![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
না প্রেমিক না বিপ্লবী [email protected]
সেদিন ছিল ১২ই নভেম্বর, ১৯৭০।
ক্লাস সেভেন।
ফৌজদারহাট কেডেট (আমার কোন ধারনা নেই যে কিভাবে কেডেট কলেজগুলো ক্যাডেট কলেজ হয়ে গেল) কলেজ।
আমরা আট জনে থাকতাম একটা ঘরে।
ক্লাস সেভেন মানেই ক্লাস এইট থেকে নিয়ে ক্লাস ইলেভেনের র্যাগিং খাওয়া এক হতভাগ্য কৃতদাসের দল।
ক্লাস টুয়েলভ এর সাথে সম্পর্কটা ছিল একটু ভিন্ন। তারা ছিল অনেকটা Guardian Angel দের মতন (কৃতদাসদের যাপিত জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে)। তো সে জীবনের কথা না হয় আরেক দিন।
১ কিমি সামনে সমুদ্র, ২০০ গজ পেছনে পাহাড়। সেদিন সকাল থেকে টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছিল।
বাবা মা ভাই বোন সেদিন ছিল কাপ্তাই লেইকে। আমার মনে হয় অনুজ তুফান বা লিও তাদের সেদিনের অভিজ্ঞতা ভাল বয়ান করতে পারবে। অনুজা টিকলী তখন এক্কেবারেই গ্যাদা।
তো আমার কথাই বলি। সেদিন সেই সময়গুলোতে, সেই স্থানে, আমার সাথে আর যারা ছিল এবং এখানে ফেইসবুকে বন্ধু হয়ে আছে তারা হ'ল জ্যাফ (Aftabur Rahman Jafree), জাল্লু (Jalal Akbar), পেটি (Mohammad Iqbal) আর যার উক্তি দিয়ে শুরু করলাম সেই .....বুন্দিস এনাম ( Enamur Rahman Chowdhury). কেউ বাদ পরলো কি?
চিটাগাং শহরে ছিল সুহৃদ ফটিক । সে বলতে পারবে সেদিনের তার চিটাগাং শহরের অভিজ্ঞতা।
তো, সন্ধ্যায় শুরু হয় সাইক্লোন। আমরা দোতলায় থাকতাম। ৮ জন এক ঘরে। এমন বাতাস আর ঝড়ের তান্ডব যে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। অবিরাম বজ্রপাত, বারান্দায় সামুদ্রিক পাখির স্তুপ।
সতীর্থ ... বুন্দিস এনাম বেচারার অবস্থা ছিল সবচে' কাহিল। সম্ভবত আগের জন্মে তার মৃত্যু হয়েছিল বজ্রপাতে। একেকটা বজ্রপাত হয় আর সে কেঁপে, লাফিয়ে, কেঁদে অস্থির! আর বজ্রপাতগুলো ছিল খুবই হৃদয়হীন, এনামের কাকুতি, মিনতি, আহাজারী কিছুতেই তাদের মন গলছিল না। আমার মনে হয় মুহুমুর্হু বজ্রপাত যাকে বলে তা আমি আমার জীবনে ওই একবারই প্রত্যক্ষ করেছি।
এক সময়ে এনাম শুরু করলো আজান দিতে, ওর কাবার্ডের পাশে।
বজ্রপাত, প্রচন্ড বাতাস, যে বাতাসে নিশ্বাস নেয়াও একটা বিশাল পরিশ্রমের কাজ!
