নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আউলা

ওয়াসিফ২৬

ওয়াসিফ২৬ › বিস্তারিত পোস্টঃ

মরমী কবি বুল্লে শাহ

০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ১০:৩০

পাঞ্জাবী সাধক সৈয়দ আবদুল্লাহ শাহ্‌ কাদরি ‘বুল্লে শাহ্’ বা ‘বুল্লা’ শাহ্‌। অস্টাদশ পাঞ্জাবের মরমী কবি। পাঞ্জাবের লালনও বলা যেতে পারে তাঁকে। বুল্লে শাহের জন্মসাল ধরা যেতে পারে ১৬৮০ খ্রিস্টাব্দ। পাঞ্জাবের ভাওয়ালপুরের 'উচ" গ্রামে। গ্রামটি ভারত বিভাগের পর পাকিস্তানের অংশে পড়েছে। বাবা বুল্লে শাহের পূর্বপুরুষ বুখারা থেকে এসেছিলেন। যার বর্তমান নাম উজবেকিস্থান। ধারনা করা হয়, তার পুর্বপুরুষগন আমাদের নবী এর বংশধর ছিলেন। বুল্লে শাহের বাবার নাম শাহ মোহাম্মদ দরবেশ। যিনি ছিলেন গ্রামের মসজিদের একজন ইমাম।

বুল্লে শাহ কবিতা লিখতেন। বুল্লে শাহ্‌-র কবিতাগুলো কাফি ঘরানার। এটি একটি পাঞ্জাবি ঘরানার রাগ, সিন্ধি এবং সিরাকি কবিতা। পাঞ্জাব এবং সিন্ধে এ ধরনের কবিতার চল রয়েছে। মুর্শিদ তথা গুরু বা পথ প্রদর্শক এবং মুরিদ তথা অনুগামীর মধ্যে কথোপকথন নিয়ে এই কবিতা রচিত হয়। এই মুরিদ কখনও মানুষ আর মুর্শিদ হলেন স্বয়ং ঈশ্বর। আবার কখনও প্রেমিক-প্রেমিকা। কাফি শুধু সুফি, সিন্ধি এবং পাঞ্জাবিদের দ্বারাই ব্যবহৃত হতো না। বরং শিখ গুরুরাও কাফি লিখতেন।

বুল্লে শাহের সময়কালটা মুসলিম ও শিখ দাঙ্গায় দুঃখজনকভাবে ছিল লাঞ্ছিত। সে ভয়াবহ সময়টায় দু-পক্ষেরই বিপুল মানুষ নিহত হচ্ছিল। সে সময়ই একবার একদল শিখ দ্বারা কয়েকজন মুসলিম নিহত হয়। মুসলিমরা বদলা নেবে সিদ্ধান্ত নেয়। প্রতিশোধ হিসেবে মুসলিমরা একজন নিরীহ শিখকে হত্যা করে। মুসলিম হলেও বাবা বুল্লে শাহের নিরীহ শিখ হত্যার বিরোধীতা করেন। তিনি দুহাত তুলে বললেন – ''স্বন্ত্রাস কখনেই স্বন্ত্রাসের জবাব নয়।'' এভাবে নিহত শিখের পক্ষ নেওয়ায় মোল্লারা বাবা বুল্লে শাহের ওপর ক্ষেপে যায়। ক্ষেপে গেলেও বাবা বুল্লে শাহ সেই হন্যমান সময়ে পাঞ্জাবের জনগনের জন্য হয়ে উঠেছিলেন শান্তির প্রতীক।

