নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি নরসুন্দা নদের হাওয়া

আফরোজা সোমা

নরসুন্দা নদের হাওয়া

আফরোজা সোমা › বিস্তারিত পোস্টঃ

বন্দী

২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৭ দুপুর ১:৫৭

এক জীবনে একটা মানুষ বুকের ভেতর কয়টা কবর ধরে? এই কথা একা একা ভাবেন রইসউদ্দী। এই পঁচাশি কি ছিয়াশী কি নব্বই বছরের জীবনে এই পর্যন্ত ১৭ জন নিকট মানুষকে নিজের হাতে গোর দিয়েছেন তিনি। কবর জমতে-জমতে বুকের ভেতর তার এখন একটা আস্ত গোরস্থান। পারিবারিক বিরাট কবরস্থানে আছে পরিবার-পরিজনের ২৮টা কবর। আর রইসউদ্দীর বুকের ভেতরেও তো কবরের সংখ্যা কম না। নিকট ১৭ জনের বিদায়ের সাথে আছে সম্পর্কের ভাঙন। গভীর ভাঙনও তো মৃত্যুই। কবরই। সব মিলিয়ে তার ‘না হইলেও তো নব্বই বচ্ছর বয়স’ এর এই জীবনে বুকের ভেতর গড়ে উঠা কবরস্থানের ভার আর বইতে পারছেন না তিনি।

আর কোনো কবর ধারণের জায়গা তার বুকের মধ্যে নাই। এখন তার সকাল-বিকাল প্রার্থনা নিজের মৃত্যু। পড়শু রাতে তিনি সালাতুল হাজতের নামাজ পরে আল্লাহর কাছে কেঁদে-কেটে নিজের মৃত্যু চেয়েছেন। বলেছেন, ‘হে খোদা! হাত-রথ থাকতে তুমি আমারে নেও। গোরে নামাও। প্রিয়জনের হাত দিয়া আমারে তুমি কব্বরে নামাও। জীবনের এই কালে আমারে তুমি আর কোনো কবরের ভার দিও না।’

রইসউদ্দীর মনটা আজ কয়েকদিন হলো খুব ভার। খুবই। ছোটো নাতির ঘরের পুতিটা হঠাত করে জ্বরে পড়লো। আর কিছু না। কিচ্ছু না। শুধু জ্বর। তিন দিনের জ্বর। কোনো অসুখ নাই, বিসুখ নাই। খালি জ্বর। জ্বরেই মেয়েটা মারা গেলো। এই মেয়েটাই গত সাড়ে চারটা বছর ধরে ছিল রইসুদ্দীর প্রাণ ভ্রোমরা।

একটু একটু করে যখন মেয়েটা ডাক শিখে, তখন সে অস্পষ্ট উচ্চারণে ডাকতো, ‘বয়ো বাবা।’ ‘বয়ো বাবা, বয়ো বাবা’ ডাকতে-ডাকতে সে টলমল-টলমল করে হাঁটতো। তারপর একা একা দৌড় শিখলো। ছড়ার বই থেকে ছড়া শিখলো। কথার উচ্চারণও স্পষ্ট হলো। ‘বড় বাবা! বড় বাবা!’ বলে এসে বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তো। ছড়া শোনাতো, ‘আতা গাছে তোতা পাকি, দালিম গাছে মউ, এতো দাকি তবু কতা কউ না কেন বউ।’

গত বছর দু'য়েক ধরে রইসুদ্দী নামাজের জন্য দুপুরে বা বিকেলে মসজিদে যাওয়ার সময় পিছু-পিছু সে-ও আসতো। আঙুলে ধরে হাঁটতে-হাঁটতে হাজার রকমের কথা বলতে-বলতে মেয়েটা হাসতো। খিলখিল হাসির শব্দে রইসুদ্দীর মনে হতো, দুপরের রোদের রং খুব উজ্জ্বল। বিকেলটা খুব মায়াবী। গল্প করতে-করতে হেঁটে এসে রইসুদ্দী মসজিদে ঢুকে নামাজ পড়তেন। আর মেয়েটা মসজিদের পুকুর পাড়ে, পুকুরের ঘাটে একা একা খেলতো। হাঁটতো। মাঝে-মাঝে মসজিদের ভিতরে ঢুকে সে-ও সিজদা দিতে দিতে ‘একা একাই বলতো, দেকো বড় বাবা, আমিও নামাজ পড়ি।’

বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন রইসউদ্দী। কোমর বেঁকে গেছে। কুঁজো হয়ে লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটেন। কিন্তু এখনো ৫ ওয়াক্তের নামাজ পড়েন নিজের সীমানার শেষ মাথায় বছর পয়ত্রিশেক আগে বানানোমসজিদে গিয়ে। এখনো শরীরে কোনো বিশেষ রোগ-বালাই নাই। এখনো ঘাটে নেমে গোসল করেন। নিজের কাপড় নিচে কাঁচেন। এখনো চাষ-বাসের সময় মাঝে মাঝে বাড়ির সামনের ক্ষেতে গিয়ে কামলা-মুনিষদের নির্দেশনা দেন। এখনো হঠাৎ-হঠাৎ লাঠিতে ভর করে দুই একবার পথে একটু বিশ্রাম নিয়ে আস্তে-আস্তে চলে যান বন্দে। বন্দের মাঝখানে বড় ক্ষেতের ফসলটা কেমন হলো, সব ঠিক-ঠাক আছে কি-না তা নিজেই দেখে আসেন।

বন্দের শেষ মাথার কিছুটা পর নদীর পাড়ে গিয়ে দুই তিন মাস আগে বসেছিলেন ঘন্টাখানেক। এই নদী দিয়েই উনার বিয়ের নৌকা গিয়েছিল। সেই নৌকায় নওশাহ বেশে চলন্ত গিয়েছিলেন তিনি। সঙ্গে ছিল ভাই-বেরাদর, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনসহ কত মানুষ। এই নদীর ঘাটেই ১০ বছর বয়সী নতুন বউ নিয়ে নেমেছিলেন জোয়ান রইসউদ্দী। ষাট কি পয়ষট্টি কি সত্তর বছর আগের সেই কথা। নদীও তখন রইসুদ্দীর মতন জোয়ান। কী পানি! কী সুন্দর! কী টলমল! এখন তো আর নদীই নাই।

এই নদীর দিকে তাকালেও নিজের বুকের ভেতর একটা কবর দেখতে পান রইসউদ্দী। কবরের নাম দুধলাইরচর নদী। খালি মানুষের মৃত্যু না, খুব প্রাণের কোনো বস্তুর ক্ষয়-লয়ও মৃত্যুই। সেই মৃত্যুও মানুষের মৃত্যুর মতই কঠিণ। যাতনাময়। এই নদীর মরনটাও তার বুকের ভেতর ভার হয়ে আছে। নদীর দুই পাশ শুকাতে-শুকাতে, ভরাট হতে-হতে, দখল করতে-করতে নদী এখন কোনো কোনো জায়গায় ১০ কি ১৫ হাত আছে। সেইসব জায়গায় বর্ষাতে একটু পানি জমলে নদীর মরণটা আরো স্পষ্ট বোঝা যায়। আর অন্য সময় তো শুকনা। চর। নানান ফসলের ক্ষেত। নদীর পাড়ে জায়গায় জায়গায় বসতি। বাজার। ঘাট। বাণিজ্য। ব্যাস্ততা। এখন ‘নদীটা কানি আঙ্গুলের মতন চিক্কন হইয়া গেছে’। ফিতার মতন খালি একটা চিকন রেখা ছাড়া নদীটার আর কিছু নাই। রেখাটার কোথাও কোথাও ডোবার মতন, জলার মতন খাবলা-খাবলা একটুখানি পানি। এই নদীর পাড়ে এলেই রইসউদ্দীর বুকটা হু হু করে ওঠে। ডুকরে ওঠে। বহু বছর ধরে কবরের পাশে যেতে যেতে একটা সময় যেমন কবরের পাশে গেলে আর চোখে পানি আসে না কিন্তু বুকের ভেতর খালি ডাকতে থাকে ঘুঘু পাখি, তেমনি এখন লাগে রইসউদ্দীর এই নদীর পাড়ে এলে। ঘুঘু ডাকতে থাকে। ডাকতে থাকে বুকের ভেতর।


