নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

How the Universe formed

উপলব্দি প্রকাশ করি নির্ভয়ে

ড. মোস্তাফিজুর রহমান

I love to write. I like to enjoy fact and knowledge.

ড. মোস্তাফিজুর রহমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

নিরু পার্ট-৩

০৯ ই জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ৯:১৮

ডিজাইন হেয়ার কাটিং সেলুনের সামনে অনেক লোকের ভিড় জমে গেছে। সেলুনের দুই কারিগর ঝগড়া লেগেছে। মারামারিতে একজনের নাক ফেটে রক্ত বের হচ্ছে আরেকজনের এক চোখ ফুলে গেছে। মানুষ খুবই মজা পাচ্ছে। এখনকার দৃশ্যটি খুবই ভালভাবে উপভোগ করছে পাবলিক। মারামারিতে কেউ কাউকে কাবু করতে না পেরে দুই জনই ক্ষুর নিয়ে এসেছে। যে কোনো একজনের গলা বা পেট কাটা যাবে কিছুক্ষণের মধ্যে। দৃশ্যটি লাইভ দেখার জন্য ভিড়ের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে গেছে। কেউ একজন বলে উঠল, মাথা ফালাইয়া দেয়। আরেকজন বলল আরে তাতে তো গেম সাথে সাথে বন্ধ হইয়া যাইবো। পা থেকে শুরু কর। দেখি কে কার পায়ের রগ আগে কাটতে পারিস। হঠাৎ পুলিশের হুইসেল আর লাঠিপেটা শুরু হতেই জায়গাটি মুহূর্তের মধ্যেই ফাঁকা হয়ে গেল। সেলুন বয় দু’জনকে পুলিশ ভ্যানে উঠিয়ে নিয়ে গেল। খবর পেয়ে নিরু ধানমন্ডি থানায় গেল। ওসি সাহেব নিরুকে দেখে বললেন- আবার কী হলো?

- দু’জন নিরীহ সেলুন কর্মচারিকে ধরে এনেছেন।

- নিরীহ নয়, সন্ত্রাসী

- বলেন কী?

- শুনুন, আপনার নাক আর লম্বা না করাই ভাল। সুযোগ পেলেই যেখানে সেখানে নাক ঢুকিয়ে দেবেন না। বেশি গলাতে গেলে শেষে নাকটিই হারাবেন। তাদেরকে কোর্টে চালান করে দেব। আপনি দ্রুত চলে যান।

- ঘটনাটা একটু শুনি।

- ওরা বাজি ধরেছিল ক্রিকেট খেলা নিয়ে। ৫টি ম্যাচে বাজি ধরে, ৫ ম্যাচেই জগদীশ জিতে আর নরেন হেরে যায়। ৫শ’ টাকা দিয়ে শুরু করে শেষ বাজিটি ধরে ১০ হাজার টাকায়। আগের ৪ বারই নরেন টাকা দেয়। শেষবার আর পারে না। তখন ঝগড়া লাগে। প্রায় খুনাখুনি। তবে একটা বিষয় বুঝতে পারছি না।

- কী বিষয়?

- জগদীশ প্রতি ম্যাচের বিস্তারিত বিবরণ দিত। যেমন আজ শ্রীলংকা-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের ব্যাপারে বলে শ্রীলংকা জিতবে ১৫ রানে। ম্যান অব দা ম্যাচ হবে দিলশান ইত্যাদি। এবং ৫টি ম্যাচেই সে যা বলেছে হুবহু তাই হয়েছে। জগদীশকে কিছু বখশিস দিতেই সে বলেছে তার গুরুজী তাকে সব আগেই বলে দিত।

- বখশিস মানে কী আর গুরুজিই বা কে?

- বখশিস মানে ধুনা, মানে ঢলা, মানে উত্তম মাধ্যম। গুরুজির নাম ধরা নাকি নিষেধ। এরপর বাঁশ ডলা দিলাম তাও বলল না। তবে এখন বুঝতে পারছি গুরুজিটা কে?

- কে?

