নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সবার কথা

আহমেদ রশীদ

আহমেদ রশীদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

আবুল মাল আবদুল মুহিত এর চোখে সদ্য প্রয়াত আমাদের শ্রদ্ধাভাজন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান

২৪ শে মার্চ, ২০১৩ সকাল ৯:৪৯



মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান ২০ মার্চ, ২০১৩ সালে ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নাইলাহি রাজিউন)। মাত্র ক’দিন আগে ৯ মার্চে তিনি তাঁর ৮৫তম জন্মদিন অনুষ্ঠানের পরেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি আজীবন রাজনীতি করেছেন, কিন্তু তাঁর শত্রু“কেউ নেই। বাংলাদেশে এইটি একান্তই অচিন্তনীয়।

তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৫১ সালের ডিসেম্বর মাসে। তিনি ফজলুল হক হলে ইতিহাসের ছাত্র। আমার চেয়ে পাঁচ বছরের বড়। আমি ১৯৫১ সালেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই এবং তিনি আর একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তিনি বয়সে যতই বড় হোন না কেন তিনি হয়ে যান সমসাময়িক আরেকজন ছাত্র। ১৯৫১ সালের ডিসেম্বরে আমি ফজলুল হক হলের বার্ষিক সাহিত্য প্রতিযোগিতায় অংশ নিই। ঢাকায় নতুন এসেছি। সুতরাং এসব অনুষ্ঠানে পরিচিত হওয়ার আকাক্সক্ষাটি হয়ত ছিল খুব বেশি। আমার সিলেটে আমি ১৯৪৫ সাল থেকে এই সব কর্মকাণ্ডে আগ্রহান্বিত বলে ভালভাবেই পরিচিত ছিলাম। পঞ্চাশের দশকে সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ছাত্রমহল দিশারীর ভূমিকা পালন করত। মাহবুব আলী ইনস্টিটিউটে মাঝে মাঝে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নাটক অথবা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করত। এগুলোতেও ছাত্রদেরই অংশগ্রহণ ছিল মুখ্য বিষয়। তবে বিভিন্ন হল এবং কলেজের ছাত্র সংসদই এইসব ক্ষেত্রে প্রধান উদ্যোক্তা ছিল। ডিসেম্বর, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি সময়কালে প্রায় প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো। একই সময়ে অনেক নাটক মঞ্চস্থ হতো।

সে বছর আমার মনে হয় প্রথম প্রতিযোগিতাটি ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত হয়। সলিমুল্লাহ হলে কিছুদিন পরে অনুষ্ঠিত হয়। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবর্ষের ছাত্র এবং ঢাকায় নতুন মুখ। পর পর দু’দিন দু’টি প্রতিযোগিতায় আমি সাফল্য লাভ করি। সে কারণেই ফজলুল হক হলের শান্তশিষ্ট নেতৃস্থানীয় ছাত্র মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান আমার সঙ্গে পরিচয় করেন। তিনি আমার সম্বন্ধে জানতে চান এবং আমার সঙ্গে আলাপ করেন। সেই থেকে আমাদের পরিচয়। যদিও জীবন সংগ্রামে আমাদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবস্থান করার ফলে তার সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ ছিল না। তবে মাঝে মাঝে যোগাযোগটি বেশ ঘনিষ্ঠই ছিল। প্রথম থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কায়দায় তিনি হয়ে গেলেন আমার জিল্লুর ভাই। এবং শেষ সময় পর্যন্ত আমাদের সম্পর্কটি সেই রকমই ছিল। জিল্লুর ভাই বোধহয় নিজে পছন্দ করে বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলতেন। আমাদের প্রয়াত কবি এবং আমার বন্ধু শামসুর রাহমান তাঁর এক স্মৃতিকথায় বলেছেন যে, তিনি জিল্লুর ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ হয়ে যান শুধু নিবিড়ভাবে আলোচনার সুযোগ নিয়ে এবং সেই সুযোগটি জিল্লুর ভাই-ই তাঁকে করে দেন। ঢাকা কলেজে ছাত্রাবস্থায় জিল্লুর ভাই একটি হোস্টেলে থাকতেন। সেখানে কবি শামসুর রাহমান তাঁর কামরায় গিয়ে নিভৃতে গল্প করতেন।

মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান ছাত্র রাজনীতিতে বেশ উচ্চাসনে অবস্থান করতেন; যদিও তিনি ছিলেন স্বল্পভাষী এবং জ্বালাময়ী বক্তৃতা তিনি করতেন না অথবা সর্বত্র তাঁকে দেখা যেত না। ছাত্র আন্দোলনে তাঁর অবস্থান থাকত সংগঠক অথবা বুদ্ধিদাতা হিসেবে। তাঁর বন্ধুসুলভ আচরণ, ভদ্র ব্যবহার এবং আদর্শে গভীর-নিবেদন তাঁকে নেতৃত্বের আসন প্রদান করে। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে আমরা তাঁর সম্যক পরিচয় পাই। অবশ্য তখন জানতাম না, পরে জেনেছি যে তিনি অল্প বয়সে ছাত্র রাজনীতিতে ঝুঁকে পড়েন। ১৯৪৭ সালের জুন মাসে সিলেটের গণভোটের কাজে তিনি অংশগ্রহণ করেন এবং তখনই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচিত হন। কিন্তু তখন তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি; যদিও আমার সেই কৈশোরে সেই উপলক্ষেই বঙ্গবন্ধু এবং অনেক বাংলা প্রেসিডেন্সির অনেক ছাত্রনেতার সঙ্গে পরিচয় আমারও হয়। ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তাঁর দু’টি বিশেষ ভূমিকা আমরা জানতে পারি। ১৯ ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় কোন একটি সভা হয়। বস্তুতপক্ষে ২৯ জানুয়ারি থেকে প্রায় রোজই এই ধরনের সভা অনুষ্ঠিত হতো। এবং কি কারণে এটি হতো সেটা সহজেই বোধগম্য। ২৭ জানুয়ারিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন ঢাকার পল্টন ময়দানে ঘোষণা দেন যে, প্রয়াত জাতির জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সাহেবের ইচ্ছানুযায়ী শুধু উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। অথচ ১৯৪৮ সালে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার জন্য বাংলাদেশের ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী সমাজ আন্দোলন করে এবং খাজা নাজিমউদ্দিন পূর্ব-বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তখন তাতে সমর্থন দেন। তাঁর এই ঘোষণার ফলেই আমরা দেখতে পাই ’৫২-এর উত্তপ্ত এবং উত্তেজিত ফেব্রুয়ারি। ১৯ তারিখে অনুষ্ঠিত আমতলার সভায় মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান সভাপতিত্ব করেন। তিনি কিন্তু তখন কোন হলের ছাত্র সংসদের কোন নির্বাচিত প্রতিনিধি নন। আবার দেখি ২০ তারিখ দুপুরে যখন ঢাকায় শোভাযাত্রা ও অনুষ্ঠানকে নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি হলো তখন ১৪৪ ধারার বিধি-নিষেধ মানা হবে কি-না সেটা নিয়ে ছাত্রমহল একটি আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সেই আলোড়নে যারা দিক-নির্দেশনামূলক সিদ্ধান্ত নেন তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন তিনি।

