![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমার ছোটবেলার বন্ধু সুমন্ত,
কবিবহুল এ শহরে আজন্ম বাস করেও ও এতদিনে একটুও কবি হয়নি।
অথচ ওর জন্য কবি হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক ছিলো।
স্কুলের আলাভোলা আসলাম পর্যন্ত যেখানে কবি হয়ে গেছে,
আসলাম-যে কিনা ‘আমার বই’ ছাড়া অন্য কোনো কবিতার বই কখনো ছুঁয়েও দেখেনি,
যাকে রাজ্জাক স্যার ব্যাকরণ না পারার দায়ে প্রতিদিন একঘণ্টা কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখতেন-
বর্গীয় বর্ণের উদাহরণে যে শুধুই ‘বর্গীয় জ’ লিখে চলে আসত,
সেই আশ্চর্য নির্বোধ আসলাম পর্যন্ত কবি হয়ে গেছে,
কিন্তু প্রচণ্ড প্রতিভাবান আমাদের সুমন্ত এখনো কবি হয়নি।
সুমন্তের যখন বার বছর বয়স তখন ওর মা-মঞ্জু কাকিমা মারা গেলেন,
পড়বার নাম করে কতবার শুধু কাকীর হাতের রান্না খেতে
ওর বাড়ি যেয়ে বসে থেকেছি,তা আজও মনে পড়ে;
এইত গেল বছর যুগান্তর ঈদসংখ্যায়
‘ঈদের দিন সকাল আর কাকিমার হাতের পায়েস’
নামে নিশানের লেখা স্মৃতিমূলক কবিতাটা ছাপা হয়ে গেল;কিন্তু
প্রতিদিন প্রতিবেলা কাকিমার হাতের রান্না খেয়ে আসা সুমন্ত
কখনো ওই পায়েসের কথা স্মরণ করে মন কেমন করা কবিতা লেখেনি।
শুনেছি বারো বছরের পর থেকে সে প্রায়ই রাত হলে মা মা বলে কাঁদে,
তবু তার কি কখনো ওই মায়ের আঁচল,মায়ের মুখ ইত্যাদি অসংখ্য বিষয় নিয়ে
অন্যদের মত বুক ফাটানো কবিতা লিখতে ইচ্ছা হয়নি?
বোধহয় না,কারণ সুমন্ত লেখেনি-
ছোটবেলা থেকেই প্রচণ্ড গোঁয়ার আমাদের সুমন্ত তাই কবিও হয়নি।
স্কুল ফাইনালের কিছু দিন আগে আলম কাকু-ওর বাবা-
অফিস থেকে আসবার পথে গাড়ির সাথে অ্যাক্সিডেন্ট করে পা হারান,
ওর বাবা-যিনি দেখা হলেই আমাদের বলতেন, ‘পড়ো বাবারা পড়ো,সামনে পরীক্ষা’-
তিনি চিরদিনের জন্যে পঙ্গু হয়ে গেলেন।
আমরা গিয়েছিলাম কাকুকে দেখতে-
হুইল চেয়ারে বসে থেকে
আমাদের দেখে আগের মতই উনি বলেছিলেন,
‘পড়ো বাবারা পড়ো,এভাবে সারাদিন টই টই করে ঘুরোনা ,সামনেই না পরীক্ষা!’
না,সামনে আমাদের পরীক্ষা ততটা ছিলোনা,যতটা ছিল সুমন্তের।
ছোট দুই ভাইবোনের দায়িত্ব সেই তখন থেকেই তার কাঁধে এসে পড়ে,
দারিদ্র্য কাব্যের আদর্শ উৎস এটা বোকারাও জানে,
কিন্তু শরীর ভালো রাখার যুক্তি দিয়ে সেদিন থেকে প্রতিদিন দুইবেলা খেয়ে আসা
আমাদের সুমন্ত তো কবি হয়নি!