বুল্লে শাহ শুধু কবি ছিলেন না তিনি একজন দার্শনিক ও ছিলেন! যার প্রমান ছোট বেলাতেই পাওয়া যায়। ঘটনাটা শেয়ার করা যাক,ছোট বেলাতে তার বাবা-মা পাঞ্জাবের একটা স্কুলে তাঁকে ভর্তি করিয়ে দেয়। তাঁর বয়সী বাচ্চাদের সাথে তিনিও স্কুলে যাওয়া আসা শুরু করেন। সব ঠিক থাকেলও সমস্যা শুরু হয়ে যায় “আলিফ” শব্দটিকে নিয়ে! বুল্লে শাহ “আলিফ” শব্দটিতেই আটকে যায়। তাঁর শিক্ষক কোন ভাবেই তাঁকে বাকি বর্ণমালা চেনাতে পারছিল না! এক সপ্তাহ চলে গেল, তাঁর বন্ধু-বান্ধব তত দিনে আরবী বর্ণমালা সব পড়ে শেষ করলেও তিনি “আরবী” শব্দেই আটকে থাকলেন! “আলিফ” এর মধ্যে কি যে পেলেন বুল্লে শাহ তা তিনিই ভালো জানেন! যাইহোক শিক্ষক বুল্লে শাহর বাবা-মাকে ডেকে বললেন,” আপনার ছেলের মানসিক বিকাশ ঠিক ভাবে হয়নি,আপনারা ওকে নিয়ে চলে যান!”
বুল্লে’র বাবা-মা স্কুল থেকে ছাড়িয়ে এরপর অন্য এক শিক্ষকের কাছে পাঠালেন,সেখানেও একি অবস্থা! এরপর তারা নানা ভাবে নানান জায়গায় তাদের সাধ্যমত চেস্টা করল কিন্তু কোন লাভ হল না। বুল্লে’র বাবা-মা হতাশ হয়ে পড়লেন। ছেলেকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ল। এতচাপ সহ্য করতে না পেরে বুল্লে শাহ একদিন বাসা থেকে পালিয়ে গেল! যাতে করে আর কেউ তাঁকে চাপ না দিতে পারে!

তারপর বুল্লে শাহ বনের মধ্যে বাস করতে শুরু করলেন আর “আলিফ” শব্দের অর্থ খুঁজতে লাগলেন। কয়েকদিন যাওয়ার পর তিনি “আলিফ” শব্দের অর্থ খুঁজে পেলেন। সবখানেই দেখছেন “এক আলিফ”। অনুভব করছেন “এক আলিফ”। ভাবছেনও ঐ “এক আলিফ” কে নিয়েই! গাছ, গাছের পাতায়,ফুল,ফল,পাহাড়-পর্বত, পোকামাকড়, পশুর মধ্যে সব খানেই উনি “আলিফ” এর অর্থ খুঁজে পেলেন!

এরপর তিনি সেই শিক্ষকের কাছে গেলেন। যিনি তাঁকে পড়াতে অ-স্বীকার করেছিলেন। শিক্ষককের কাছে গিয়ে তিনি মাথা নিচু করে তাঁকে সম্মান করলেন কিন্তু শিক্ষক তাঁকে চিনতে পারেন নাই। তখন বুল্লে বলে উঠল,''আমি আলিফ পড়া শিখে এসেছি এবং আমি আপনাকে তা লিখে দেখাতে চাই।'' শিক্ষক তখন চিনলেন আর মুচকি হেসে বললেন,''ঠিক আছে বোর্ডে লিখো'' বুল্লে বোর্ডের মধ্যে প্রথমে একটা বিন্দু বা ফোঁটা দিলো এরপর তিনি একটা লম্বা দাগ টানলেন মানে বোর্ডে উনি “আলিফ” শব্দটি লিখলেন। প্রথমে বিন্দু এবং পরের টান দিয়ে উনি আলিফ শব্দটিকে দ্বি-খন্ডিত করলেন এবং এটার ব্যাখ্যা করলেন। শিক্ষক শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন এবং খুশি হয়ে বললেন,''তুমি একটা বর্ণ আলিফের মধ্যে যা শিখেছ তা আমি সব বর্ণ মুখস্ত করেও তা শিখতে পারি নি'' এরপর বুল্লে শাহ ক্লাসরুমের বসে থাকা তাঁর বন্ধুদের উদ্দেশে একটা গান ধরলেন। সেই গান নিয়ে পরে আলোচনা করছি।

