নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আবু উযাইর

আবু উযাইর › বিস্তারিত পোস্টঃ

একটি বিস্ময়কর ডায়াগনোসিসের গল্প (ডাক্তারদের জন্য হলেও সকলেই পড়তে পারেন)

১৩ ই জুন, ২০১৩ বিকাল ৫:৩৩

ইন্টেস্টাইনাল অবস্ট্রাকশন নামের একটি গুরুতর রোগ আছে, যার বাংলা হতে পারে অন্ত্র বন্ধ হয়ে যাওয়া। মানুষের শরীরের পাকস্থলির পর থেকে শুরু হয় জট পাকানো দীর্ঘ ক্ষুদ্রান্ত্র আর এর পর থাকে আকারে মোটা কিন্তু দৈর্ঘ্যে ছোট বৃহদান্ত্র। খাবার হজম করে এর থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি বের করার মূল কাজটা করে রাবারের পাইপের মতো দেখতে এই অন্ত্র বা ইন্টেস্টাইন। এখানকার কোন একটা যায়গা যদি কোন কারণে বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে সে অবস্থাই হলো ইন্টেস্টাইনাল অবস্ট্রাকশন। এ সকল ক্ষেত্রে রোগীর পায়খানা বন্ধ হয়ে যায়, পেট ফুলে উঠে ও প্রচুর বমি হতে থাকে। এক্ষেত্রে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করে অপারেশন করতে হয়, না হলে অন্ত্রের পচন ধরে যায় এবং মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।



ঘটনাটি ২০০৫ সালের দিকের। ঢাকা মেডিকেল কলেজের সার্জারী বিভাগের একটি ইউনিটে ভর্তি হয়েছেন ৬৫ বছর বয়স্ক আবুল হোসেন (ছদ্ম নাম)। বেশ কিছুদিন ধরে বমি হচ্ছিল তাঁর। অবশেষে পাঁচদিন ধরে পায়খানা বন্ধ হয়ে পেট ফুলে গেলো। ডায়াগনিস অবধারিতভাবে ইন্টেস্টাইনাল অবস্ট্রাকশন। সার্জারী বিভাগে তাঁকে ভর্তি করা হলো। শরীরের আনস্টেবল অবস্থা, ফ্লুইড ও ইলেকট্রোলাইটের ব্যালান্স ইত্যাদি ঠিক হয়ে এলেই অপারেশন করা হবে। ভর্তির দ্বিতীয় দিন রাতে রোগীর হঠাৎ খিঁচুনী হলো এবং সংজ্ঞাহীন হয়ে গেলেন তিনি। অজ্ঞান হবার কারণ হিসাবে শক (শরীরের কোন অবস্থার কারণে ভেতরের নানা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে রক্ত সরবরাহ কমে যাওয়া) নামের বিপদজনক বিষয়টির কথাই ভাবা হলো। কিন্তু রোগীর পালস, ব্লাডপ্রেশার ইত্যাদি শকের বার্তা দিচ্ছিল না। রোগীর যেহেতু খিঁচুনী হয়েছে এবং যেকোন খিঁচুনীর উৎস হলো ব্রেইন বা মস্তিষ্ক, তাই ব্রেইনের অবস্থা জানার জন্য সার্জারীর তখনকার প্রফেসর সিটি স্ক্যান করার জন্য পাঠালেন। সিটি স্ক্যানে দেখা গেলো ব্রেইনের সেরিব্রামে (মস্তিষ্কের সবচেয়ে বড় অংশ) একটি ইনফার্ক্ট দেখা যাচ্ছে সাথে আছে এর কারণ জমাট বাঁধা রক্ত। এ ধরণের জমাট রক্ত থেকেই হয় এক ধরণের স্ট্রোক। তাহলে এই রোগী হাসপাতালে আসার পর স্ট্রোক করেছে। যাক, অবশেষে উৎস খুঁজে পাওয়া গেছে। সার্জারীর সবাই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। স্ট্রোকের চিকিৎসার জন্য রোগীকে রেফার করা হলো নিউরোমেডিসিন বিভাগে। আসল বিস্ময় অপেক্ষা করছিলো সেখানেই।



