![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
অতি সম্প্রতি ফেসবুকে দেশের মুভিপ্রেমী গ্রুপগুলোতে একটি আলোচনা প্রধান কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে আর তা হল দেশের সিনেমা হল গুলোতে বলিউডের সিনেমা প্রচারের পরিকল্পনা। মূল বিষয়টি হল বাংলাদেশ চলচ্চিত্র আমদানিকারক ও প্রদর্শক সমিতি “ওয়ান্টেড”, “তারে জমিন পার” সহ মোট চারটি ভারতীয় হিন্দি সিনেমা বাংলাদেশে আমদানি করেছে যেগুলো এই মুহুর্তে হযরত শাহজালাল (র) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ছাড়পত্রের অপেক্ষায় আছে। শত সমালোচনা সত্বেও এই সিনেমাগুলো প্রচারের সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে চলচ্চিত্র আমদানিকারক ও প্রদর্শক সমিতি।
এই অযৌক্তিক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বিভিন্ন পেজে ও গ্রুপে এমনকি পারসোনাল অ্যাকাউন্টে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছে ফেসবুক ব্যবহারকারীরা। প্রায় সবাইই এর পক্ষে ও বিপক্ষে মত দিচ্ছেন। আমার এই লেখাটার কারণ হচ্ছে আমি গত দুই তিন দিন থেকে বিভিন্ন গ্রুপে ঘুরে ঘুরে মন্তব্যগুলো দেখেছি এবং কিছু বিষয় বার বার ঘুরে ফিরে এসেছে যেগুলো আসলে খানিকটা পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করা দরকার।
প্রথম কথা হচ্ছে, শিল্প নীতি অনুযায়ী যদি সরাসরি সিনেমা শিল্পে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনকারী কোন দেশ থেকে কোন সিনেমা আমদানি করতে হয়, তাহলে সেই দেশে সমসংখ্যক সিনেমা রপ্তানি করতে হয়। তাই ভারতের সাথে যেহেতু চলচ্চিত্র আমদানীকারক ও প্রদর্শক সমিতি সরাসরি বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে তাহলে আমাদের চারটি সিনেমাও সেখানে রপ্তানি হওয়া আবশ্যক। কিন্তু সম্ভবত বাংলাদেশী সিনেমা আমদানিতে সম্মতি দেয় নি ভারত। তাহলে কথা হল, যদি সেই দেশে আমাদের সিনেমা রপ্তানি না হয়, তাহলে শিল্প রপ্তানি নীতি ভেঙ্গে তাদের সিনেমা বাংলাদেশে ছাড়পত্র পায় কিভাবে। এখানে আরেকটা ছোট্ট প্রশ্ন আসতে পারে যে বাংলাদেশে তো হলিউডের সিনেমাও চলে, তাহলে আমরা কেন হলিউডে আমাদের সিনেমা রপ্তানি করি না। এখানে কারণ হল আমাদের দেশের সাথে সিনেমা শিল্পে হলিউডের সরাসরি কোন বাণিজ্যিক সম্পর্ক নেই। হলিউডের সিনেমা সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দেয়া হয়, সেগুলো আমাদের একটা কি দুটো সিনেপ্লেক্স কিনে আনে। আমাদের মত দেশের সিনেমা হল গুলো যদি তাদের সিনেমা না কেনে, কোন ক্ষতি তাদের হবে না। অন্যদিকে বলিউডের সাথে আমাদের সরাসরি আমদানি রপ্তানি চুক্তি হচ্ছে, অতএব হলিউড আর বলিউড এক সাথে মিলিয়ে লাভ নেই।
এবার আসা যাক বাংলাদেশে বলিউডের সিনেমার গ্রহণযোগ্যতার দিকে। একবিংশ শতাব্দির শুরুর দিকে, মানে ২০০১-০২ সালের দিকে বাংলা সিনেমা অশ্লীলতা আর মানের নিম্ন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। মানুষ এক সময় হলে যাওয়া ছেড়েই দিয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে অনেক বিখ্যাত সিনেমা হলও। এই অন্ধকার যুগ চলেছে কম করে হলে ২০০৮ সাল পর্যন্ত। তারপর আবার আস্তে আস্তে সিনেমা মাথা তুলে দাঁড়াতে শুরু করেছে। এখন কথা হল দেশের সাধারণ মানুষের উপর এই ৭/৮ বছরে বাংলা সিনেমার চাইতে বলিউডের হিন্দি সিনেমা যথেষ্ট প্রভাব ফেলতে সমর্থ হয়েছে। দেখার মত বাংলা সিনেমা না পেয়ে মানুষ হিন্দি সিনেমাই গিলেছে বেশি। সেই সাথে ইন্ডিয়ান চ্যানেলগুলোও আমাদের চ্যানেলের বাজার দখল করে বেশ শক্ত একটা প্লাটফর্ম পেতে সমর্থ হয়েছে। বর্তমান আমাদের সিনেমা মাত্র মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে, এখনো মানুষের মধ্য থেকে বলিউডের প্রভাব যায় নি। এই মুহুর্তে যদি বাংলাদেশের হলগুলোতে বলিউডের সিনেমা চালানো হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে সেই প্রভাব কে উস্কে দেয়া ছাড়া ভালো কোন লাভ হবে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশে হলিউডের সিনেমা এখন একটা কি দুটো হলে চলে। এখন বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে মুক্তি দিলে দেশের অনেক হলেই চলবে বলিউডের মুভি। ফলাফল, মার খাবে আমাদের দেশীয় সিনেমা।