- আমরা পুলিশের লোক, গন্ধ শুঁকে শুঁকে আসামী খুঁজে বের করি। গুরুজিটা হলেন মিয়া আপনি। আপনাকেই বরং বখশিস দিয়ে দেখি।

- বখশিস খারাপ কিছু না। শরীরের জন্য এটি খুবই ভাল। জগদীশ প্রতি ম্যাচের আগের রাতে আমাকে জিজ্ঞেস করত, কে জিতবে। আমি এমনিই বলতাম, আমি তো জানতাম না সে বাজি ধরত।



নিরু এই নিরু! জামাল কাকার ডাক শুনে নিরু হতবাক হয়ে গেল।

- তোকে খুঁজতে খুঁজতে আমি বুড়ো হয়ে গেলাম। তুই দেখি থানায় বসে আছিস। তার কোন কথা না শুনে টেনে নিয়ে রিক্সায় উঠলেন। নিরু বলল কী কাকা প্রাইভেট রিক্সা কিনেছেন নাকি?

- না, ভাড়া নিয়েছি।

- কী ব্যাপার?

- বিয়েতে যাব, সময় খুব কম। আমার সব সময়তো তোর পিছনেই নষ্ট করে ফেললাম।

- আমার দরকার কী? আমাকে নিয়ে এর আগে কোন বিয়েতে গেছেন মনে পড়ে না তো। আমি হঠাৎ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেলাম কেন?

- আরে তোকে ছাড়া বিয়ে হবে কীভাবে? তোকেই তো দরকার। আজ তোর বিয়ে।

চলতি রিক্সা হতে লাফিয়ে নেমে নিরু দৌড় শুরু করল। নিরু জানে জামাল কাকা হার্টের রুগি। দৌড়ে পারবে না। তবে জামাল কাকার জন্য তার মায়া হয়। বংশের সব ছেলেমেয়েদের বিয়ের দায়িত্ব স্বেচ্ছায় তিনি কাঁধে তুলে নিয়েছেন। ভদ্রলোকের প্রতি মাসে গড়ে প্রায় পনের হাজার টাকা এ কাজে খরচ হয়। নিজে খরচ করবেন। মেয়ে দেখতে যাবেন মিষ্টি দরকার, আংটি নিতে হবে, ছেলে আসবে মেয়ে দেখতে আপ্যায়নের বাজার এসব তিনি হাসিমুখেই করেন। বেচারা জামাল সাহেব রিক্সা থামিয়ে নামলেন, ফুটপাতে দাঁড়িয়ে চা খেলেন। তার ডায়াবেটিস বেশি। ফুটপাতে চিনিমুক্ত চা পেলেন না তবুও খেলেন। রুমাল বের করে ঘাম মুছলেন। চিন্তা করছেন কী করা যায়। সিদ্ধান্ত নিলেন নিজের বাসায় চলে যাবেন। প্রতিজ্ঞা করলেন আর কারো কোন ভাল মন্দ নিয়ে তিনি মাথা ঘামাবেন না। অবশ্য এটি তার উনত্রিশতম প্রতিজ্ঞা। জামাল সাহেবের ঘনিষ্ঠ বন্ধু জসিম উদ্দিন হেঁটে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ ফুটপাতে দাঁড়ানো জামাল সাহেবকে দেখে বললেনÑ

- কিরে জামাল। এখানে কী করিস?

- প্রায় কিছুই না।

- কোথায় গিয়েছিলি?

- প্রায় স্টেডিয়াম

- কোথায় যাবি?

- প্রায় শ্বশুর বাড়ি।

- কি খাবি? চল কোথাও বসি।

- না, আমি খেয়েছি।

- কী খেয়েছিস?