১৭জন প্রিয় মানুষের কবরের সাথে, ভেঙে যাওয়া সম্পর্কগুলোর কবরের সাথে, এই নদীর মৃত্যুটাও একটা মৃত্যু। একটা কবর। একটা ভার। ঘুঘুর ডাক। এইসব ভার আর তিনি বইতে চান না। এইসব ডাক তিনি আর শুনতে চান না। তাই, গত পড়শু সালাতুল হাজতের নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে কান্না-কাটি করেছেন।


জীবনের প্রথম কবর তার বুকের ভেতর জমেছিল ৭ বছর বয়সী ছোটো ভাইটার মরণ দিয়ে। একটা কালসাপের কামরে সারা অঙ্গ তার নীল হয়ে গিয়েছিল। কবিরাজ-বৈদ্য কারো কাছে যাওয়ারই কোনো সুযোগ দেয় নাই সেই ভাই। খেলার সময় জঙ্গলে ফুল তুলতে গিয়ে সেই যে সাপের কামড় খেয়ে মরলো ভাই, সেই দিয়ে বুকের ভেতর ‘কব্বর’ জমা শুরু। তারপর একে একে দাদা, দাদী, মায়ের চেয়েও আপন বড় খালা, মা, চাচা, বাজান, শ্বশ্বুড়, শ্বাশুড়ী, বড় চাচা, মেঝো চাচা, বড় বোন, দুলাভাই, ছোটো বেলার দোস্ত আব্বাস। আরো কত কবর জমেছে।

তবে, আব্বাসের মরণটা এখনো তার চোখের সামনে ভাসে। হাটবারে হাট থেকে ফেরার সময় রেললাইন বরাবর তারা হেঁটে আসছিল। সেই সময় ‘আৎকা নামলো শাওইন্যা বৃষ্টি’। ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টির সাথে মুহুর্মুহূ ‘ঠাডা’। বৃষ্টির মধ্যে রইসুদ্দীর খুব ‘পেশাব’ চাপলো। সে পেশাব করতে বসলো রেললাইনের একটু নিচে রাস্তার ঢালে। আর রেললাইনের উপরে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ভিজতে ভিজতে আব্বাস বলছিল, ‘রইসুদ্দী, লও কাইল মাছ মারতে যাই। নয়া পানির মাছ।’

রইসউদ্দী তখনো কোনো উত্তর না দিয়ে সে 'পেশাব' করে উঠে-উঠে প্রায়। এমন সময় পড়লো আরেকটা ‘ঠাডা’। বিকট শব্দে। 'ঠাডা'টা পড়লো আব্বাসের মাথায়। জায়গায় দাঁড়িয়ে আব্বাস মুর্হূতে মূর্তির মতন হয়ে গেলো। মুখটাও তার ছিল হা করা। চোখের পাতাটাও ছিল খোলা।

আব্বাস কবে মরলো! ‘কম তো নাহ। ষাইট কি সত্তর বছর তো অইবই। দেশভাগ হওনের কয়েক বছর পরেই তো ঘটলো ঘটনা।’

তারপরে সময় গেলো। একে একে রইসউদ্দীর দুই মেয়ে গেলো। তিন ছেলের মধ্যে এক ছেলে গেলো। এক নাতি গেলো। আরো কত নিকটজন, বন্ধুজন গেলো। তাদের সকলকেই নিজের হাতে রইসউদ্দী দিয়েছেন বিদায়।

