![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
শখের লেখক। লিখতে ভালো লাগে, তাই লিখি।
প্রথম পর্ব এখানেঃ Click This Link
যখনকার কথা বলছি, তখন আমি তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ি। সেবার প্রচুর বন্যা হয়েছিলো। ক্লাশ বন্ধ থাকায় গ্রামের বাড়ি চলে আসলাম মা’র সাথে। বাবা চাকুরীতে থাকায় তিনি আসতে পারলেন না। গ্রামটা তখনো ঘন ঝোপ-জঙ্গলে ভর্তি। চারদিকে শুধু বন-জঙ্গল আর বাঁশঝাড়। এর মাঝেই মাঝে মধ্যে খবর পাওয়া যায়, বাঁশের বাড়ি খেয়ে অমুক জখম হয়েছে। রাস্তা দিয়ে চলতেই হুট করে অমুক বাঁশের আগায় উঠে গেছে। আমাদের বাড়ির গোয়ালা নাকি একবার গরু নিয়ে বাঁশঝারের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলো। ঝড়ে ভেঙ্গে নুইয়ে পড়া বাঁশগাছ থেকে গরুটা পাতা চিবোচ্ছিলো। এরই মাঝে হঠাৎ করে একটা বাঁশ নাকি সাই করে উপরে উঠে যায় আর বাঁশের আগা তার গেঞ্জির কলারে আটকে যায়।
বেচারার অবস্থা আর দেখে কে? ভয়ে আত্মারাম খাপছাড়া হওয়ার উপক্রম। চোখ বন্ধ করে বেচারা চিৎকার করতে লাগলো- “ও মা গো, জ্বীনে ধরছে গো! বাঁচাও গো!” ততক্ষণে সারা গাঁয়ের মানুষ সেখানে জড়ো হয়ে গেছে। ওইদিকে গোয়ালার চিৎকার বেড়েই চলছে- “কেউ বাঁচাও গো। মাইরা ফালাইবো গো।” এই বলে সারা শরীরের শক্তি এক করে বাঁশ গাছটি ধরে ছিলো। আগায় দেড় মণ ওজন নিয়ে বাঁশ গাছটি ইতস্তত চারদিকে ঝুলছিলো। এই ভার গাছটি বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারলো না। গোয়ালা বেটা এতো লম্ফঝম্প না করলে বোধকরি গাছটার এই দুরাবস্থা হতো না। কিন্তু, ভাগ্যের লিখন না যায় খন্ডন। কেউ কিছু করার আগেই মড়মড় শব্দে গাছের গোড়া ভেঙ্গে গেলো এবং ফলস্বরূপ গোয়ালা চিতপটাং।
সেই থেকে ব্যাটা ছয় মাস যাবৎ শয্যাগত। মাঝে মাঝেই উল্টাপাল্টা কথা বলে। লোকে বলে জ্বীনের আছর। যাহাই হোক না কেনো, সবচেয়ে তাজ্জব ব্যাপার হলো তার জন্য যে ৫০০ গ্রাম আঙ্গুর নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো, সেটা সে তিন ঢোকে শেষ করে দিয়েছিলো। লোকে যেভাবে ড্রিঙ্কস করে, সেরকমভাবে। চিন্তা করতে পারেন!
