![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আজ ৮ মার্চ, ২০১৪ "আন্তর্জাতিক নারী দিবস"। আমি আমার সংগঠন "আমরা ফাউন্ডেশন" এর পক্ষ থেকে দেশের ও বিশ্বের নারী সমাজকে এই দিবসের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি। একটি সুখ, সমৃদ্ধ ও সমতা ভিত্তিক পৃথিবী গড়ার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাধনে পুরুষের পাশাপাশি নারীর অংশগ্রহণ এখন সময়ের দাবি।
উত্তর আমেরিকার শ্রম আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নারী দিবসের পথ চলা শুরু হয়। ১৯০৯ সালে আমেরিকায় প্রথমবারের মত জাতীয়ভাবে নারী দিবস উদযাপন করা হয়। পরে ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসাবে ঘোষণা করে। শত বছর পাড়ি দিয়ে বর্তমানে আন্তর্জাতিক নারী দিবস প্রায় সব দেশেই উদযাপন করা হয়। হিউম্যান রাইটস ডিক্লারেশন থেকে আমাদের সংবিধানও নারী ও পুরুষের মধ্যে সমতার ব্যাপারটি নিশ্চিত করেছে। তথাপি দেশ ও বিদেশে নারীরা প্রতিনিয়ত নির্যাতিত ও নিপীড়িত হচ্ছে, যা, এই দিনটি উদযাপনের বাস্তবতা প্রমান করে।
বিগত কয়েক দশক ধরে আমাদের দেশেও এই দিবসটি বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে উদযাপিত হচ্ছে। তবে আমাদের দেশে এর আবহ অন্যান্য দেশের তুলনায় কিছুটা ভিন্ন। এদানিংকালে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নারীদের অর্জন বেশ আশা জাগানিয়া। তারপরেও, নারী উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে আমাদের দেশের নারীরা অনেকটা পিছিয়ে আছে। দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে পিছিয়ে পড়া নারী সমাজকে সামনে এগিয়ে আনতে রাষ্ট্রীয় নীতিমালা, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক আইনকানুন, বিধিবিধানের প্রয়োগ থাকলেও কাঙ্ক্ষিত সফলতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। নারী ও মেয়ে শিশুর প্রতি সহিংসতা মোটেও কমছে না বরং ক্ষেত্র বিশেষে তা আরো বাড়ছে। যা খুবই উদ্বেগের ব্যাপার। ধর্ষণ, অ্যাসিড নিক্ষেপ, ইভ টিজিং ও যৌতুকের দাবিতে নির্যাতনসহ নানা রকমের সহিংসতা দমনে রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। যা খুবই দুঃখজনক। এই ধরনের বর্বর ঘটনা নারীর মর্যাদা ও অধিকার বাস্তবায়নের পথকে দীর্ঘায়িত করছে। যদিও নারী পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ব্যাতিত আমাদের কাঙ্ক্ষিত সফলতা অর্জন সম্ভবপর নয়। তাই হয়ত আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন-
"বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর"
বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষি নির্ভর। মোট শ্রম শক্তির ৪৮.১ শতাংশ সরাসরি কৃষি খাতে জড়িত। দেশের নারী সমাজের অধিকাংশই গ্রামে বসবাস করে। গ্রামে নারীর শ্রমের বিনিময়েই দেশে উন্নয়নের ভিত আস্তে আস্তে পোক্ত হচ্ছে। যদিও নারীর অনেক শ্রমই মূল্যহীন রয়ে যায়। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে বর্তমান দেশে প্রায় ১ কোটি ৩৬ লাখ ৭৬ হাজার নারী সরাসরি কৃষি খাতের সঙ্গে জড়িত আছে।
গ্রামের নারী শ্রমিকরা তাদের পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মত কৃষি কাজে ব্যাস্ত থাকলেও তাদের নুন্যতম মূল্যায়নও হয় না। তার উপর রয়েছে মজুরি বৈষম্যসহ অন্যান্য সমস্যা। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক তথ্যে জানা যায় যে, বর্তমানে প্রায় ২ কোটি নারী ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহীতা রয়েছে। বেসরকারি সংস্থাসমুহ তাদের জন্য ক্ষুদ্র ঋণের ব্যাবস্থা করলেও উক্ত অর্থের উপর তাদের নিয়ন্ত্রন থাকে না বললেই চলে। সরকারি বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি নারী বান্ধব না হওয়ায় তাদের সঞ্চয়ের ব্যাপারটিও থাকে অবহেলিত। এতে নারীর আর্থিক নিরাপত্তা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। মাতৃত্বকালীন ভাতা বা ছুটি যেন এক বিলাসিতা।