- প্রায় শরবত।

আচ্ছা ব্যাপার কী? সব কথার সাথে শুধু প্রায়-প্রায় ঘটনাটা কী বলতো। ঘটনা হচ্ছে ভাতিজাকে নিয়ে রিক্সায় যাচ্ছিলাম তার বৌ দেখব বলে। হঠাৎ সে রিক্সা হতে নেমে দৌড় দিল। পিছনে দৌড় দিতে গিয়েও থেমে গেছি। মনে হচ্ছিল স্টেডিয়ামে আছি হাজার হাজার দর্শক তাকিয়ে আছে। এখন যাব মেয়েদের বাসায়, ওখানে আমার শ্বশুরও আছেন। অবশ্য সেখানে গেলে একটু আগে নিজের সাথে করা প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হয়ে যাবে। আর এখানে চা খেলাম তেমন গরম নয় তবে কড়া মিষ্টি। প্রায় সমাচার বুঝতে পেরেছ?

- প্রায় বুঝেছি।

- হা হা হা

দৌড়তে দৌড়েতে হিমু ধানমন্ডি লেকের পারে চলে এল। কত রাত হল জানা দরকার। স্নায়ু বলছে ১০ টা। একজনকে জিজ্ঞেস করল ভাই কয়টা বাজে?

- দশটা দশ।

- ১০ মিনিট ফার্স্ট, সময়টা ঠিক করে নেবেন।

- ধন্যবাদ ভাই, মনে থাকে না তো, আজই ঠিক করে নেব।

একটুপর একজন যুবককে জিজ্ঞেস করল, ভাই কয়টা বাজে?

- দশটা বাজতে ৫ মিনিট বাকি

- সাত মিনিট স্লো, সময়টা ঠিক করে নেবেন।

- এতই যখন জানেন, জিজ্ঞেস করলেন কেন ভাঁই কয়টা বাঁজে?

- ভাবলাম আপনার সাথে একটু আলাপ করি।

- এত খেজুর‌্যা আলাপের দরকার নাই, ভাগেন।

- না ভাগব না। আপনার সাথে থাকব।

- এই ব্যাটা এত প্যাঁচাল পাড়তাছস কেন? যাইতে কইছি যা না হয় লটকাইয়্যা ফালামু।

- আচ্ছা ভাই সত্যি বলেন তো, আপনার ঘড়ির সময়তো ঠিকই ছিল। কিন্তু যতই ঘড়ি দশটার কাঁটার দিকে যাচ্ছিল আপনি এক/দুই মিনিট করে পিছিয়ে দিচ্ছিলেন। এখনও একবার পিছানোর চিন্তা করছেন, কিন্তু আমার সামনে পারছেন না এজন্যই কি আমার উপর রেগে গেলেন?

- হ্যাঁ

- আপনি কি দশটা বাজুক এটি চান না? অর্থাৎ আপনি রাত দশটাকে ভয় পাচ্ছেন। কিন্তু কেন?

- ভাই আপনার সাথে আমার কোন রাগ নাই। যান আপনি চলে যান। আমার অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ আছে।

- কিন্তু একজন আত্মহত্যা করতে যাওয়া মানুষকে কি ফেলে যাওয়া যায়?

- জ্বি-জ্বি, আপনি ...............আপনি..................

- আপনার গুরুত্বপূর্ণ কাজটি কি আমি জানি। আমি বলছি আপনার আত্মহত্যার কথা। ধরুন, আমি আপনাকে সাহায্য করলাম। সাক্ষী থাকলাম। আত্মহত্যার পর যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা ইত্যাদি করলাম। আপনি একটি চিরকুট লিখে দিতে পারেন। নিচে স্বাক্ষর করে দেবেন। কেউ যাতে আপনার লাশের অমর্যাদা না করে এ ব্যাপারটি আমি আপনাকে আশ্বস্ত করতে চাই। আর আপনার ডেড বডি কোথায় সমাহিত করা হবে আমাকে বলতে পারেন। যুবকটি দৌড়ে এসে নিরুর পায়ে ধরল।

