নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি নরসুন্দা নদের হাওয়া

আফরোজা সোমা

নরসুন্দা নদের হাওয়া

আফরোজা সোমা › বিস্তারিত পোস্টঃ

কোথাও মায়া রহিয়া গেলো

০৬ ই মার্চ, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:১৩

হৃৎযমুনায়...

“যমুনার বিবাহের দিনক্ষণ ঠিক হইয়া গিয়াছিল। ঢাকায় ছোটাছুটি করিয়া অতিকষ্টে মাইগ্রেশন সার্টিফিকেটও জুটিয়াছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাক দাঙ্গাবাজের আঘাত যমুনাকে পৃথিবী হইতেই মুছিয়া দিয়াছে”। এই বর্ণনা ছাপা হয় আনন্দবাজার পত্রিকায়। ১৯৬৪ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারিতে। তার আগের দিন ভারত সীমান্তে পেট্রাপোল স্টেশানে আনন্দবাজারের প্রতিবেদকের কাছে এই কাহিনী সবিস্তারে বর্ণণা করেছিলেন শ্রীমতি পূর্ণলক্ষী গোপ। নারায়নগঞ্জের মোগড়াপাড়ায় নিজের ভিটা রেখে পূর্ণলক্ষী দেশান্তরী হয়েছিলেন।

স্বেচ্ছায়, সৌভাগ্যের খোঁজে বা অর্জনের নেশায় যারা পাড়ি দিয়েছে কালাপানি, যারা আলোভুক পতঙ্গের মতন গিয়েছে সোনার খনির দিকে তাদের কথা বলছি না। বিদেশ-বিভূঁইয়ে গেলেও বিভূতিভূষণের অপুর মতন, বহু বছর পরে হলেও, প্রাণের টানে যে আবার চাইলেই ফিরতে পারে নাড়িপোঁতা গ্রামের ভিটায় তার কথাও বলছি না। তাহলে কার কথা বলছি?

আকাশের তারকারাজিকে স্বাক্ষী রেখে বারান্দায় ঝোলানো পাখির খাঁচার দুয়ার খুলে দিয়ে পাথরের মত ভারি হয়ে আসা অসাড় পায়ে নি:শব্দে যেতে যেতে অনমনে যাদের ভিজে যায় চোখের পাতা, তাদের কথা বলছি। নামে ও চেহারায় তারা ভিন্ন। দেশ ও কাল ভেদে তারা বিভিন্ন গোত্র ও ধর্মের মানুষ। তারা কেউ যমুনা, কেউ মান্টো, কেউ ঋত্বিক। কেউ পাকিস্তান থেকে পালিয়ে বেঁচে নিজেকে শপেছে ভারত মায়ের বুকে। কেউ ভারত থেকে বিতারিত হয়ে পাকিস্তানে পুনরায় পায়ের নিচে খুঁজে পেতে চেয়েছে ভরসার ভূমি। আর কেউ প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে ইয়াতরিবে নিয়েছেন আশ্রয়। আজকের রোহিঙ্গারাও রয়েছে এই দেশহারা মানুষের কাফেলায়।


ভাগের মানুষ...

আশ্রয় থেকে নিরাশ্রয়। নিরাশ্রয় থেকে ফের আশ্রয়ের সুলুক-সন্ধান। যমুনার কাহিনীটা ৬৪ সালের। আরেকটু পেছনে চলুন। ১৯৪৬-এ। ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’কে ঘিরে কলকাতা তখন গরম কড়াই। উত্তেজনার পারদ তুঙ্গে। ১৬ই অগাস্ট। ছড়িয়ে পড়লো দাঙ্গা। পরস্পরকে কচুকাটা করলো হিন্দু ও মুসলমান। দাঙ্গার পর মিলিটারির গাড়িতে করে, ২২শে অগাস্ট বিষুদবারে, সরেজমিনে শহর দেখতে বের হন জনাকয়েক সাংবাদিক। দাঙ্গাপিড়ীত সেই নরকপুরীর বিবরন ৪৬ সালের ২৭ অগাস্টে ছাপা হয় স্বাধীনতা পত্রিকায়: “চিত্তরঞ্জন এভিনিউয়ের ওপর দিয়া চলিয়াছি। দেখিলাম একটি মৃতদেহকে ঘিরিয়া প্রচুর শকুনী নৃত্য করিতেছে। রাস্তার আবর্জনা, গবাদিপশুর মৃতদেহ পোড়ানো, কাপড়জামা ও আসবাবপত্র সমস্ত একাকার হইয়া নরককুণ্ড সৃষ্টি করিয়াছে। একজন সাংবাদিক বন্ধু বলিলেন, প্রত্যেকটি ম্যানহোলে মৃতদেহ ভর্তি”।