আসলে সেই সময়ে আমাদের গ্রামটাই এরকম ছিলো যে, সবসময় গা ছমছম একটা ভাব থাকতো। দিনের বেলাও কাছের দোকানে একা একা যাওয়ার সাহস হতো না। রাত্রিবেলা তো পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠে। একে তো কারেন্ট নেই, কুপিবাতির নিভু নিভু আলোতে সবকিছু কেমন যেনো ভৌতিক ভৌতিক লাগে। তার উপর আবার মাঝে মাঝে হটাৎ করেই কানের কাছে শেয়াল ডেকে উঠে হুক্কা-হুয়া করে। আকস্মিক এই শব্দে যে কোন দুর্বল চিত্তের মানুষের নার্ভাস ব্রেকডাউন হতে বাধ্য।
আমাদের রুমটা বাড়ির অন্যান্য রুম থেকে একটু দূরে। পাশের ব্লকে দাদী আর চাচা-চাচি থাকেন। আমাদের ব্লকটা সবসময় খালিই পড়ে থাকে। বছরে এক-দুইবার আমরা আসলে ব্যাবহার করি। সুতরাং, অনেকদিন পর বাড়িতে আসলে ঘষামাজা করতেই অনেক সময় লেগে যায়, কেননা কেউ না থাকার দরুণ আমাদের ব্লকটা বাদুড়ের অভয়ারণ্য হয়ে উঠে। এমনকি, সব ঠিকঠাক করার পরেও রাত্রি বেলা হঠাৎ করেই দুইএকটা বাদুড় ছিলিং এর উপর থেকে লাফ দিলে আত্মা ছ্যাঁত করে উঠে। বাদুড়গুলোও বদমাইশের একশের। তাদেরকে ঘায়েল করা যেনতেন কাজ না। ছোটবেলায় ভাবতাম, বাদুড় তো চোখে দেখে না। তাহলে লাঠি তুলে ধরলেই পালিয়ে যায় কীভাবে? এখন বুঝি, আসলে বাদুড়েরা দেখতে পায়। কোন ব্যাটা কবে বোধকরি বলে ফেলেছিলো যে বাদুড়েরা দেখতে পায় না, তাই সবাই মেনে নিয়ে ফলাও করে প্রচার করে। এরকম আরও কত সিরিয়াস মিথ যে আমরা সত্য জেনে বসে থাকি, তার খবর শুধু উপরওয়ালাই জানেন। বাদুড়ের চরিত্র বিশ্লেষণ আমার কাজ না। সে কাজ প্রানিবিদরা অনেক ভালো পারবেন। আমি মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি।
বাড়িতে গেলে আমি আর আমার মা আমাদের ব্লকে ঘুমাতাম। মা ছিলেন অনেক সাহসী। তা না হলে এরকম একটা জায়গায় আলাদা ব্লকে আমার মত ছোট একটা মানুষকে নিয়ে থাকা কি সম্ভব ছিলো? আমি বাজি ধরে বলতে পারি, যারা নিজেদেরকে হৃষ্টপুষ্ট সাহসী ভাবেন, তাদেরকে যদি সেই সময়ে আমাদের ব্লকে রাত্রিবেলা একা একা ছেড়ে দেওয়া হতো, তাহলে সকালবেলা উঠে কাপড়চোপড় অক্ষত থাকার সম্ভাবনা খুবই কম থাকতো।
যেদিন বাড়িতে গেলাম, সেদিন কিছুই ঘটলো না। কাহিনীটা ঘটলো পরের দিন রাত্রে। সেই ভয়ঙ্কর ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা আমি এখানে দেবো।
গ্রামাঞ্চলে রাত নামে অনেক তাড়াতাড়ি। তার উপর যদি কারেন্টহীন হয়, তাহলে তো কথাই নেই। সুতরাং, সন্ধ্যা নামার পরপরই আমরা রাতের খাওয়া শেষ করে টয়লেট করে শুয়ে পড়তাম। টয়লেট টা ছিলো অনেক ভেতরের দিকে এবং সম্পূর্ণ নতুন একটা ব্লকে। তাই স্বভাবতই সেখানে অন্ধকারে রাত্রিবেলা যাওয়ার মতো বুকের পাটা কারোরই ছিলো না। অগত্যা প্রাকৃতিক সকল কাজ ভালোভাবে সম্পাদন করে ঘুমোতে যেতে হতো।
সেদিন রাত্রে সকল কাজ শেষ করে আমি আর মা শুয়ে পড়লাম। যদিও আমার ঘুম আসছিলো না। অতিরিক্ত গরম, তার উপর কারেন্ট নেই। তাই জানালা খোলা ছিলো। জানালা দিয়ে একটু দূরেই আমাদের পারিবারিক গোরস্থানটা দেখা যায়। রাত্রি বেলা অদ্ভুত আঁধারে গোরস্থানটাকে কেমন যেনো রহস্যময় লাগছিলো। কেমন যেনো একটা অনুভূতি হছিলো। মনে হচ্ছিলো, এই বুঝি কবর থেকে কেউ একজন উঠে আমাকে জাপটে ধরবে। অবশ্য, ওই বয়সে এরকম একটা ধারণাকে পুরোপুরি অমূলক বলা যায় না। এরকম নানা কিছু চিন্তাভাবনা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি বলতেই পারি না।