এবার “আলিফ” নিয়ে ব্যাখ্যায় আসা যাক, “আলিফ” শব্দটি লিখতে হলে সবার আগে একটা ফোটা বা বিন্দু দিয়ে “আলিফ” লিখতে হয় এই ফোঁটা বা বিন্দুটি দেখতে অঙ্কের ০ এর মত যার অর্থ কিছুই না। প্রতিটি সৃষ্টির শুরু হয়েছে বিন্দু থেকে যার আগে কিছুই ছিল না! এমনকি বিজ্ঞানীরাও বলছেন,শূন্য বিন্দু থেকে মহাবিশ্বের উৎপত্তি। শক্তির নিত্যতা সূত্র অনুযায়ী,শূন্য বিন্দুর মোট শক্তির পরিমান হবে শূন্য! বিগব্যাং থিউরিতেও এই বিন্দুর কথা বলা হয়েছে। বিগব্যাং থিওরি অনুযায়ী,মহাবিশ্ব শুরুতে একটা কনারুপে বা বিন্দু ছিল,পরে মহাবিস্ফোরণে এটা বাড়তে শুরু করে! আলিফ যেহেতু আরবী বর্ণমালার প্রথম শব্দ তার আগে কোন শব্দ নাই ঠিক তেমনি আলিফ লিখতে হলে এই বিন্দু দিয়ে শুরু করতে হয় যার আগেও কিছু নাই। সব শূন্য! এই বিন্দু দিয়ে যেমন আলিফ লেখাটা শুরু ঠিক তেমনি ভাবে বিন্দু থেকেই সকল কিছুর সৃষ্টি হয়েছে! আবার আরবীতে “আল্লাহ” শব্দটি লিখতে হল আলিফ লাগে। আল্লাহ্‌ আবার সব কিছুর মালিক সব কিছু তিনিই সৃষ্টি করেছেন অতএব যা কিছু আজ আমরা দেখতে পাই সব কিছুর সুচনা কিন্তু আল্লাহর কাছ থেকেই সুতরাং আলিফ এর বিন্দুর মধ্যেই সকল সৃষ্টির অর্থ লুকাইত আছে! আলিফ শব্দটি অনেক তাৎপর্য বহন করে!

এবার গানের প্রসঙ্গে আসা যাক। গানটির নাম “এক আলিফ”। পাকিস্তানের Coke Studio এর কারনে আবার আমাদের কাছে নতুন ভাবে পরিচিত করে দেন শিল্পী শাই জহুর। ২০১৫ সালে বাংলাদেশে ইন্টারন্যাশনাল ফোক ফেস্টিভালে পারফর্ম করেছিলেন। যার পারফরমেন্সে মেতে উঠেছিল আর্মি স্টাডিয়ামে উপস্থিত হওয়া হাজারো দর্শক। গানটির লিরিক দেয়া হল যেটা বুল্লে শাহ তাঁর শিক্ষক এবং বন্ধুদের সামনে গেয়েছিলেন।



Aik Alif
You read to become all knowledgable
But you never read yourself

You run to enter your mosques and temples
But you never entered your own heart

Everyday you fight Satan
But you never fight your own Ego

Bulleh Shah you try grabbing that which is in the sky
But you never get hold of what sits inside yourself


