![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কারাগারে থাকা শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নির্দেশনায় জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) পুনরায় সংগঠিত ও সক্রিয় হয়েছে। এসব নেতা কারাগার থেকে নিয়মিত মুঠোফোন ও চিঠিসহ নানা মাধ্যমে বাইরে থাকা জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা এবং দল পরিচালনা করছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, জেএমবির বেশির ভাগ নেতা কারাবন্দী থাকলেও তাঁদের অর্থের উৎস বন্ধ হয়নি। নিষিদ্ধ এই সংগঠনটিকে এখন আর্থিকভাবে মূল সহায়তা দিচ্ছেন এর ‘সুধী’ তথা সাধারণ সমর্থকেরা। বিভিন্ন এলাকায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা, আইসক্রিম কারখানা, ইটখোলাসহ ছোট-মাঝারি ধরনের বেশ কিছু ব্যবসাও রয়েছে জেএমবির সদস্যদের।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ ও প্রতিকার কমিটির ১৫তম সভায় (৪ জুন, ২০১৩) উপস্থাপিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জেএমবির বর্তমান সাংগঠনিক কাঠামোতে ১০০ জন এহসার সদস্য (সার্বক্ষণিক কর্মী), ৫০০ জন সদস্য গায়রে এহসার (সার্বক্ষণিক নয়), এক হাজার সাধারণ সদস্য ও দুই হাজার সুধী রয়েছেন।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সুধী ও সাধারণ সদস্যরা সংগঠনকে নিয়মিত চাঁদা দেন। বিভিন্ন সময়ে জঙ্গি আস্তানা থেকে উদ্ধার করা নথিপত্রে এ বাবদ আয়-ব্যয়ের হিসাবপত্র পাওয়া গেছে। এর মধ্যে এহসার সদস্যদের মাসিক খরচ সংগঠন থেকে দেওয়া হয়। এ ছাড়া নিহত ও কারাবন্দী নেতাদের অনেকের পরিবারকেও আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়।
সর্বশেষ গত রোববার ময়মনসিংহের ত্রিশালে পুলিশ হত্যা করে তিন দণ্ডপ্রাপ্ত নেতাকে ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে জেএমবি প্রায় ৫০ লাখ টাকার তহবিল গঠন করে। জিজ্ঞাসাবাদে যুক্ত একজন কর্মকর্তা জানান, গ্রেপ্তারের পর বন্দুকযুদ্ধে নিহত হাফেজ মাহমুদ ওরফে রাকিব হাসান ও এখন রিমান্ডে থাকা জাকারিয়া বলেছেন, এ অভিযানের জন্য জোগাড় করা ৫০ লাখ টাকার মধ্যে ৩০ লাখ টাকা পরিবহন খাতে ব্যয় করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০ লাখ ৮০ হাজার টাকা দিয়ে দুটি মাইক্রোবাস কেনার বিষয়ে প্রথম আলোর নিজস্ব অনুসন্ধানে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
রোববারের ওই হামলা ও আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা ও সমন্বয়েও যুক্ত ছিলেন জেএমবির কারাবন্দী নেতারা। তাঁরা কারাগারে বসেই মুঠোফোনে বাইরের জঙ্গিদের সঙ্গে সমন্বয় করেন। একটি গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, প্রিজন ভ্যান থেকে পালিয়ে যাওয়া জঙ্গিনেতা সালাহউদ্দিন ওরফে সালেহীন, হাফেজ মাহমুদ ওরফে রাকিব হাসান ও জাহিদুল ইসলাম ওরফে বোমা মিজান—তিনজনই কাশিমপুর কারাগারে থাকা অবস্থায় তিনটি মুঠোফোন ব্যবহার করেছেন। কারাগারের ভেতরে তাঁরা একে অন্যের সঙ্গে খুদে বার্তা (এসএমএস) বিনিময় করেছেন। ওই তিনটি ফোনের সঙ্গে বাইরের শুধু একটি ফোনের যোগাযোগ ছিল। সর্বশেষ রোববার ঘটনার দিন সকাল আটটা ৪৭ মিনিটে দুটি খুদে বার্তা পাঠানো হয় ময়মনসিংহের ভালুকায় থাকা একটি নম্বরে।
জঙ্গিনেতারা যে কারাগার থেকে সংগঠন পরিচালনা করেন, এ তথ্য জঙ্গি দমন কাজে যুক্ত সরকারি একাধিক সংস্থার কাছ থেকেও পাওয়া গেছে। কারাগার থেকে জেএমবি নেতাদের পাঠানো এবং বাইরে থেকে তাঁদের কাছে আসা চিঠি বিভিন্ন সময়ে কারাগার ও বাইরের জঙ্গি আস্তানা থেকে উদ্ধারও করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
