![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে জৈবিক বস্তুসমূহ পচনের মাধ্যমে যে গ্যাস উৎপন্ন হয় তাকে সাধারণত বায়োগ্যাস বলে। বায়োগ্যাসে থাকে মিথেন, হাউড্রোজেন ও কার্বন মনো-অক্সাইড। অক্সিজেনের সঙ্গে মিথেন, হাউড্রোজেন ও কার্বন মনো-অক্সাইডের জারণে যে শক্তি উৎপাদিত হয় তা জ্বালানী হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
ইথানল ও বায়ো-ডিজেলের মতো বায়োগ্যাসের রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। ত্রয়োদশ শতকে গবেষক মার্কো পলো জানান, চীনারা পচা ময়লা-আবর্জনা ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। সপ্তদশ শতকে রবিনসন ক্রশোর লেখক ড্যানিয়েল ডিফো বায়োগ্যাস প্রযুক্তির কথা উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়া যুক্তরাজ্যে কয়েক দশক ধরে ব্যাপকভাবে বায়োগ্যাস ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ১৮৯৫ সালে এক্সিটার (যুক্তরাজ্যের শহর) শহরের রাস্তার লাইট জ্বালাতে ব্যবহৃত হয় বায়োগ্যাস, যা স্যুয়ারেজ থেকে উৎপন্ন।
ফার্মের বর্জ্য ও জৈবপদার্থসমূহ পচিয়ে যেখানে বায়োগ্যাস উৎপন্ন করা হয় তাকে সাধারণত ব্যায়োগ্যাস প্ল্যান্ট বলে। আর যে প্রক্রিয়ায় এ বায়োগ্যাস উৎপন্ন হয় তাকে এনারোবিক ডাইজেশন বলা হয়।
বায়োগ্যাস তৈরীর উপদানসমূহ : বিশ্বব্যাপী বায়োগ্যাস সাধারণত জৈব-জ্বালানী হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আর জৈব-বস্তুপুঞ্জ, মল, নর্দমার পচা আবর্জনা, পৌর বর্জ্য, সেপটিক ট্যাঙ্কস, সবুজ আবর্জনা ও ফসলের পরিত্যক্ত বস্তুর মতো পচনশীল জৈব-বস্তুসমূহের গাজনের মাধ্যমে উৎপাদিত হয় বায়োগ্যাস। এই গ্যাসে প্রাথমিকভাবে থাকে মিথেন ও কার্বন ডাই-অক্সাইড। তবে এই বায়োগ্যাসের ভালো-মন্দ নির্ভর করে পচন প্রক্রিয়া বা এনারোবিক ডাইজেশনের ওপর।
বায়োগ্যাসের একটি বিশেষ প্রক্রিয়াকে আবার এলএফজি বা ল্যান্ডফিল গ্যাস কিংবা ডাইজেস্টার গ্যাসও বলা হয়। এলএফজি তৈরীতে ল্যান্ডফিলে ভেজা আবর্জনাসমূহ এনারোবিক ডাইজেশন প্রক্রিয়ার জন্য রাখা হয়। এর ওপর নতুন করে আবর্জনা দেওয়া হয় যাতে নিচের জৈববস্তুসমূহ ভালোভাবে পচতে পারে। এর ভেতরে অক্সিজেন ঢুকতে না পারায় বিভিন্ন জীবাণু এগুলোকে পচাতে সহায়তা করে। এতে আস্তে আস্তে সেখানে গ্যাস তৈরী হয়। কিন্তু এটি ধরে রাখার ব্যবস্থা না করলে তা বায়ুমণ্ডলে মিশে যায়।
তবে এলএফজি উৎপাদনে অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। অর্থাৎ এ প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত গ্যাস নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে— প্রথমত, ল্যান্ডফিল থেকে বের হওয়া গ্যাস অক্সিজেনের সঙ্গে মিশে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে, দ্বিতীয়ত, মিথেন সম্বিলিত বায়োগ্যাস গ্রীন-হাউজ থেকে উৎপন্ন কার্বন-ডাই-অক্সাইডের তুলনায় ২০ গুণ বেশী শক্তিশালী হয়ে থাকে। তাই অনিয়ন্ত্রিত ল্যান্ডফিল গ্যাস বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণ হতে পারে।
বায়োগ্যাস ব্যবহার কেন : যখন সিএসজি (কোল সিম গ্যাস) বা কয়লা থেকে উৎপাদিত গ্যাস সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে এবং বলা হচ্ছে, মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মলমূত্র পানিসহ পরিবেশের দূষণ ঘটাচ্ছে তখন আমাদের আবর্জনার স্তূপ হচ্ছে। অন্যদিকে, জ্বালানীর উৎস হ্রাস পাচ্ছে।