Stop it all my friend
Stop seeking all this knowledge my friend


Only an Alif is what you need
Stop it all my friend


Stop seeking all this knowledge my friend
God is Greatness, God is All


I shall follow the Jogi (ascetic/Sufi)
Those who deny the strength of Truth


God does not give them courage
We have drowned in the river of Self


The boat and the flowing waters do not matter
Stop it all my friend


Stop seeking all this knowledge my friend
God is Greatness, God is All


বুল্লে শাহ্‌-র নাম আধুনিক মানুষের কাছে প্রথমে আসে ১৯৯০ সালে যখন পাকিস্তানী ব্যান্ড ‘জুনুন’ তার ‘বুল্লা কি জানা’ কবিতাটিকে গানে পরিণত করে। ২০০৪ সালে রাব্বি শেরগিল তার প্রথম অ্যালবাম ‘রাব্বি’-তে এই গানটি নতুন করে গেয়েছিলেন যা ২০০৫ সালে টপচার্টে ছিল।
বুল্লে শাহ্‌-র কবিতা থেকে বলিউডেও প্রচুর গান হয়েছে। তার কিছু কিছু জানলে অনেকেই হয়েতো অবাক হবেন। ‘মেরা পিয়া ঘার আয়া’ বুল্লাহ্‌-র সৃষ্টি। যে কোন অনুষ্ঠানে রুনা লায়লা একটা গান গেয়েই থাকেন। ‘দামা দাম মাস্ত কালান্দার’। এটি বুল্লে শাহ্‌-র কবিতা, যা থেকে কাওয়ালী গাওয়া হয় এবং বুল্লে শাহ্‌ এটি শাহবাজ কালান্দার নামক আরেকজন সূফী সাধকের সম্মানে লিখেছিলেন। ২০১০ সালে মুক্তি পাওয়া মণি রত্নমের ‘রাবণ’ সিনেমার ‘রাঞ্ঝা রাঞ্ঝা’ গানের রচয়িতা বুল্লে শাহ্‌। এবং তার রচিত পাঞ্জাবী কবিতা ‘তাহাইয়া তাহাইয়া’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই গুলজার, এ আর রহমান এবং মণি রত্নম কালজয়ী গান ‘ছাইয়া ছাইয়া’ তৈরি করেন।
বুল্লে শাহ্‌কে ধারণ ও তার কবিতা থেকে গান গেয়ে যারা তাকে অমর করে রেখেছেন, তাদের মধ্যে আবিদা পারভিন এবং সাই জহুরের নাম সর্বাগ্রে আসে। এছাড়াও নুসরাত ফতেহ্ আলী খাঁ, শাবরি ব্রাদার্স, ওয়াদালি ব্রাদার্সের নাম বলতে হয়। কোক স্টুডিওর গুনে আধুনিক মানুষের মনেও তিনি ছাপ ফেলছেন। সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত করন জোহর পরিচালিত ‘অ্যায় দিল হ্যাঁয় মুশকিল’ সিনেমায় ‘বুল্লেয়া’ শীর্ষক গানে এই বুল্লে শাহ্‌-র কথাই বলা হয়েছে এবং তাকে ‘প্রেমিকের বন্ধু’, ‘পথ প্রদর্শক’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।


দেশ-কাল কিংবা বলা যায় সব ভাষায়ই হয়তো একজন লালন থাকেন।ঠিক তেমনি এক লালন হলেন পাঞ্জাবী সাধক সৈয়দ আবদুল্লাহ শাহ্‌ কাদরি ‘বুল্লে শাহ্‌’ বা ‘বুল্লা’ শাহ্‌। আবার কখনো তিনি ‘বুল্লেয়া’ নামে পরিচিত। ১৬৮০ থেকে পলাশীর যুদ্ধ পর্যন্ত ছিলো যার জীবনকাল। ১৭৫৭ সালে তিনি মারা যান, তার কবর 'কাসুর' এ অবস্থিত, যা বর্তমানে পাকিস্তানের অংশ। এই মহামানবদের জন্ম ভারত পাকিস্তান যেখানেই হোক না কেন তাঁরা পুরা পৃথিবীর সম্পদ, তাঁদের দেশ একটাই,সেটা হল এই পৃথিবী।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.