ঘুম ভাঙলো কেমন যেনো অস্বাভাবিকতায়। কিন্তু কি অস্বাভাবিকতা, সেটা ধরতে পারছিলাম না। কিন্তু, কিছুক্ষণের মাঝেই বুঝলাম কেমন যেনো শীত করছে। ভীষণ রকমের শীত। কিন্তু, এখন তো শীত লাগার কথা না। ততক্ষণে আমার ঘুম পুরোদমে ভেঙ্গে গেছে। মা’কে ঘুম থেকে জাগানোর চিন্তা করলাম। এই শীতে একটা কাঁথা ছাড়া তো চলছে না। কিন্তু, মা’কে ডাক দিতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম, মা জেগে আছেন। চোখ খোলা। কিন্তু, কথা বলতে পারছেন না। মুখ কেমন নীল হয়ে গেছে। জানালা দিয়ে গড়িয়ে পড়া আবছা চাঁদের আলোয় নীলাভ রঙকে কেমন যেনো কালচে দেখাচ্ছে।
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। বুঝতে পারছিলাম, মা কিছু বলতে চাচ্ছেন। অনেকটা নিজের অজান্তেই আমার হাত মা’র মুখের দিকে চলে গেলো এবং আমি খুব শীতল একটা কিছু অনুভব করলাম। খুব শীতল। ফ্রিজে পানি রেখে দিলে সবচেয়ে ঠান্ডা যে বরফটি পাওয়া যায়, তার চেয়েও শীতল। ঝট করে সাথে সাথেই হাত সরিয়ে নিলাম। এতে যেনো জাদুর মতো কাজ হলো। হঠাৎ করেই মা ঝট করে বিছানায় উঠে বসলেন এবং মুখ দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলেন। মানুষকে পানির নিচে এক মিনিট রেখে দেওয়া হলে বাতাসের সংস্পর্শে আসলে যেমন হাভাতের মত শ্বাস নেয়, অনেকটা সেরকম। ধীরে ধীরে মা’র মুখের নীলাভ ভাবটা কেটে যেতে লাগলো। তাতে করে আমিও স্বস্তি পেলাম। মা আমার কাছে এক গ্লাস পানি চাইলেন, আমি কলসি থেকে পানি এনে দিলাম। সেটা এক চুমুকে শেষ করে আবার শুয়ে হাঁপাতে লাগলেন।
আমি কি হয়েছিলো জানতে চাইলাম। মা বললেন, “বাজে স্বপ্ন দেখেছি বাবা!” অথচ আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম, মা মিথ্যা বলছেন। কেননা, আমি ডাক দেওয়ার সময় তিনি সজাগ ছিলেন এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। মনে হচ্ছিলো, অস্বাভাবিক ঠান্ডা একটা মনুষ্যবিহীন হাত মা’র মুখ চেপে ধরে রেখেছিলো। কিন্তু, আমি ভয় পাবো সেজন্য মনে হয় মা আমার কাছে প্রকাশ করলেন না। আমার নিজের অনেক ভয় করছিলো, তাই মা’কে আর ঘাঁটালাম না।
এমন সময় স্টোররুমে একটা শব্দ হলো। ধানের গোলার পাশে যেসব পুরনো কাঁসা-পিতলের জিনিসপত্র ছিলো, সেগুলো ঝন ঝন করে একটার পর একটা পড়তে লাগলো। মনে হয় যেনো প্রচন্ড আক্রশে কেউ সবকিছু ভাঙচুর করছে। এতে করে মা অনেক ভয় পেয়ে গেলেন। ভয়ের মাত্রা টা বুঝতে পারলাম, যখন মা এতো ভাঙচুর হওয়ার পরেও কোন কথা বললেন না। আমার মা অগোছালো কোন কিছু একেবারে পছন্দ করেন না। তাই, অন্য যেকোনো সময় হলে সাথে সাথেই সব গুছিয়ে রাখতেন। কিন্তু, এখন পরিস্থিতি অনেকটাই আলাদা। কিছুক্ষণ আগে এমন একটা ব্যাপার ঘটে গেছে যে, এখন সবকিছুই অশরীরী মনে হচ্ছে। এখন যাই গোলমাল বাঁধুক না কেনো, মনে হবে সবকিছুতেই জ্বীনের হাত আছে। মানবমনের বৈশিষ্ট্যই তো এমন। কোন একটা কিছু মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকলে সামনে যাই ঘটুকনা কেনো, সবকিছুর সাথেই সেই জিনিসের একটা যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়।
ঝন ঝন শব্দ শুনে পাশের ব্লক থেকে দাদী চেঁচিয়ে মা’কে উদ্দেশ্য করে বললেন- “জান্নাত! জেগে আছো?”