আমরা যতই অন্যের উৎপাদিত পণ্য ক্রয় করব কোম্পানিগুলো ততই পণ্য উৎপাদন করে আমাদের সরবরাহ করবে। কিন্তু এ অবস্থা আর কত দিন। এখন আমাদের পরিবর্তন হতে হবে। আমাদের অভ্যাস বদলাতে হবে। আর এর জন্য একটি কাজ করতে হবে সেটি হলো— নিজেদের পণ্য নিজেরাই উৎপাদন করতে হবে। অর্থাৎ আমি আমাদের বর্জ্য থেকে নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা বলছি।
এটি আর আধুনিক রূপকথা নয়। এটি এখন বাস্তবে সম্ভব। তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশই এ প্রযুক্তি স্থাপন করে পচা আবর্জনা থেকে গ্যাস উৎপাদন করছে। আর এ ব্যাপারে প্রায়ই উন্নত দেশ কিংবা বিভিন্ন সংস্থা সহায়তা করছে। তৃতীয় বিশ্বের এ সব দেশের মানুষ খুব স্বাচ্ছন্দ্যেই এ গ্যাস ব্যবহার করে রান্না-বান্নার কাজ সারছে। অথচ তাদের ঘরে ধোঁয়ার কোনো সমস্যা হচ্ছে না। আর এ সব বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপনের ফলে গোটা সমাজ উপকৃত হচ্ছে। এলাকার গরু, ছাগল, ভেড়া, হাস-মুরগী এমনকি মানুষের মলমূত্র মিথেন গ্যাস উৎপাদনে ব্যবহৃত হচ্ছে। আর উৎপাদিত গ্যাস জ্বালানীর বড় সমস্যা মেটাচ্ছে। সেই সাথে গ্যাস উৎপাদনের অবশিষ্টাংশ সার হিসেবে জমিতে ব্যবহৃত হচ্ছে।
পরিবেশ দূষণের অন্যতম ক্ষতিকারক উপাদান হলো মিথেন। কয়লাভিত্তিক কিংবা খনিভিত্তিক গ্যাস উৎপাদনের মিথেন গ্যাস বায়ুমণ্ডলে মিশে পরিবেশ দূষিত করে। কিন্তু আমরা যদি বায়োগ্যাস উৎপাদন করতে পারি তাহলে পরিবেশ দূষণের আশঙ্কা কমে আসবে। কারণ বায়োগ্যাস নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে উৎপাদনের ফলে মিথেন গ্যাস বায়ুমণ্ডলে কম মিশতে পারে। তা ছাড়া ময়লা, পচা আবর্জনা যা পানিসহ পরিবেশ দূষণ সে সম্ভাবনাও কমে যায়। কারণ বায়োগ্যাস উৎপাদনই হয় এ সব আবর্জনা থেকে।
বাংলাদেশে সবুজ জ্বালানী বাড়ছে : সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল রিনিউঅ্যাবল এনার্জি এজেন্সি (আইআরইএনএ) এক প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশ নবায়নযোগ্য জ্বালানী উৎপাদনে বেশ অগ্রগতি সাধন করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিগত ১০ বছরে বাংলাদেশে সৌর বিদ্যুতায়িত পরিবারের সংখ্যা ২৫ হাজার থেকে হয়েছে ২০ লাখ ৮০ হাজার। ফলে নবায়নযোগ্য জ্বালানীর ক্ষেত্রে দেশটির অবস্থান এখন ছয় নম্বরে। তা ছাড়া এই খাতে অন্তত লক্ষাধিক লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। ২০১১ সালে এ খাতে যে পরিমাণ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছিল। মাত্র দুই বছরে ২০১৩ সালে তা দ্বিগুণ হয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানী উৎপাদনে আরও বড় বড় স্থাপনা তৈরী হচ্ছে বলেও প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়। এতে আরও বেশী লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে।
বাংলাদেশ সরকার পরিবর্তিত চাহিদা মেটাতে ২০১৫ সালের মধ্যে ১৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। সরকার আশা করছে, এর মধ্যে অন্তত ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সৌর শক্তি থেকে উৎপাদন করা হবে। ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে সৌর শক্তির সর্বাত্মক ব্যবহারের একটি কর্মসূচিও হাতে নিয়েছে সরকার।