খাণ্ডবদাহনও থেমেছিল। কলকাতাও শান্ত হয়। তবে, দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে বিহার, পাঞ্জাব, নোয়াখালিসহ আরো নানান জায়গায়। দাঙ্গাতাড়িত মানুষ প্রাণভয়ে পালিয়েছে। দেশ বন্টনের পর ভাগের মানুষেরা ছেড়েছে জন্মভিটা। ভিটাহারা মানুষেরা বিষাদের উদরে লালিত সহোদর-সহোদরা। তাই, একই শরে বিদ্ধ দেখি ঋত্বিক কুমার ঘটক আর সাদত হাসান মান্টোর বুক। ঋত্বিকের ‘কোমলগান্ধার’ সিনেমার ভৃগু আর অনসূয়ার কথা মনে করুন। পদ্মার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে ওরা দুইজন। রূপালী নদীর ওইপাড়ে বাংলাদেশ। ওইপাড়ে আলো জ্বলে। এ পাড় থেকে তার আভা দেখা যায়। দেখা যায়। কিন্তু যাওয়া যায় না।

যেতে না পাড়ার আহাজারীই দেশান্তরী মানুষের অর্ন্তগত সুর। সেই সুরই দেশহারা মান্টো এঁকেছেন ‘টোবা টেক সিং’ গল্পে। টোবা টেক সিং হলো পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের একটি স্থান। সেখানে ছিল এই গল্পের মূলচরিত্র বিষান সিং-এর বাড়ি। চরিত্রটি উন্মাদ। দেশভাগের দুই তিন বছর পরে ভারত ও পাকিস্তানের সরকার পাগলদেরও ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়। মানে হিন্দু পাগলের ঠিকানা হবে ভারত। আর মুসলিম পাগলদের ঠাঁই হবে পাকিস্তানে। বিষান অমুসলিম। তাই, ভারতই তার গন্তব্য। কিন্তু বিষান সিং-এর বাড়ি পাকিস্তানের টোবা টেক সিং-এ। তাই, সে বারবার টোবা টেক সিং-এ যেতে চায়। কিন্তু ক্ষমতাবান রাষ্ট্রের কাছে এক পাগলের ইচ্ছের কী দাম আছে! শেষে, বিষান সিং-এর মৃত্যু হয়। কাঁটাতারের দুই পাশে দুই পা মেলে পড়ে থাকে বিষান। লাশের দুই পায়ের নিচে পড়ে থাকে দুই দেশের সীমানা। বিষান গল্পের চরিত্র। তাই, পাঠক হয়তো এই ভেবে স্বান্ত্বনা পেতে পারে যে, বিষাণ তো সত্যিকারে দেশহারা হয়নি। কিন্তু বাস্তবেই শরাহত পক্ষীশাবকের মতন জিয়ন্তে মরে ছিলেন ঋত্বিক ও মান্টো।

কারো কাছ থেকে যদি ছিনিয়ে নেয়া হয় তার দেশ বা গ্রাম বা জন্মভিটার অধিকার, কেমন লাগে তার? এই প্রশ্নের উত্তরে বিষণ্ন ঘুঘুর মতন ডেকে উঠবেন নির্বাসিত কবি দাউদ হায়দার। হাতের পাশে দেশ থাকতেও দেশে আসার অনুমতি না পেলে কেমন লাগে? সেই উত্তর ভালো দিতে পারবেন বহ্মপুত্র পাড়ের তসলিমা নাসরীন। এদেশে দাগী অপরাধীর থাকার অধিকার আছে। রাজাকার, ধর্ষক, দুর্নীতিবাজ এদেশে নিষিদ্ধ নয়। কিন্তু বহ্মপুত্রের জলোহাওয়ায়, আমের বোলের সুতীব্র ঘাণে তসলিমার ফেরার অধিকার আজও নিষিদ্ধ। রাষ্ট্র আটকাতে পারে কবির শরীর। তসলিমা ও দাউদের হৃদয়ে তো বসে আছে ঋত্বিকের ভৃগু ও অনুসূয়া। হৃদয়ের ব্যাকুলতা ঠেকাতে পারে পৃথিবীতে তেমন আইন কই!