- ভাই আমারে মাফ কইরা দেন।

- আপনিতো কোন অপরাধ করেন নি।

- না, আমি জানি আপনি মহাপুরুষ। আমারে মাফ করেন।

- আচ্ছা করলাম।

- মন থেকে মাফ করেন।

- করলাম।

- আমারে বাঁচান।

- সেটা আপনার নিজের কাছে। আপনাকে আপনিই বাঁচাতে হবে।

- আমি আত্মহত্যা করব না, কিন্তু আমার বেঁচে থাকার কোন সুযোগও নেই।

- চলুন, বসি। কী হয়েছে খুলে বলুন।

লেকের পানির কাছাকাছি দু’জন গিয়ে বসল এবং যুবকটি তার কাহিনী বলা শুরু করল। আমার নাম জাহান্ধার। বাড়ি নারায়ণগঞ্জ। জন্মের সময় মাকে হারিয়েছি। এক ফুফুর কাছে লালিত পালিত হচ্ছিলাম। বয়স যখন ১০ বছর হল আমি তখন ক্লাস ফোরে পড়ি, বাবাকে হারাই। মাঝে মাঝে দাদু বাড়িতে যেতাম। দাদা-দাদু যতদিন জীবিত ছিল ততদিন গিয়েছি। তাদের মৃত্যুর পর যাওয়ার সুযোগ সীমিত হয়ে গিয়েছিল। একবার ফুফুর সাথে গেলাম। খাবারের মধ্যে বিষ দিয়ে আমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা হলো। ২০দিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। এরপর আর ঐ বাড়িতে যাইনি। এ ঘটনায় আমার ফুফুও তার বাবার বাড়িতে যাননি। চাচারা সম্পদের কোন ভাগ আমার ফুফুকেও দেয়নি, আমাকেও না।

- আপনার দাদা-দাদু কবে মারা গেছেন?

- দাদা মারা গেছেন ৫ বছর আগে, দাদু মারা গেছেন প্রায় ২ বছর হল। আচ্ছা আপনি কি বিরক্ত হচ্ছেন? আমি কি আপনার সময় নষ্ট করছি?

- না, না আমি সহজে বিরক্ত হই না। আর আমার হাতে প্রচুর সময় আছে। বলতে পারেন সারারাত। এখনতো মোটে রাত এগারটা হলো। আপনার কথাগুলো বলুন।

- জ্বি বলছি। আমি এস এস সিতে খুব ভাল রেজাল্ট করি। ফুফু আমাকে নটরডেম কলেজে ভর্তি করান। আমি জানতাম আমার খরচ চালাতে ফুফুর খুবই কষ্ট হচ্ছিল। ভর্তির সময় এককালীন খরচ দিতে গিয়ে ফুফাকে না জানিয়ে ফুফু তার কানের দুল বিক্রি করেছেন। আমার ফুফাতো বোন আছে একজন। তার খরচও তাদের চালাতে হয়। আমি সাইন্সের ছাত্র হওয়ায় আরও অতিরিক্ত খরচ। আমার ফুফা পুলিশে চাকরি করেন। মানুষ হিসেবে খুব খারাপ না হলেও বদমেজাজী। আমাকে নিয়ে একদিন ফুফা-ফুফুর ঝগড়া হলো। সেদিন গভীর রাতে কাউকে না জানিয়ে কাপড়-চোপড় আর বইপত্র নিয়ে ফুফুর বাড়ি হতে বের হয়ে গেলাম। ফুফু যাতে কষ্ট না পায় বা কম কষ্ট পায় সেভাবে বুঝিয়ে একটি চিঠি রেখে আসলাম। আমার কাছে জমানো টাকা ছিল সর্বমোট দু’শ’ টাকা। এত রাতে কোন বাস ছিল না। কিছু হেঁটে, কিছু রিক্সায় আমি ঢাকার পথে রওয়ানা দিলাম। যাত্রাবাড়ী এলাকায় দু’ছিনতাইকারী আমার পথরোধ করে। একজন আমার কণ্ঠনালীতে ছুরি ধরে। অন্যজন আমার ব্যাগ ও শরীর চেক করল। হাতে সাধারণ ঘড়ি আর নগদ ১৩০ টাকা পেয়ে তারা সন্তুষ্ট হলো না। একজন কষে একটি চড় মারল অন্যজন লাথি মারল পেটে, আর বলল, শালা এত কম টাকা নিয়ে কেউ ঢাকা শহরে আসে? আমি চড় আর লাথি খেয়ে জ্ঞান হারালাম। কতক্ষণ বেহুঁশ ছিলাম জানি না। জ্ঞান ফিরে দেখলাম ফুটপাতে শুয়ে আছি। মাথার নিচে বইয়ের ব্যাগ। জামা-কাপড়ের থলেটি এলোমেলো। নতুন একটি শার্ট ছিল শুধু সেটি নেই।