একেকটা বজ্রপাত হয় আর এনাম পারলে কাবার্ডে সেঁধিয়ে যায়, আজানরত অবস্থাতেই।
হঠাৎ এনামের ত্রাহি প্রার্থণাঃ "আল্লারে মওলারে বা, দুয়া খরিতে খরিতে গুলা শুকাইয়া যায়রে বাআ।"
এক সময় ভোরের আলো খুব অল্প করে ফোটা শুরু করলো। আধো আলো আধো অন্ধকার, প্রচন্ড ঝড়, বৃষ্টি , বজ্রপাত।
ভোরের আলো ফুটতেই দেখি পেছনের জানলা দিয়ে অভূতপূর্ব দৃশ্য। পাহাড় আগে ছিল ঘন জংগলে ঢাকা গাঢ় সবুজের একটি উল্লম্ফ প্রকৃতি- সে পাহাড়ে তো কোন গাছই নেইই, এমনকি কোন ঘাসও নেই, সবুজ গাছ গাছালীতে ঢাকা পাহাড় এখন মুড়ানো খয়েরী রংএর টিলা।
হাউজ বেয়ারা কিছুক্ষন পর ডাকলো পাখী দেখতে, বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। শামুক খচা (ভাংগা), কাঞ্চি চোরা, ওয়াক, স্নাইপ, গাংচিল, বক আরো অচেনা অনেক প্রজাতির পাখি। বিশাল আকারের চার বালতিতেও কুলায় নি, বারান্দার একপাশে জড়ো করা আছে বাকিগুলো।
পাখিগুলো সমুদ্রের দিক থেকে এসে আছড়ে পড়ে মরছিল হাউজের সাথে বাড়ি খেয়ে খেয়ে সারারাত ধরে।
পৃথিবীর লিপিবদ্ধ ইতিহাসের ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড়।
আমরা ইতোমধ্যে জানি যে বাংলাদেশের উপকূলেই সবচেয়ে বেশী ঘূর্নিঝড় আঘত হেনেছে এই পৃথিবীতে এবং ক্ষয়ক্ষতিও সবচেয়ে বেশী হয়েছে। এই বাংলাদেশেই আঘাত হানে স্মরনাতীত কালের ভয়াবহতম ঘুর্নিঝড়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে যেটা পৃথিবীর তৃতীয়তম প্রাণ সংহারী।
এই সাইক্লোনকে বলা হয়ে থাকে "১৯৭০ ভোলা সাইক্লোন" বা “গ্রেইট ভোলা সাইক্লোন”।
আজ থেকে ঠিক পয়তাল্লিশ বছর আগের এইদিনে পৃথিবীর লিপিবদ্ধ ইতিহাসের ভয়াবহতম জলোচ্ছ্বাস আমাদের উপকুলে আছড়ে পরে।
এটা আরো ছিল বিশ্বের সবচে' প্রাণ সংহারী তিনটি প্রাকৃতিক দূর্যোগের একটি।
এক রাতের মধ্যে পাঁচ লক্ষ মানুষ (অনেক উপাত্তে দশ লক্ষ) নিহত হয় । সবচে' ক্ষতিগ্রস্থ হয় ভোলা। তজুমুদ্দিন থানার ৪৬.৩ শতাংশ মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
এলাকার ৮৫ শতাংশ ঘর বাড়ি, উপকূলের ৬৫ শতাংশ মাছ ধরার ক্ষমতা (fishing capabilities) ধ্বংস হয়, ৭৭ হাজার জেলে যারা ডাংগায় ছিল তখন তাদের মধ্যে ৪৬ হাজার নিহত হয়, ৩৬ লক্ষ মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ হয় এই দূর্যোগে।
[sb]পাঁচ লক্ষ মানুষের মধ্যে ১০ বছরের কম বয়সী শিশুই ছিল আড়াই লক্ষের বেশী।
২ লক্ষ ৮০ হাজার গবাদিপশু মারা পড়ে এই দূর্যোগে।
অনেক রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞদের মতে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার একটি নিয়ামক ছিল এই জলোচ্ছ্বাস । দূর্যোগ ব্যাবস্থাপনা ও দূর্যোগ উত্তর ত্রাণে সীমাহীন ব্যার্থতা সাধারন বাংগালীদের মনে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাষন যন্ত্রের প্রতি পুরোপুরি বীতশ্রদ্ধ করে তোলে।
১৯৭১ এর জর্জ হ্যারিসন-বব ডেলেন আয়োজিত বাংলাদেশ কন্সার্টের একটা কারনও ছিল এই জলোচ্ছাস।
জলচ্ছ্বাসে নিহত ছোট্ট একটি মেয়ের মৃতদেহ সৎকারের চেষ্টা
এ ঘটনার বেশ কিছুদিন পর আমাদের শীতের ছুটি হয়। ছুটিতে বাবার শিকারের সংগী হয়ে একদিন শিকার কুড়োতে কুড়োতে উত্তর পতেংগা থেকে হালি শহর সৈকতে আসি। তখন সন্ধ্যা প্রায়। বীচ থেকে (তখন মাটির বাঁধ আর ম্যাংগ্রোভ ছিলনা) একসারি নারিকেল গাছ আমাদেরকে গ্রামের ভেতর দিয়ে সোজা সমুদ্র পাড় থেকে রাস্তায় নিয়ে আসতো (আমরা নাম দিয়েছিলাম তাহিতি)। বাবা উত্তর পতেংগায় নেমে গাড়িটিকে হালিশহরে পাঠিয়ে দিতেন। যেখানে বীচ শেষ এবং গ্রাম শুরু হ'তে যাচ্ছে ঠিক সেখানেই একটা ঝোপের মধ্যে কমলা রংয়ের কিছু একটা দেখে এগিয়ে যাই আমরা তিন ভাই। তিন চার বছরের একটা মেয়ে শিশুর মৃতদেহ -সমুদ্রের পানিতে ভেসে আসা ঘুর্ণিঝড়ের সংহার। বেশ কিছুদিন গত হয়েছে। কিন্তু তাতে না পচঁন ধরেছে না মুখটা একটুও বিকৃত হয়েছে। দেখে মনে হচ্ছিল শিশুটি পুতুল খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাবা অনেক চেষ্টা করলেন সৎকারের। গ্রামের লোকদের অসহযোগিতায় তা আর সম্ভব হয়নি। তারা এক পর্যায়ে বলা শুরু করলো "শহরোত্তুন মাঁরি আনি খবর দিত ছায়" (শহর থেকে বাচ্চাটাকে মেরে এনে এই নির্জন জায়গায় কবর দিতে চাচ্ছে)।