১৪৪ ধারা জারি হলে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ বিকেলে একটি জরুরী সভায় মিলিত হয়। সেই সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রাক্তন বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম এবং সেখানে বিস্তৃত আলোচনার পরে সিদ্ধান্ত হয় যে, ১৪৪ ধারার নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করা হবে না। এই সভায় ছাত্র প্রতিনিধি মেডিকেল কলেজের গোলাম মওলা, ফজলুল হক হলের শামসুল আলম, সলিমুল্লাহ হলের আব্দুল মতিন এবং যুবলীগের অলি আহাদ এই সিদ্ধান্তের বিপরীতে কঠোর অভিমত ব্যক্ত করেন এবং তাঁরা জানিয়ে দেন যে, তাঁরা ২১ তারিখ সকাল বেলা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন যে এই নিষেধাজ্ঞা মানবেন কি-না। সলিমুল্লাহ হলে ফকির শাহাবুদ্দীন (যিনি পরবর্তীকালে বাংলাদেশের প্রথম এ্যাটর্নি জেনারেল হন) এবং ফজলুল হক হলে আব্দুল মোমিন (যিনি পরবর্তীকালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মন্ত্রী হন), পরের দিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গের জন্য ছাত্রদের উদ্বুদ্ধ করেন। সকলের অজান্তে অত্যন্ত গোপনীয় একটি আসর বসে ফজলুল হক হলে। যেখানে ১১ জন ছাত্রনেতা উপস্থিত ছিলেন। প্রয়াত নেতা অলি আহাদের সূত্রে জানা যায় যে, সেইসব নেতা ছিলেন তিনি ছাড়া প্রয়াত গাজীউল হক, প্রয়াত মোঃ সুলতান, প্রয়াত এম আর আখতার মুকুল, প্রয়াত আব্দুল মোমিন , প্রয়াত এস এ বারি এ টি প্রয়াত কামরুদ্দীন শহুদ, প্রয়াত আনোয়ারুল হক খান, প্রয়াত মনজুর হোসেন, প্রয়াত আনোয়ার হোসেন, বিচারপতি হাবিবুর রহমান শেলী এবং সদ্যপ্রয়াত মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান। এরা সকলেই প্রগতিশীল চিন্তাধারার ছাত্রনেতা ছিলেন। তারা সিদ্ধান্ত নেন যে, যেভাবেই হোক ২১ তারিখে ১৪৪ ধারার নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করা হবে এবং সেজন্য আমতলার সভা সেজন্য কিভাবে পরিচালনা করা হবে সে সম্বন্ধেও তারা সিদ্ধান্ত নেন। আমরা জানি যে এই সিদ্ধান্তটি শেষ পর্যন্ত কার্যকরী হয়। আমরা এও জানি যে, ২১ তারিখে এই সিদ্ধান্তের ফলেই প্রধানত একটি ছাত্র আন্দোলন গণআন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। আমরা আরও জানি যে, পরবর্তী চার বছরের প্রচেষ্টায় বাংলা ভাষা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। কিন্তু এছাড়াও এই আন্দোলন আমাদের জীবনে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তখন থেকেই পুনরায় শুরু হয় বাংলাদেশে জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ। এরকম উদ্যোগ প্রায় পনেরো শো বছরে নানা সময়ে হয়েছিল এবং তার সর্বশেষটি ছিল ভারত বিভাগের আগে- ’৪৭ সালের এপ্রিল মাসের ‘যুক্তবাংলা’ আন্দোলন।

১৯৫২-র শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছাত্র সংসদের নির্বাচন হয়। প্রথম নির্বাচন হয় সলিমুল্লাহ হলে এবং সেখানে প্রগতিশীল ছাত্রদের নানা গোষ্ঠী ‘গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্ট’ প্রতিষ্ঠা করে। তাদের প্রার্থীরা সকলেই বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। প্রয়াত শামসুল হক (এক সময়ের আওয়ামী লীগের পাটমন্ত্রী), প্রয়াত বদরুজ্জামান (এক সময়ের জজ), প্রয়াত সিরাজ হোসেন খান (এক সময়ে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের কর্মকর্তা) এবং আমি সেই সময় ছাত্র সংসদের যথাক্রমে সহ-সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, ক্রীড়া সম্পাদক এবং যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হই। তার পরে ফজলুল হক হলে সংসদ নির্বাচন হয় এবং সেখানে একটি অসাধারণ ঘটনা ঘটে। সম্ভবত ’৫০ এবং ’৬০-এর দশকের একটি ব্যতিক্রমী নির্বাচন সেখানে অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেও প্রগতিশীল শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্বাচন লড়ে এবং বিজয় লাভ করে। তবে সেখানে সর্বসম্মতিক্রমে মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। সেই সময়ই তাঁর কোন শত্রু ছিল না এবং সব বিভাজনের উর্ধে তিনি অবস্থান করতেন।