রাঙামাটির কাপ্তাই লেকে বেড়াতে যায় ভ্রমন পিপাসু পর্যটকের দল। সেখানে বোটে চলতে-চলতে নৌকা থামিয়ে পানির নিচে অঙ্গুলি নির্দেশ করে গাইড দেখায়, একদা ওইখানে ছিল রাজার বাড়ি। এখন তা শুধুই স্মৃতি। পাকিস্তান আমলে জলবিদ্যুৎ তৈরির উদ্দেশ্যে কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দিয়ে কৃত্রিমভাবে বানানো হয় এই বিরাট জলাধার। রাষ্ট্রের এক অংশের উন্নয়নের জন্যে কোরবান হয়ে যায় আরেক অংশের মানুষের জমি-বাড়ি-বাস্তুভিটা।

ট্রমাক্রান্তের মনোজগত...
চাপে পড়ে কালে কালে পৃথিবীতে বাস্তুভিটাচ্যুত হয়েছে মানুষ। দখলদারদের ইচ্ছের বলি হয়ে আজো রচিত হচ্ছে নতমুখে পৃথিবীর বুকে আয়লান কুর্দীদের পড়ে থাকার মর্মন্তুত কাহিনী। সিরিয়ায়, মিয়ানমারে— মানুষ কাঁদছে। ভয় ও ট্রমাক্রান্ত মানুষ ভিটা-মাটি ফেলে উদ্বাস্তু হচ্ছে। একটু নিশ্চিন্তির আশায় জীবন বাজি রেখে কতজন পাড়ি দিচ্ছে অথৈ সাগর। উদ্বাস্তুদের কেউ কেউ হয়তো জীবনে ঘুরে দাঁড়ায়। অর্জন করে অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিশ্চিন্তি। তবু, তুমুল চোরাটানের মতন তাদের আত্মার গহীনে রয়ে যায় হাহাকার, আহাজারী। তাদের মনোজগতে থেকে যায় ভয়, অবিশ্বাস আর ট্রমার স্মৃতি। ঠিক তেমনি ট্রমাক্রান্ত এক চরিত্রের নাম বাবর। সৈয়দ শামসুল হকের ‘খেলারাম খেলে যা’ উপন্যাসে এই বাবরই মূল চরিত্র।

বাবর শিক্ষিত, সুদর্শন, অবিবাহিত ও সুকথক। সমাজের অন্য দশজনের থেকে বিত্তবান। আপাতঅর্থে মনে হয়, মাঝবয়সী এই বাবরের যেন কোনো দুঃখ নেই। পিছু টান নেই। মনে হয়, শরীরের সুখ পাওয়াটাই তার জীবনের একমাত্র বাসনা। যেনো শিশ্নের ইচ্ছেকে চরিতার্থ করতে পারাতেই যত আনন্দ। কিন্তু এমন লম্পট চরিত্রের লোকটিরও মাঝে-মাঝে খুব একা লাগে। খুব মন কেমন করে তার। বাবরের এমন মন কেমন করা দিনের খবর জানাতে গিয়ে সৈয়দ হক লিখেছেন: “বাবর বালিশে মুখ ডুবিয়ে রইলো অনেক্ষণ। ভেতর থেকে একটা কান্না পাচ্ছে কিন্তু কিছুতেই বাইরে আসছে না। বাইরে আসছে না বলে ভীষন ভয় করছে। ভয় করছে এই ভেবে যে স্মৃতিও বুঝি তার কাছে আর যথেষ্ট নয়”। লেখক ক্রমে আমাদের জানাতে থাকেন বাবরের উন্মুল বিহ্বলতা: “আমার কেউ নেই। কেউ নেই। কোনো কিছু আমার নয়। না মাটি, না মন, না মানুষ”।

