![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বাঙালী ঘরকুনো, বাঙালীর সাহস নাই, বাঙালী পেটুক, পরিশ্রম করতে পারে না। এত্তসব বদনাম ঘোচানোর জন্য চারজন বঙ্গ সন্তান বিমল মুখার্জি, অশোক মুখার্জি, আনন্দ মুখার্জি এবং মণীন্দ্র ঘোষ, নিজেদের পৃথিবী দেখবার স্বপ্ন পূরণের বাসনা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। সম্বল চারটি বিএসএ সাইকেল। পকেটে একটি পয়সা নেই তবুও তারা বেরিয়ে পড়েছে পাঠান সম্রাট শেরশাহ এর তৈরি কলকাতা থেকে পেশোয়ার পর্যন্ত ১৫০০ মাইল দ্বীর্ঘ্য জিটি রোড ধরে। কথা আছে কলকাতায় কমিটি ফান্ড জোগাড় করে তাদের টাকা পাঠাবে।
এরপর তাদের যাত্রা চলতে থাকে জিটি রোড ধরে বেনারস, দিল্লি, হায়দ্রাবাদ, করাচি, ইরাক, সিরিয়া, তুরষ্ক হয়ে। ইরাকে প্রবেশের পূর্বেই তাদের চোখ রাঙায় উত্তপ্ত মরুভূমি। দিনের পর দিন গোসল ছাড়া চলতে চলতে সকলের গায়ে পোকা হয়ে যায়! এমনকি বেদুইনের অতিথি হতেও কুন্ঠা বোধ করেনি কেউ। দিনে প্রচন্ড রোদে চলতে হয় রাতে আবার প্রচন্ড ঠান্ডা। কথা ছিলো ইরাকে টাকা পাঠাবে কমিটি। কিন্তু কমিটির কোন চিঠি না পেয়ে কিছুটা হতাশ হয় সবাই। তবুও মনোবল হারায় না কেউ, ভাবে সামনে জার্মানিতে গিয়ে হয়তো টাকা পাওয়া যাবে। সামনে প্রচন্ত শীতের রাস্তা , কারো কাছে পর্যাপ্ত গরম জামা নেই। তথাপি আবার যাত্রা শুরু করে তারা বুলগেরিয়া, যুগস্লাভিয়া, হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়া হয়ে জার্মানি পর্যন্ত। অস্ট্রিয়ার মাইনাস ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় বরফের উপর দিয়ে চলতে হয় তাদের। কখনো কোন গরীব কৃষকের বাসায় কখনো খুব কমদামী পান্থশালায় রাত কাটাতে হয় তাদের। দিন কেটেছে পথের পাশে ফল খেয়ে অথবা সামান্য খরচে রুটি, পনির, সসেজ খেয়ে। পকেটে ছিলো মরুদ্যানে কুড়িয়ে পাওয়া মাত্র ১৩০ টাকা।
জার্মানিতে পৌছে কমিটির চিঠি না পেয়ে সবাই হতাশ হয়ে পড়ে। বিমল ইউনিভার্সিটিতে, রেডিওতে নিজেদের ভ্রমন কাহিনী বলে কিছু টাকা উপার্যন করে। বোর্ডিং হাউস যাকে ইউরোপে পান্সিয়ান বলে সেখানে চারমাস অবস্থান করে সবাই। এই ফাঁকে বিমল ফটোগ্রাফি শিখে নেয়। মণীন্দ্র ভ্রমণ সমাপ্তি করবে বলে ঠিক করে, জার্মানিতেই রয়ে যায়। বাকি তিনজন কমিটির আশা ছেড়ে আবার যাত্রা শুরু করে নেদারল্যান্ড হয়ে ইংল্যান্ড পর্যন্ত।
জার্মানিতে থাকার সময় অশোকের পরিচয় হয় আনালিসে নামের এক নেদারল্যান্ডের তরুণীর সাথে। পরবর্তিতে পরিচয় প্রণয়ে রূপ নেয়। কমিটির টাকা পাঠানোর অপরাগ অবস্থানে এবং নিজেদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অশোক এবং আনন্দ ব্রাজিল চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের সহায়তা করে আনালিসের বাবা। কিন্তু বিমল পৃথিবী দেখবার স্বপ্ন থেকে সরে আসতে পারে না। সে কিছুকাল লন্ডনে অবস্থান করে অর্থ উপার্যনের জন্য। সে মিডল্যান্ড ব্যাংকে চাকরি নেয় এবং ইন্সটিটিউট অব ব্যাংকার্স এর ফাইনাল পরীক্ষার জন্য প্রস্ততি শুরু করে। একদিন ভোরে দৌড়াতে গিয়ে পড়ের গিয়ে বিমল পায়ে প্রচন্ড আঘাত পায়। এক্সরেতে দেখা যায় তার দুপায়ের গ্রায়েন ফুলে গেছ। ফলে তার দু পায়ে অস্ত্রোপাচার করতে হয় এবং তাকে ৬মাস শয্যাশায়ী হতে হয়। লন্ডন থেকে বার্মিংহাম যাবার পথে আবার সে ট্রেন দূর্ঘটনার শিকার হয়। তাই দ্বীর্ঘ্য বিরতির পর ১৯২৮ সালে অলিম্পিকে ভারতের জয়ের শাক্ষী হয়ে আবার সে বেড়িয়ে পরে।