জিল্লুর রহমান সারাজীবন শুধু রাজনীতিই করেন। ছাত্র আন্দোলনের শেষে ১৯৫৪ সালে তিনি প্রাদেশিক নির্বাচনী প্রচারে অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ভৈরবে পৌরসভা নির্বাচনে সাফল্যের সঙ্গে তিনি অংশগ্রহণ করেন এবং এক সময় চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হন। ১৯৫৬ সালেই তিনি ভৈরবের আওয়ামী লীগের সভাপতি হন। রোজগারের জন্য তিনি ওকালতি করতেন এবং তার মূল কাজ ছিল জনসেবা। ছাত্র আন্দোলনে জড়িত থাকার কারণে তাঁর এমএ এবং আইন সনদ বহুদিন স্থগিত ছিল। বস্তুতপক্ষে ১৯৫৪ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেন এবং ১৯৫৬ সালে আমি শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ই নয় ছাত্র রাজনীতিও ছেড়ে দিই। এর পরে বহুদিন জিল্লুর ভাইয়ের সঙ্গে কোন যোগাযোগ ছিল না। যোগাযোগ পুনর্প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৮-৬৯ সালের উত্তাল সময়ে। তখন তিনি শুধু মফস্বল আওয়ামী লীগ নয়, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের একজন সবিশেষ নেতা এবং বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সহকর্মী হিসেবে পরিচিত। ১৯৭১ সালে স্বাভাবিকভাবেই তিনি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। মুজিবনগর থেকে আব্দুল গাফফার চৌধুরী সম্পাদিত ‘জয়বাংলা’ সাময়িকীর পরিচালনায় তার বিশেষ ভূমিকা ছিল।

স্বাধীনতা অর্জনের পর জিল্লুর ভাইয়ের কর্মস্থল হলো ঢাকা। ১৯৭০-এর নির্বাচনে তিনি জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত হন। স্বাধীনতা লাভের পরপরই ১৯৭২ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। দু’মেয়াদে তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন বঙ্গবন্ধুর সহকর্মী হিসেবে। বাকশালেরও তিনি ছিলেন তিন সম্পাদকের একজন। ১৯৭৫ সালের প্রতিবিপ্লবের পর তাঁর ওপর নির্যাতনের খগড়টি ছিল অত্যন্ত কঠোর। তাঁকে চারটি বছর কারাবাস করতে হয়। সামরিক প্রশাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান যখন আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দিলেন তখন আওয়ামী লীগকে যারা বাঁচিয়ে রাখেন তাঁর মধ্যে অন্যতম ছিলেন জিল্লুর ভাই। জননেত্রী শেখ হাসিনা আবার এসে ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের হাল ধরলেন। তখন জিল্লুর ভাই হলেন তারও সেনাপতি। ’৯০-এর দশকে তিনি দু-দু’বার আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন। ২০০২ সালে সেই দায়িত্বটি তিনি প্রয়াত আবদুল জলিলের হাতে তুলে দিয়ে প্রেসিডিয়ামে প্রত্যাবর্তন করেন। ২০০৯ সালে তিনি হন বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি। দলের প্রতি আনুগত্য এবং নেতৃত্বের আস্থা অর্জনে তিনি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর যেমন বিশ্বস্ত সহকর্মী ছিলেন তেমনিভাবে হন জননেত্রী শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত সহকর্মী। কোন লোভ, কোন নির্যাতন, কোন কষ্ট, তাকে আওয়ামী লীগের আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে ব্যর্থ হয়।