অনেক কষ্ট করে হেঁটে আরামবাগে এক বন্ধুর মেসে উঠলাম। সে আমাকে অনেক সহযোগিতা করে। নিজের ৩টি টিউশনীর মধ্যে একটি আমাকে ছেড়ে দেয়। ওদেরকে বলে তার সমস্যা আছে পড়াতে পারবে না। পরে সে আরো একটি টিউশনি ম্যানেজ করে দেয়। মোটামুটি আমার পৃথিবী সবচেয়ে আনন্দময় হয়ে উঠে তিন-চার মাস। ইতিমধ্যে ফার্স্টইয়ার ফাইনাল শেষ হয়েছে। সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস শুরু হয়েছে। হঠাৎ দেখি একদিন ফুফু এসে হাজির, সঙ্গে ফুফাত বোন সুনয়না। ফুফু কেঁদে কেটে অস্থির। বললেন, আমি তোকে নিয়ে খুব খারাপ স্বপ্ন দেখেছি। অনেক সাধনা করে তোর ঠিকানা বের করেছি। আমি তোকে নিয়ে যাব। আমি ফুফুকে ধরে অনেক কাঁদলাম। বললাম, কোন সমস্যা হবে না। বুঝিয়ে শুনিয়ে পাঠিয়ে দিলাম। ঐদিন আর কোন টিউশনিতে যাইনি। পরদিন কলেজ থেকে মাত্র মেসে ঢুকলাম। দেখলাম মেস ভর্তি পুলিশ। আমি ঢুকতেই পুলিশ এরেস্ট করল। মতিঝিল থানায় নিয়ে যাওয়া হল। জানলাম আমার প্রথম টিউশনির মাস্টার এবং মিসেস অর্থাৎ আমার ছাত্র আরেফীনের পিতা-মাতা নিজ বাসায় ভোরের দিকে খুন হয়েছেন। সন্দেহভাজনদের তালিকায় আমাকেও রাখা হয়েছে। বিশ্বাস করুন আমি উনাদের দু’জনকে খুবই শ্রদ্ধা করতাম। পেশায় দু’জনই ছিলেন সাংবাদিক। আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। আমি ভাইয়া আর ভাবী ডাকতাম। একদিন ভাবী বলেছিলেন, জাহান তুমি সাংবাদিকতা করবে?

আমি খুবই উৎফুল্ল হয়ে উঠি। তিনি বলেছেন, ইন্টারমেডিয়েট শেষ কর, তারপর তোমাকে আমি ট্রেনিং দেব। তাদের খারাপ কিছু হোক তা কখনো কল্পনাও করতাম না। অথচ তাদেরকে হত্যার দায়ে আমাকে গ্রেফতার করা হলো। আমার নাম এক নং আসামী দেখানো হলো। চার্জশীটে আমাকে মূল হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হলো। তবে ফাইনাল রায়ের আগে জজ সাহেবের কেন জানি সন্দেহ হলো। তিনি আমাকে খাস কামরায় নিয়ে একাকী কথা বললেন। রায়ে ২ জন আসামীর ফাঁসি ও বিভিন্ন জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হল। আমার সাজা হল দুই বছর। এর মধ্যে গ্রেফতার থেকে রায় পর্যন্ত প্রায় ছয় মাস আর জেলখানায় কাজ-কর্মের কারণে আরো ছয় মাস বাদ দিয়ে রায়ের পর হতে আরো এক বছর জেলখানায় ছিলাম।

- আপনাকে কি শিশু-কিশোর ওয়ার্ডে রাখা হয়েছিল?

