নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শেষ ট্রেনে বাড়ি ফিরি।

শুন্য বিলাস

জামাল হোসেন

শুন্য বিলাস › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প -নেপথ্যের বিলাপ ।

০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ বিকাল ৫:৩৫

দুই গ্রামের মাঝখানে একটা খাল। বিশাল প্রান্তরের একেবারে শেষ অংশে শুরু হয়ে নিকটবর্তী গাঙে মিশে যাওয়া এই খালটির গরিবি দশাই তার একমাত্র গৌরব । দীন এই খালটিই রমিজ মাঝিকে ধারণ করেছে দুই দশকেরও বেশি সময়।বংশ পরম্পরায় নামে মাঝি হলেও রমিজ আসলে একজন পুরোদস্তুর জেলেই ছিলেন । দুই দশক যে খালের উপর নির্ভর থেকে জীবন যাপন করেছেন মরণের পরে দেখা গেল হতদরিদ্র রমিজ মাঝিকে দাফনের জন্য খালপাড় ছাড়া তার উত্তরাধিকারদের কাছে আর তেমন বিকল্প নাই।

অগ্রহায়নের এক পড়ন্ত বিকালে এই খালপাড়েই রমিজ মাঝির কবর ঘিরে আবার মানুষের জটলা দেখা গেল । তার বড় পুত্র উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে পিতার মুণ্ডুপাত করছে । পিতাকে শায়েস্তা করার জন্য কোদাল দিয়ে মাটি খুড়ে খুড়ে ক্রমশ নিম্নমুখী হচ্ছে । ছয় বছর আগে এই খাল পাড়েই রমিজ মাঝির খরা জালের সম্মুখে মানুষের জমায়েত হয়েছিল গভীর রাতেও। টর্চ লাইটের আলোর রোশনাই ছড়িয়ে পড়েছিল চারদিকে।মানুষের হাউকাউ শুনে সকালবেলা মশলাদার খবরের আশায় আচানক নিদ্রাভঙ্গ অলস লোকেরা আবার পাশ ফিরে শুয়েছিল ।অতি উৎসাহীরা অবশ্য নিজেদের অর্ধাঙ্গিনীদের বিরহকাতর অবস্থায় রেখেই অকুস্থলে হাজির হয়েছিল।তাদের সকলের মনোবাঞ্ছা কবুল হয়েছিল সেদিন ।পরদিন সকালবেলা সত্যি সত্যি বেশ মুখরোচক এক খবর ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। আলাপের মশলার খরায় থাকা গ্রাম্য মানুষেরা কয়েক সপ্তাহের জন্য চায়ের কাপে ঝড় তোলার বিষয়ববস্তু পেয়ে একপ্রকার হাফ ছেড়ে বাঁচে। গল্প বিনে আর কি আছে তাদের! রাত্রি বেলা তীব্র আলোর ঝল্কানির হাড়ির খবর হল ছয় সন্তানের পিতা, নাতি নাতনির মুখে দাদা ডাক শোনার গৌরব অর্জন করা রমিজ মাঝির নতুন প্রণয়ী জুটেছে। পাশের গ্রামের আব্দুর রশিদের সদ্য ত্রিশ পেরোনো বিধবা স্ত্রী রাফেজার সাথে তার রাত্রিকালীন রোমান্স পর্ব চলছে। পঞ্চাশ পেরোনো রমিজ মাঝি আর বিধবা রাফেজার কাছে অবশ্য শরীর ভিন্ন এই উথালপাতাল নিশুতি অধিবেশনের বিকল্প ব্যাখ্যা নাই বলা চলে। অপরদিকে শরীরের উত্তাপ নিবারণের দাওয়াই নিতে নাকি অন্য কোন কারন জানা যায়নি রাত দশটার দিকে রমিজ মাঝির প্রথম স্ত্রী লাকী বেগম যখন পতির রাত্রিকালীন আবাসে হাজির হয় তখন খরো জালের টং ঘর থেকে নারী পুরুষের আদিম মিলিত হওয়ার শীৎকার তার কানে ভেসে আসে। রমিজ মাঝি বর্ষাকালে প্রায় রাতেই টং ঘরে রাত্রি যাপন করেন , অপরাপর জেলেরাও তাই করেন । ত্রিশ বছর দাম্পত্য জীবনের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন লাকী বেগম বুঝে মুহূর্তেই বুঝে যান সেখানে কি হচ্ছে। প্রবল জোছনার মাতাল করা শিহরনের সাথে পারস্পরিক আদিম উত্তাপের দাপটে টং ঘরটি হেলে দুলে উঠছে বারবার। লাকী বেগম বুঝে যায় অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়েছে তার স্বামী। উচ্চস্বরে বিলাপ করে মুহূর্তের মাঝেই লোক জড়ো করে ফেলে সে। রমিজ মাঝি আর তার প্রনয়ী হতভম্ব হয়ে টং ঘরেই পরবর্তী পরিস্থিতি দেখার অপেক্ষা করতে থাকে। গ্রাম্য শালিসে দাপট দেখিয়ে সুনাম অর্জন করা মোবারক আলির হুংকারে উভয়ে মাথা নিচু করে এসে জড়ো হওয়া প্রাপ্তবয়স্ক জনতার কাঠগড়ায় এসে দাঁড়ায় । নিজ সন্তানেরাও পিতার এহেন কাজে হতভম্ব হয়ে মাথা হেট করে দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে। পরদিন সন্ধ্যায় ইস্পাত কঠিন সালিসে এই দুই জেনাকারীকে উপযুক্ত শাস্তি দানের অঙ্গীকার করে মোবারক আলি সমবেত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দেয় । পরদিন সালিসে ঘটনার বিবরণ ও শাস্তির প্রসঙ্গ উঠার আগেই রমিজ মাঝি বিধবা রাফেজাকে বিয়ে করার ঘোষনা দেয়। বিবাহের ঘোষনা উত্তাপ প্রশমনের আপাত দাওয়াই হলেও জেনা করার অপরাধে শালিসের সিদ্ধান্ত মোতাবেক একশো জুতার বাড়ি হজম করতে হয় তাকে।