মানুষের মৃত্যুর বাইরে, দুধলাইরচর নদীর মৃত্যুর বাইরে যে কয়টা ঘটনায় রইসউদ্দীর বুকের মধ্যে জমেছে কবর সেগুলোর মধ্যে একটা হলো, তার প্রিয় এক বন্ধুর সাথে ছাড়াছাড়ি। সেই ছাড়াছাড়ির কারণ সে মনেও আনতে চায় না। মুখে তো না-ই। তবে, মানুষ যে চোখ উল্টাতে পারে সেই বন্ধুর ঘটনায় রইসুদ্দী তা প্রথম অনুধাবন করেন। মানুষ যে এমন চতুরতা করতে পারে সেটা তখনই তিনি প্রথম টের পান। চতুরতা টের পেয়ে নিজেই ধীরে ধীরে সেই সম্পর্কের ইতি টানেন। কিন্তু যৌবনের প্রারম্ভে—আবেগ যখন টুইটুম্বুর, অভিমানের যখন কোনো সীমা-পরিসীমা নাই—সেই ঘটনায় এমন ব্যাথা তিনি পেয়েছিলেন যে, আজো বুকের মধ্যে ছিন্নসম্পর্কের একটা কবর তিনি দেখেন।

আরো একটা ‘কব্বর’ তার আছে। খুব গোপন। সেই কবরের নাম গীতা। পাশের বাড়ির গীতাকে যখনই তিনি দেখতেন সেই কৈশোর শেষ হয়-হয় বয়সে, রইসউদ্দীর বুকের ভেতর কেমন যে করতো! সেই ১৫ কি ১৬ বছর বয়সে তখন ক্ষণে মনে হতো, মনের ভেতর থেকে একশ’টা প্রজাপতি এক সাথে উড়ে গেলে আসমানে। ক্ষণে মনে হতো, পেটের ভেতর একটা পাঁক দিয়ে সব কেমন খালি হয়ে গেছে। ক্ষণে মনে হতো, হাঁটুতে শক্তি নাই কোনো। আবার ক্ষণে মনে হতো, বুকের মধ্যে কীর্তনের ঢোলের মতন বাজছে ঢোল। যেনো তার শব্দে এখনি বন্ধ হবে নিশ্বাস। গীতাকে কোনো দিন কিছু বলা তো দূরের কথা সামনা-সামনি হলে চোখ তুলে দেখতেও লজ্জা লাগতো। কিন্তু সেই গীতারা ৪৭-এর দেশভাগের সময় ‘গেলো গা ইন্ডিয়ায়’। পাড়া-প্রতিবেশী কাউকে কিছু না জানিয়ে, একরাতে গীতাদের পুরো পরিবার— বাবা, কাকা, দাদা, মোসো সবাই— একসাথে চলে গেলো।

তাদের গোয়ালভরা গরু গোয়ালে রইলো। বাড়ির সামনে ও পুকুরের শান-বাঁধানো ঘাট রইলো পরে। এমনকি গীতাদের বড়ঘরের বারান্দায় গীতার পোষাপাখির যে পিঞ্জিরাটা ছিল, সেটাও সেখানেই ঝুলছিল। শুধু তার দরজাটা ছিল খোলা। যাওয়ার সময়, ময়নাটাকে নিশ্চয়ই সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারে নাই, গীতা। ময়নাটা নিলে তো পিঞ্জিরাটাও নিতো। নিশ্চয়ই ময়নাটাকে ছেড়ে দিয়েছিল গীতা বা তার মা।

গীতাদের এই হঠাত নাই হয়ে যাওয়ার সংবদাটা পেয়ে তাদের বাড়িতে গিয়ে ভেঙে পড়লো সাত গাঁওয়ের মানুষ। সেই খবরে রইসুদ্দীও যান। গিয়ে দেখেন সব ঘরের দুয়ার খোলা। হাট করে খোলা। খোলা দুয়ার দিয়ে যার ইচ্ছা যাচ্ছে। যার ইচ্ছা আসছে। কেউ বলার নেই। কেউ দেখার নেই। সকাল থেকে লোকেরা যারা আসছিল, তাদেরই মধ্যে থেকে উৎসাহী কেউ কেউ হয়তো দরজার তালাগুলো ভেঙেছে। তালা ভেঙে ঘরে ঢুকে দেখেছে কী আছে, কী নেই। কিন্তু ময়নার খাঁচাটা ওইখানেই ছিল। ঝোলানো। কেউ ধরেনি। কেউ নেয়নি। পিঞ্জিরার খোলা দুয়ারটাও কেউ আটকে দেয়নি।