- না, আমাকে সাধারণ কয়েদীদের সাথে রাখা হয়েছিল। রাতে আমি কখনোই ঘুমাতে পারতাম না। যাউকগা এসব কথা বলে এখন সময় নষ্ট করতে চাই না। একবছর পর যখন কুমিল্লা কারাগার থেকে বের হলাম তখন আমি খুবই অসুস্থ। বাইরে ফুফু আর ফুফাত বোনকে দেখে আমি অবাক হই। চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না। অনেকক্ষণ কাঁদলাম। তারাও কাঁদলো। আবার ফুফুর বাড়ীতে ফিরলাম। পরের বছর প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে ইন্টার পরীক্ষা দিলাম। মোটামুটি ভালই পাশ করেছি। এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োকেমিস্ট্রিতে ভর্তি হয়েছি। কিন্তু বিধি বাম! কে জানি হাইকোর্টে রীট করেছে। পরীক্ষা বাতিল করে আবার পরীক্ষা নেয়ার অর্ডার হলো। সেই পরীক্ষায় আমি কৃতকার্য হলাম না। এই বলে জাহান্ধার দাঁড়িয়ে গেল। বললÑনা, আত্মহত্যা ছাড়া আমার আর কোন পথ খোলা নেই। আপনি শুধু শুধু আমাকে দেরী করিয়ে দিলেন। আজ অমাবস্যার রাত। আমার সময় ঘনিয়ে এসেছে। নিরু জোর করে তাকে বসিয়ে দিল। বলল- আপনার আসল স্বপ্ন পূরণ হবে। হতাশ হলে চলবে না। সুনয়নাকে আপনি পাবেন।

- না, পাব না। জামাল্যা দিবে না।

- জামাল্যা দিবে না মানে কি?

- জামাল্যা হলো ফুফুর ভাসুরের মেয়ের জামাই। আমার ফুফা গত কয়েকমাস ধরে অসুস্থ । ডিউটিতে থাকাকালীন কোন আঁতেলকে পাছায় লাথি মেরেছিল। আর আঁতেলটা নাকি বলেছে তোর পা পচে যাক। এর কয়েকদিন পর ফুফা বাড়িতে গেলে একটা গাছের সাথে ওস্টা খায়। ঘটনা কিছুই না, কিন্তু ফুফার পায়ে পচন ধরে। কোন কিছুতেই চিকিৎসা হচ্ছে না। ডাক্তার বলেছে পা কেটে ফেলতে হবে। চাকরিটা যায় যায় অবস্থা।

- ঐ গাছটা কি খুব প্রাচীন বট বৃক্ষ

- জ্বী হ্যাঁ, কেন?

- না, তেমন কিছু না। আচ্ছা জামাল সাহেব কি তার ভাতিজার সাথে সুনয়নার বিয়ে দিতে চাচ্ছেন?

- আরে চাচ্ছেন আবার কী? বিয়েতো আজকে। এতক্ষণে মনে হয় হয়েই গেছে। না আমি উঠলাম, আত্মহত্যা ছাড়া দুনিয়াতে আর কোন সমাধান নেই।

- আরে ভাই সমাধান নাই কে বলল? বিয়ে হয়নি সুনয়নার। বিয়েতো আপনার সাথেই হবে।

- শুনুন আপনাকে আমি শ্রদ্ধা করা শুরু করছিলাম। উল্টাপাল্টা বলে আবার আমার মেজাজ উঠাবেন না।

- আচ্ছা জামাল সাহেবের কথায় আপনার ফুফা-ফুফু রাজিতো?

- আমার ফুফুর অনেক আগের ইচ্ছে আমার সাথে সুনয়নার বিয়ে দেবে। ফুফার তেমন কোন বক্তব্য ছিল না। কিন্তু ঐ যে ফুফার পায়ে পচন ধরল, জামাল্যা এসে সাহায্য করা শুরু করল। এখন ফুফা এক পায়ে খাড়া জামাল্যার ভাতিজার লগে সুনয়নাকে বিয়ে দেবে।

- জামাল সাহেবের ভাতিজা কী করে?