আগের বিরান ভূমির টং ঘরে অবৈধ যৌন অভিসা্রের সংবাদ লোকেদের যতটা আনন্দ দিয়েছিল এইবেলা তার চেয়ে বেশি আনন্দ পেল যখন জানা গেল পরিবারের মুখে কলঙ্কের তিলক লাগানো এই বিয়ের নব দম্পতির বাসর শয্যার জন্য কোন কক্ষ দেয়নি তার সন্তানেরা। কাম জ্বালা হোক আর নববধুর সম্মান রক্ষার খাতিরেই হোক রমিজ মিয়াকে ফুলশয্যার একটি কক্ষের জন্য দুই ঘর পরের এক পড়শির দ্বারস্থ হতে হয়েছে। পরদিন এই খবর চাউর হলে লোকেরা আরেকদফা মশলা মাখা খবর পেয়ে উল্লসিত হয়ে উঠে।ভাবী বধূর জন্য তেল সাবান সংস্থানের সক্ষমতা অর্জন করতে না পারা বিএ পাশ অবিবাহিত বেকার যুবকদের নিজেদের মানব জনম নিয়ে হা হুতাশ করতে দেখা যায়। পূর্বের দুই স্ত্রীসহ তিন স্ত্রীর গর্বিত স্বামী রমিজ মাঝি প্রায়দিনই বউদের নিয়ে মাছ ধরতে বেরুতেন। প্রথম দিকে প্রবল আপত্তি থাকলেও এক সময় প্রথম ও দ্বিতীয় স্ত্রী রাফেজা বেগমকে তাদের বৈধ সতীনের মর্যাদা দেয়। অভাব আর টানাপোড়নে বসবাস করলেও তিন স্ত্রীর সাথে যৌথ জীবন যাপনের সুচনা করে কিংবদন্তীতে পরিণত হয় রমিজ মাঝি। কেবল আড়াল কথার বেড়াজালে পড়ে তার প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের জীবন এক প্রকার তিক্ত হয়ে উঠে। প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠে তাদের মাঝে। পিতার লাগামছাড়া যৌনক্ষুধা নিবারনের এহেন কর্মকান্ড তাদের সামাজিক জীবন হুমকির মুখে ফেলেছে বলে জানিয়ে পিতার মতের বিরুদ্ধে যেতে থাকে সব ক্ষেত্রে। তাদের মাতারা মেনে নিলেও রাফেজা বেগমকে কোনভাবেই মেনে নিতে পারেনি তারা। প্রতি পদক্ষেপে তাকে অপমান করার সুযোগ নিত তারা।মূর্তিমতী দোজখে পরিণত হয় রমিজ মাঝির সংসার । এই দোজখের মাঝে রমিজ মিয়ার ঔরসে চার বছরে রাফেজা বেগমের দুটি সন্তান দুনিয়ায় তাদের উপস্থিতি জানান দেয় । লোকেদের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় আরেক দফা । অবিবাহিত বেকার সম্প্রদায়ের হাহাকারে মনে হয় আসমান জমিন একাকার হয়ে যাবে ।অথচ নাটকের শেষ অংক যে এত নিকটবর্তী তা হয়তো কল্পনাও করেননি রমিজ মাঝি । অকস্মাৎ ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে তিন মাস শয্যায় থেকে একপ্রকার বিনা চিকিৎসায় দুনিয়ায় নিজের কিংবদন্তিতুল্য জীবনের ইতি ঘটে রমিজ মাঝির। জগতের সকল বিদ্যমান ধারার প্রতি নতমুখী থেকে তার সব পক্ষের পুত্রদের মাঝে রমিজ মাঝির একমাত্র রেখে যাওয়া সম্পদ বাস্তুভিটায় সকলের মর্যাদাপূর্ণ দখল নিয়ে বছর না ঘুরতেই লড়াই তুঙ্গে উঠে। কিন্তু লড়াই জমজমাট হওয়ার আগেই কিংবা মীমাংসার জন্য শালিস আহবানের আগেই প্রকৃতি নিজেই বিচারকের ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়। এক কালবৈশাখীতে রমিজ মাঝির ঘরের পিছনের দন্ডায়মান আমগাছ শিকড়শুদ্ধ উপড়ে পড়ে পুকুরে । বিস্তৃত শিকড় সম্বলিত এই আমগাছ একা পরাস্ত হয়নি সাথে রমিজ মাঝির রসুই ঘরটিও ভারসাম্য হারিয়ে পুকুরে পতিত হয়।