নিউরোমেডিসিন বিভাগের প্রধান এলেন। সাথে চারজন অ্যাসোসিয়েট প্রোফেসর, কনসাল্ট্যান্ট সহ একদল তরুণ চিকিৎসক। স্যার এসে সব হিস্ট্রি শুনে যা বললেন তাতে বিস্মিত হলো সবাই। স্যার বললেন, "এটা স্ট্রোক নয়, এটা ব্রেইনে সেকেন্ডারি (শরীরের অন্য কোথাও ক্যান্সার থাকলে যখন তা সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে, তখন দেহের বিভিন্ন স্থানে নতুন করে ক্যান্সার তৈরী হয় যেগুলোকে বলে সেকেন্ডারি)। সম্ভবত তার অন্য কোথাও প্রাইমারি ক্যান্সার আছে"। আমরা সবাই বিস্ময়ে হতবাক। একজন প্রশ্ন করল "স্যার, কিভাবে এটা সম্ভব?" স্যার যেভাবে বললেন তা আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনলাম। তিনি বললেন-

"রোগীটির যদি ইনফার্কশন থেকে স্ট্রোক হয়ে থাকে তাহলে অজ্ঞান বা খিঁচুনী হবার সম্ভাবনা খুব কম। আর সিটি স্ক্যানে যেটা ইনফার্ক্ট হিসাবে রিপোর্টে এসেছে তা সেকেন্ডারী হবার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশী"।

"কিন্তু স্যার তাহলে রোগীর পেট ফুলে যাওয়া, পায়খানা বন্ধ হওয়া আর বমি কেন হবে? এটা তো ইন্টেস্টাইনাল অবস্ট্রাকশন ছাড়া অন্য কিছু ভাবার কথা না"।

"প্রথম ভাবনা হিসাবে অবশ্যই তা আসা উচিৎ। তবে রোগিটার সম্ভবত আগেই ক্রনিক ভমিটিং ছিল। বমির ফলে তার দেহের পটাশিয়াম কমে গেছে। পটাশিয়াম কমে প্যারালাইটিক আইলিয়াস (অন্ত্র প্যরালাইজড হয়ে কাজ বন্ধ করে দিয়েছে) হয়েছে। এর ফলেই তার পেট ফুলেছে ও কনস্টিপেশন হয়েছে"।

"প্রাইমারি ক্যান্সারটা কোথায় স্যার?"

"যে কোন যায়গায় হতে পারে। লাংস এর ক্ষেত্রে বেশী হয়। একটা এক্সরে করে আগে লাংসটা দেখ"।



এক্সরে করা হলো। আশ্চর্য ব্যাপার। সত্যিই দেখা গেলো লাংসে ভয়ানকভাবে বাসা বেঁধে আছে ছড়িয়ে পড়া প্রাথমিক ক্যান্সার। পরদিনও স্যার রাউন্ডে এলেন রোগীটিকে দেখতে। জ্ঞান ফিরে আসেনি এবং আসার প্রশ্নও আসেনা। স্যার রোগীর লোকদের ডেকে বুঝিয়ে বললেন। স্বভাবিকভাবেই তারা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়লো। কিছুতেই মানতে পারছিল না কথাগুলো। রাউন্ড শেষ হবার পর ওদের দুজন আমাদের কাছে এসে প্রবল আপত্তিও জানালো। এক সপ্তাহ আগে সুস্থ্য একটি লোককে এভাবে শেষ অবস্থার ক্যান্সার ঘোষণা করাটা ঠিক হয়েছে কিনা সে কথাও জানালো। তবে পরদিন রাতেই মারা গেলো রোগীটি। আমরা সবাই শোকে বিহবল ছিলাম সেদিন ঐ পরিবারটির সঙ্গে। এই দুঃখের সময়েও পরিবারের কয়েকজন ডাক্তারদের কাছে অ্যাপোলজি করলো।



