নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সে এসেছিল আমার জীবনে প্রথমহয়তোবা সে-ই আমার শেষবিকেলের হলুদাভ আভায়আমি খুঁজি তারই লুন্ঠিত অবশেষ।
আমরা হাঁটলে পৃথিবী স্থবির হয়ে যায়। সময় থেমে যায় কলেজ রোডের মোড়ে। সবগুলো কাল এসে মিশে যায় বসন্ত বাড়ির গেটে। জগতে তখন শুধুই রুকুর মুখে ফুটে ওঠা ঘাম, নাসিকার ফুলে ওঠা, ঠোঁটের ফাঁক গলে বেরিয়ে আসা মধুর সংলাপ। আমার অন্তর বাহির এক অজানা শিহরণে কাঁপে।পনের মিনিটের পথ সেকেণ্ডে নেমে এলে চারপাশে থাকে শুধু অন্ধকার।
আমাদের পথটি মেঠো এবং লাল। বাতাসের ঝাপটা এসে লুটোপুটি খাচ্ছে রুকুর চুলে। ওড়নাটা মাঝে মাঝে আমাকে জড়িয়ে ধরছে। বামে পাহাড়ের দীর্ঘ সাড়ি। ডানে নদী। পাহাড়ি ঝর্ণার টলটলে অশ্রু নিয়ে ছুটছে কোনো অজানা প্রেমিকের টানে। নদীর ওপরে ব্রীজ। ব্রীজে জমে আছে গাড়ির বহর। দূরে আকাশ কালো হয়ে মেঘ ধরেছে। বৃষ্টি নামবে বলে। নদীতে যান্ত্রিক নৌকা আর ছোট বড় লঞ্চ। ছুটছে নিজস্ব নিয়মে।
দীর্ঘ অদেখার পর ওকে দেখছি অবাক হয়ে। ওর মধ্যে কোন জড়তা নেই, নেই অদেখার দূরত্ব। ঠিক তেমনটিই আছে যেমনটি ছিল দশ বছর আগে। প্রাণবন্ত এবং সজীব। কথা বলছে, অন্তহীন খইফোটা স্বরে। হাসছে শিশুর সারল্যে। কোন এক সকালে গোসল সেরে খালি গায়ে ছিলাম। ওকে দেখে ছুটে পালিয়েছিলাম। সেই কথা বলার সাথে সাথে এমন করে হাসছিল-আমার কান্না পেল! কেন এমন হয়? সময়গুলো কেন এত দ্রুত দৌড়ায়! কেন আমরা স্মৃতি হাতড়ে মরি!
ভাইজীকে সাথে নিয়ে টিলার ওপরে নিজেদের ঘরে ফিরছিল রুকু। আমার ঢিলটি ওদের তিন গজের মধ্যে জায়গা খুঁজে পেলে পিচ্চি ভাইজি তৎক্ষণাৎ একটি ইটের টুকরো তুলে নিলো। মুখ ভেংচিয়ে ঢিল ছুড়তে উদ্যত হতেই ওর হাত থেকে নিজের হাতে টুকরোটি নিয়ে নিলো রুকু। তারপর হাওয়ায় ভাসিয়ে পাঠিয়ে দিল আমার দিকে। আমি অবাক হয়ে দেখলাম ঢিলটি ঠিক আমার দিকেই আসছে। রুকুর পাঠানো উপহার মাথা পেতে নিলাম। আর তাতেই ফুপু-ভাইজি একসাথে এত জোরে হেসে উঠল যে চার-পাঁচটি হাঁস চমকে ডেকে উঠলো। ভাইজীকে বিদায় দিয়ে আমার দিকে হেঁটে আসলো রুকু।
দশ বছরে এতটুকু বদলায়নি ও। সেই চুল, দীঘলকালো। চোখের কোলে কাজলের খেলা আর নাকের পুরোটা জুড়ে দুষ্টুমি ভরা কৌতুক! এসেই ডান হাত দিয়ে আমার বাঁ হাতের চামড়ায় জ্বালা ধরানো মোচড় দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-কি রে বখাটে! মেয়েদের দিকে ঢিল ছোঁড়ার সাহস কই পেলি? আগে তো ছিলি ভেদা মাছ। এখন কি কই মাছ হবার শখ হয়েছে?
সেই রুকু। আমাদের রুকু! আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়েই থাকলাম। আমার চোখের সামনে হাত নাচিয়ে তুড়ি মেরে চমক ভাঙ্গালো।
-প্রবলেম কি রে তোর! এমন ভ্যাবলার মত তাকিয়ে আছিস কেন?