কেন এত ফাঁকা লাগে বাবরের? কেন এত নেই-নেই বোধ? নিজের অবচেতনেই কেন সে বর্ধমানে ফেলে আসা লেবু গাছটার কথা ভাবে? সেই কানা ফকিরটা বেঁচে আছে না মরে গেছে, এই প্রশ্ন মনের মধ্যে সময়ে-অসময়ে কেন গুঞ্জরিয়া ওঠে? তার এত কেনর উত্তর সুলুকের মারপ্যাঁচের মতন রাখা আছে দেশভাগের দাঙ্গায়। ‘খেলারাম খেলে যা’ উপন্যাসের গল্প এগিয়েছে। আমরা জেনেছি, হাসনুর কথা। জেনেছি, মেলার বিকেলের গল্প। দাঙ্গার ভয়ে সেই মেলা ভেঙে গিয়েছিল। সন্ত্রস্ত দুই ভাই-বোন বাবর ও হাসনু মেলা থেকে ত্রস্তপায়ে ফিরছিল বাড়ি। কিন্তু ফেরা আর হয়নি। মাঝপথে হাসনুকে দাঙ্গাকারীরা তুলে নেয়। হাসনু তখন ‘দাদা দাদা’ বলে তারস্বরে ডেকেছে। কিন্তু প্রাণভয়ে সেদিন ছোটোবোনকে রক্ষায় এগিয়ে যেতে পারেনি বাবর। উন্মত্ত হায়েনাদলের হাতে প্রিয় হাসনুকে রেখে প্রাণভয়ে দাদা পালিয়েছিল।

ঘটনার পর দেশান্তরিত বাবর আসে পাকিস্তানে। সে পায় নতুন জীবন। পায় সুনাম ও সমৃদ্ধি। তবু, অন্তরের রিক্ততা ঘোচে না। খুব গোপনে মুখ লুকিয়ে শিশুর মতন সে কাঁপে থরো থরো। পাঠক জানতে পায়, দেশহারা, মাটিহারা, বাবরের আর্তি। দেখতে পায়, ট্রামাক্রান্ত বাবরের উলটপালট হয়ে যাওয়া মনোজগত। বোনের সেই ধর্ষণ ঠেকাতে না পারা, প্রাণ নিয়ে নিজের পলায়ন এবং দেশহারা হওয়ার ঘটনার ঘাতেই কি তবে বাবরের বিকারের জন্ম? সেই বিকারই কি তবে তাকে পরবর্তীতে করে তোলে নারী লোলুপ?

এই উপন্যাসের একেবারে শেষে বাবরের নারীসঙ্গী জাহেদাকে ধর্ষণ করতে জঙ্গলের ভেতর টেনে নিয়ে যায় একদল গ্রামবাসী। অপহরণের সময় জাহেদা প্রাণপনে আর্তনাদ করছিল। কিন্তু সেই আর্তনাদে, আপাতার্থে, কোনো সাড়া দেয়নি বাবর। সাড়া না দেয়ায় ওই মুহূর্তে বাবরের প্রতি পাঠকের রাগ হতে পারে। কিন্তু দেখা যায়, প্রকৃতার্থে, বাবরের অচেতনের ভেতর তখন জাগ্রত হয়ে ছিল আরেক বাবর। এই বাবর ব্যথাতুর। তীব্র অপরাধবোধে লজ্জিত। বোনকে ছেড়ে পালিয়ে আসার মর্মযাতনায় মরা। তো, এই নতুন বাবর— যে কি-না থাকে সচেতন, সুচতুর, সুদর্শন বাবরের গহীনে গোপন— সেই বাবর হঠাৎই বেরিয়ে আসে জাহেদার ডাকে।

কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই পাঠক বুঝতে পারবে, মূলত জাহেদার ডাক নয়, মনোলোকে হাসনুর ডাক শোনে সুদূর অতীতের এক ছোট্ট কিশোর। শুনতে পায় যেনো কেউ ডাকছে— ‘দাদা, দাদা’। বাবর ছুটে যায় ‘দাদা’ ডাকের দিকে। যায় হাসনুকে উদ্ধার করতে। অর্থাৎ যে বাবর প্রেমিকা জাহেদাকে উদ্ধার করে আনে, সে আর চতুর বাবর নয়। সে সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ। তারা একের ভেতর দুই। এক বাবর লম্পট, চতুর। আরেক বাবর অতীতে নিমজ্জিত। দু:খময় অতীত থেকে মুক্তি পেতে ব্যাকুল। তাই, জাহেদাকে উদ্ধারের ভেতর দিয়ে বাবর আসলে তার স্মৃতির ভেতর থেকে করে হাসনুকে উদ্ধার। এই ঘটনার ভেতর দিয়েই হয়তো বাবর নিজেকেও খানিকটা উদ্ধার করে। হয়তো তার মনোতাপও কিছুটা লাঘব হয়। তবে এবিষয়ে উপন্যাসে আর কোনো আলাপ বা ইশারা নেই। এই ঘটনার পরপরই লেখক গল্পের ইতি টেনেছেন।

কোমলগান্ধার...

জীবনের গল্প বিস্তৃত। দেশহারা বা দেশছাড়া মানুষের মনোজগতে ছেড়ে আসা জন্মভূমির প্রভাব সম্ভবত অলঙ্ঘনীয়। মাওলানা জালাল উদ্দীন রুমীর কবিতাতেও আছে ছেড়ে যাওয়া জন্মভূমির কথা। তাদেরকে কেউ তাড়িয়ে দেয়নি। স্বেচ্ছায়ই গিয়েছেন। বাল্খ অঞ্চলে ভাক্শ নদীর তীরবর্তী লোকালয়ে ১২০৭ সালে রুমির জন্ম। সেখানেই বেড়ে ওঠা। ১২১২ সালের দিকে রুমির পিতা বাহা ভালাদ (বাহা উদ্দীন ওয়ালাদ) ভাক্স ছাড়েন। তখন রুমির বয়স মোটে ছয়। ওই এলাকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি তখন ক্রমে উত্তপ্ত হয়ে ওঠছে। প্রবল হয়ে উঠছে খোয়ারেজ্ম শাহর প্রতাপ। একদিকে, তিনি নিজের জন্য খুঁজছিলেন বড় পদমর্যাদা বা ভালো কাজ। অন্যদিকে, আসন্ন যুদ্ধের দিন। উত্তাপ এড়াতে আগেই উপযুক্ত নতুন ঠিকানার সন্ধান করেন বাহা ভালাদ। ক্যারাভানে করে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন তারা। দীর্ঘ যাত্রা। দিনের পর দিন। ক্যারাভান চলে, থামে। ঘোড়ার চলার ছন্দে ঘন্টা বাজে টুংটাং। পথ পাড়ি দিতে দিতে শিশু রুমির স্মৃতিতে গেঁথে যায় ক্যারাভানের ঘন্টাধ্বনি। এই ক্যারাভানের সুর পরবর্তীতে উপমায় এসেছে রুমির কবিতায়।

ততদিনে রুমির বাবা আনাতোলিয়ায় থিতু হয়েছেন। তবে, তাদের ফেলে আসা ভূখন্ড তখনো অশান্ত। যুদ্ধ, লড়াই, মৃত্যু তখন বাল্খ অঞ্চলের নিত্য সাথী। খোয়ারেজ্ম বংশের ইসলামী শাসন তখন মোঙ্গলদের আক্রমনে ব্যতিব্যস্ত। নিজের জন্মস্থান বাল্খে তখনো বাহা ভালদের আপনজনেরা ছিলেন। তাই, আনাতোলিয়ায় বসেও বাহা ভালাদ আপনজনদের বিপদ-আপদের কথা ভাবতেন। এইসব স্মৃতিও রুমির ছিল।

পরবর্তীতে, রুমির কবিতায় ঝিলিক দিয়ে উঠেছে তার জন্মভূমি বাল্খের কথা। এক কবিতায় তিনি লিখেছেন, “ডে এন্ড নাইট আ্যাম থিংকিং অফ ইউ/ ইন দিস ব্লাডি ডেইস এন্ড নাইটস, হাই ডু ইউ ফিল?/এজ দিস ফায়ার ফেল ইনটু দি ওয়ার্ল্ড/ ইন দিস স্মোক অফ দি তাতার আর্মি, হাউ ডু ইউ ফিল?” অর্থাৎ মাতৃভূমিকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলছেন, দিবানিশি তোমার কথা ভাবি। এই রক্তস্নাত দিনে, তুমি কেমন আছ! তাতার সেনাদের হাতে আক্রান্ত হয়ে অগ্নি ও ধোঁয়ার কুণ্ডুলিতে, না জানি তুমি কেমন আছ।