- হুনছি বেকার, ভবঘুরে।

- তাহলে সুনয়নাকে আপনিই পাবেন। তবে আপনাকে কিছু কষ্ট করতে হবে।

- কী কষ্ট? দুনিয়ার তামাম কষ্ট করতে আমি রাজি আছি।

- আজ অমাবস্যার রাত। লেকে নামতে হবে। সাত ফুট তলায় ডুব দিয়ে পানি খেতে হবে।

- এই অন্ধকারে? আমি একা?

- না, না আমি থাকবো সাথে।

- ঠিক আছে।

দু’জনেই লেকে নামার প্রস্তুতি নিল। নিরু বলল ড্রেস খুলে ফেলুন। অন্ধকােের কেউ কাউকে দেখছি না। ড্রেস খুলে এক জায়গায় রেখে দু’জনই পানিতে নামল। সাঁতার কেটে মোটামুটি মাঝামাঝি জায়গায় গিয়ে নিরু বলল- জাহান্ধার আপনার ফুফার পা আর কাটতে হবে না। আপনার বিয়ে সুনয়নার সাথে হবে। তবে আপনাকে একটি শপথ করতে হবে। শপথের কথা ভাবতে ভাবতে পানিতে ডুব দিবেন। এখন যেখানে পা আছে তার আরো ১-২ ফুট নিচে নেমে পানি খেতে হবে।

- কী শপথ করতে হবে?

- আপনার সাথে সুনয়নার বিয়ে হলে ফুফুর সংসারে ভাল-মন্দ বেশিরভাগ ব্যাপরই আপনার পরামর্শ অনুযায়ী হবে। যে প্রাচীন বটবৃক্ষের সাথে আপনার ফুফা ওষ্টা খেয়ে পা পেঁচিয়ে ফেলেছেন, সে বৃক্ষটি তিনি কেটে ফেলতে চাইবেন। বিক্রি করলেও অনেক টাকা পাওয়া যাবে। প্রথম শর্ত হলো আপনি যতদিন জীবিত থাকবেন গাছটি কাটতে পারবেন না বা কাটতে দেবেন না।

- এটা কোনো ব্যাপার না। আমি মানলাম।

- অবশ্যই ব্যাপার। আপনি হয়তো জানেন না আপনার ফুফার বাবা, দাদা, পর দাদা সবাই আত্মহত্যা করেছিল। শপথ ভঙ্গ করলে আপনার ফুফা এবং আপনিও আত্মহত্যা করবেন হয়তো।

- ঠিক আছে আর বলতে হবে না। এখন ডুব দেব?

- ইয়েস

একসাথে দু’জন ডুব দিল। একটুপর মাথা উঠালো। নিরু বলল- পানি খেয়েছেন?

- জ্বি, তিন ঢোক খেয়েছি, আপনি খেয়েছেন?

- না, আমিতো আপনাকে সঙ্গ দিলাম মাত্র। চলুন, তীরে যাওয়া যাক।

- তীরে উঠে দেখল তাদের জামাগুলো জায়গায় নেই। আশেপাশে অনেক খোঁজাখুজি করেও পেল না। উপরে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে দু’জন টহল পুলিশ। তারা দু’জন উলঙ্গ লোক দেখে দ্বিধায় পড়ে গেল। একজন বলল, এত রাতে দু’পাগল এক সাথ হল কীভাবে। অন্যজন বলল দুই পাগল একসাথে কখনো থাকে না। এর ভূত। তাড়াতাড়ি কেটে পড় ভাই। পুলিশ দু’জন দ্রুত পায়ে চলে গেল । নিরু দেখল পুলিশ দু’জন তাদেরকে দেখেও চলে যাচ্ছে। এ মুহূর্তে লজ্জা করলে লাভ নেই, সাহায্য দরকার। রাস্তার দিকে উঠতে গিয়ে দেখল ভ্যানগাড়িতে করে তিনজন লোক ব্যানার লাগাচ্ছে। দু’জন উলঙ্গ লোক একসাথে তাদের দিকে দৌড়ে আসছে দেখে ভূত ভেবে তিনজন তিনদিকে দৌড়ে পালাল। জাহান্ধার দৌড়ে গিয়ে দু’টি ব্যানার নিয়ে এল। দুই জনে দু’টি ব্যানার লুঙ্গির মত করে পরল। নিরু বলল