দাদী যে রুমে থাকেন, সেটা আমাদের রুম থেকে মাত্র এক গজ দূরে হবে। কিন্তু, সম্পূর্ণ আলাদা ব্লক। তাই যোগাযোগের কোন দরজা নেই। বরং দুই রুমের মাঝখান দিয়ে বাইরে যাওয়ার রাস্তা।
দাদীর কথা শুনে মা কিছুটা স্বস্তি পেলেন। বললেন- “হ্যাঁ মা। শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো।”
যেহেতু অস্বাভাবিকভাবে ঘুম ভেঙ্গে গেছে এবং বলা যায় ঘুমটা অনেক গাঢ় হয়েছিলো। তাই এটা বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, এখন নিশ্চয়ই মাঝরাত। এখন তো দাদীর জেগে থাকার কথা না। তার মানে নিশ্চয়ই দাদীরও ঝন ঝনানির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেছে। দাদী উত্তর দিলেন- “আর বলো না। ইদানিং বেড়ালগুলো যা জালাচ্ছে না! এখন আর জালাবে না। ঘুমিয়ে পড়। কাল সকালে সব ঠিকঠাক করো।”
“আচ্ছা মা।” বলে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মা শুয়ে পড়লেন। তার মানে, এই দুটি ব্যাপার সম্পূর্ণ আলাদা। বাসন-কোসন পড়ার সাথে ওই ঠান্ডা হাতের কোন যোগসুত্র নেই। মা অন্তত তাই ভাবলেন এবং ওই ঠান্ডা হাতটার কথা স্বপ্ন বলে ধরে নিলেন। আমাকে বললেন- “শুয়ে পড় বাবা! ভয় পাওয়ার কিছু নেই।”
আমি কিন্তু অতটা নিশ্চিন্ত হতে পারলাম না। কেননা, সেই ঠাণ্ডা অনুভূতি আমার কাছে তখনো কেমন যেনো টাটকা লাগছে। মা হয়তোবা ভাবছেন, সবটাই তার মনের ভুল। কিন্তু, আমিও যে এটার সাক্ষী! তাহলে এটা ভুল কীভাবে হয়! একসাথে দুইটা মানুষ তো আর একই জিনিস নিয়ে ভুল করতে পারে না। তবু মা’কে কিছু বললাম না। শুধু শুধু ভয় দেখিয়ে কি লাভ! ওইরকম ছোট বয়সেও আমি এরকম একটা ঠান্ডা চিন্তার কাজ কি করে করলাম, আজও ভেবে অবাক হই।
কিছুক্ষণের মাঝেই মা বেঘোরে ঘুমিয়ে পড়লেন। আমি কিন্তু ঘুমাতে পারলাম না। কেবলই মনে হচ্ছিলো এই বুঝি কেউ এসে ঠাণ্ডা হাতে আমার গলা চেপে ধরবে। সামান্য শব্দেই কেমন পিলে চমকে উঠছিলাম। ঘরের মাঝের আসবাবপত্র- আলনা, চেয়ার যাই দেখিনা কেনো, সবকিছুই মানুষের মত মনে হচ্ছিলো। আর মনে হচ্ছিলো এই বুঝি আক্রমণ করে বসবে। আমি মা’র দিকে আরও একটু চেপে শুয়ে পড়লাম। তাতে করে ভয় কিছুটা কমলো। অনেক কষ্ট করে চোখ বন্ধ করে রাখলাম, যাতে করে কিছু দেখতে না হয়। কেননা, আমি যাই দেখি তাই অস্বাভাবিক লাগছিলো এবং তাতে করে আমার ভয় আরো বেড়ে যাচ্ছিলো। এরকম দোটানার মাঝে একসময় নিজের অজান্তেই আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।
তখনো জানতাম না পরের দিন আমার জন্য কি চমক অপেক্ষা করছে। কিন্তু, যে চমক পেলাম সেটা এতোই ভয়াবহ ছিলো যে তারপর আর একরাতও সেখানে থাকার সাহস করতে পারিনি এবং তার দুই বছরের মধ্যে আমি আর গ্রামের বাড়ির পথ মাড়াই নি।
তৃতীয় পর্ব ঃ Click This Link
০৮ ই মার্চ, ২০১৫ দুপুর ২:৩২
আল কাফি বলেছেন: ধন্যবাদ
©somewhere in net ltd.
১|
০৭ ই মার্চ, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৫৮
নাসিফ ওমর বলেছেন: অপেক্ষায় রইলাম