কেমন আছ জন্মভূমি আমার! না জানি তুমি কেমন আছ, আমার জন্মগ্রাম! এই বোধ মানুষের চিরায়ত। যে মাটিতে মানুষের জন্ম, যে জল-হাওয়ায় বেড়ে উঠা সেই মাটির জন্য মানুষের মন কেমন করে। বিশেষত, যখন তা জোর করে কেড়ে নেয়া হয় বা চাপে পড়ে সেই ভূমি ছেড়ে আসতে হয়, তখন মানুষ যেনো হারিয়ে ফেলে তার স্বত্তারই একটি অংশ। এই বিচ্ছেদের সুর করুন। কোমলগান্ধার। এই বিচ্ছিন্নতা মানতে পারে না বলেই এমনকি মৃত্যুর পরেও মানুষ নিজের দেশে ফিরতে চান। ‘শঙ্খচিল শালিকের বেশে’ বা ‘ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে আবার ফেরার বাসনা জানিয়েছিলেন জীবননানন্দ দাশ।

এইরকম ফিরে আসা ক’জনকে একবার দেখেছিলাম। তখন ক্লাশ থ্রি বা ফোরে পড়ি। টুকরো টুকরো ছবিগুলোর কোলাজ করলে চিত্রটা দাঁড়াবে এমন: ৯০ কি ৯১ সাল। স্থান আমাদের প্রতিবেশী কন্ট্রাক্টর বাড়ির সামনে। ৪/৫ জন নারী-পুরুষকে ঘিরে আমাদের এলাকার মানুষদের জটলা। অতিথিরা ভিনদেশী। তারা কথা বলে হিন্দি-বাংলা মিশিয়ে। নারীদের কপালে সিঁদুর। তাদের পড়নের শাড়ির আঁচল উল্টো করে পেছন থেকে সামনের দিকে আনা। জানা যায়, তারা বা তাদের অভিভাবকেরা একদা এ তল্লাটেই ছিলেন। সংগ্রামের সময় দেশ ছাড়ে। কেউ ছেড়েছে এরও আগে।

দেশছাড়া ‘হিন্দু’দের কথা শুনেছি। শুনেছি, তারা ‘নিজেদের দেশ ইন্ডিয়ায়’ চলে গেছে। এইসব কথা উঠতো বিভিন্ন ঘটনায়। যেমন, একবার পড়াবাড়িতে পুষ্কুনির পাড়ে একগাছের গোড়ায় খুঁড়তে গিয়ে মাটির নিচে কে যেনো হঠাৎ লোহা-লক্কর এবং আরো জিনিসের সন্ধান পায়। তখন ময়-মুরুব্বিরা বলেন: ‘হিন্দুরা যাওনের সময় মাটির তলে অনেক কিছু থইয়া গেছে’।

ভিনদেশী অতিথিদের দেখে মরুব্বিরা দরদভরা সুরে কথা বলেছেন। বিভিন্ন জনের নাম জিজ্ঞেস করে খোঁজ খবর নিয়েছেন। সেই আলাপের একটা কথা আমার খেয়াল আছে। কে যেনো বলছিলেন, ‘এলাকাডা হাইট্টা-গুইট্টা দেইখ্যা যাইতো আইছে গো... দেশের লাইগ্যা মনে অয় পেট পুড়ে গো’।

দেশের জন্য দেশছাড়াদের পেটপোড়ে। তাদের মন কেমন করে। যেমন করতো বাবরের। যেমন করতো ঋত্বিক, মান্টোর। দেশের বাড়িতে আত্মীয় কেউ না থাকলেও, প্রতিবেশির বাড়ির পুকুর পাড়ে হেলে থাকা পুরনো তালগাছটা দেখলেও মায়া-মায়া লাগে। এই মায়া লাগার নামই দেশ। এরই নাম ভিটা। এই মায়ার কাছে ফিরতে মানুষের মন মোচরায়; পেটপোড়ে। এই পেটপোড়াকেই কমলকুমারের ভাষায় বলে, ‘কোথাও মায়া রহিয়া গেলো’।