বেসরকারি সেবা ও ম্যানুফেকচারিং খাতে অনেক নারীর কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। তৈরি পোশাক খাতে বর্তমানে প্রায় ৩০ লাখ নারী প্রত্যক্ষভাবে জড়িত আছে। ব্যাংক বীমাসহ অন্যান্য খাতে আরো অনেক নারী সুনামের সাথে কাজ করছে। তৈরি পোশাক খাতে নারীরা মজুরিসহ অন্যান্য ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সেবাখাতে সংশ্লিষ্ট অনেক শিক্ষিত কর্মজীবী নারীরা মাতৃকালীন ছুটির মত অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যা অনভিপ্রেত। অনেক শিক্ষিত নারী চাকরি ছেড়ে বাচ্চা লালন পালনে বাধ্য হচ্ছে।
বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান আইসিটি খাতে নারীর অংশগ্রহণ হতাশাজনক। নারীরা শুরু থেকে এই নব যাত্রায় পিছিয়ে আছে। আইটি শিক্ষা খাতে নারীরা বেশ পিছিয়ে আছে এমনকি এর ব্যাবহারেও নারীদের অংশগ্রহণ নিতান্ত কম। এই পিছিয়ে থাকার দরুন অনেক ক্ষত্রে নারীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। সাইবার বুলিইংয়ের প্রধান শিকার হচ্ছে তথ্য প্রযুক্তি খাতে পিছিয়ে থাকা নারীরা। প্রতি মাসে সাইবার অপরাদের কারনে কোনও না কোন নারীকে আত্মহননে বাধ্য করা হচ্ছে।
সামাজিক যেসব সূচকে আমরা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পাচ্ছি তাতে নারীরা রাখছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। অথচ নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রধান বাধাসমুহ যেমন বাল্য বিবাহ, মাতৃ মৃত্যুহার, অশিক্ষা ও জীবন ধারনের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাব চিহ্নিত করা গেলেও এই ব্যাপারে আমাদের অর্জন তেমন সুখকর নয়।
অনেক গবেষণায় এটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, নারী ও মেয়ে শিশুর উপর বিনিয়োগ জাতীয় প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে। তথাপি, মেয়ে শিশু ও কিশোরীদের প্রতি আমাদের সমাজের আচরণ অনেকটা রক্ষণশীল। মেয়েদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার ব্যাপারটি নিশ্চিত করা গেলে বাল্য বিবাহ অনেকটা রোধ করা সম্ভব হবে এবং সেই সাথে প্রসবকালীন মৃত্যু হার একবারে কমে আসবে। এতে নারীর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করে তার মেধাকে জাতীয় উন্নয়নে সংযুক্ত করা সম্ভবপর হবে। নারী শিক্ষায় আরো মনোযোগী ও বিনিয়োগ বাড়ালে পরবর্তী প্রজন্মের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা নিয়ে সরকারকে আর ভাবতেই হবে না।
দেশে প্রায় ৪০ শতাংশ লোক চরমভাবে দরিদ্র। এই দরিদ্র অংশের অধিকাংশ আবার নারী। প্রয়োজনীয় কারিগরি দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে নারীরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারে। বিভিন্ন অপ্রচলিত পেশায় নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারলে তা দারিদ্র বিমোচনে বেশ কাজে আসবে।
সামাজিক বিভন্ন সুচকে নারীর কদর্য অবস্থানকে উন্নত করার মাধ্যমে জাতীয় উন্নতি বেগবান করতে চাইলে এখনই প্রয়োজন ব্যাপক সামাজিক বিনিয়োগ। দেশে বর্তমানে নারী উন্নয়নকল্পে অনেক নীতিমালা, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক আইনকানুন, বিধিবিধান কার্যকর রয়েছে। এখন দরকার এর বাস্তব সম্মত প্রয়োগ। কন্যা শিশু ও কিশোরীদের বাধামুক্ত পরিবেশে বাড়তে দেয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে। নারীকে ভীতিমুক্ত পরিবেশে বেড়ে উঠতে দিলে সে সোশ্যাল ক্যাটালিস্ট হিসাবে কাজ করতে সক্ষম হবে। মনস্তাত্তিক ও সামাজিক বাঁধাসমূহ দূর করে নারীর জন্য লেভেল প্লেইং ফিল্ড তৈরি করতে হবে। সেই চেষ্টাটা আমার মনে হয় আমাদের ঘর থেকেই শুরু করা উচিত। আজ আপন বোন, ভাগিনি আর ভাতিজিদের যদি পথ দেখাই তাইলে এক সময় তারাই পরবর্তী প্রজন্মকে পথ দেখাতে পারবে। নারী যদি উন্নয়নের পথে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয় তাইলে একটি সমৃদ্ধ ও সমতা ভিত্তিক পৃথিবী গড়া সম্ভবপর হবে যেখানে নারী ও পুরুষ একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠতে সক্ষম হবে।
"সেদিন দূরে নয়-
যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়"
(জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম)
মোঃ জাকারিয়া জামান
প্রেসিডেন্ট, আমরা ফাউন্ডেশন
©somewhere in net ltd.