-তুই একটুও বদলাসনি রুকু! কথাটা শুনে খুব হাসলো।
-তুই দেখি কথা বলা শিখে গেছিস! আগে তো কথাই বলতি না।
-তুই জানিস আমি এখন রাজনীতি করি!এলাকায় অনেক কিছুই আমার ইশারায় চলে!
-বাহ্ বাহ! আমাকে ভয় দেখাচ্ছিস? আমি যদি ভয় পাইও কী লাভ তোর!
-না রে ভয় না। আমি আর আগের মত নেই-এটাই বুঝাতে চাচ্ছি শুধু। কিন্তু তুই সেই আগের মতই রয়ে গেছিস। তা তোর বর কী করে রে রুকু? প্রশ্ন শুনে আবারও হাসি। সেই সাথে আমার মাথায় জোরে একটা গাট্টা দিয়ে বললো,
-কেন বিয়ে করবি নাকি আমাকে?
এবার লজ্জায় পড়ে গেলাম! কী বলে মেয়েটি। বিবাহিত মেয়েকে বিয়ে করে কিভাবে? বরের কথা জিজ্ঞেস করলে বুঝি এভাবেই কথা বলে মেয়েরা? আমার মনে পড়ে গেলো, কলেজে রুকুরা আমাকে লাজুক বলে ক্ষেপাতো। একবার রুকু, মিনি আর কেয়া জোর করে একটা রুমে নিয়ে গেল। দরজা বন্ধ করে ভেতরে রুকু, বাইরে মিনি আর কেয়া।
-তোর কিসের এত লজ্জা হ্যাঁ! আজ তোর লজ্জা ভাঙ্গাবোই!বলে ওড়নায় হাত দিলো। আমি দুহাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলেছিলাম সেদিন! মেয়েরা এত বাজে হয়! আমাকে একা রেখে বের হয়ে গিয়েছিল রুকু। আর কোনদিন আমাকে ক্ষ্যাপায়নি ওরা। হয়তো ওদের নিজেদেরই খারাপ লেগেছিল-অত বড় ছেলের কান্না দেখে।
আমাকে উদাস দেখে রুকু গলা খাকারি দিয়ে বলে উঠলো, তোর কান্নার কথা আমার আজো মনে পড়ে। মেয়েটা আমার মন পড়তে পারে, সে আমি অনেক আগে থেকেই জানি। আমি যখন যেটার ভয় পেতাম তখন ঠিক সেই কাজটিই করে বসতো ও। আজো ঠিক ঠিক পড়ে ফেললো আমার মন। নিজেকে এত বদলেও রুকুর কাছে সেই লাজুকটিই রয়ে গেলাম!
-এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলবি নাকি অন্য কোথাও যাবি?
-বাসায় তোর জন্য চিন্তা করবে না?
-কেন চিন্তা করবে? দরকার পড়লে ফোন দিবে। মোবাইল তো হাতেই।
-তা ঠিক।
-তোর কি হয়েছে রে বাদল? এমন উদাস উদাস লাগছে কেন তোকে?
-তুই কি আমার সাথে কলেজের পথে একটু হাঁটবি? রুকু বড় বড় চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো আমার দিকে।
-কলেজে পড়ার সময়ে খুব চাইতি যেন শুধু আমরা দুজন একসাথে এ পথে হাঁটি তাই না?
-ধুর! কী যে বলিস!
-আমি তোর অন্তর পুরাটাই দেখতে পাইরে বাদল!
রুকু আমার গা ঘেঁসে হাঁটছিল ইচ্ছে করেই। মিনি, কেয়া, নাবিলাদের ইতিহাস শুনালো কিছুক্ষণ। কায়েস, মাহমুদ, রুবেলদের কথাও বললো। ওরা সবাই ভালো স্টুডেন্ট। ঢাকায় পড়তে গিয়ে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রেখেছিল। আমি অথর্ব, গ্রামেই পড়ে থাকলাম। কারো খোঁজই আর রাখিনি। সবার কথা বললেও নিজের কথা একটুও বললো না রুকু।
-তোর বর কী করে বললি না তো রুকু!
-তুই ও তো বললি না আমাকে বিয়ে করবি কি না!
-কী মসিবত! এর সাথে তোকে বিয়ে করার সম্পর্ক কী!
-আমার বিয়ে হয়নি জানলে আমাকে বিয়ে করতে চাইবি না তুই?
-ধুর কী যে বলিস না তুই! কোথায় তুই আর কোথায় আমি!
-কিন্তু তুই তো আমাকে ভালোবাসিস তাই না!