ইশকুল ফাইনালের পর থেকে সুমন্ত নিয়মিত টিউশানি করিয়েছে,
সারাবিকেল সারাসন্ধ্যা পড়িয়ে রাতের আড্ডায় গলা ছেড়ে যখন লালন গেয়েছে,
তখন ও শুধু গেয়েছেই,বাড়ি যেয়ে আট কুঠুরি নয় দরজার রহস্য ভাঙতে
কাগজ কলম নিয়ে সাগ্রহে বসে পড়েনি,তাই সুমন্ত কখনো কবিও হতে পারেনি।
সুমন্তের জীবনে প্রেমও এসেছিল-
ভার্সিটির সেকেণ্ড ইয়ারে তিশার সাথে ওর সম্পর্ক হয়;মনে আছে
তিশাকে প্রথম দেখার পর সুমন্ত টানা তিন রাত ঘুমোয়নি,
রাত জেগে ওর বাড়ির সামনে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে ছিল-একবার দেখবে বলে,
নীলক্ষেত থেকে হেলাল হাফিজের বই কিনে এনে সারারাত সুমন্ত
উচ্চস্বরে এলোমেলো পদ্য আউড়েছিল,তবু তিশাকে দেবার জন্য
ডেস্কে পড়ে থাকা হাতে বানানো নিউজপ্রিণ্ট খাতাটায় ও একটাও কবিতা লেখেনি।
তিশার মেঘের ভেলার মত চুল আর আশ্চর্য সুন্দর চোখ-
ওকে সারারাত ভাবিয়েছেই শুধু,কবিতা লেখাতে পারেনি
যেবার তিশার বিয়ে হয়ে গেল ফেরারি হাঁকানো এক বড় ভাইয়ের সাথে,
সেবার সুমন্ত আবার জেগে ছিল টানা তিনরাত,
প্রতিরাতে কম করে হলেও দু প্যাকেট গোল্ডলীফ ফুঁকেছিল ও,
পাড়ার আসাদ ভাইয়ের কাছ থেকে বাঙলা কিনে এনে খেয়ে
সারারাত যখন রাস্তার পাশে পড়ে ছিল,
তখন ওর কথা শুনে আমাদের আঁতেল স্বাগতও একটা আশ্চর্য সুন্দর কবিতা লিখেছিল,
কিন্তু তিনদিন পর আবার ক্লাসে এসে লাস্ট বেঞ্চে বসে পড়া সুমন্ত
কোনোদিন একটাও কবিতা লেখেনি।
বরং তারপরের কয়েকদিন ও জীবনানন্দের বই নিয়ে ঘুরেছে;
লাশকাটা ঘর আর উড়ন্ত চিলের কথা বলে
সবাইকে চমকে দিয়েছে।
কিন্তু বেতের ফলের কথা ভেবে,পৃথিবীর পথের কথা ভেবে
সুমন্ত কখনো কবিতা লেখেনি;সুমন্ত কখনো কবি হয়নি।
সুমন্তের বাবাটা মরল,সুমন্তের ভাইটা বখে গেল,
সুমন্তের বোনটার বিয়ে হল এক পাষণ্ড বুড়োর সাথে,
সুমন্ত অনাথ,সুমন্ত প্রেমে ব্যর্থ,
সুমন্তের জীবনে আশা নেই,সুখ নেই,স্বপ্ন নেই,
সুমন্ত প্রচণ্ড কাঁদে,সুমন্ত হঠাৎ হাসে,
সুমন্ত আজকেও তিশাকে ভালোবাসে,
সুমন্তের মাঝে মাঝে মারা যেতে ইচ্ছে হয়-
কিন্তু সুমন্তের কখনও কবি হতে ইচ্ছে হয়না।
তার ইচ্ছে হয় একটা পাখি হতে ;
তার ইচ্ছে হয় সাগর পাড়ি দিয়ে ছুটে চলা একটা পাখি হতে-
প্রতিদিনের ক্লান্ত সময় শেষে যখন সে একা একা ঘরে ফিরে আসে,
আকাশের দিকে তাকিয়ে তার ঈর্ষাবোধ হয়,
পাখিদের দিকে তাকিয়ে তার ঈর্ষাবোধ হয়,
কারণ সে জানে সে কখনো পাখি হবেনা,এটা
জানে বলেই সে কখনো কবি হয়নি-
জানে বলেই সুমন্তরা কখনো কবি হয় না-
তারা হাজার বছরের পুরোনো সভ্যতার লালচে দেয়ালে আরেকটা ছোট ইট হয়,
আর পূবের হলুদ সূর্য ঢেরা বাজাতে বাজাতে যখন লাল হয়ে পশ্চিমে ঢলে পড়ে
সুমন্তরা শুধুই অপঠিত আরেকটা কবিতা হয়ে যায়...
২১ শে জুলাই, ২০১২ রাত ১১:২৪
উপল মুনতাসির বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ
©somewhere in net ltd.
১|
১১ ই জুলাই, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:৫১
বিষাদ সজল বলেছেন: পড়ে ভাল লাগল ।