এই ডায়াগনোসিস এতো বিস্ময়কর ছিলো যে, আমরা যারা তখন উপস্থিত ছিলাম তাদের সবার জন্যই এটা একটি স্মরণীয় ঘটনা হয়ে আছে। সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতি ও ডায়নস্টিক সুবিধা সম্বলিত দেশেও এ ধরণের রোগী মিস ডায়াগনোসিস হয়ে অপারেশন টেবিলে বা অপারেশনের পর পর মৃত্যু হবার সম্ভাবনা বোধ করি শতকরা পঁচানব্বই ভাগ। এই বিস্ম্যকর ডায়াগনোসিস রোগীটিকে বাঁচাতে পারেনি সত্য, তবে তা অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যা থেকে মুক্তি দিয়েছে সকলকে। সার্জনরা যদি অপারেশন করতে যেত তাহলে অপারেশন টেবিলে বা অপারেশনের পর পর রোগী মারা যাবার সম্ভাবনা ছিল শতভাগ।



মানুষ ভুল করবেই আর ভুল করবে চিকিৎসকরাও এবং তা হয় পৃথিবীর সবখানেই। তবে ভুল চিকিৎসার জন্য আমাদের দেশের মতো হেনস্তা আর কোথাও হতে হয় কিনা সন্দেহ আছে। আর চিকিৎসা সাফল্যের কোন পুরস্কার বা উৎসাহ আমাদের দেশেই হয়তো সবচেয়ে কম। দিন শেষে চিকিৎসায় সুস্থ্য কোন একজন রোগীর কৃতজ্ঞ হাসিই হয়তো এদেশের চিকিৎসকদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।

মন্তব্য ১৯ টি রেটিং +৭/-০

মন্তব্য (১৯) মন্তব্য লিখুন

১| ১৩ ই জুন, ২০১৩ বিকাল ৫:৫৫

েনহ।ল বলেছেন: আপনাদের স্যার তো পুরা HOUSE এর মত ।। চমৎকার story

১৩ ই জুন, ২০১৩ রাত ৮:১৯

আবু উযাইর বলেছেন: ধন্যবাদ। কিন্তু হাউজ কি ভাই?

২| ১৩ ই জুন, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:০৬

টানিম বলেছেন: ভালো লাগলো ।

১৩ ই জুন, ২০১৩ রাত ৮:২০

আবু উযাইর বলেছেন: ধন্যবাদ।

৩| ১৩ ই জুন, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:২২

মদন বলেছেন: এগুলোতো ভাই একদিনে হয় না। অনেক স্টাডী, দীর্ঘ অভিজ্ঞতা আর ঐকান্তিক অধ্যাবসায়ের ফল। শুনতে যাদুর মতো মনে হলেও সবই ক্যালকুলেশনরে ফল।

অভিজ্ঞতার বিকল্প নেই।

১৩ ই জুন, ২০১৩ রাত ৮:২২

আবু উযাইর বলেছেন: এক্সাক্টলি তাই।

৪| ১৩ ই জুন, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:২৪

মদন বলেছেন: +

১৩ ই জুন, ২০১৩ রাত ৮:২২

আবু উযাইর বলেছেন: স্মাইলি।

৫| ১৩ ই জুন, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:৫৮

ডাঃ মোঃ কায়েস হায়দার চৌধুরী বলেছেন: দিন শেষে চিকিৎসায় সুস্থ্য কোন একজন রোগীর কৃতজ্ঞ হাসিই হয়তো এদেশের চিকিৎসকদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।

১৩ ই জুন, ২০১৩ রাত ৮:২৩

আবু উযাইর বলেছেন: হুঁ।

৬| ১৩ ই জুন, ২০১৩ রাত ৯:৪৩

না পারভীন বলেছেন: ভাল লাগল । ++

১৪ ই জুন, ২০১৩ রাত ১২:২১

আবু উযাইর বলেছেন: থ্যাংকস।

৭| ১৩ ই জুন, ২০১৩ রাত ১০:২১

রমাকান্তকামার১১০১১৪৫ বলেছেন: অভিজ্ঞতা বিশাল ব্যাপার...