স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে জিল্লুর ভাইয়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ মোটামুটিভাবে বেশ ভালভাবেই বহাল ছিল। তারা যখন এরশাদবিরোধী আন্দোলন পরিচালনা করেন তখন থেকেই (১৯৮৩ সাল থেকেই) তার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের প্রায় চার বছর ১৯৮৭ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত আমি বিদেশে, বিশেষ করে আমেরিকায় ছিলাম। তিনি যখন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ছিলেন তখন পরিবেশ আন্দোলনের একজন কর্মী হিসেবে আমি বিভিন্নভাবে তার সহায়তা পেতে সক্ষম হই। আমার জানামতে নদী সংরক্ষণ আইনটি তারই উদ্যোগে প্রণীত হয় এবং এই কাজে পরিবেশবাদীরাই তাকে উদ্বুদ্ধ করেন। পরিবেশবাদীদের একটি সম্মেলনে ১৯৯৭ বা ১৯৯৮ সালে তিনি প্রায় অর্ধদিবস আমাদের সঙ্গে কাটান এবং আমাদের সুপারিশগুলো তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন। তারই ফসল নদী সংরক্ষণ আইন বলে আমি মনে করি।

২০০৪ সালে জিল্লুর ভাইয়ের জীবনে নেমে আসে অমানিশা। তিনি নিজেই বেগম আইভি রহমানকে পছন্দ করেন এবং সাহসিকতার সঙ্গে তার পাণি গ্রহণের প্রার্থনা বেগম আইভি রহমানের পিতা দুর্দান্ত অধ্যাপক বলে খ্যাত জালাল উদ্দীন আহমদের কাছে সরাসরি তুলে ধরেন। অল্প বয়সেই জিল্লুর ভাই মাতাপিতা হারান এবং দুঃখের সঙ্গে তার পরিচয় ছিল গভীর। আইভি ভাবীকে পেয়ে সেই দুঃখ খুবই প্রশমিত হয় বলে মনে করি। তারা ছিলেন আদর্শ দম্পতি। আইভি ভাবীকে ছাড়া জিল্লুর ভাইয়ের রাজনীতি করা, রাজনীতিতে আদর্শচ্যুত না হওয়া, নানা নির্যাতন ও ত্যাগ সহ্য করা এবং সুচারুভাবে তাঁর সব কর্তব্য সম্পাদন করা সম্ভব হতো না বলে আমি মনে করি। আইভি ভাবী মহিলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা ছিলেন। সেই আইভি ভাবী ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের জঘন্য গ্রেনেড হামলায় আহত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। চারদলীয় জোটের এই গ্রেনেড আক্রমণটি ছিল জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য এবং এতে মোট ২২ জন মৃত্যুবরণ করেন এবং শতাধিক নেতাকর্মী আহত হন। জিল্লুর ভাই তখন একেবারেই ভেঙ্গে পড়েন। আমরা স্বামী-স্ত্রী তখন তাঁর ওখানে মাঝে মাঝেই যেতাম। একদিন তিনি আমাকে বললেন যে, তাঁর জীবনধারণ করাই প্রায় দুরূহ হয়ে উঠেছে। তিনি বললেন যে, কখন কোন যুগে যে তিনি নিজে নিজের কাপড়-চোপড় পছন্দ করেছেন তা তার মনে নেই। তার প্রশ্ন ছিল, “আমি যে কি পরব সব আপনার ভাবী ঠিক করে রাখতেন এবং আমি সেগুলো পরতাম। এখন আমি কি করব?” রাজনীতির টানে এবং জননেত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে তিনি এই বিপর্যস্ত অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পান। অবশ্য নিশ্চয়ই ভাবীর স্মৃতি ও তাঁর নির্মম হত্যাকাণ্ড সব সময়ই তাঁকে দুঃখ দিয়েছে। দম্পতি হিসেবে তাঁদের চলার পথ ছিল একটিই এবং পরিবার হিসেবে তারা ছিলেন খুব সুখী- এক পুত্র ও দুই কন্যাসহ।

