![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ছোটগল্প: মেঘলা আকাশ
আকাশের মন ভালো নেই! না রোদ না বৃষ্টি! ঘন মেঘের আবরণে ঢেকে আকাশ রেখেছে সেই মধ্যরাত থেকে।
ভোরের আগে কিছুটা রিমঝিম বৃষ্টি ঝরলেও, তারপর থেকে অভিমানী কিশোরীর মতো মুখ ভার করে রেখেছে সুনীল আকাশ; আকাশের এমন গুমড়ানো ভাব পলেনের কাছে ছোটবেলা থেকেই বিরক্তিকর!
সে চায়Ñ হয় রোদ ওঠুক, নয় তো বৃষ্টি ঝরে আকাশ পরিস্কার হয়ে যাক। খামাখা মেঘ যতই চেষ্টা করে না কেন, সুর্যের আলোকে কি আর বেঁেধ দিয়ে রাখতে পারে! জানালা খুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিরক্তিমনে স্বামীর কাছে গিয়ে পলেন বলে, ‘মুসাফির.. মুসাফির..
বিয়ের আগে থেকেই স্বামীকে নাম ধরে ডাকে পলেন। অবশ্য বিয়ের পর পর কিছুদিন ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করেছিল; কিন্তু মুসাফির নিজেই তাকে নাম ধরে ডেকে ‘তুমি’ সম্বোধনের অনুমতি দিয়ে দেয়। স্ত্রীর মুখে নিজের নামটি শোনে খুবই আনন্দ পায় মুসাফির!
মুসাফির জানালা খুলে গুমড়ানো আকাশের দিকে তাকিয়ে লেখালেখিতে নিমগ্ন! সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ঝাঁজালো কণ্ঠে পলেন বলে, ‘আকাশে মেঘ জমলেই বুঝি তোমার মনের আকাশ ভাবে ভারী হয়ে ওঠে, তাই না? এখন আর ভাব নিয়ে বসে থাকলে চলবে না; তাড়াতাড়ি যেতে হবে। কয়টা বাজে, খবর আছে তোমার! ওদিকে ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে বসে আছে। আর তুমি এদিকে বসে বসে মনের মেঘলা আকাশে ওড়ে বেড়াচ্ছ!’
তার কথায় প্রভাবিত না হয়ে লেখায় মনোনিবেশ করে আছে মুসাফির। তাকে প্রতিত্তুর করতে না দেখে পলেন চটে গিয়ে বলে, ‘এমন ভাব নিয়ে কী লিখতেছো; কয়েকবছর যাবৎ আমাকে নিয়ে তোমাকে কিছুই লিখতে দেখেনি। কাকে নিয়ে তোমার এমন লেখালেখি?’
কাগজটি টেনে হাতে নিয়ে বলে, দেখি কী লিখছোÑ
‘আমি মেঘমালার মতো আকাশে উড়ে উড়ে
শুকুনের তীক্ষè দৃষ্টিতে তাকিয়ে খুঁজে বেড়াই তোমাকে...
পাহাড়ের জনহীন কুয়াশাভেজা পথে ঘুরে ঘুরে
নিশুতি অমা-আঁধারে আজও খুঁজে বেড়াই তোমাকে’..
বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে পলেন বলে, ‘এই, তুমি কাকে খুঁজে বেড়াও? গোপনে কার প্রেমের মালা তুমি গলায় পড়েছো? হ্যাঁ, সত্যি করে বল তো!’
মুচকি হেসে মুসাফির বলে, ‘তোমাকে ছাড়া আমার কেউ নেই।’
- তাহলে একথাগুলো লিখছো কার উদ্দেশ্যে?
- তোমার উদ্দেশ্যে...
- আমার উদ্দেশ্যে মানে!
- আমাকে কাছে পেয়েও হারানোর কবিতা লিখছো; এতো শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতোই!
- এতক্ষণ তুমি কাছে ছিলে না, তাই!
- ফাইজলামি করার সময় পাও না। ওঠো বলছি..