আর গণ্ডগোলের বছরটার কথা তো রইসউদ্দী মনেই করতে চান না। কী আজাবের দিন তখন গেছে! তিনি যুদ্ধে যান নাই। কিন্তু মুক্তিদের জন্য কী তিনি করেন নাই! লুকিয়ে-চুরিয়ে খাওয়ানো, টাকা দেওয়া, আশ্রয় দেওয়া, খবর দেওয়া কী তিনি করেন নাই! আর ‘মইত্যা রাজাকার তখন কী উৎপাতটাই না করলো! দুই দিন পরে-পরে সোলজার নিয়া আসার ডর দেখাইয়া সে সবাইরে লুঠছে! পাকবাহিনী নিয়া পূব পাড়ার হিন্দু পাড়াটাতে আগুন নিয়া তামা-তামা কইরা দিলো, মইত্যা’! রইসউদ্দীরা প্রাণ নিয়ে এই ক্ষেতে সেই ক্ষেতে, মাটির গর্তের ভেতর লুকিয়ে-চুরিয়ে থেকে দেখেছেন, এই ২০ কি ২২ বছর বয়সী সেনাদের নিয়ে-নিয়ে সে হিন্দু বাড়ি-বাড়ি গেছে। মুক্তিদের বাড়ি-বাড়ি গেছে। হিন্দু বউ-ঝিদের টেনে-টেনে গাড়িতে তুলেছে। 'কানাই কাকার মেয়েটারে যেদিন তুইল্যা নিলো সেদিন তার কান্দনে একবার রাম দা নিয়া ঝাঁপাইয়া পড়তে ইচ্ছা হইছিল’ রইসউদ্দীর।

রইসউদ্দীকেও তো কম শাসায় নাই, মইত্যা। মুক্তিদের সাহায্য করলে ছাড়া নাই বলে কী দাবড়ানিটাই না সে মানুষকে দিলো। পরে অবশ্য, যুদ্ধের শেষে তাকে পাড়ার বড় শিমুল গাছের সাথে ‘বাইন্ধা খুঁচাইয়া খুঁচাইয়া মারছে মুক্তিরা’। এই মাত্র একটা মরন যা দেখে রইসউদ্দীর কষ্ট হয় নাই। বরং শান্তি লেগেছে।

কিন্তু তবু, একাত্তরের কথা মনে হলেই রইসউদ্দীর মনের মধ্যে খালি কবরই ভাসে। নদীর দক্ষিণের ঘাটে লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে গুলি করে ‘নারায়ন কাকা, নরেন কাকা, কানু, পরিমলসহ আরো কতজনকে মারলো!’ তারা কবরও পায় নাই। চিতাও পায় নাই। তারা ঘাটেই পঁচে গলে স্বর্গে গেছে। কিন্তু একটু দূরের শ্মশ্মানঘাটে তাদের লাশ কেউ নেওয়ার সাহস পায় নাই।

এই ঘটনার পর গ্রামের মানুষ নদীর মাছ খায় নাই দুই বছর। তাই একাত্তরের পুরো সময়টাই রইসউদ্দীর কাছে একটা কবর। একটা কবরে অনেক মানুষ। অনেক প্রিয়জন।

