের মধ্যে নয়। জেগে থেকে স্বপ্ন দেখা ভালো। এবং স্বপ্ন গুলো সত্যি করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.