প্রকৃতির এই প্রতিশোধের দায় কারো উপর চাপাতে না পেরে ভিটেমাটি হারানো বড়পুত্র ফজলের কাছে একমাত্র অপরাধী হিসেবে তার পিতার নামই মাথায় আসে। যেহেতুধ্বসে পড়া ভিটার অপর অংশে রাফেজা বেগম তার পুত্র সহযোগে আবাস গেড়েছে সেহেতু প্রথম ও দ্বিতীয় পক্ষের জন্য মাথা গোজার জন্য অবশিষ্ট আর কিছুই নেই। এক চিলতে উঠানে নতুন ঘর নির্মাণও দুষ্কর । রাফেজা বেগমকে উৎখাত অথবা তার অনুগ্রহ হয়ে তার ঘরের অপর অংশে আশ্রয় নেওয়া ভিন্ন তাদের বিকল্প আর কিছু নাই । তখন অধিকার বঞ্চিত হওয়ার ক্ষোভ অথবা নিজেদের পীড়িত দশার হতাশা লাঘবে মৃত রমিজ মাঝিকে অহেতুক সংসার বড় করার দায়ে কতল করার নিয়ত করে ফজল । জীবদ্দশায় পিতাকে শায়েস্তা করতে না পেরে মৃত পিতাকেই শায়েস্তা করাই উপযুক্ত বিবেচিত হয় তার কাছে । জড়ো হওয়া লোকেরা ফজল কে থামানো উচিত নাকি সায় দেয়া উচিত তাই নিয়ে এক মনস্তাতিক লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয় । এক পক্ষ অবশ্য চা বিড়ি ফুকার সময় আজকের এই ঘটনা নতুন মাত্রা যোগ করবে ভেবে আনন্দিতই হয় ।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ৮:০৫

রাজীব নুর বলেছেন: চমৎকার গল্প।

২| ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ১:১৪

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: আপনার গল্পের লেখনী প্রথাগত থেকে আলাদা মনে হয়েছে। +++ শব্দচয়ণে আরেকটু যত্নবান হলে ভাল হয়। ++++

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.