-----

মন্তব্য ১০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১০) মন্তব্য লিখুন

১| ০৬ ই মার্চ, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:১৭

নূর মোহাম্মদ নূরু বলেছেন:
যে কারনেই হোক যারা নিজের মাতৃভূমি ছেড়ে বিদেশে
যেতে বাধ্য হয় তারা হতভাগা। কারন
‘জননী জন্মভূমি স্বর্গাদপি গরীয়সী’, অর্থাৎ
‘জননী জন্মভূমি স্বর্গের চাইতেও গরীয়ান’

০৭ ই মার্চ, ২০২০ বিকাল ৪:৩০

আফরোজা সোমা বলেছেন: পড়ার জন্য কৃতজ্ঞতা। ভালো থাকবেন।

২| ০৬ ই মার্চ, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৫৫

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: পড়তে পড়তে মন কখনো উদাস হয়েছে, কখনো দেশহারাদের বেদনায় মন বেদনার্ত হয়ে উঠেছে। 'খেলারাম খেলে যা' পড়েছিলাম অনেক অনেক আগে, আপনার পর্যালোচনায় এবার বিষয়টা গভীরভাবে বুঝতে পেরেছি।

এমনকি নিজ দেশে থেকেও জন্মভিটা থেকে বহুদিন দূরে থাকলে মন হুহু করতে থাকে। যারা দেশছাড়া হয়েছে নানা কারণে, তাদের মনোকষ্ট বর্ণনাতীত।

অনেক ভালো লিখেছেন। শুভ কামনা আপনার জন্য।

০৭ ই মার্চ, ২০২০ বিকাল ৪:৩৪

আফরোজা সোমা বলেছেন: দীর্ঘ লেখা পড়ার জন্য ধন্যবাদ আর মতামতের জন্য কৃতজ্ঞতা। 'খেলারাম খেলে যা' উপন্যাসটা নিয়ে আমার একটা প্রবন্ধ আছে। বছর ছয়েক আগে সামুতেই আপ করেছিলাম। নিচে লিংক রইলো। কখনো আগ্রহ হলে ঢু দেবেন। ভালো থাকবেন। অনেক শুভ কামনা।

https://www.somewhereinblog.net/blog/afrojashomabdblog/29924505

৩| ০৬ ই মার্চ, ২০২০ রাত ৮:১২

নেওয়াজ আলি বলেছেন: অসাধারণ লেখা।

০৭ ই মার্চ, ২০২০ বিকাল ৪:৩৪

আফরোজা সোমা বলেছেন: কৃতজ্ঞতা। ভালো থাকবেন।

৪| ০৬ ই মার্চ, ২০২০ রাত ১০:০০

রাজীব নুর বলেছেন: আমাদের বিশাল ব্যবসা ছিলো ভারতে। দাঙ্গার কারনে সব গুছিয়ে চলে আসতে হলো ঢাকায়।
যাই হোক, খুব সুন্দর লিখেছেন সহজ সরল, ভাষায়।

এতদিন কোথায় ছিলেন? বহু দিন পর ব্লগে আপানকে দেখলাম।

০৭ ই মার্চ, ২০২০ বিকাল ৪:৩৮

আফরোজা সোমা বলেছেন: মাঝে তো ব্লগে কিছু দিন এম্নিতেই প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল. . . তরপরে আর আসি আসি করে হয়ে ওঠেনি... আপনাদের আদিনিবাস ছেড়ে আসতে হয়েছে জেনে খারাপ লাগলো। আপনার বাবার কি ছেড়ে আসার স্মৃতি ছিল বা ছেড়ে আসার ঘটনার পূর্বাপর নিয়ে আপনার দাদার বয়সীদের সাথে কি কখনো কথা হয়েছে?

৫| ০৭ ই মার্চ, ২০২০ সকাল ১১:০৮

সোহানী বলেছেন: ভালো লাগলো.....

০৭ ই মার্চ, ২০২০ বিকাল ৪:৩৮

আফরোজা সোমা বলেছেন: ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.