আরেকটা কবর যা বুকের মধ্যে অষ্টক্ষণ ব্যাথার মতন লাগে, তা হলো রইসউদ্দীর গিন্নির কবর। সেই কবে, ১০ বছর বয়সে পুতুলের মতন দেখতে সুন্দর আর ফড়িঙের মতন চটপটে একটা মেয়েকে বিয়ে করে বাড়িতে এনেছিল রইসুদ্দী। তখনো সে ঋতুবতীই হয় নাই। তখনো সে সংসার বোঝে না। তখনো সে সুযোগ পেলে, কাপড় কাছা দিয়ে উঠে যায় শ্বশুড় বাড়ীর বড়ই গাছে কি আমগাছে কি তেঁতুল গাছে।

সেই তারামুন্নেছা পরে কী শান্ত হলো! কী সংসারী হলো। সংসারে বিপুল জমা-জমী ঘর সামলে তো সেই রেখেছে বুদ্ধি করে। সে না থাকলে রইসুদ্দীর কি এতো কিছু হতো! হলেও থাকতো না। সেই তারামুন্নেছা ৪৩ বছর সংসার করার পর একদিন চলে গেলো। যাওয়ার আগে কিছু বলেও গেলো না। প্রতিদিনের মত সব কাজ শেষ করে সব কিছুর দেখভাল করে মেঝো নাতিকে সঙ্গে নিয়ে পালঙ্কে ওঠলো। মেঝো নাতি রোজকার মতন থাকলো মাঝখানে। তার দুই পাশে শুইলো তারামুন্নেছা আর রইসউদ্দী। রোজ রাতের মতন গীত গাইলো তারামুন্নেছা। নাতির অনুরোধে দুইবার করে গাইলো নাতির প্রিয় ‘গাঙ্গে দিয়া ভাইস্যা যায় গো, নানান ফুলের কলি গো’ গীতটা। তারপর সকালে তারামুন্নেছা আর উঠলো না। উঠলোই না।

এই হাতে তারামুন্নেছাকে রইসউদ্দী ‘কব্বরে শুয়াইছে’। এই হাতে তারামুন্নেছাকে তিনি রেখেছেন মাটির নিচে। আজ প্রায় ২০-২৫ বছর।

এতো এতো কবর তো আর সব খালি পারিবারিক গোরস্থানেই না। কবর জমে বুকের ভেতরেও। কিন্তু এক জীবনে একটা মানুষ বুকের ভেতর কয়টা কবর ধরতে পারে? সাড়ে চার বছরের মেয়েটা মারা যাবার পর থেকে কেবল এই কথাটাই ভাবছেন রইসউদ্দী।

একটা সময়ে প্রায় প্রতিদিনই তিনি কবরস্থানে যেতেন। ছোটো ভাই, বাবা, মা, বড়খালার কবর দেখতেন। কিন্তু তারামুন্নেছার মৃত্যুর পর থেকে কবরস্থানে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন রইসুদ্দী। বুকের ভেতর কবর জমতে জমতে তিনি নিজেই যখন একটা কবরস্থান তখন কার কাছে আর তিনি যাবেন? রইসউদ্দী ভাবেন, ‘কব্বরস্থানে যায় জীবিত মানুষ। কব্বরের মাটি ছুঁইয়া জীবিতরা নিতে চায় প্রিয়জনের পরশ। কিন্তু একটা কব্বরস্থান আরেকটা কব্বরস্থানে গিয়া কী করবো!’

রইসুদ্দীর এখন নিজেকে মনে হয়, তার ভেতরটা একটা কবরস্থান। সেখানে সারি সারি আছে অনেক কবর। আর তার দেহটা কবরস্থানের সীমানা। সেই সীমানায় ‘পাক্কা ওয়াল তুলে দিয়ে দেওয়া আছে একটা লোহার গেইট। সেই গেইট খুইল্যা কেউ ভিতরে ঢুকলে দেখবো সবুজ ঘাসে ছাওয়া মাটি।’ সেই মাটির নিচে প্রিয় সব মুখ। সেই মাটির নিচে দুধলাইরচর নদী। মাটির নিচে তারামুন্নেছা। মাটির নিচেই আছে সাড়ে চার বছরের বৈশাখী।