সৈকতে অনেকদিন পর্যন্ত মানুষের লাশ ভেসে আসতো।
__________________________________
১২ নভেম্বর নিয়ে আগে লেখা আমার ব্লগঃ
http://www.somewhereinblog.net/blog/Trishonku/29481830
সুত্রঃ
The 10 deadliest storms in history
PAKISTAN: Top 10 natural disasters since 1935
NaturalDisaster.us
10 Biggest, Deadliest, Most Destructive Hurricane's EVER!!
10 The biggest disaster with most victims.
Category:Bangladesh Cyclones
1970 Bhola cyclone
১৩ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:৫৩
ত্রিশোনকু বলেছেন: ধন্যবাদ আনারুল ।
২| ১২ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:০৫
বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: অনেক অনেক ধন্যবাদ।
আসলেই স্মরণের এই পোষ্ট না পরলে ভুলেই গিছিলাম ১২ নভেম্বরের কথা। ৭০তো দেখিনি! কিন্তু ৯১র প্রলয়ংকরী ঝড়ের কথা মনে আছে। ঢাকাতে ছিলাম। কিন্তু সারারাত জেগে ছিলাম ৯১র সেইদিনে! আর ভাবছিলাম ঐ এলকারা মানুষ না জানি কেমন আছে... রেডিওটা অন ছিল সারাক্ষন! বাইরে তুমুল ঝড় তুফান আর বজ্রপাতের সাথে সাথে এক ব্যকুল হৃদয় রেডিওটা নিয়ে ব্যকুল প্রার্থনায় রত ছিল!!!!
আল্লারে মওলারে বা, দুয়া খরিতে খরিতে গুলা শুকাইয়া যায়রে বাআ।" একেবারে সঠিক বর্ণনা। করুন আর্তি যখন প্রান্তসীমায় চলে আসে তখইন এমন আবেগ আসে।
সকলে নিরাপদে সকাল দেখতে পেয়েছেন শুকরিয়া-নইলে পোষ্ট পেতাম কোত্থেকে ???
১৩ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১:০৫
ত্রিশোনকু বলেছেন: বিদ্রোহী ভৃগু, আমার অনেকদিনের ব্লগ সহচর।
সুন্দর মন্তব্যের জন্যে অনেক ধন্যবাদ।
৩| ১২ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:০০
ঢাকাবাসী বলেছেন: এরপর আমরা ভার্সিটি থেকে যাই বরিশাল বরগুনাতে সাহায্য নিয়ে। লেখাটি ভাল লাগল্।
১৩ ই নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ১১:৪৯
ত্রিশোনকু বলেছেন: ধন্যবাদ ঢাকাবাসী।
৪| ১৩ ই নভেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৩২
আহমেদ জী এস বলেছেন: ত্রিশোনকু ,
ভয়াল সে দিনটির তান্ডবের খবর কিন্তু ৩/৪ দিন পর্য্যন্ত ঢাকা শহরেও এসে পৌঁছেনি । বাকী দেশ জানতেই পারেনি পৃথিবীর লিপিবদ্ধ ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড় ঘটে গেছে বাংলাদেশের দক্ষিন অঞ্চলে ।
কারন খবর দেয়ার মতো মানুষ ছিলোনা সেদিন দক্ষিনের ঐসব উপকূলীয় এলাকায় ।
শেষাংশে তিক্ত স্মৃতিটুকু পড়ে আবারো মনে হলো , মানুষ আসলেই নিকৃষ্ট এক প্রানী ।
১৫ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:৫৪
ত্রিশোনকু বলেছেন: "স্মৃতিটুকু পড়ে আবারো মনে হলো , মানুষ আসলেই নিকৃষ্ট এক প্রানী ।"
ফুলের মতন বাচ্চা মেয়েটিকে কবর না দিতে পারা্র কষ্ট বাবাকে সারা জীবন তাড়িয়ে বেড়িয়েছে।
ধন্যবাদ আহমেদজী, আমার লেখাটিকে তথ্য সমৃদ্ধ করার জন্যে।
©somewhere in net ltd.
১|
১২ ই নভেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৫৬
মোঃ-আনারুল ইসলাম বলেছেন: আমার বয়স খুব একটি বেশী নয় যার দরুন এই সকল ঘটনা জানা নেই সাথে হয় তো অনুরুপ ইতিহাসের বই পড়া নেই, কিন্তু আপনার বর্ণনা শুনেই গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।