-তাতে কি! একজন মানুষকে কত লোকই তো ভালোবাসতে পারে। সবাইকে কি আর তার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব? রুকু চুপ করে থাকে। বিষণ্ন মুখে জানতে চায়,
-আমি যদি তোকে সত্যিই বিয়ে করতে চাই তুই বিয়ে করবি না আমাকে?
-রুকু তুই এত নিষ্ঠুর কেন? মাইন্ড গেমে আরেকজনকে হারানোয় কী এত আনন্দ বল তো! কলেজে থাকতেও তুই অযথা আমাকে এভাবেই কষ্ট দিতি!
-আচ্ছা বাদল, তোর কখনো কি মনে হয়নি আমি কিভাবে সব সময় তোর মনের খবর জেনে যেতাম?
-আমি কি করে বলবো? আমি তো তোদের মত ভালো স্টুডেন্ট ছিলাম না।
-তোর কি মনে পড়ে একদিন তুই নৌকা থেকে লাফ দিয়ে একটা মেয়েকে বাঁচিয়েছিলি?
-হ্যাঁ মনে আছে।
-তুই কি মেয়েটিকে চিনিস?
-কিভাবে চিনবো, অত ছোটবেলার কথা মনে থাকে নাকি!
-তোর কখনো মনে হয়নি মেয়েটিকে চেনা দরকার!
-মনে হইলেই কি! আমি তো ওর চেহারাই দেখিনি।আচ্ছা, ওই ঘটনা তোকে কে বলেছিল? নিশ্চয়ই রুবেল? রুবেল চাইতো তোর সাথে আমার কিছু একটা হোক!
-সত্যিই তুই দশ বছরে অনেক বদলেছিস। সব কিছু সাহস করে বলে ফেলছিস।
-তা তো কিছুটা বদলেছিই। আমার সাথে কলেজ পর্যন্ত গেলেই টের পাবি আমার ক্ষমতা কতটুকু। -তুই কি জীবনে অনেক ক্ষমতাবান হতে চাস?
-নাহ্।
-তাহলে তোর ক্ষমতা আমাকে দেখাতে চাস কেন?
-তুই একদিন আমাকে কলেজের ছাদে ডেকে নিয়েছিলি মনে আছে?
-বলে যা!
-তুই বলেছিলি, আমাকে নিয়ে সবাই হাসাহাসি করে, এটা দেখলে তোর খুব কষ্ট হয়। আমি যদি নিজেকে বদলাতে না পারি তাহলে যেন তোর সামনে কোনদিন না পড়ি। তোর চোখে সেদিন প্রথমবারের মত পানি দেখেছিলাম। আমারও তখন খুব কান্না পাচ্ছিল!
আমরা হাঁটতে হাঁটতে রেলস্টেশনে পৌঁছে গেলাম। স্টেশনের পরেই কলেজ। রুকুর হঠাৎ রেল ভ্রমণের শখ হলো। বললো,
-চল না রেলে করে কোথাও চলে যাই।
-কিন্তু আমার তো অনেকগুলা কাজ আছে। রেলে করে কোথাও গেলে তো সারাদিনের কাজ মাটি হয়ে যাবে।
-আমার জন্য তোর একদিনের কাজ মাটি করতে পারবি না? রুকুর চোখে পানি জমেছে।কথাগুলোও কেমন জড়ানো।
-তোর কি হয়েছে রে রুকু? তুই এ ভাবে কথা বলছিস কেন?
-ট্রেনের টিকিট কাট। তোকে নিয়ে ঘুরতে যাব আমি। ওর কথায় একরোখা ভাব। এমন ছেলেমানুষি তো কখনো করতো না রুকু!
ট্রেনের টিকিট কেটে আমরা বাশারের হোটেলে চা খেতে বসলাম। বাশার আমাদের কলেজ বন্ধু। বেশ বড় ব্যবসায়ী। আমাকে ইশারায় কাছে ডাকলো বাশার। রুকুকে বসতে বলে বাশারের কাছে গেলাম। ও বললো,
-রুকু যে পাগল সেটা তো দেখে বোঝা যায় না! আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-কে বললো ও পাগল?