ভোক্তাদের সুবিধা : শুধু বাংলাদেশই নবায়নযোগ্য জ্বালানীর ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ নিচ্ছে তা নয় বরং অনেক দেশই এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্যাপকভাবে লাভবান হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের ইমপ্লিমেন্টেশন, মনিটরিং এবং ইভ্যালুয়েশন ডিপার্টমেন্টের (আইএমইডি) এক জরিপে বলা হয়েছে, সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী ৯৮.৮ শতাংশ পরিবার তাদের জ্বালানী খরচ কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। অর্থাৎ আগে কেরোসিন, মোমবাতি কিংবা টর্সের জন্য যে খরচ হতো এখন তা অনেক কমে গেছে। এ ছাড়া ৮৯ শতাংশ পরিবারের অবস্থা আগের চেয়ে স্বাস্থ্যকর হয়েছে।
উত্তর আমেরিকায় বায়োগ্যাস থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতে মোট চাহিদার ৩ শতাংশ পূরণ হয়। অধিকন্তু বায়োগ্যাস বৈশ্বিক উষ্ণায়নের মাত্রাও উল্লেখযোগ্য হারে কমাতে সাহায্য করে। এনারোবিক প্ল্যান্টে প্রচুর পরিমাণে মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়। এ ছাড়া আবর্জনা যখন স্তূপ করা হয় এবং যখন জমিতে দেয়া হয় তখন নাইট্রাস অক্সাইড উৎপন্ন হয়। আর নাইট্রাস অক্সাইড (N2O) কার্বন ডাই-অক্সাইডের তুলনায় ৩২০ গুণ ক্ষতিকর। এ ছাড়া মিথেন কার্বন ডাই-অক্সাইড থেকে ২১ গুণ বেশী ক্ষতিকর।
এনারোবিক প্রক্রিয়ায় শুধু গরুর গোবর মিথেনে রূপান্তর করে যুক্তরাষ্ট্রে ১০০ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব যা দেশটির কয়েক লাখ পরিবারের চাহিদা মেটাতে সক্ষম। একটি গরু দিনে যে পরিমাণ গোবর দেয় তা দিয়ে অন্তত ৩ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। আর কোনো পরিবারে ১০০ ওয়াটের একটি বাল্ব জ্বালাতে ২.৪ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন। এভাবে বায়োগ্যাসের ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে বৈশ্বিক উষ্ণতা ৪ শতাংশ কমানো সম্ভব।
জাপানের আইসিন সেইকি কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে যৌথভাবে জেবি বায়োগ্যাস লিমিটেড গাজীপুরের যমুনা গ্রামে একটি প্ল্যান্ট স্থাপন করেছে। বিশ্বের অন্যতম আধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন এ প্ল্যান্টটি থেকে দৈনিক ৩৮ ঘনমিটার বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। যা দিয়ে ১৮টি পরিবারের রান্না ও গৃহস্থালীর প্রয়োজন মেটানো সম্ভব হচ্ছে।
জেবি বায়োগ্যাস প্ল্যান্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেলাওয়ার হোসেন রিপন এ বিষয়ে বলেছেন, জাপানের আইসিন সেইকি হেডকোয়ার্টার থেকে এ প্ল্যান্টটি সরাসরি পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। জাপানি কর্মকর্তা মাসে অন্তত একবার প্ল্যান্টটি পর্যবেক্ষণ করে থাকেন।
প্ল্যান্টটির প্রধান (অপারেশন) ওয়াহিদুর রহমান রানা বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানীর ক্ষেত্রে আমরা সফলভাবে এ প্ল্যান্টটি স্থাপন করেছি। তিনি আরও বলেন, এটি আমাদের পরীক্ষামূলক প্রকল্প। আইসিন সেইকি কোম্পানি লিমিটেডের সহযোগিতায় সারাদেশে এই প্রকল্প ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান তিনি।
প্রসঙ্গত, আইসিন সেইকি কোম্পানি লিমিটেড বিশ্বের বিখ্যাত টয়োটা কোম্পানির একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান।
©somewhere in net ltd.
১|
২৬ শে নভেম্বর, ২০১৪ সকাল ৯:০৪
মুরশীদ বলেছেন: সহমত আপনার সাথে ।