- সবকিছু গুছিয়ে রেডি হও, আমি আসছি।
- সব প্রস্তুত। কেবল বের হওয়া বাকি।
চেয়ার ছেড়ে ওঠে স্ত্রীর পিছু পিছু বের হয়ে গেল মুসাফির। ছুটির দিনগুলো তারা বাসায় কাটাতে চায় না। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। আজ তাদের কুমিল্লা যাবার কথা; মেঘলা আকাশ কিছুটা দেরি করিয়ে ছাড়ল।
কোটবাড়ি পৌছতে তাদের বিকেল হয়ে গেল। গাড়ি থেকে নেমে দু’জনে হেঁটে শালবনের ভেতরে প্রবেশ করে...
মুসাফিরকে বিয়ে করে পলেন সুখি। দু’জনের মধ্যে বেশ বোঝাবুঝি ও মিল-মহব্বত। একে অপরকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছে। কলেজে ভর্তি হবার পর উভয়ের পরিচয় হয়। কলেজে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তির পর্বটা মুসাফির বেশ জমিয়ে তুলতো। তাছাড়া আবৃত্তিতে প্রথম পুরস্কারটা তাকে ছাড়া কেউ সহজে স্পর্শ করতে পারেনি। তার কবিতা আবৃত্তির ছন্দময় সুরের জালে পলেন এসে ধরা পড়ে। তারপর থেকেই মুসাফিরের লেখালেখির কেন্দ্রবিন্দু পলেনের দখলে চলে যায়। তাকে নিয়ে প্রায়ই লিখে থাকে গল্প, কবিতা...
মুসাফিরের ইচ্ছা ছিল নামকরা একজন কবি হবে! বিভিন্ন পত্রিকায়ও তার লেখা প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু চাকরির ব্যস্ততায় আগের মতো আর লেখালেখিতে সময় দিতে পারে না। বিশেষ করে বিয়ের পর, তার লেখালেখির প্লাটর্ফম অনেকটাই নির্জীব হয়ে যায়। রামপুরা মহানগর প্রজেক্টে ফ্লাট ভাড়া করে থাকে তারা। ছুটির দিনগুলোতে স্ত্রীকে নিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বেড়ায় মহানন্দে!
কোটবাড়িতে বেড়াতে এসে, দু’জনে শালবনের ভেজা লাল মাটির পথ দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে পাশপাশি হেঁটে হেঁটে!
মেঘঢাকা আকাশের মেঘ তখনও পুরোপুরি কাটেনি। মেঘের আড়াল থেকে সূর্যালোক উঁিক মেরে তাকায়Ñ ঘোমটাপরা নববধূর লজ্জিত চাহনির মতো! টিলার পাদদেশ ঘেঁসা হেঁটে চলার সময় আচমকা মুসাফিরের চোখ গিয়ে পড়েÑ বিপরীত দিক থেকে হেঁটে আসা এক নারীর দিকে; সাথে তার ফুটফুটে দু’টি মেয়ে, অন্যদিকে দৃষ্টিপাত করে তাদের পাশ কাটিয়ে যাবার সময় গতিরোধ করে সামনে দাঁড়িয়ে মুসাফির বলে, ‘অনামিকা..
আৎকে ওঠে দাঁড়িয়ে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অনামিকা! চেহারায় চিন্তার রেখা বিকশিত হয়ে ওঠছে! অবাক চাহনিতে তাকিয়ে থাকাবস্থায় অস্পষ্ট স্বরে অনামিকা বলে, ‘তোমাকে মুসাফিরের মতো-ই মনে হচ্ছে!’
- হ্যাঁ। এত সহজে ভুলে গেছো!
উচ্ছল হাসি হেসে অনামিকা বলে, ‘মুসাফির, তোমাকে চিনব কেমন করে বল, তুমি আগের চেয়ে অনেকটা মোটা ও র্স্মাট হয়ে গেছো।’
পলেনের দিকে ইঙ্গিত করে পুনরায় অনামিকা বলে, ‘তোমার সাথের উনি কে? তোমার স্ত্রী নিশ্চয়!’