এবারে শুরু হয় তার একক পৃথিবী ভ্রমণের যাত্রা। এইবারে সে আয়ারল্যান্ড হয়ে স্কটল্যান্ডে যায়। স্কটল্যান্ডের এবারডিন শহর থেকে একটি মাছ ধরার জাহাজ ”মার্গারেট ক্লার্কে“ সহকারি নাবিকের কাজ নেয় সে। ছয়মাস এটিতে কাজ করে অন্য একটি স্পানিশ জাহাজ ইসাবেলাতে করে সে গ্রীনল্যান্ড যায়। এরপর সে নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, রাশিয়া, ইউক্রেন, গ্রিস হয়ে মিশর পৌছে। রাশিয়ায় তখন চলছে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। সমস্ত গ্রামের মানুষের খাবার রান্নার জন্য কমিউনিটি কিচেন, প্রতিটি গ্রামে লাইব্রেরি, দেশের জন্য মানুষের কাজ করার প্রবল আগ্রহ তাকে বিষ্মিত করে।
এরপর মিশর থেকে সুদান, লিবিয়া, টিউনিস, ইতালি, সুইজারল্যান্ড, স্পেন, ফ্রান্স হয়ে ডেনমার্ক । ইতালিতে তখন চলছে মুসোলিনির সময়। মুসোলিনির চিন্তা এবং ভাবধারার সাথে একমত হতে না পারলেও তার কঠোর নিয়মানুবর্তিতা বিমলকে প্রভাবিত করে। এছাড়াও ইতালিতে মিকেল এঞ্জেলোর অমর কীর্তি সব ভাস্কর্য দেখে প্রবলভাবে বিষ্মিত হয় সে। ডেনমার্কে তার পরিচয় হয় ইয়ার্ল নামে এক পঞ্চাশোর্ধ মানুষের সাথে, যিনি ভারতীয় সংস্কৃতির বিরাট ভক্ত। তার বাসায় আশ্রয় নিয়ে বিমলে আলসার ধরা পড়ে, ফলে তাকে দ্বীর্ঘ্যদিন সেখানে কাটাতে হয়। সময় কাটানোর জন্য বিমল ইয়ার্লের সেফিনবার্গ ফার্মে কাজ নেয়। এই সময়ে সে বিমান চালনা শিখে ফেলে! আলসার সেরে গেলেও সে অনেকটা সময় ইয়ার্ল এবং তার স্ত্রী ইয়ুটার সাথে ডেনমার্কে কাটায়। সে অনেকটা ইয়ার্ল পরিারের সদস্যই হয়ে গিয়েছিলো। এরপর একদিন সবাইকে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে সে বেরিয়ে পড়ে তার আজন্ম সাধ পৃথিবী দেখার ইচ্ছা পূরণের জন্য।
এইবারে সে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য ঘুরে কিউবা থেকে আবার যুক্তরাষ্ট্র হয়ে মেক্রিকো, পানামা, কলম্বিয়া, ইকোয়েডোর, পেরু, তাহিতি, হনুলুলু দ্বীপ হয়ে চলতে থাকে জাপানে। মাঝে বিরাট সময় তাকে জাহাজে কাটাতে হয় স্থল পথ না থাকায়। জাপান থেকে সে প্রবেশ করে চিনে। তখন চিন এখনকার মতো এত উন্নত ছিলো না। চিনের শ্রমজীবী মানুষের দৈন্যদশা তাকে পিড়িত করে, যাদের বেশিরভাগ কৃষক এবং যৌথ পরিবারে বাস করে। বিভিন্ন দেশে নিজের ভ্রমণ কাহিনি শুনিয়ে, নিজের তোল চিত্র প্রদর্শিত করে সে মোটামুটি ভারত পৌছানোর মতো অর্থ উপার্যন করেছিলো। তাই তাকে চিনে কোন উপার্যনের চিন্তা করতে হয় না। চিন থেকে সে হংকং, ভিয়েতনাম, লাউস, কমে্বাজ, থাইল্যান্ড মলয়(বর্তমান মালেশিয়া), সিঙ্গাপুর, জাভা হয়ে ভারতীয় উপমহাদেশ পৌছে ১৯৩৮ সালে, প্রথম ভারতীয় ভূপর্যটক হিসেবে।
বলাই বাহুল্য তখনো ভারতবর্ষ ভাগ হয়নি তাই পাকিস্থান, শ্রিলংকার উল্লেখ পাওয়া যাবে না ভ্রমণে। আর তখন ভারতীয়দের অস্ট্রেলিয়া যাবার অনুমতি ছিলো না। তার এই ১২বছরের ভ্রমণ বৃত্তান্ত বিস্তরে বর্ননা করা আছে বইয়ে। কোথাও একটু বাড়িয়ে বলা নেই বা রং চাড়নোর চেষ্টা নেই। বরং আমার মনেহয় ভদ্রলোক কিছু লুকিয়েছেন। এই বারো বছরে তিনি পৃথিবীর কোন রমনীর প্রেমে পড়েননি! ভদ্রলোকের রুচি অসাধারণ। পুরো ভ্রমণে কোন খাবার তার কাছে বিস্বাদ লাগেনি! প্রচন্ড গরমে এবং ঠান্ডায় একজন মানুষের টিকে থাকার লড়াই দেখতে পাওয়া যাবে বইটিতে। পৃথিবীর আদি সভ্যতা গুলো যেমনঃ গ্রিক, রোমান স্বচক্ষে দেখবার বিস্তারিত বর্ননা পাওয়া যাবে বইটিতে। ভ্রমণ পিপাশুদের মনে বইটি অনন্য স্থান করে নেবে আশাকরি। আর যাদের পৃথিবী ঘুরে দেখবার শখ, তাদের কাছে তো এই বই একখানা থাকতেই হবে।
বই - দুচাকায় দুনিয়া
লেখক - বিমল মুখার্জি
স্বর্ণাক্ষর প্রকাশনী (ভারত)
মূল্য - ৫৪০ (রকমারিতে)
©somewhere in net ltd.