১৪ ই জুন, ২০১৩ রাত ১২:২২

আবু উযাইর বলেছেন: নিসন্দেহে।

১৪ ই জুন, ২০১৩ রাত ১২:২৪

আবু উযাইর বলেছেন: নিসন্দেহে।

৮| ১৩ ই জুন, ২০১৩ রাত ১০:৩৭

আমিনুর রহমান বলেছেন:

ভালো লাগলো। আপনার পোষ্টে +++



দিন শেষে চিকিৎসায় সুস্থ্য কোন একজন রোগীর কৃতজ্ঞ হাসিই হয়তো এদেশের চিকিৎসকদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।



এই দেশেই হয়ত ভুল চিকিৎসার জন্য সবচেয়ে বেশী হেনস্তা হতে হয় এটাও হয়ত হতে পারে এই দেশেই রোগীরা সবচেয়ে বেশী অবহেলিত হয়। সবার ক্ষেত্রে বলছি না। একটা ছোট গল্প বলি- আবার বাবার চিকিৎসা'র জন্য আব্বুকে নিয়ে আমি ভারতের কলকাতায় যাই সেখানে রবীদ্রনাথ ঠাকুর কার্ডিয়াকে ডাঃ কুনাল এর সাথে সাক্ষাতের সময় ছিলো বিকাল ৩টা এবং উনি হাসপাতালে রোগী দেখতেন ৫টা পর্যন্ত কিন্তু আমরা হসপিটালে পৌছাই সন্ধ্যা ৭ টায়। স্বাভাবিকভাবেই ডাঃ কে আমরা পাইনি উনি বের হয়ে গেছেন। অন্য কোথাও উনাকে দেখানো যাবে কিনা যদি বলেন তো সেখানেই যাবো ভেবে উনাকে ফোন দিলাম। কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্য উনি আমাদের অপেক্ষা করতে বললেন হাসপাতালে উনি আসবেন আব্বু দেখতে। আধ ঘন্টার মধ্যে আসলেন এবং শুধু আব্বুকে দেখেই আবার চলে গেলেন। আরো ঘটনা শুনেছি ভারতের ডাক্তারটার কর্তব্য সম্পর্কে যা আমাদের দেশে খুব একটা শুনা যায় না।

১৪ ই জুন, ২০১৩ রাত ১:১২

আবু উযাইর বলেছেন: আপনার মূল্যায়ন ক্ষেত্রবিশেষে ঠিক আছে। তবে আমাদের দেশের ডাক্তারদের দারুণ সব কর্তব্যবোধের কাহিনীও কম নয়। কলকাতায় আপনার ভালো অভিজ্ঞতা হয়েছে। তবে কলকাতায় গিয়ে সাংঘাতিকভাবে প্রতারণার শিকার হতে হয়েছে এরকম রোগীও অনেক দেখেছি। আসলে ভালো-মন্দ মিলিয়েই আমাদের বসবাস।

৯| ১৩ ই জুন, ২০১৩ রাত ১১:২০

পীপিলিকা বলেছেন: ভাই লাংস ক্যান্সারের ম্যাটাস্টেসিসের ইন্টারেস্টিং কেইস হিস্ট্রি শুনলাম। ভালো লাগলো। সোজা প্রিয়তে..

১৪ ই জুন, ২০১৩ রাত ১:১৪

আবু উযাইর বলেছেন: ধন্যবাদ। খুবই ইন্টারেস্টিং হিস্ট্রি, যা সব ডাক্তারদের কাজে লাগবে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.