- যাক পরনের ব্যবস্থা হয়েছে। এবার আপনার ব্যবস্থা করা যাক।

- কী করবেন।

- চলুন ধানমন্ডি থানায় যাব।

- আমাকে পুলিশে দেবেন?

- না, ভেবেছিলাম ওখানে গিয়ে পোশাক পাব। কিন্তু পুলিশের পোশাকতো সাধারণ মানুষকে পরতে দেবে না। বড় খালার বাসায় যাব।

রাত তিনটার সময় কলিং বেল বেজে উঠায় জাহানারা বেগম ঘাবড়ে গেলেন। না জানি আফজাল সাহেবের কিছু হয়েছে। গেইটের বাইরে নিরুকে দেখলেন। দরজা খুলে বাইরে এসে বললেন-একি নিরু। তোর কী হয়েছে? পাগল সাজলি কেন?

- না খালা পাগল সাজিনি। আমাদের পোশাক চুরি হয়ে গেছে।

- গায়ের পোশাক চুরির ঘটনাতো আর শুনিনি।

- খালুজান কোথায়?

- এখনো ফিরেনি। মোবাইল বন্ধ।

- চিন্তা করো না খালা। ঠিক হয়ে যাবে। এখন দুটো লুঙ্গি আর দু’টি শার্ট দাও। জাহানারা বেগম দু’টি শার্ট আর দু’টি লুঙ্গি নিয়ে এলেন। বললেন-এত রাতে কোথায় যাবি বরং থেকে যা।

- না, সময় নেই হাতে।

- কিসের এত তাড়া।

- বিয়েতে যাব।

- গভীর রাতে কিসের বিয়ে?

- এই যে জাহান্ধার। আমার বন্ধু। তার বিয়ে হবে নারায়নগঞ্জে। সন্ধ্যায় মেয়েদের বাড়িতে বিয়ে হওয়ার কথা। যে কোন দুর্ঘটনায় সেটি হয়নি। বুঝতে পারছ মেয়ে পক্ষের অবস্থাটা কী। সেজন্য দ্রুত যাওয়া দরকার।

- ঠিক আছে যা।

- খালা একটা আবদার করব?

- কী বল?

- এক হাজার টাকা দাও আর খালুর গাড়ীর চাবিটা ।

- টাকা দিচ্ছি। কিন্তু গাড়ির চাবিতো দিতে পারব না। তোর খালুর অনুমতি লাগবে।

- শুন খালা। খালুর সমস্যাগুলো আমি সমাধান করে দেব। গাড়ি নিয়ে গেলে খালু কিছুই বলবে না।

- তাছাড়া গাড়ি চালাবে কে? ড্রাইভার ছুটিতে গেছে।

- সেটা তুমি ভেব না। আমি ভাল ড্রাইভিং জানি।

- না বাবা আমি পারব না।

- খালা আমার উপর আস্থা রাখ। আজ পর্যন্ত আমি তোমার কোন ক্ষতি করেছি?

- আজ পর্যন্ত করিস নি। কিন্তু কাল যে করবি না তার গ্যারান্টি কি?

- আমার দিকে তাকাও খালা। গ্যারান্টি আমি নিজে।

- ঠিক আছে দাঁড়া। আমি টাকা আর চাবি নিয়ে আসছি।

জাহানারা বেগম এক হাজার টাকার ১টি নোট ও গাড়ির চাবি নিরুর হাতে দিয়ে বললেন-

সাবধানে যাবি। তোর খালু জানলে আমি বলব তুই চুরি করে নিয়ে গেছিস।

- ঠিক আছে।



মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.