কারাগার থেকে লেখা ও তাঁদের কাছে আসা চিঠিতে সাংগঠনিক দিকনির্দেশনা থেকে শুরু করে, আর্থিক আয় ও ব্যয়ের হিসাব-নিকাশ, এমনকি নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির মীমংসার উদ্যোগও রয়েছে। এসব চিঠিতে জঙ্গিদের নাম-পরিচয়সহ বিভিন্ন বিষয়ে সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে।
কাশিমপুর কারাগারের হাই সিকিউরিটি ইউনিটের সিনিয়র জেল সুপার আবদুর রাজ্জাক প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, আসামির কাছে মুঠোফোন থাকার সুযোগ নেই। কারাগারের ভেতরে মুঠোফোনের তরঙ্গ প্রতিরোধযন্ত্র (জ্যামার) লাগানো রয়েছে। এ ছাড়া সিসি (ক্লোজড সার্কিট) ক্যামেরা দিয়ে সার্বক্ষণিক নজরদারি করা হয়।
তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেছেন, জঙ্গিরা যে কারাগারে বসে মুঠোফোনে বাইরে যোগাযোগ রক্ষা করে, এ ব্যাপারে ডিবির কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ রয়েছে। এ ছাড়া চিঠিতে এবং মামলায় হাজিরার দিন আদালতে নিলে সেখানে জঙ্গিদের সঙ্গে তাদের বাইরের সহযোগীরা এসে দেখা করে।
জঙ্গি দমনসংশ্লিষ্ট সংস্থায় যুক্ত একজন পদস্থ কর্মকর্তা জানান, প্রতিষ্ঠাতা শায়খ আবদুর রহমানসহ শীর্ষস্থানীয় ছয় নেতার ফাঁসি কার্যকর, এরপর আমিরের দায়িত্বপ্রাপ্ত হবিগঞ্জের সাইদুর রহমানসহ বেশির ভাগ নেতাকে গ্রেপ্তারের পর জেএমবি প্রায় শেষ হয়ে গেছে বলে ধরে নিয়েছিল সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলো।
র্যাব ও পুলিশ কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে দাবি করে আসছিলেন, জেএমবি বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। কিন্তু গত রোববার পুলিশ হত্যা করে তিন জঙ্গিনেতাকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের হকচকিত করেছে।
জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমে সক্রিয় ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা যেসব তথ্যপ্রমাণ পেয়েছেন, তাতে দেখা গেছে, জেএমবির একটি উপদল সংগঠিত হয়ে এবং লম্বা সময় প্রস্তুতি নিয়ে এই আক্রমণ করেছে। তাঁর মতে, মূলত তিনটি কারণে ওই আক্রমণ করে জঙ্গিরা। প্রথমত, নতুন করে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেওয়া; দ্বিতীয়ত, এর মধ্য দিয়ে নিষ্ক্রিয় ও সাবেক কর্মীদের আবার উদ্বুদ্ধ করা এবং তৃতীয়ত, সালাহউদ্দিন ও হাফেজ মাহমুদের মতো জেএমবির শুরুর দিকের শুরা সদস্যদের দিয়ে দলের নেতৃত্বশূন্যতা গোছানো।
তবে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে দীর্ঘদিন সরাসরি যুক্ত ছিলেন এমন একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, তিনি পেশাগত কারণে গত বছর কারাগারে গিয়ে জেএমবির বর্তমান আমির সাইদুর রহমানের সঙ্গে কথা বলেন। তখন আলাপচারিতার একপর্যায়ে সাইদুর রহমান বলেন, কারাগারে থাকায় তাঁর সাংগঠনিক যোগাযোগে বরং সুবিধা হচ্ছে। কারণ, এখানে ধরা পড়ার ভয় নেই।
ওই কর্মকর্তা আরও জানান, সাইদুর বলেছেন তিনিই জেএমবির আমির। কুষ্টিয়ার সোহেল মাহফুজকে যে ভারপ্রাপ্ত আমির বলে প্রচার করা হচ্ছে, তা ঠিক নয়। জেএমবির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আমির পদে কাউকে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দিতে হলে মজলিশে শুরার বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সর্বশেষ শুরা কমিটির বেশির ভাগ সদস্য কারাগারে থাকায় সে বৈঠকের সুযোগ নেই।
সংশ্লিষ্ট অপর একটি সূত্র দাবি করে, সাইদুর রহমানের কর্মকৌশল একটি অংশের পছন্দ নয়। তাই জামালপুরের ফারুক হোসেনের নেতৃত্বে মূলত একটি উপদলীয় গ্রুপ পুনরায় সংগঠিত হয়। এই ফারুক ২০১২ সালে জামিনে মুক্তি পান। রোববারের হামলারও নেতৃত্ব দেন তিনি। এ গ্রুপে নাশকতা চালানোর মতো সর্বোচ্চ ৩০ জন জঙ্গি রয়েছে বলে দাবি করেন একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা।
©somewhere in net ltd.