- হ্যাঁ, তোমার ধারণা ঠিক। পরিচয় হয়ে নাও। আমার স্ত্রী পলেন।
হাস্যেজ্জল পরিচয়ের পর, অনামিকার উদ্দেশ্যে মুসাফির বলে, ‘অনেক বছর পর তোমার সাথে দেখা হলো, চল না একসাথে কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়াই।’
কত কী ভেবে পলেন বলে, ‘এতদিন পর তোমার সাথে দেখা হয়ে আমারও খুব ভালো লাগছে! তুমি জান কিনা জানি না, আমার শ্বশুর বাড়ি এখান থেকে অল্প দূরে, লালমাই। আমি প্রায়ই এদিকে এসে থাকি। বরং তোমরাই ঘুরে বেড়িয়ে আসো। তোমাদের না আসা পর্যন্ত আমি জাদুঘরের পাশে অপেক্ষা করব।
অনামিকা চলে যাবার পর সামনে এগিয়ে গেল মুসাফির। ফ্যাকাশে চেহারায় মুখ ভার করে হাঁটতে দেখে মুসাফিরের হাত ধরে পলেন বলে, ‘তোমার হাস্যেজ্জল চেহারায় এমন অন্ধকার এলো কোত্থেকে? অনামিকা, তোমার মুখের হাসি কেড়ে নিয়েছে বুঝি! কে এই অনামিকা?’
মুসাফির নিঃশব্দে আনমনে হেঁটে চলছে...
তাকে কথা বলতে না দেখে পুনরায় পলেন বলে, ‘একেবারে চুপ হয়ে কী ভাবছো? মেঘ হয়ে আকাশে উড়ে উড়ে কী তাকেই খুঁজে বেড়াচ্ছো নাকি? এবার বোঝেছি, কার বিরহে তুমি ভেসে ভেসে কবিতা লিখে থাক।’
অনামিকা ছোট্টবেলা থেকেই মামার বাড়িতে থাকতো। তার বাবা ঘৃন্যতম এক পরিস্থিতির শিকার হয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিল। যার ফলে স্বামীর সংসার ছেড়ে চার বছরের অনামিকাকে নিয়ে তার মা বাপের বাড়ি চলে আসেন। মামার বাড়িতেই বড় হয় অনামিকা; লেখাপড়ার হাতেখড়ি শুরু হয় এখানে থেকেই।
মুসাফিরের পাশের বাড়ির তাজু মোল্লা, অনামিকার একমাত্র মামা। সে অনামিকাকে সন্তানের মতোই যতœ করে মানুষ করেছে।
তখন থেকেই মুসাফিরের সাথে অনামিকার চলফেরা শুরু হয়। একই সাথে স্কুলে পড়ালেখা; স্কুলে যাওয়া-আসা, বইপত্র আদান-প্রদান থেকে শুরু করে গল্প-গুজবে একে অপরের পাশাপাশি ছিল ছোটবেলা থেকে কলেজে পড়া পর্যন্ত।
সময়ে-অসময়ে অনামিকা এসে বসে থাকতো মুসাফিরের পড়ার ঘরে। দুষ্টমি, রাগারাগি, হাসি-আনন্দ ও মান-অভিমানে কেউ কাউকে কখনও ছাড়েনি। তখন থেকেই তাকে নিয়ে বিচিত্র ছন্দ-কবিতা লিখতো মুসাফির। এগুলো পড়ে অনামিকা যারপরনাই আনন্দ পেতো!
বয়স বাড়ার সাথে সাথে একসঙ্গে চলতে গিয়ে একসময় মুসাফির দুর্বল হয়ে পড়ে অনামিকার প্রতি। অনামিকার প্রতি তার করুণা ও অনুরাগ মুখে বলতে না পারলেও, তার লেখা ছন্দ-কবিতায় স্পষ্টই প্রকাশ পেতো। তার মনের এমন অতৃপ্ত অনুরাগের কথা বোঝেও অনামিকা মুখে কিছুই বলতো না। দু’জনের অব্যক্ত অনুরাগের কথা কেবল প্রকাশ পেতো একে অপরের প্রতি তাকিয়ে থাকার মধ্য দিয়ে। মুখে না বললে, গোপন ভালোবাসার কি বা মূল্য আছে!
এক ফাগুন পূর্ণিমারাতে কয়েকটি গন্ধরাজ ফুল নিয়ে অনামিকা এসে দাঁড়ায় মুসাফিরের পড়ার ঘরের দুয়ারে; ফিস্ ফিস্ করে ডাকতে শুরু করে...
দরজা খুলে বের হয়ে এসে মুসাফির বলেছিল, ‘কি গো অনামিকা, এমন রাতে তুমি কেন এসেছো?’
তার হাতে ডালসহ গন্ধরাজ দেখে মুসাফির বলে, ‘ফুল চুরি করেছো কোত্থেকে, আমার বাগান থেকে নয় তো?’