-কেন তুই জানিস না, ভার্সিটির এক টিচারকে খুন করেছিল রুকু? পাঁচ বছর জেল খাটার পর পাগল হয়ে যায়। পরে ওকে জেল থেকে ছাড়িয়ে ইংল্যান্ড নিয়ে যায় ওর বড় ভাই। দেশে এসেছে তো কিছুদিন হলো। আশপাশের লোকজন বলছিল, এখনো নাকি পাগলই আছে। কিন্তু তোর সাথে দেখে তো পাগল মনে হচ্ছে না।
আমার মাথা ঘুরে উঠল। চারপাশ দুলতে দুলতে ঝাপসা হতে থাকলো। আমি মাথা চেপে ধরলাম। উৎকণ্ঠিত স্বরে কারা যেন কি কি বলাবলি করছে। হঠাৎ একসাথে আঠারোটি ট্রেন হুইসেল বাজিয়ে আমার মাথায় ঢুকে পড়লো। আরো চব্বিশটি ট্রেন আমাকে টানতে টানতে গতির রাজত্বে নিয়ে গেল। সেখানে নানান বর্ণের আলো চরদিকে ছুটছে। আমি হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে কখন যেন ব্রীজের পাশে পৌঁছে গেলাম। তারপর টুপ করে ঝরে পড়লাম নদীতে। ঝরে পড়া ফলের মত ডুবতে ডুবতে এক সময় ভুস করে ভেসে উঠলাম।
চোখ মেলতেই দেখি রুকু আমার মুখের উপর ঝুঁকে আছে। অবাক হয়ে সবার দিকে তাকালাম। বাশারের মুখ চোখে পড়তেই সব মনে পড়ে গেল। আমার ডান গালে ছোট্ট করে একটা চড় দিয়ে রুকু বললো,
-ট্রেনে ঘুরতে যাবি না বললেই হতো। শুধু শুধু নাটক করার কী দরকার ছিল!
-ঘুরতে যাব না কে বললো তোকে?
-কে আর বলবে। এতক্ষণ হুঁশ নেই। ট্রেনটা চলে যাবার পরই তোর হুঁশ হলো।
-কী বলিস! এতক্ষণ বেহুঁশ ছিলাম? বলে উঠতে গিয়ে আবার মাথা টলে উঠলো। রুকু দু’ হাতে আমাকে আগলে ধরলো। বাশার বললো, খারাপ লাগলে আরো কিছুক্ষণ শুয়ে থাক।
আমি রুকুকে নিয়ে বাশারের হোটেল থেকে বেরিয়ে ধীরে ধীরে কলেজের দিকে এগুতে থাকি। ততক্ষণে দু-একফোটা বৃষ্টি ঝরতে শুরু করেছে। হাতের ছাতাটা মেলে ধরলাম।
-তুই পড়ে গিয়েছিলি কেন?
-আমি বুঝি পড়ে গিয়েছিলাম?
-বাশার তোকে কী বলেছিল?
-রুকু! তুই কি সত্যিই বিয়ে করিসনি?
-বৃষ্টিতে ভিজবি?
-তোর অসুখ করবে না?
-করুক। তবু ভিজবো। তুই ভিজবি আমার সাথে?
-রুকু! সত্যি করে বল তো তোর কি হয়েছে?
-কেন? বাশার তোকে কিছু বলেছে?
-তুই আর আগের মত নেই। কোথায় যেন কিছু একটা হয়েছে।
-প্রথমে যে বলেছিলি আগের মতই আছি!
-বৃষ্টি তো এসে গেল। ছাতার নীচে আয়।
-তুই আমাকে নিয়ে নৌকায় চড়বি?
-এখন নৌকায় ওঠা ঠিক হবে না। কী বাতাস দেখেছিস?
-তুই ছোটবেলায় যাকে একবার ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচিয়েছিলি, বড় বেলায় কি তাকে আরেকবার বাঁচাতে পারবি না?
মহাকাল থমকে দাঁড়ালো আমাদের মাঝে। সেখানে একে একে দৃশ্যায়িত হতে থাকলো হাজারো স্ন্যাপ। ক্লাসের সবচেয়ে মেধাবী হবার পরও রুকু কেন আমাকে এত গুরুত্ব দিতো, কেন নিজের সমস্ত লজ্জা জলাঞ্জলি দিয়ে আমার লজ্জা ভাংগানোর চেষ্টা করেছিল, কেন আমাকে নিয়ে অন্যদের হাসাহাসি ওর অন্তর পুড়িয়ে দিতো-সবগুলো প্রশ্নের জবাব মুহুর্তেই ফাঁস হয়ে গেল!
বৃষ্টিতে নিজেকে সপে দিয়েছে রুকু। দু’ হাত দু’ দিকে মেলে বৃষ্টি বরণ করছে মেয়েটি। আমি শুধু চিনতে না পারা এক পরমাত্মীয়ের দিকে তাকিয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরাতে থাকলাম।
©somewhere in net ltd.
১| ১৬ ই মে, ২০১৪ দুপুর ১২:৩৫
অলিন্দ বলেছেন: আমি শুধু চিনতে না পারা এক পরমাত্মীয়ের দিকে তাকিয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরাতে থাকলাম।