এক জীবনে একটা মানুষ বুকের মধ্যে কয়টা কবর ধরে! এই প্রশ্নের উত্তর রইসউদ্দীর কাছে নাই। কিন্তু বৈশাখীর মৃত্যুর পর থেকে এই দীর্ঘ আয়ুটাকে তার কাছে মনে হচ্ছে অভিশাপ। মনে হচ্ছে, বন্দী জীবন। মনে হচ্ছে, শাস্তি। রইসউদ্দীর মনে হয়, আর কোনো কবর বুকের মধ্যে জায়গা দেয়ার জায়গা এখন তার বুকের ভেতর নাই। তাই, এইবার তিনি মুক্তি চান এই বন্দী জীবন থেকে। কিন্তু মুক্তির কোনো সহজ উপায় তো নাই। তিনি ভাবেন, ‘জেল ভাইঙ্গা বন্দী পলাইতে পারলেও, জীবন ভাইঙ্গা তো পলাইয়া যাওনের পথ নাই!’ তিনি ভাবেন, ‘জীবন ভাইঙ্গা গেলে তো পরপারেও আর কোনো দিন তারামুন্নেছার সাক্ষাত মিলবো না’। তার বাবা-মা, ভাই-বোন আব্বাসের দেখা মিলবো না। মিলবে না বৈশাখীর সাক্ষাতও।

কিন্তু আর তিনি বইতে পারছেন না কবরের ভার। বৈশাখির মৃত্যুর পর তো না-ই। তাই, নিজের মুক্তির জন্য সালাতুল হাজতের নামাজ পড়ে খোদার কাছে তিনি খুব কেঁদেছেন পড়শুদিন। উপুর হয়ে কাঁদতে-কাঁদতে কখন যেনো নামাজের বিছানায়ই চোখ লেগে গিয়েছিল তার। সেই হাল্কা ঘুম ভাঙলো অদ্ভুত এক খোয়াব দেখে। খোয়াবে রইসুদ্দী দেখেন, নওশাহ বেশে তিনি বিয়ে করতে যাচ্ছেন। সাজানো-গোজানো নৌকা প্রস্তুত দুধলাইর চর নদীর ঘাটে। নদীটাও আগের মতন বড়; পানিতে টুইটুম্বুর। আর বিয়ের কনে সেজে তার জন্য বসে আছেন ১০ বছর বয়সী তারামুন্নেছা।


২৬।০১।১৭

মন্তব্য ২২ টি রেটিং +৬/-০

মন্তব্য (২২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৭ দুপুর ২:০৬

মাহমুদুর রহমান সুজন বলেছেন: পোষ্টটি ভাল লেগেছে। আপনার লিখায় দারুণ সুন্দর ও স্পষ্ট কিছু ম্যাসেজ থাকে।শুভ্চ্ছো শতত।

একজন ভাল লেখিকা নতুন ব্লগে এসেছে কিন্তু ওনার লিখা প্রথম পেইজে আসছেনা তাই ওনি মনক্ষন্ন। আমার মতে ওনি অনেক প্রতিভাবান অাসুন ওনার পোষ্টটি পড়ে দেখে নিই ওনার লিখনির অবস্থান।

এখানে লিঙ্কটি দিলাম প্লিজ পড়বেন

২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৭ দুপুর ২:২১

আফরোজা সোমা বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ, সুজন। সময় দিয়ে পড়ার জন্য এবং আপনার মতামত জানানোর জন্য।

আর আপনার লিংটাও পড়বো আশা করি। ভালো থাকবেন।

২| ২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৭ দুপুর ২:২৮

পুলহ বলেছেন: ব্লগে এইরকম লেখা দেখলে ভালো লাগে। ব্লগে সময় দেয়াটাকে 'সময় নষ্ট' বলে মনে হয় না।
হ্যাটস অফ ট্যু দ্য রাইটিং স্কিল অফ দ্য রাইটার।
ভালো থাকবেন আপু

৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৭ দুপুর ২:৫৭

আফরোজা সোমা বলেছেন: সময়টা যে আপনার নষ্ট হয়নি, এটা জেনে ভালো লাগছে।

আপনিও খুব ভালো থাকবেন, পুলহ।

৩| ২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৭ দুপুর ২:৪৪

শায়মা বলেছেন: আপু!!!!!!!!!