জননেত্রী শেখ হাসিনা জিল্লুর ভাইয়ের দায়িত্ব অনেক বাড়িয়ে দেন এবং এই দায়িত্বের ভারই তাঁর কষ্টটাকে কিছুটা প্রশমিত করে বলে আমার মনে হয়। তবে জিল্লুর ভাই তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন ২০০৭-০৮ সালে- যখন আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর হস্তে অর্পণ করেন। শেখ হাসিনার উপদেষ্টা হিসেবে আমি তখন আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডে গভীরভাবে সম্পৃক্ত এবং সেই কারণে জিল্লুর ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক অনেক গভীর। আমি ২০০১ সালে জিল্লুর ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে আওয়ামী লীগের সদস্য হই এবং তখন থেকে তিনি ছিলেন আমার শুভানুধ্যায়ী এবং উপদেষ্টা- এক কথায় আমার অভিভাবক। আমি শেখ হাসিনার উপদেষ্টা হিসেবে তাঁর বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনায় এবং তাঁর নির্দেশে কাজ করতাম। আমি নির্বাচনী সংস্কার নিয়ে অনেক কাজ করি। এছাড়া আর একটি কাজেও আমি তার নির্দেশমতো অগ্রসর হই। এবং সেটি ছিল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়ন। সে কাজটি শুরু করি ২০০৪ সালে এবং একবার সেটি চূড়ান্ত হয় ২০০৬ সালে। পরবর্তীকালে আবারও সেইটি সংশোধন হয় ২০০৮ সালে। আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডে আমার এই রকম সম্পৃক্তির কারণে জিল্লুর ভাই ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করার পরেই আমাকে ডাক দেন। তখন আমাকে শুধু এইটুকুই বলেন যে, জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে সংগঠনটিকে পরিচালনা করা ও তাঁর সংরক্ষণ করার দায়িত্ব দিয়েছেন এবং সেজন্য তিনি একটি মন্ত্রই দিয়ে গেছেন। তা হলো, যেভাবেই হোক দলের নেতা এবং কর্মীদের ঐক্য রক্ষা। এই কাজটি জিল্লুর ভাই অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে চালিয়ে যান এবং তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব এবং আচরণ এই অসাধারণ কাজটি সাধন করতে তাঁকে সাফল্য দেয়। আমি অনেক সময় ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছি, রাগারাগি করেছি; কিন্তু জিল্লুর ভাই সবসময় আমাকে শান্ত করতে সক্ষম হন এবং সাগ্রহে তাঁর নির্দেশ আমি প্রতিপালন করি।

একটি বিষয়ে তিনি অত্যন্ত দৃঢ়চিত্ত ছিলেন। তিনি যে সম্বন্ধে একটি অভিমত স্থির করে ফেলতেন সেই অভিমতটি তিনি দৃঢ়ভাবে প্রকাশ করতেন এবং সেখান থেকে তিনি কখনও বিচ্যুত হতেন না। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপের সময় আমি সেই দৃঢ়তা প্রত্যক্ষ করি। আমার মনে হয় সাধারণ নির্বাচনের আগে উপজেলা নির্বাচন সম্পন্ন করতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিশেষ আগ্রহ ছিল; তা ব্যর্থ হয় জিল্লুর ভাইয়ের কারণে। তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলে দেন যে, উপজেলা নির্বাচন হবে জাতীয় নির্বাচনের পরে। অন্য নেতারা সংসদ নির্বাচনের স্বার্থে এই বিষয়ে ছাড় দিতে প্রস্তুত ছিলেন এবং সে রকম ধারণা তারা নির্বাচন কমিশনকেও প্রদান করেন। শুধু জিল্লুর ভাইয়ের লিখিত বক্তব্যের দৃঢ়তার কারণেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অবশেষে তার দাবিই মানতে হয়। জিল্লুর ভাই সিলেটের ১৯টি নির্বাচনী এলাকা সম্বন্ধে আমাকে একটি প্রতিবেদন প্রণয়নের দায়িত্ব দেন। সেই প্রতিবেদনটি তার নির্দেশে জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরলে পর ২০০৮ সালে তাঁর কাছে পৌঁছে দিই।

তাঁর মহাপ্রয়াণে আমি খুব বেশি শোকসন্তপ্ত নই। আমি মনে করি একটি পূর্ণ, সৎ এবং সফল জীবন-যাপন করে একটি পরিণত বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেছেন। দেশের, দশের এবং নানামতের মুনীদের শ্রদ্ধা আহরণ করে তিনি সসম্মানে তাঁর পরবর্তী যাত্রা শুরু করেছেন। আমি তাঁর মাগফিরাত কামনা করি এবং তাঁর আত্মার শান্তি প্রার্থনা করি।