হিন্দি সিনেমা প্রচারের পক্ষের দিক থেকে যে যুক্তি টি বেশি এসেছে সেটি হল আমাদের সিনেমা নিম্ন মানের, কিন্তু বলিউডের মুভি ছাড়লে তার সাথে প্রতিযোগীতা করে আমাদের সিনেমা আরো সমৃদ্ধ হবে। একটা ছোট্ট উদাহরণ দেই, ক্লাস টু এর একটা বাচ্চাকে যদি ক্লাস ফাইভের একটা বাচ্চার সাথে প্রতিযোগীতা করতে দেয়া হয়, বেচারা জীবনেও ক্লাস ফাইভের বাচ্চার সাথে প্রতিযোগীতায় জিততে পারবে না। আমাদের সিনেমা এখন অনেকটা ক্লাস টু এর বাচ্চার মতই, বলিউডের সিনেমাগুলো যথেষ্ট বাণিজ্যিক বিধায় তারা উন্নত প্রযুক্তি ও বিশাল বাজেট দিয়ে নিজেদের সিনেমাকে আমাদের তুলনায় ক্লাস ফাইভের বাচ্চার পর্যায়ে নিয়ে গেছে। সুতরাং তাদের সাথে প্রতিযোগীতা করতে গেলে আমাদের সিনেমাই মার খাবে বেশি।
এছাড়াও কথা উঠেছে ইরানী মুভি নিয়ে। ইরানী মুভি কম বাজেটে কিভাবে এত ব্যবসা করছে সেটা নিয়ে। এক্ষেত্রে আমার বক্তব্য হল প্রায় ৮০ বছরের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে বেঁচে আছে ইরান। ১৯৩০ সাল থেকে তাদের সিনেমা জগৎ শুরু। এই মুহুর্তে তারা অনেকটা সমৃদ্ধ। আর আমরা এখন মাত্র তাদের চেয়ে অর্ধেক বয়স পেরিয়েছি। নিশ্চয়ই আমাদের সিনেমা জগৎ আশি বছর পর ওদের সিনেমার মতই সেরা অবস্থানে যাবে।
আমাদের সিনেমার রেনেসাঁ যুগ চলছে এখন। ধীরে ধীরে নতুন কনসেপ্টের ভালো ভালো সিনেমা আসতে শুরু করেছে। সম্প্রতি রিলিজ হয়েছে টেলিভিশন, চোরাবালি, গেরিলা, আমার বন্ধু রাশেদ এর মত ভালো ভালো সিনেমা। আর কমার্শিয়াল মুভির বাজারটাকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করছেন অনন্ত জলিল, নতুন কিছু দেখানোর চেষ্টায় তিনি পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। এটা সত্য যে তার আরো উন্নতি প্রয়োজন, কিন্তু শুরুতেই সব হয় না। এদিকে মানুষ আবার হলমুখী হচ্ছে, আমাদের সিনেমা শিল্প লাভজনক হতে শুরু করছে। কয়েক বছর ধরে ঢালিউডের “ওয়ান ম্যান আর্মি” শাকিব খানও এখন উৎসাহ পাচ্ছেন ভালো কিছু দেখাতে। পরিচালকরা সিনেমা বানিয়ে লাভ অর্জন করছেন, নতুন নতুন প্রযুক্তি আমাদের সিনেমায় যোগ হচ্ছে। সিনেমা হল গুলো আবার হাউসফুল শো দেখাতে সক্ষম হচ্ছে।
শুধু আমাদের একটাই অভাব, ভালো বাজেটের। অদূর ভবিষ্যতে সেই ঘাটতি পূরণ হবে বলে সবাই আশাবাদী। অনেকেই বলে বাংলাদেশের সিনেমাজগতে মেধাবী পরিচালক নেই, তাদের কে আমি চাষি নজরুল ইসলাম, তানভীর মোকাম্মেল এর নাম মনে করিয়ে দিতে চাই। সদ্য প্রয়াত তারেক মাসুদ, হুমায়ুন আহমেদ, সুভাষ দত্ত তাদের নামও মনে করিয়ে দিতে চাই। নতুন করে সিনেমা জগতে এসেছেন মেধাবী পরিচালক মোস্তফা সরোয়ার ফারুকি ও রেদওয়ান রনি। উপহার দিয়েছেন, ব্যাচেলর, থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার, মেইড ইন বাংলাদেশ, টেলিভিশন, চোরাবালির মত অসাধারণ সিনেমা। ভালো বাজেট হলে আমাদের সিনেমা জগৎ অনেক ভালো ভালো কিছু উপহার দিতে পারে নিঃসন্দেহে।
এই উন্নতির পথে বলিউডের সিনেমার প্রভাবে প্রভাবিত আমাদের দেশের সিনেমা দর্শকদের কে নতুন করে বলিউডের পথে নিয়ে যাওয়া কতটা যৌক্তিক হবে তা ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না। তবে এইটুকু বুঝতে পারছি যে এখন হলগুলোতে হিন্দি সিনেমা রিলিজ দেয়া মানে আমাদের সিনেমা শিল্পের অগ্রযাত্রাকে মন্থর করে দেয়া। এর প্রতিবাদ হওয়া যেমন জরুরী, তেমনি সবার আমাদের সিনেমার প্রতি আস্থাবান ও আশাবাদী হওয়া জরুরী। শুধু এটুকুই বলতে পারি, বাংলা সিনেমার সোনালী দিন আসছে, আমাদের অপেক্ষা করাই শ্রেয়!
©somewhere in net ltd.