অনামিকা প্রায়ই এসে গোপনে মুসাফিরের বাগান থেকে ফুল চুরি করে নিয়ে যেতো। এ নিয়ে বেশ কয়েকবার দু’জনার বাকবচসা হয়েছে, হয়েছে মান-অভিমান।
অস্পষ্ট স্বরে অনামিকা বলেছিল, ‘চল না, তোমার বাগান থেকে ঘুরে আসি, দেখে আসিÑ তোমার বাগানে কী কী ফুল ফোটেছে!’
মুসাফিরের পড়ার ঘরের সামনে ছিল ফুলের বাগান, এখনও আছে। বাগানটি তার নিজেরই গড়া। গাছ লাগানো, আলবালে জল সেচনসহ সব কাজ নিজহাতে করতো মুসাফির। বাগানের ফাঁকে ফাঁকে বসার জন্য উপযুক্ত জায়গা বানিয়ে রেখেছিল। সেখানে বসে বসে ফুলের ঘ্রাণ নিত অনামিকা।
হা¯œাহেনার অনাঘ্রাত সুঘ্রানে চারদিক আমোদিত হয়েছিল তখন! অনিন্দ্য চাঁদের মনহরী জো¯œামালা বিকশিত হয়েছিল সানন্দে! বর্ষার জল বাগানের পাশে এসে কলকল ঢেউ তুলছিল!
বাগানের শেষ মাথায় গিয়ে বসে অনামিকা বলেছিল, ‘তোমাকে একটি কথা বলতে গিয়েও বলতে পারি না! কেমন ডর ডর লাগে!’
- কত কথাই তুমি বলে থাক, ডর আবার কীসের?
- কীভাবে বলব, সেটাই বুঝি না।
- যেভাবে সবসময় বলে থাকো, সেভাবেই বল।
সাময়িক নীরবতার পর, মুসাফিরের চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে রইল অপলক চাহনিতে। সহসা মুসাফিরের হাতে ফুলগুলো দিয়েই ত্বরিত বাগান থেকে বাড়ির দিকে ছুট লাগায় অনামিকা...
যাবার সময় অস্পষ্ট স্বরে বলে গেল, ‘তুমিই বুঝে নিও...
মুসাফিরের বোঝতে কিছুটা বিলম্ব হলেও, অনামিকার বিয়ে ঠিক হতে বেশি দেরি হয়নি। প্রবাস ফেরত এক ধনবানের সাথে তার বিয়ে হয়ে গেল; শৈশবের দীপ্তিময় ভালোবাসা ঘোমটার আড়ালে লুকিয়ে শ্বশুর বাড়িতে চলে গেল অনামিকা। তার পর আর মুসাফিরের সাথে দেখা হয়নি অনামিকার।
মুসাফির গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। লেখাপড়া শেষ করে চাকুরি হয়। বিয়ে করে দিব্যি সংসার করছে। ছুটিতে বাড়িতে গেলেও আর অনামিকার সঙ্গে তার দেখা বা যোগাযোগ কিছুই হয়ে ওঠেনি।
আজ এমনো মেঘমেদুর সাঁঝের বেলায় কোথা হতে অনামিকা এসে মুসাফিরের মনের আকাশে মেঘের আয়োজন বাড়িয়ে দিয়েছে! অনামিকার ছবি প্রায়ই সময় অসময়ে মুসাফিরের মনের আকাশে মেঘ হয়ে উড়ে বেড়ায়। তখন তাকে নিয়ে লেখালেখিতে বসে। স্ত্রীর ভয়ে আনামিকার কথাই স্ত্রীর ওপর ঠেলে দিয়ে কলহ নিবারণ করে এসেছে, এতে স্ত্রীও অত্যন্ত খুশি!
আজ কুমিল্লায় বেড়াতে এসে মুসাফিরের মনে বারবার উঁকি মেরে তাকাচ্ছে অনামিকার সাথে তার ফেলে আসা স্মৃতিগুলো। স্ত্রীকে পাশে রেখে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঠিকই, মনে বারবার তাড়া জেড়ে ওঠছেÑ কখন গিয়ে অনামিকার সাথে দেখা করবে, তার পাশে বসে হারানো প্রেমের পুরনো সৌরভে নিজেকে আমোদিত করবে!
©somewhere in net ltd.