মুগ্ধ হয়ে গেলাম!!!!!!

রইসুদ্দীনের জন্য কষ্ট!


কেমন করে লিখলে তার কথা!!!!!! :(

৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৭ দুপুর ২:৫৭

আফরোজা সোমা বলেছেন: অনেক অনেক ধন্যবাদ, শায়মা!! অনেক শুভ কামনা।

৪| ২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৩:১৯

হাসান জাকির ৭১৭১ বলেছেন: অসাধারণ !!!
দীর্ঘ লেখা, সময় নিয়ে পড়লাম। খুব ভাল লাগল। আপনার অনুভূতিগুলোর প্রকাশ দারুন।
অনেক ধন্যবাদ।

৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৭ দুপুর ২:৫৮

আফরোজা সোমা বলেছেন: সময় নিয়ে এমন দীর্ঘ লেখা পড়ার জন্য কৃতজ্ঞতা।

অনেক শুভ কামনা। ভালো থাকবেন।

৫| ২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৫:৩৩

চিরন্তন মহাশূন্য বলেছেন: অনবদ্য হয়েছে আপু, খুবই ভাল…

৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৭ দুপুর ২:৫৯

আফরোজা সোমা বলেছেন: শুকরিয়া। অনেক অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।

৬| ২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৫:৫৭

ভ্রমরের ডানা বলেছেন:


কিছু মুহুর্ত কিছু সময় জীবনের শুধু অপেক্ষার! সেই সময়ে জীবনের ভার অত্যন্ত ভারী। সে সময়কে চিত্রিত করে গল্পের ঘেরায় বন্দি হলাম!


৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৩:০০

আফরোজা সোমা বলেছেন: :)

ভালো থাকবেন। অনেক শুভকামনা, ভ্রমরের ডানা।

৭| ২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ৮:২৫

আহমেদ জী এস বলেছেন: আফরোজা সোমা ,



খুব সুন্দর সাজানো গোছানো একটা গল্প পড়লুম ।

"...... জীবন ভাইঙ্গা তো পলাইয়া যাওনের পথ নাই !" এরচে' পরম সত্য আর কিছু আছে কি জীবনে ?

৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৩:০১

আফরোজা সোমা বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ, আহমেদ জী এস। ভালো থাকবেন। অনেক শুভকামনা।

৮| ২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ১১:৫৫

কালীদাস বলেছেন: নদী ভাঙনের কষ্টের উপর দিয়ে এতগুলো বেদনা একসাথে চালিয়ে দিলেন কিভাবে? :P
সুন্দর :)

৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৩:০৩

আফরোজা সোমা বলেছেন: অনেক ব্যাথার ভার জমে গেলে, সব একাকার হয়ে গিয়ে বুঝি এমনি হয়, জানি না।

ভালো থাকবেন।

৯| ২৭ শে জানুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৩:২৭

প্রাইমারি স্কুল বলেছেন: নিজের মুক্তির জন্য সালাতুল হাজতের নামাজ পড়ে খোদার কাছে তিনি খুব কেঁদেছেন

৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৩:০৪

আফরোজা সোমা বলেছেন: সময় দিয়ে লেখাটি পড়ার জন্য এবং মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ, প্রাইমারি স্কুল। ভালো থাকবেন।

১০| ৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৭ দুপুর ২:৫৫

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: মুগ্ধ।

৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৩:০৪

আফরোজা সোমা বলেছেন: শুকরিয়া। ভালো থাকবেন।

১১| ৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৪:৪৫

শেরিফ আল সায়ার বলেছেন: চমৎকার আপা

০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সকাল ১০:৫৪

আফরোজা সোমা বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ, শেরিফ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.