জিল্লুর ভাইয়ের কোন একজন উত্তরাধিকারী পাওয়া যাবে না; কিন্তু দুনিয়াতে কোন শূন্যতা বিরাজ করে না তাই তাঁর জায়গাও খালি থাকবে না। জিল্লুর ভাই চলে গেলেন এমন এক সময়ে যখন আমাদের দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টির একটি শক্ত প্রয়াস চলছে। যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করার জন্য দেশশত্রু জামায়াত-শিবির গুপ্ত হত্যা, রেললাইন বা বিদ্যুৎ কেন্দ্র ধ্বংস করা, আকস্মিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু করার মতো ঘৃণ্য উদ্যোগে লিপ্ত। একই সঙ্গে শুধু সরকার বিরোধিতার কারণে অনেকেই বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট হয়ে জামায়াত-শিবিরের রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডকে উস্কে না দিলেও মেনে নিচ্ছে। এই ভ্রষ্ট রাজনীতির পথ পরিহার আমাদের করতেই হবে। মনে হয় জিল্লুর ভাইয়ের তিরোধান এই অবস্থা থেকে উত্তরণের একটি সুযোগ আমাদের করে দিয়েছে। বেশ কিছুদিন পরে উত্তাপ ও উত্তেজনা বিদূরিত হয়েছে এবং সকলে মিলে শান্তির স্বাদ পাচ্ছি। তাঁর ইন্তেকাল শুভবুদ্ধির সব মানুষ ও দলকে তাঁর জন্য শোক প্রকাশ ও শ্রদ্ধা-নিবেদনে ঐক্যবদ্ধ করেছে। সারাদেশ তাঁর জন্য তিনদিন জাতীয় শোক দিবস পালন করছে। আশা করছি এরই ধারাবাহিকতায় আমরা সহিংস হরতাল ও বেপরোয়া ভাঙচুরের পথ পরিহার করব। এবং আসল রাজনৈতিক সমস্যায় কি করে এই সংসদের মেয়াদ শেষে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করা যাবে তা নিয়ে সংলাপে বসতে পারব। বর্তমানে যেভাবে নির্বাচন পরিচালিত হচ্ছে সেখানে ভোট জালিয়াতির সুযোগ মোটামুটিভাবে অনুপস্থিত। তবুও বিরোধী দল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে অংশগ্রহণ করলে নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রতি গণআস্থা আরও বৃদ্ধি পাবে।

আমরা তাঁর স্মৃতিকে রক্ষা করতে পারব যদি কতিপয় সংকল্প আমরা গ্রহণ করি। তবে আমরা সবাই হয়ত সবগুলো সংকল্প প্রতিপালন করতে পারব না কিন্তু তার মধ্যে কয়েকটিই যদি অনুসরণ করি তাহলেই বোধহয় অনেক কিছু সাধিত হতে পারে। যেমন-

ক্স আমরা রাজনৈতিক বক্তৃতায় কঠোর ভাষা ব্যবহারে বিরত থাকব,

ক্স আমরা ব্যক্তিগত ব্যবহারে সজ্জন থাকব,

ক্স আমরা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অটুটভাবে দলের আদর্শ অনুসরণ করব,

ক্স আমরা দল এবং নেতৃত্বের প্রতি অনুগত থাকব,

ক্স আমরা বিরোধীদলীয় শক্তিকে সহ্য করব, তাদের প্রতিবাদ শুনব ও তাদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করব,

ক্স আমরা রাজনৈতিক জীবনে লোভ ও দুর্নীতি পরিহার করব,

ক্স আমরা সর্বকালে সততা বজায় রাখব,

ক্স আমরা সবসময় ন্যায়ের অনুগামী থাকব,

ক্স আমরা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনে স্বজন ও দল সেবার পরিবর্তে জনসেবা করব।

ক্স আমাদের জীবন হবে একটি খোলা গ্রন্থ।

ক্স আমরা রাজনীতিকে দেশ-সেবা ও জনসেবার সর্বোত্তম রাস্তা বলে মনে করব।



মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.